মতিউর রহমান
বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আর্ভিং গফম্যান তার যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘জনপরিসরে সম্পর্ক’ (রিলেশনস ইন পাবলিক, ১৯৭১)-এ এক মৌলিক সামাজিক সত্য উন্মোচন করেছিলেন-জনসমাগমে মানুষের আচরণ কখনোই এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল নয়; বরং তা অদৃশ্য সামাজিক নিয়ম, সূক্ষ্ম সংকেত এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই “পারস্পরিক ক্রিয়া ব্যবস্থা” বা ‘মিথস্ক্রিয়া বিন্যাস’ সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অপরিহার্য। ঢাকা শহরের মতো পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ একটি নগরের ক্ষেত্রে গফম্যানের এই তত্ত্ব অত্যন্ত কার্যকর, কারণ এখানকার নাগরিক জীবন প্রতিনিয়ত মানব মিথস্ক্রিয়ার চরম ঘনত্ব এবং জটিলতার অভিজ্ঞতা লাভ করে।
ঢাকার তীব্র যানজট, হাঁটাপথের ভিড়, অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং শ্রেণিগতভাবে চিহ্নিত নগরজীবন-সবকিছু মিলিয়ে এখানে জনসমাগমের আচরণকে বোঝার জন্য গফম্যানের তত্ত্ব এক শক্তিশালী বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি সরবরাহ করে। ঢাকার রাস্তাঘাটে প্রতিদিন লক্ষ-কোটি ক্ষুদ্র পারস্পরিক ক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া ঘটে, যা শহরের সামাজিক কাঠামো, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং সাংস্কৃতিক রীতিনীতিকে সূক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত করে। এই জনপরিসর কেবল চলাচলের স্থান নয়; এটি একটি জীবন্ত সামাজিক মঞ্চ যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই তাৎপর্যপূর্ণ।
এই চরম ঘনত্বের মধ্যেও, গফম্যান দেখান যে মানুষ সূক্ষ্ম রীতিনীতি অনুসরণ করে এক ধরনের ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখে, যদিও শারীরিক দূরত্ব প্রায় থাকেই না। এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রক্রিয়াটি ঢাকার নাগরিক জীবনে এক নীরব শৃঙ্খলা তৈরি করে।
এই শৃঙ্খলার প্রকাশ দেখা যায় চোখে চোখ না মেলানোর মাধ্যমে, যা ভিড়ের মধ্যে অন্যের প্রতি ‘নাগরিক ঔদাসীন্য’ প্রকাশের একটি প্রধান কৌশল। এর মাধ্যমে আমি অন্যকে স্বীকার করি, কিন্তু তার ব্যক্তিগত পরিসরে অযাচিতভাবে প্রবেশ করি না। এছাড়াও, পাশ কাটানোর সময় শরীর সামান্য সরিয়ে নেওয়া, হাত-পা নিয়ন্ত্রণ করা বা একটি মৃদু মাথা ঝাঁকানো হলো দেহভঙ্গির মাধ্যমে সংকেত প্রদান। অন্যদিকে, “ভাইয়া”, “আপা”, অথবা “মাফ করবেন” ধরনের সম্বোধন বা সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহার করে অস্বস্তি কমানো এবং পারস্পরিক স্থানকে মৌখিক শিষ্টাচারের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়।
গফম্যানের মতে, এই ক্ষুদ্র আচরণগুলোই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটি নীরব শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে যা ‘পারস্পরিক ক্রিয়া বিন্যাস’-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদি কেউ এই নীরব নিয়ম ভেঙে অযাচিতভাবে ব্যক্তিগত পরিসরে প্রবেশ করে, তবে তাৎক্ষণিক অসন্তোষ বা বিরোধ তৈরি হতে পারে, যা প্রমাণ করে এই অদৃশ্য নিয়মগুলির গুরুত্ব। ঢাকার এই ঘনবসতিপূর্ণ জীবন প্রমাণ করে যে, সামাজিক নিয়মগুলি ভৌত কাঠামোর চেয়েও বেশি শক্তিশালী হতে পারে।
ঢাকার জনপরিসরে শ্রেণিগতভাবে স্থান-দখলের একটি অনুষঙ্গ স্পষ্ট, যা গফম্যানের মতে বৃহত্তর ক্ষমতার কাঠামোকে প্রতিফলিত করে। জনসমাগমের মিথস্ক্রিয়া প্রায়শই সামাজিক বৈষম্য এবং কাঠামোগত ক্ষমতা প্রদর্শনের মঞ্চ হিসেবে কাজ করে। ঢাকায় এটি দেখা যায় কীভাবে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ রাস্তায় নিজেদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করে এবং অন্যদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সম্মান দাবি করে।
অফিসফেরত মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরা পথ অতিক্রম করার সময় স্বাভাবিকভাবেই আশা করে ফুটপাতের হকার, শ্রমজীবী মানুষ বা রিকশাচালকরা পথ ছেড়ে দেবে বা তাদের দ্রুত চলনকে অগ্রাধিকার দেবে। এই প্রত্যাশিত সম্মান বা অগ্রাধিকার এক ধরনের অদৃশ্য সামাজিক শ্রেণিচিহ্ন দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা হাঁটার গতি, দেহভঙ্গি, পোশাক এবং চোখের দৃষ্টির মতো উপাদান দ্বারা পরিবাহিত হয়।
দ্রুত এবং সোজা হয়ে হাঁটা প্রায়শই উচ্চ সামাজিক অবস্থান বা সময়ের মূল্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো হকার বা পথচারী যদি এই “অনুমানিত” শ্রেণিকাঠামো অমান্য করে বা সমান মর্যাদা দাবি করে তবে তাৎক্ষণিক অসন্তোষ বা বিরোধ তৈরি হয়, যা প্রায়শই ট্রাফিক জ্যাম বা ফুটপাতের তর্কাতর্কিতে দেখা যায়।
এতে বোঝা যায়, ঢাকার দ্রুত পরিবর্তনশীল নগরজীবনে শ্রেণিগত শক্তি কীভাবে জনপরিসরে জায়গা নিয়ন্ত্রণ করে। ফুটপাতের ‘মালিকানা’ নিয়ে হকার ও মধ্যবিত্ত পথচারীর মধ্যে যে নীরব টানাপোড়েন, তা এই ক্ষমতা-কাঠামোরই নিত্যদিনের প্রতিফলন। এই নীরব সংঘাতটিই মূলত সামাজিক ন্যায্যতার অনুপস্থিতিকে প্রতিফলিত করে।
গফম্যানের বর্ণিত “নাগরিক ঔদাসীন্য”অর্থাৎ অন্যকে স্বীকার করেও মিথস্ক্রিয়ায় না জড়ানোর কৌশল-ঢাকায় বিশেষভাবে পরিবর্তিত রূপে দেখা যায়। অতিরিক্ত ভিড়, উচ্চ শব্দ, অসহনীয় গরম কিংবা নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে একই সঙ্গে সতর্ক থাকতে এবং উদাসীন থাকার এক অদ্ভুত ভারসাম্য বজায় রাখতে বাধ্য করে। এই সতর্কতা এবং উদাসীনতার মিশ্রণ ঢাকার রাস্তার “সামাজিক মনোযোগ ব্যবস্থাকে” চালনা করে।
এর মাধ্যমে মানুষ ক্রমাগত পারিপার্শ্বিকতা মূল্যায়ন করতে থাকে। বাসে উঠলে নতুন যাত্রীর দিকে সংক্ষিপ্ত নজর দেওয়া, কারও আচরণ সম্ভাব্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে কি না তা বোঝার চেষ্টা, অথবা আসন নিয়ে নীরব টানাপোড়েন-সবকিছুই এই মনোযোগ ব্যবস্থার প্রতিফলন।
নারীদের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ ও সতর্কতা আরও তীব্র। তারা প্রায়শই ভিড়ের মধ্যে অবাঞ্ছিত স্পর্শ বা হয়রানি এড়াতে শরীরের ভাষা, দৃষ্টি এবং চলনভঙ্গিতে বিশেষ রক্ষণশীলতা বজায় রাখে। ব্যাগ বা হাত দিয়ে সামনে আড়াল তৈরি করা, স্থির এবং সতর্ক দৃষ্টি রাখা, কিংবা দ্রুত হাঁটা,এগুলো তাদের “সুরক্ষামূলক অভিনয়”-এর অংশ, যা জনপরিসরে তাদের ব্যক্তিগত স্থানকে রক্ষা করে এবং সম্ভাব্য লঙ্ঘনকারীদের নিরুৎসাহিত করে।
এই নিয়ন্ত্রিত অভিনয় কেবল ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য নয়, বরং জনপরিসরে নিজেদের সম্মানজনক মর্যাদা বজায় রাখার জন্যও অপরিহার্য। এই ধরণের স্ব-নিয়ন্ত্রণ দেখায় যে জনপরিসর নারীদের জন্য এক ধরনের নিরন্তর পরীক্ষা ক্ষেত্র যেখানে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রধানত তাদের নিজেদের ওপরই বর্তায়।
ঢাকার অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির চরিত্রদের আচরণ গফম্যানীয় “অভিনয়ের” উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গফম্যানের নাটকীয়তা তত্ত্ব অনুযায়ী, সামাজিক জীবন একটি মঞ্চ এবং মানুষ অভিনেতা। রিকশাচালক, হকার, ভিক্ষুক, বাসের সহকারী বা পথশিল্পীরা তাদের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের জন্য অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে তাদের ভূমিকা পরিবেশন করে।
যাত্রী টানার জন্য রিকশাচালকের অতিরিক্ত হাসি বা বিনয়, হকারের চটপটে কথা ও পণ্য বিক্রির জন্য উদ্ভাবনী লিখিত বক্তব্য, ভিক্ষুকের অনুনয় বা দুঃখজনক দেহভঙ্গি, সিএনজি চালকের গন্তব্য শোনার পর হিসাবি নীরবতা-সবই একেকটি সামাজিক অভিনয়, যা একটি কাক্সিক্ষত প্রতিক্রিয়া বা অর্থনৈতিক লেনদেন আদায়ের উদ্দেশ্যে সাজানো।
এই চরিত্রগুলি তাদের “সম্মুখ মঞ্চ”-এ (যাত্রীর সামনে) থাকে বিনয়, পেশাদারিত্ব বা অসহায়ত্বের মুখোশ; কিন্তু যখন তারা সহকর্মীর সাথে জটলার মধ্যে থাকে (পেছনের মঞ্চ বা গুপ্ত ক্ষেত্র), তখন তাদের ভাষা ও আচরণ ভিন্ন হয়। এই অভিনয়গুলো ঢাকার রাস্তাঘাটকে একটি চলমান নাট্যশালায় পরিণত করে, যেখানে প্রতিটি ভূমিকাই জরুরি, প্রতিটি অভিব্যক্তিই তাৎপর্যময় এবং প্রতিটি পারস্পরিক ক্রিয়া তাদের দৈনন্দিন জীবিকার জন্য অপরিহার্য। এই দৃশ্যপট প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের নগর অর্থনীতি কতা মানুষের সামাজিক দক্ষতার উপর নির্ভরশীল।
ঢাকার রাস্তায় সংঘর্ষ বা উত্তেজনার মুহূর্তগুলো গফম্যানের ব্যাখ্যাকে আরও স্পষ্ট করে। ট্রাফিক জট নিয়ে ঝগড়া, বাসের সহকারীর টিকিট বা ভাড়া নিয়ে মারামারি, অথবা দুর্ঘটনার পর জনসাধারণের উত্তেজনা,এগুলো সবই মিথস্ক্রিয়া ব্যবস্থার ভাঙনের ফল। যখন প্রচলিত শিষ্টাচার বা “পারস্পরিক ক্রিয়া বিন্যাস” ভেঙে যায় (যেমন: কেউ লাইনে না দাঁড়িয়ে সামনে চলে আসে বা রিকশা হঠাৎ ব্রেক করে), তখন সমাজের নীরব নিয়মগুলো হঠাৎ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
এই ভাঙন কেবল অবকাঠামোগত ব্যর্থতার ফল নয়; বরং এটি মানুষের প্রত্যাশিত সম্মান, স্থান ও মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থারও সংকট। ঝগড়া বা বিরোধের সময় মানুষ তাদের “সম্মুখের মর্যাদা” রক্ষার জন্য লড়াই করে, যা গফম্যানের “মর্যাদা রক্ষার কাজ” তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত। এই মর্যাদা রক্ষার কাজের ব্যর্থতাই জনপরিসরে সংঘর্ষের জন্ম দেয়। তবুও ঢাকা শুধুই সংঘর্ষের শহর নয়। শহরের কঠিন বাস্তবতার মাঝেও মানবিক সংহতি বিদ্যমান।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা বা দুর্ঘটনার মুহূর্তে অপরিচিত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা হাত ধরে রাস্তা পার করানো, আটকে থাকা মোটর সাইকেল উঠিয়ে দেওয়া, কিংবা পানিতে ডুবে যাওয়া ফুটপাতে অপরকে সাহায্য করা গফম্যানের “সহায়ক বিনিময়”-এর অদৃশ্য কাঠামোকে তুলে ধরে। এই ধরনের ক্ষুদ্র মানবিকতার বিনিময় এবং অনিশ্চয়তার মুখে মানুষের প্রতি মানুষের সহযোগিতা জনপরিসরের সামাজিক জীবনীশক্তিকে টিকিয়ে রাখে।
সব মিলিয়ে, ঢাকার রাস্তাগুলো একটি জটিল সামাজিক মঞ্চ, যেখানে প্রতিটি মানুষ অবিরামভাবে নিজের ভূমিকাকে পুনর্গঠন করে। গফম্যানের জনপরিসরে সম্পর্ক তত্ত্ব আমাদের শেখায়, জনপরিসরের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, দৃষ্টি, দেহভঙ্গি, নীরবতা, এমনকি ঝগড়া পর্যন্তও একটি সামাজিক যুক্তির অনুসরণে ঘটে। এই তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, ভিড়ের মধ্যে চলতে গিয়েও আমরা কীভাবে সূক্ষ্মভাবে একে অপরের সাথে ‘বোঝাপড়া’ করি এবং স্থান ভাগ করে নেই।
ঢাকার রাস্তায় বিশৃঙ্খলার আড়ালে তাই দেখা যায় এক সূক্ষ্ম সংগতি-একটি অদৃশ্য নৃত্য পরিকল্পনা-যা প্রতিদিনের নগরজীবনকে পরিচালিত করে। গফম্যানীয় দৃষ্টিতে, ঢাকা শহরের পথঘাট কেবল চলাচলের স্থান নয়; এটি একটি জীবন্ত সামাজিক ক্ষেত্র, যেখানে আধুনিক নগরবাংলাদেশ প্রতিদিন অভিনীত, অনুশীলিত এবং পুনর্গঠিত হয়। এই গভীর সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের দেখায় যে, ঢাকাবাসী তাদের দৈনিক জীবনে কেমন করে ব্যক্তিগত স্বায়ত্তশাসন এবং সামাজিক নিয়মের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলে।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতিউর রহমান
বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫
বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আর্ভিং গফম্যান তার যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘জনপরিসরে সম্পর্ক’ (রিলেশনস ইন পাবলিক, ১৯৭১)-এ এক মৌলিক সামাজিক সত্য উন্মোচন করেছিলেন-জনসমাগমে মানুষের আচরণ কখনোই এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল নয়; বরং তা অদৃশ্য সামাজিক নিয়ম, সূক্ষ্ম সংকেত এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই “পারস্পরিক ক্রিয়া ব্যবস্থা” বা ‘মিথস্ক্রিয়া বিন্যাস’ সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অপরিহার্য। ঢাকা শহরের মতো পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ একটি নগরের ক্ষেত্রে গফম্যানের এই তত্ত্ব অত্যন্ত কার্যকর, কারণ এখানকার নাগরিক জীবন প্রতিনিয়ত মানব মিথস্ক্রিয়ার চরম ঘনত্ব এবং জটিলতার অভিজ্ঞতা লাভ করে।
ঢাকার তীব্র যানজট, হাঁটাপথের ভিড়, অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং শ্রেণিগতভাবে চিহ্নিত নগরজীবন-সবকিছু মিলিয়ে এখানে জনসমাগমের আচরণকে বোঝার জন্য গফম্যানের তত্ত্ব এক শক্তিশালী বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি সরবরাহ করে। ঢাকার রাস্তাঘাটে প্রতিদিন লক্ষ-কোটি ক্ষুদ্র পারস্পরিক ক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া ঘটে, যা শহরের সামাজিক কাঠামো, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং সাংস্কৃতিক রীতিনীতিকে সূক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত করে। এই জনপরিসর কেবল চলাচলের স্থান নয়; এটি একটি জীবন্ত সামাজিক মঞ্চ যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই তাৎপর্যপূর্ণ।
এই চরম ঘনত্বের মধ্যেও, গফম্যান দেখান যে মানুষ সূক্ষ্ম রীতিনীতি অনুসরণ করে এক ধরনের ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখে, যদিও শারীরিক দূরত্ব প্রায় থাকেই না। এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রক্রিয়াটি ঢাকার নাগরিক জীবনে এক নীরব শৃঙ্খলা তৈরি করে।
এই শৃঙ্খলার প্রকাশ দেখা যায় চোখে চোখ না মেলানোর মাধ্যমে, যা ভিড়ের মধ্যে অন্যের প্রতি ‘নাগরিক ঔদাসীন্য’ প্রকাশের একটি প্রধান কৌশল। এর মাধ্যমে আমি অন্যকে স্বীকার করি, কিন্তু তার ব্যক্তিগত পরিসরে অযাচিতভাবে প্রবেশ করি না। এছাড়াও, পাশ কাটানোর সময় শরীর সামান্য সরিয়ে নেওয়া, হাত-পা নিয়ন্ত্রণ করা বা একটি মৃদু মাথা ঝাঁকানো হলো দেহভঙ্গির মাধ্যমে সংকেত প্রদান। অন্যদিকে, “ভাইয়া”, “আপা”, অথবা “মাফ করবেন” ধরনের সম্বোধন বা সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহার করে অস্বস্তি কমানো এবং পারস্পরিক স্থানকে মৌখিক শিষ্টাচারের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়।
গফম্যানের মতে, এই ক্ষুদ্র আচরণগুলোই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটি নীরব শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে যা ‘পারস্পরিক ক্রিয়া বিন্যাস’-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদি কেউ এই নীরব নিয়ম ভেঙে অযাচিতভাবে ব্যক্তিগত পরিসরে প্রবেশ করে, তবে তাৎক্ষণিক অসন্তোষ বা বিরোধ তৈরি হতে পারে, যা প্রমাণ করে এই অদৃশ্য নিয়মগুলির গুরুত্ব। ঢাকার এই ঘনবসতিপূর্ণ জীবন প্রমাণ করে যে, সামাজিক নিয়মগুলি ভৌত কাঠামোর চেয়েও বেশি শক্তিশালী হতে পারে।
ঢাকার জনপরিসরে শ্রেণিগতভাবে স্থান-দখলের একটি অনুষঙ্গ স্পষ্ট, যা গফম্যানের মতে বৃহত্তর ক্ষমতার কাঠামোকে প্রতিফলিত করে। জনসমাগমের মিথস্ক্রিয়া প্রায়শই সামাজিক বৈষম্য এবং কাঠামোগত ক্ষমতা প্রদর্শনের মঞ্চ হিসেবে কাজ করে। ঢাকায় এটি দেখা যায় কীভাবে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ রাস্তায় নিজেদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করে এবং অন্যদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সম্মান দাবি করে।
অফিসফেরত মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরা পথ অতিক্রম করার সময় স্বাভাবিকভাবেই আশা করে ফুটপাতের হকার, শ্রমজীবী মানুষ বা রিকশাচালকরা পথ ছেড়ে দেবে বা তাদের দ্রুত চলনকে অগ্রাধিকার দেবে। এই প্রত্যাশিত সম্মান বা অগ্রাধিকার এক ধরনের অদৃশ্য সামাজিক শ্রেণিচিহ্ন দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা হাঁটার গতি, দেহভঙ্গি, পোশাক এবং চোখের দৃষ্টির মতো উপাদান দ্বারা পরিবাহিত হয়।
দ্রুত এবং সোজা হয়ে হাঁটা প্রায়শই উচ্চ সামাজিক অবস্থান বা সময়ের মূল্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো হকার বা পথচারী যদি এই “অনুমানিত” শ্রেণিকাঠামো অমান্য করে বা সমান মর্যাদা দাবি করে তবে তাৎক্ষণিক অসন্তোষ বা বিরোধ তৈরি হয়, যা প্রায়শই ট্রাফিক জ্যাম বা ফুটপাতের তর্কাতর্কিতে দেখা যায়।
এতে বোঝা যায়, ঢাকার দ্রুত পরিবর্তনশীল নগরজীবনে শ্রেণিগত শক্তি কীভাবে জনপরিসরে জায়গা নিয়ন্ত্রণ করে। ফুটপাতের ‘মালিকানা’ নিয়ে হকার ও মধ্যবিত্ত পথচারীর মধ্যে যে নীরব টানাপোড়েন, তা এই ক্ষমতা-কাঠামোরই নিত্যদিনের প্রতিফলন। এই নীরব সংঘাতটিই মূলত সামাজিক ন্যায্যতার অনুপস্থিতিকে প্রতিফলিত করে।
গফম্যানের বর্ণিত “নাগরিক ঔদাসীন্য”অর্থাৎ অন্যকে স্বীকার করেও মিথস্ক্রিয়ায় না জড়ানোর কৌশল-ঢাকায় বিশেষভাবে পরিবর্তিত রূপে দেখা যায়। অতিরিক্ত ভিড়, উচ্চ শব্দ, অসহনীয় গরম কিংবা নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে একই সঙ্গে সতর্ক থাকতে এবং উদাসীন থাকার এক অদ্ভুত ভারসাম্য বজায় রাখতে বাধ্য করে। এই সতর্কতা এবং উদাসীনতার মিশ্রণ ঢাকার রাস্তার “সামাজিক মনোযোগ ব্যবস্থাকে” চালনা করে।
এর মাধ্যমে মানুষ ক্রমাগত পারিপার্শ্বিকতা মূল্যায়ন করতে থাকে। বাসে উঠলে নতুন যাত্রীর দিকে সংক্ষিপ্ত নজর দেওয়া, কারও আচরণ সম্ভাব্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে কি না তা বোঝার চেষ্টা, অথবা আসন নিয়ে নীরব টানাপোড়েন-সবকিছুই এই মনোযোগ ব্যবস্থার প্রতিফলন।
নারীদের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ ও সতর্কতা আরও তীব্র। তারা প্রায়শই ভিড়ের মধ্যে অবাঞ্ছিত স্পর্শ বা হয়রানি এড়াতে শরীরের ভাষা, দৃষ্টি এবং চলনভঙ্গিতে বিশেষ রক্ষণশীলতা বজায় রাখে। ব্যাগ বা হাত দিয়ে সামনে আড়াল তৈরি করা, স্থির এবং সতর্ক দৃষ্টি রাখা, কিংবা দ্রুত হাঁটা,এগুলো তাদের “সুরক্ষামূলক অভিনয়”-এর অংশ, যা জনপরিসরে তাদের ব্যক্তিগত স্থানকে রক্ষা করে এবং সম্ভাব্য লঙ্ঘনকারীদের নিরুৎসাহিত করে।
এই নিয়ন্ত্রিত অভিনয় কেবল ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য নয়, বরং জনপরিসরে নিজেদের সম্মানজনক মর্যাদা বজায় রাখার জন্যও অপরিহার্য। এই ধরণের স্ব-নিয়ন্ত্রণ দেখায় যে জনপরিসর নারীদের জন্য এক ধরনের নিরন্তর পরীক্ষা ক্ষেত্র যেখানে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রধানত তাদের নিজেদের ওপরই বর্তায়।
ঢাকার অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির চরিত্রদের আচরণ গফম্যানীয় “অভিনয়ের” উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গফম্যানের নাটকীয়তা তত্ত্ব অনুযায়ী, সামাজিক জীবন একটি মঞ্চ এবং মানুষ অভিনেতা। রিকশাচালক, হকার, ভিক্ষুক, বাসের সহকারী বা পথশিল্পীরা তাদের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের জন্য অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে তাদের ভূমিকা পরিবেশন করে।
যাত্রী টানার জন্য রিকশাচালকের অতিরিক্ত হাসি বা বিনয়, হকারের চটপটে কথা ও পণ্য বিক্রির জন্য উদ্ভাবনী লিখিত বক্তব্য, ভিক্ষুকের অনুনয় বা দুঃখজনক দেহভঙ্গি, সিএনজি চালকের গন্তব্য শোনার পর হিসাবি নীরবতা-সবই একেকটি সামাজিক অভিনয়, যা একটি কাক্সিক্ষত প্রতিক্রিয়া বা অর্থনৈতিক লেনদেন আদায়ের উদ্দেশ্যে সাজানো।
এই চরিত্রগুলি তাদের “সম্মুখ মঞ্চ”-এ (যাত্রীর সামনে) থাকে বিনয়, পেশাদারিত্ব বা অসহায়ত্বের মুখোশ; কিন্তু যখন তারা সহকর্মীর সাথে জটলার মধ্যে থাকে (পেছনের মঞ্চ বা গুপ্ত ক্ষেত্র), তখন তাদের ভাষা ও আচরণ ভিন্ন হয়। এই অভিনয়গুলো ঢাকার রাস্তাঘাটকে একটি চলমান নাট্যশালায় পরিণত করে, যেখানে প্রতিটি ভূমিকাই জরুরি, প্রতিটি অভিব্যক্তিই তাৎপর্যময় এবং প্রতিটি পারস্পরিক ক্রিয়া তাদের দৈনন্দিন জীবিকার জন্য অপরিহার্য। এই দৃশ্যপট প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের নগর অর্থনীতি কতা মানুষের সামাজিক দক্ষতার উপর নির্ভরশীল।
ঢাকার রাস্তায় সংঘর্ষ বা উত্তেজনার মুহূর্তগুলো গফম্যানের ব্যাখ্যাকে আরও স্পষ্ট করে। ট্রাফিক জট নিয়ে ঝগড়া, বাসের সহকারীর টিকিট বা ভাড়া নিয়ে মারামারি, অথবা দুর্ঘটনার পর জনসাধারণের উত্তেজনা,এগুলো সবই মিথস্ক্রিয়া ব্যবস্থার ভাঙনের ফল। যখন প্রচলিত শিষ্টাচার বা “পারস্পরিক ক্রিয়া বিন্যাস” ভেঙে যায় (যেমন: কেউ লাইনে না দাঁড়িয়ে সামনে চলে আসে বা রিকশা হঠাৎ ব্রেক করে), তখন সমাজের নীরব নিয়মগুলো হঠাৎ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
এই ভাঙন কেবল অবকাঠামোগত ব্যর্থতার ফল নয়; বরং এটি মানুষের প্রত্যাশিত সম্মান, স্থান ও মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থারও সংকট। ঝগড়া বা বিরোধের সময় মানুষ তাদের “সম্মুখের মর্যাদা” রক্ষার জন্য লড়াই করে, যা গফম্যানের “মর্যাদা রক্ষার কাজ” তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত। এই মর্যাদা রক্ষার কাজের ব্যর্থতাই জনপরিসরে সংঘর্ষের জন্ম দেয়। তবুও ঢাকা শুধুই সংঘর্ষের শহর নয়। শহরের কঠিন বাস্তবতার মাঝেও মানবিক সংহতি বিদ্যমান।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা বা দুর্ঘটনার মুহূর্তে অপরিচিত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা হাত ধরে রাস্তা পার করানো, আটকে থাকা মোটর সাইকেল উঠিয়ে দেওয়া, কিংবা পানিতে ডুবে যাওয়া ফুটপাতে অপরকে সাহায্য করা গফম্যানের “সহায়ক বিনিময়”-এর অদৃশ্য কাঠামোকে তুলে ধরে। এই ধরনের ক্ষুদ্র মানবিকতার বিনিময় এবং অনিশ্চয়তার মুখে মানুষের প্রতি মানুষের সহযোগিতা জনপরিসরের সামাজিক জীবনীশক্তিকে টিকিয়ে রাখে।
সব মিলিয়ে, ঢাকার রাস্তাগুলো একটি জটিল সামাজিক মঞ্চ, যেখানে প্রতিটি মানুষ অবিরামভাবে নিজের ভূমিকাকে পুনর্গঠন করে। গফম্যানের জনপরিসরে সম্পর্ক তত্ত্ব আমাদের শেখায়, জনপরিসরের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, দৃষ্টি, দেহভঙ্গি, নীরবতা, এমনকি ঝগড়া পর্যন্তও একটি সামাজিক যুক্তির অনুসরণে ঘটে। এই তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, ভিড়ের মধ্যে চলতে গিয়েও আমরা কীভাবে সূক্ষ্মভাবে একে অপরের সাথে ‘বোঝাপড়া’ করি এবং স্থান ভাগ করে নেই।
ঢাকার রাস্তায় বিশৃঙ্খলার আড়ালে তাই দেখা যায় এক সূক্ষ্ম সংগতি-একটি অদৃশ্য নৃত্য পরিকল্পনা-যা প্রতিদিনের নগরজীবনকে পরিচালিত করে। গফম্যানীয় দৃষ্টিতে, ঢাকা শহরের পথঘাট কেবল চলাচলের স্থান নয়; এটি একটি জীবন্ত সামাজিক ক্ষেত্র, যেখানে আধুনিক নগরবাংলাদেশ প্রতিদিন অভিনীত, অনুশীলিত এবং পুনর্গঠিত হয়। এই গভীর সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের দেখায় যে, ঢাকাবাসী তাদের দৈনিক জীবনে কেমন করে ব্যক্তিগত স্বায়ত্তশাসন এবং সামাজিক নিয়মের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলে।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]