alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

সাদিয়া সুলতানা রিমি

: বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫

ডিজিটাল যুগের দ্রুত বিকাশ আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে অভাবনীয়ভাবে। আজ আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোন থেকেই শুরু করে ঘরের ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, কম্পিউটার, টিভি প্রতিটি জিনিসই আমাদের দৈনন্দিন কাজে সহজতা এনে দিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির এই আরাম-সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর বাস্তবতা ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্যের বাড়তি চাপ। এ এক নীরব বিষ, যা আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের বাতাসে, খাবারের মাটিতে, পানির উৎসে ধীরে ধীরে মিশে গিয়ে ভবিষ্যৎকে দগ্ধ করছে। প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে, ই-বর্জ্যের পরিমাণও তত দ্রুত বাড়ছে, আর আমরা হয়তো বুঝতেই পারছি না কখন এই বর্জ্য আমাদের জীবন, পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৬ কোটি টনের মতো ই-বর্জ্য তৈরি হয়, যার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ নিরাপদভাবে পুনর্ব্যবহার করা হয়। বাকি অংশ কোথায় যায়?

ই-বর্জ্যের প্রধান সমস্যা হলো এটি যতটা মূল্যবান ধাতু বহন করে, তারচেয়েও বেশি বহন করে ভয়ংকর বিষাক্ত রাসায়নিক। নষ্ট ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ভেতরে থাকা সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, নিকেল এবং প্লাস্টিকের বিভিন্ন ক্ষতিকর যৌগ মানবদেহের জন্য এমনভাবে ক্ষতিকর যে অল্প পরিমাণে হলেও এগুলো দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর রোগের জন্ম দেয়। সীসা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, পারদ স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করে, ক্যাডমিয়াম কিডনি অকেজো করে দিতে পারে, আর প্লাস্টিক থেকে নির্গত রাসায়নিক হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে। এই সবই ঘটে ধীরে ধীরে, নীরবে; তাই এ হুমকি প্রথম থেকেই বোঝা যায় না, আর সেটাই সবচেয়ে ভয়ংকর।

বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৬ কোটি টনের মতো ই-বর্জ্য তৈরি হয়, যার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ নিরাপদভাবে পুনর্ব্যবহার করা হয়। বাকি অংশ কোথায় যায়? অধিকাংশ ই-বর্জ্য জমা হয় ল্যান্ডফিলে, নদীর পাড়ে, ড্রেনে, খোলা জায়গায় বা ছোট ছোট অনানুষ্ঠানিক কারখানায় যেখানে শিশু-কিশোর পর্যন্ত কাজ করে। এই বর্জ্য যখন ভাঙা হয় বা পোড়ানো হয়, তখন বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে রাসায়নিক দ্রব্য জমির নিচের পানি পর্যন্ত পৌঁছে যায়, আর মাটির উর্বরতা কমে যায়। শেষ পর্যন্ত এগুলো মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে নানা রোগের জন্ম দেয়। ক্ষতিকর রাসায়নিক যতটা সহজে বাতাস, মাটি, পানিতে ছড়িয়ে পড়ে, তা ফিরিয়ে আনা ততটাই কঠিন। ফলে ই-বর্জ্যের ক্ষতি কখনও আজকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে পারে।

বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের সমস্যা দিন দিন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ায় প্রতিবছর কয়েক লাখ টন ই-বর্জ্য জমা হচ্ছে, যার বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিষ্পত্তি করা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, নারায়ণগঞ্জ বা চট্টগ্রামের আশপাশে ছোট ছোট অস্থায়ী ওয়ার্কশপে প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি ভাঙা হয়। এখানে শ্রমিকেরা প্রায় কোনো সুরক্ষা ছাড়া দিনরাত কাজ করে। তাদের হাতে থাকা হিটার দিয়ে প্লাস্টিক গলানো হয়, মাইক্রোচিপ ভাঙা হয়, ব্যাটারি কাটার সময় বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। যেসব শিশু অল্প বয়সে এই কাজ করে, তাদের ফুসফুসের ক্ষতি, ত্বকে জ্বালা, মাথা ব্যথা, চোখে জ্বালা, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি হয়। শুধু শ্রমিক নয়, এইসব ওয়ার্কশপের আশপাশের বাসিন্দারাও এসব বিষাক্ত প্রভাবের শিকার হয়। কিন্তু যেহেতু এসব সমস্যা সময় নিয়ে প্রকাশ পায়, তাই মানুষ খুব কমই এ বিষয়ে সতর্ক থাকে।

আমাদের দেশের আরেকটি বড় সমস্যা হলো ই-বর্জ্য কীভাবে ফেলা উচিত, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো ধারণাই নেই। মোবাইল ফোন নষ্ট হলে অনেকেই ডাস্টবিনে ফেলে দেন, ব্যাটারি ড্রেনে ছুঁড়ে দেন, অথবা পুরোনো ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র রাস্তার পাশে রেখে দেন। ডাস্টবিনে যখন এই বর্জ্য জমা হয়, তখন অন্য বর্জ্যের সঙ্গে মিশে পরিবেশে বিষ ছড়ায়। ড্রেনে ফেলা ব্যাটারির অ্যাসিড পানির সঙ্গে মিশে যায়, যা নদীর পানি দূষিত করে এবং জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পুরোনো চার্জার, তার, চিপস এসব ছোট ছোট জিনিসও পরিবেশে বিশাল ক্ষতির কারণ হতে পারে। অথচ আমাদের সবার ধারণা এগুলো খুব ক্ষতিকর কিছু নয়।

তবে ই-বর্জ্য কেবল মানবস্বাস্থ্যকেই বিপদে ফেলছে না, ক্ষতিগ্রস্ত করছে পুরো ইকোসিস্টেমকে। মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে কৃষিজ উৎপাদন কমে যায়, নদী-নালা দূষিত হয়ে মাছ কমে যায় বা মরে যায়, পাখি ও ছোট প্রাণী খাবার খাওয়ার সময় এইসব ক্ষতিকর কণা গ্রহণ করে ধীরে ধীরে আক্রান্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ই-বর্জ্যের কারণে কোনো একটি এলাকার গাছপালা শুকিয়ে যাচ্ছে বা মাটির গুণগত মান নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবেশের এই ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৃদ্ধি করতে পারে। সুতরাং, ই-বর্জ্য একটি দেশের শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবেশকেই নয়, অর্থনীতিকেও ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেয়।

ই-বর্জ্যের এই ক্রমবর্ধমান হুমকিকে কমাতে হলে প্রয়োজন সচেতনতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা। প্রথমত, মানুষকে জানতে হবে ই-বর্জ্য একটি ভয়ংকর জিনিস এবং এটি কোনোভাবেই সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মেশানো উচিত নয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সামাজিক সংগঠন সব জায়গায় ই-বর্জ্য সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি জেলা শহরে ই-বর্জ্য জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট কেন্দ্র থাকতে পারে, যেখানে মানুষ নিরাপদে তাদের পুরোনো ডিভাইস জমা দিতে পারবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। অনেক দেশে বড় কোম্পানিগুলো পুরোনো ডিভাইস ফেরত নিয়ে পুনর্ব্যবহার করে; আমাদের দেশেও এ ধরনের উদ্যোগ আরও বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যক্তিগত দায়িত্ব। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত নিজ নিজ জায়গা থেকে এই সমস্যা গুরুত্ব না দিচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাধান আসবে না। অযথা ডিভাইস বদলানো কমাতে হবে, যতদিন সম্ভব কোনো প্রযুক্তি ব্যবহারযোগ্য থাকলে ব্যবহার করতে হবে। নষ্ট ডিভাইস রাস্তার পাশে বা ডাস্টবিনে না ফেলে সঠিক সংগ্রহকেন্দ্রে দিতে হবে। ব্যাটারি, চার্জার বা ছোট খুচরা যন্ত্রাংশ আলাদা করে সংরক্ষণ করা উচিত। একটি পরিবার থেকে বছরে যতটুকু ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়, সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করলেই পরিবেশের ওপর চাপ অনেক কমে যাবে।

দিনের শেষে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি নিরাপদ পৃথিবী দিয়ে যেতে চাই, নাকি বিষাক্ত পৃথিবীর উত্তরাধিকার তুলে দেব হাতে? আজ আমরা যারা প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করছি, তাদের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীকে আমরা যতটা গ্রহণ করেছি, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেরত দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। তাই ই-বর্জ্যের মতো ভয়ংকর, নীরব বিপদকে অবহেলা করলে চলবে না। আজ থেকেই যদি সচেতন হই, ছোট ছোট দায়িত্ব পালন করি, তবে ই-বর্জ্যের অব্যক্ত হুমকি কমিয়ে একটি নিরাপদ, টেকসই পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।

[লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

ভূমিকম্প, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা: মানসিকতার নতুন অর্থনীতি

নবম পে স্কেল ও এর আর্থসামাজিক প্রভাব

মৃত্যুদণ্ড, তারপর...

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

সাদিয়া সুলতানা রিমি

বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫

ডিজিটাল যুগের দ্রুত বিকাশ আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে অভাবনীয়ভাবে। আজ আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোন থেকেই শুরু করে ঘরের ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, কম্পিউটার, টিভি প্রতিটি জিনিসই আমাদের দৈনন্দিন কাজে সহজতা এনে দিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির এই আরাম-সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর বাস্তবতা ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্যের বাড়তি চাপ। এ এক নীরব বিষ, যা আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের বাতাসে, খাবারের মাটিতে, পানির উৎসে ধীরে ধীরে মিশে গিয়ে ভবিষ্যৎকে দগ্ধ করছে। প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে, ই-বর্জ্যের পরিমাণও তত দ্রুত বাড়ছে, আর আমরা হয়তো বুঝতেই পারছি না কখন এই বর্জ্য আমাদের জীবন, পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৬ কোটি টনের মতো ই-বর্জ্য তৈরি হয়, যার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ নিরাপদভাবে পুনর্ব্যবহার করা হয়। বাকি অংশ কোথায় যায়?

ই-বর্জ্যের প্রধান সমস্যা হলো এটি যতটা মূল্যবান ধাতু বহন করে, তারচেয়েও বেশি বহন করে ভয়ংকর বিষাক্ত রাসায়নিক। নষ্ট ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ভেতরে থাকা সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, নিকেল এবং প্লাস্টিকের বিভিন্ন ক্ষতিকর যৌগ মানবদেহের জন্য এমনভাবে ক্ষতিকর যে অল্প পরিমাণে হলেও এগুলো দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর রোগের জন্ম দেয়। সীসা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, পারদ স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করে, ক্যাডমিয়াম কিডনি অকেজো করে দিতে পারে, আর প্লাস্টিক থেকে নির্গত রাসায়নিক হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে। এই সবই ঘটে ধীরে ধীরে, নীরবে; তাই এ হুমকি প্রথম থেকেই বোঝা যায় না, আর সেটাই সবচেয়ে ভয়ংকর।

বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৬ কোটি টনের মতো ই-বর্জ্য তৈরি হয়, যার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ নিরাপদভাবে পুনর্ব্যবহার করা হয়। বাকি অংশ কোথায় যায়? অধিকাংশ ই-বর্জ্য জমা হয় ল্যান্ডফিলে, নদীর পাড়ে, ড্রেনে, খোলা জায়গায় বা ছোট ছোট অনানুষ্ঠানিক কারখানায় যেখানে শিশু-কিশোর পর্যন্ত কাজ করে। এই বর্জ্য যখন ভাঙা হয় বা পোড়ানো হয়, তখন বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে রাসায়নিক দ্রব্য জমির নিচের পানি পর্যন্ত পৌঁছে যায়, আর মাটির উর্বরতা কমে যায়। শেষ পর্যন্ত এগুলো মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে নানা রোগের জন্ম দেয়। ক্ষতিকর রাসায়নিক যতটা সহজে বাতাস, মাটি, পানিতে ছড়িয়ে পড়ে, তা ফিরিয়ে আনা ততটাই কঠিন। ফলে ই-বর্জ্যের ক্ষতি কখনও আজকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে পারে।

বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের সমস্যা দিন দিন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ায় প্রতিবছর কয়েক লাখ টন ই-বর্জ্য জমা হচ্ছে, যার বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিষ্পত্তি করা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, নারায়ণগঞ্জ বা চট্টগ্রামের আশপাশে ছোট ছোট অস্থায়ী ওয়ার্কশপে প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি ভাঙা হয়। এখানে শ্রমিকেরা প্রায় কোনো সুরক্ষা ছাড়া দিনরাত কাজ করে। তাদের হাতে থাকা হিটার দিয়ে প্লাস্টিক গলানো হয়, মাইক্রোচিপ ভাঙা হয়, ব্যাটারি কাটার সময় বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। যেসব শিশু অল্প বয়সে এই কাজ করে, তাদের ফুসফুসের ক্ষতি, ত্বকে জ্বালা, মাথা ব্যথা, চোখে জ্বালা, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি হয়। শুধু শ্রমিক নয়, এইসব ওয়ার্কশপের আশপাশের বাসিন্দারাও এসব বিষাক্ত প্রভাবের শিকার হয়। কিন্তু যেহেতু এসব সমস্যা সময় নিয়ে প্রকাশ পায়, তাই মানুষ খুব কমই এ বিষয়ে সতর্ক থাকে।

আমাদের দেশের আরেকটি বড় সমস্যা হলো ই-বর্জ্য কীভাবে ফেলা উচিত, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো ধারণাই নেই। মোবাইল ফোন নষ্ট হলে অনেকেই ডাস্টবিনে ফেলে দেন, ব্যাটারি ড্রেনে ছুঁড়ে দেন, অথবা পুরোনো ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র রাস্তার পাশে রেখে দেন। ডাস্টবিনে যখন এই বর্জ্য জমা হয়, তখন অন্য বর্জ্যের সঙ্গে মিশে পরিবেশে বিষ ছড়ায়। ড্রেনে ফেলা ব্যাটারির অ্যাসিড পানির সঙ্গে মিশে যায়, যা নদীর পানি দূষিত করে এবং জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পুরোনো চার্জার, তার, চিপস এসব ছোট ছোট জিনিসও পরিবেশে বিশাল ক্ষতির কারণ হতে পারে। অথচ আমাদের সবার ধারণা এগুলো খুব ক্ষতিকর কিছু নয়।

তবে ই-বর্জ্য কেবল মানবস্বাস্থ্যকেই বিপদে ফেলছে না, ক্ষতিগ্রস্ত করছে পুরো ইকোসিস্টেমকে। মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে কৃষিজ উৎপাদন কমে যায়, নদী-নালা দূষিত হয়ে মাছ কমে যায় বা মরে যায়, পাখি ও ছোট প্রাণী খাবার খাওয়ার সময় এইসব ক্ষতিকর কণা গ্রহণ করে ধীরে ধীরে আক্রান্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ই-বর্জ্যের কারণে কোনো একটি এলাকার গাছপালা শুকিয়ে যাচ্ছে বা মাটির গুণগত মান নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবেশের এই ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৃদ্ধি করতে পারে। সুতরাং, ই-বর্জ্য একটি দেশের শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবেশকেই নয়, অর্থনীতিকেও ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেয়।

ই-বর্জ্যের এই ক্রমবর্ধমান হুমকিকে কমাতে হলে প্রয়োজন সচেতনতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা। প্রথমত, মানুষকে জানতে হবে ই-বর্জ্য একটি ভয়ংকর জিনিস এবং এটি কোনোভাবেই সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মেশানো উচিত নয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সামাজিক সংগঠন সব জায়গায় ই-বর্জ্য সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি জেলা শহরে ই-বর্জ্য জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট কেন্দ্র থাকতে পারে, যেখানে মানুষ নিরাপদে তাদের পুরোনো ডিভাইস জমা দিতে পারবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। অনেক দেশে বড় কোম্পানিগুলো পুরোনো ডিভাইস ফেরত নিয়ে পুনর্ব্যবহার করে; আমাদের দেশেও এ ধরনের উদ্যোগ আরও বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যক্তিগত দায়িত্ব। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত নিজ নিজ জায়গা থেকে এই সমস্যা গুরুত্ব না দিচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাধান আসবে না। অযথা ডিভাইস বদলানো কমাতে হবে, যতদিন সম্ভব কোনো প্রযুক্তি ব্যবহারযোগ্য থাকলে ব্যবহার করতে হবে। নষ্ট ডিভাইস রাস্তার পাশে বা ডাস্টবিনে না ফেলে সঠিক সংগ্রহকেন্দ্রে দিতে হবে। ব্যাটারি, চার্জার বা ছোট খুচরা যন্ত্রাংশ আলাদা করে সংরক্ষণ করা উচিত। একটি পরিবার থেকে বছরে যতটুকু ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়, সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করলেই পরিবেশের ওপর চাপ অনেক কমে যাবে।

দিনের শেষে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি নিরাপদ পৃথিবী দিয়ে যেতে চাই, নাকি বিষাক্ত পৃথিবীর উত্তরাধিকার তুলে দেব হাতে? আজ আমরা যারা প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করছি, তাদের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীকে আমরা যতটা গ্রহণ করেছি, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেরত দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। তাই ই-বর্জ্যের মতো ভয়ংকর, নীরব বিপদকে অবহেলা করলে চলবে না। আজ থেকেই যদি সচেতন হই, ছোট ছোট দায়িত্ব পালন করি, তবে ই-বর্জ্যের অব্যক্ত হুমকি কমিয়ে একটি নিরাপদ, টেকসই পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।

[লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top