মিহির কুমার রায়

দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত হলেও কৃষির জিডিপি অবদান মাত্র ১৩-১৪ শতাংশ। অর্থাৎ কৃষকের শ্রমের প্রকৃত মূল্য সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না
অর্থনীতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক বর্তমানে নিম্নমুখী রয়েছে। যেমন-বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি-এসবই বিনিয়োগ স্থবিরতা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দীর্ঘায়িত প্রভাব, কারখানায় গ্যাসসংকট ও ডলারের তারল্য সংকট। এরই মধ্যে সাড়ে তিন শ’রও বেশি ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান খাতে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই দ্বিমুখী ধাক্কার মুখে রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়লে ক্ষতিতে চলে যাবে অর্থনীতি।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও সংস্কারে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে দুর্বল কর রাজস্ব, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতি এখনো চ্যালেঞ্জে রয়েছে। তাদের মতে, রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সমস্যা মোকাবিলায় সাহসী নীতি গ্রহণ জরুরি। যাতে টেকসই আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করে শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা যায়। নীতি প্রণয়নে বিলম্ব বা অপর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হলে ঝুঁকি আরও বাড়বে। মধ্যমেয়াদে শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করা, যুব বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ ত্বরান্বিত করতে ব্যাপক কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন-যা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেই ১লা নভেম্বর দেশব্যাপী জাতীয় কৃষি দিবস ও অগ্রহায়ণ-নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। কৃষিভিত্তিক হাজার বছরের ঐতিহ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে দিনটিকে ‘জাতীয় কৃষি দিবস’ ঘোষণা করা হয়। বাংলার হেমন্তকাল মানেই ধান কাটা, নতুন চালের পিঠা-পায়েস আর কৃষকের মুখে হাসি। এই দিনটি কৃষির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণের জাতীয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। অথচ কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি হলেও কৃষক আজও সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত হলেও কৃষির জিডিপি অবদান মাত্র ১৩-১৪ শতাংশ। অর্থাৎ কৃষকের শ্রমের প্রকৃত মূল্য সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না-এ বৈষম্যই কৃষকজীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তারা ক্ষমতায় এসেই নানামুখী সংস্কারের কথা বলেছে এবং ১১টি বিষয়ে কমিশন করেছে। কিন্তু কৃষি বা কৃষক-কোনোটির জন্যই কোনো কমিশন হয়নি। সম্ভবত দু’টি কারণে: প্রথমত, এটি সরকারের অগ্রাধিকার নয়; দ্বিতীয়ত, তারা মনে করে কৃষক বা কৃষির কোনো সমস্যা নেই। অথচ কৃষি দেশের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান খাত, কিন্তু এখানে কোনো নির্ধারিত মূল্যনীতি নেই। পণ্যের অস্থির বাজারমূল্য, উৎপাদন ব্যয় না ওঠা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকের জীবন দুর্বিষহ। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক কৃষকের আত্মহত্যা এই সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ।
মেহেরপুরের পেঁয়াজ চাষি সাইফুল শেখ মাত্র ৬০০ টাকা মণে পেঁয়াজ বিক্রি করে দেখেন, সেই পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সপ্তাহ পর ২,০০০ টাকায় বিক্রি করছে। ঋণের বোঝা, মহাজন ও এনজিওর চাপ তাকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। একইভাবে রাজশাহীর বাঘায় পেঁয়াজ চাষি মীর রুহুল আমিন, মোহনপুরের পানচাষি আকবর হোসেন, কিংবা পাবার কৃষক মিনারুল-কেউই এই দুঃসহ চক্র থেকে বের হতে পারেননি। মিনারুল তো ১৪ আগস্ট স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেছেন। রেখে গেছেন চিরকুট-“আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে।”
কৃষকের মৃত্যু আমাদের সমাজকে নড়ায় না। কারণ গুরুত্বপূর্ণ হতে হলে বিপুল অর্থসম্পদ বা সংগঠিত শক্তি থাকতে হয়। কৃষকের কোনোটি নেই। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও শক্তিশালী কোনো কৃষক আন্দোলন হয়নি। ১৯৯৯ সালে প্রথম জাতীয় কৃষিনীতি প্রণীত হয়, পরে দুটি সংশোধিত সংস্করণ আসে-কিন্তু কৃষকেরা তা জানেন কি? এমনকি যারা কৃষকদের নিয়ে রাজনীতি করেন, তাঁরাও কি জানেন? আমাদের কৃষিনীতি কেবল উৎপাদনমুখী; মানুষ-অর্থাৎ কৃষক-এই নীতির বাইরে।
বিশ্বের উন্নত কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে কৃষকদের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষা কর্মসূচি থাকে। বাংলাদেশে এখনো নেই। যেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত পরিবার একসময় ছিল ৯০ শতাংশ, এখন তা নেমে এসেছে ৪৬ শতাংশে-যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কৃষি শস্য খাতে বাজেট মাত্র ৩.৪ শতাংশ। কৃষির প্রবৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের নিচে। এর পেছনে বড় কারণ-কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। মূল্যনিয়ন্ত্রণের কোনো স্বাধীন সংস্থা না থাকায় ‘কৃষি মূল্য কমিশন’ এখন সময়ের দাবি।
এই কমিশন হতে হবে সংবিধিবদ্ধ, স্বাধীন ও কার্যকর। এটি বাজারের গতিবিধি বিশ্লেষণ, উৎপাদন খরচ নির্ধারণ, এমএসপি ঘোষণা, বাজার নিয়ন্ত্রণ, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানো ও কৃষি সাবসিডি ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে। এতে কৃষক স্থিতিশীল মূল্য পাবে, জীবন-নিরাপত্তা বাড়বে, এবং গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নগাথায় ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ও আরএমজিই আলোচনায় থেকেছে। কিন্তু এই দেশের সামাজিক কাঠামোর আসল নায়ক কৃষক। দাম পাক বা না পাক-তিনিই খাদ্য জোগান দেন। তাই সরকারের এখনই প্রয়োজন সমন্বিত, জনমুখী ও কৃষককেন্দ্রিক কৃষিনীতি প্রণয়ন।
[লেখক: সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ; সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মিহির কুমার রায়

দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত হলেও কৃষির জিডিপি অবদান মাত্র ১৩-১৪ শতাংশ। অর্থাৎ কৃষকের শ্রমের প্রকৃত মূল্য সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না
শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫
অর্থনীতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক বর্তমানে নিম্নমুখী রয়েছে। যেমন-বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি-এসবই বিনিয়োগ স্থবিরতা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দীর্ঘায়িত প্রভাব, কারখানায় গ্যাসসংকট ও ডলারের তারল্য সংকট। এরই মধ্যে সাড়ে তিন শ’রও বেশি ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান খাতে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই দ্বিমুখী ধাক্কার মুখে রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়লে ক্ষতিতে চলে যাবে অর্থনীতি।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও সংস্কারে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে দুর্বল কর রাজস্ব, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতি এখনো চ্যালেঞ্জে রয়েছে। তাদের মতে, রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সমস্যা মোকাবিলায় সাহসী নীতি গ্রহণ জরুরি। যাতে টেকসই আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করে শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা যায়। নীতি প্রণয়নে বিলম্ব বা অপর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হলে ঝুঁকি আরও বাড়বে। মধ্যমেয়াদে শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করা, যুব বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ ত্বরান্বিত করতে ব্যাপক কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন-যা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেই ১লা নভেম্বর দেশব্যাপী জাতীয় কৃষি দিবস ও অগ্রহায়ণ-নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। কৃষিভিত্তিক হাজার বছরের ঐতিহ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে দিনটিকে ‘জাতীয় কৃষি দিবস’ ঘোষণা করা হয়। বাংলার হেমন্তকাল মানেই ধান কাটা, নতুন চালের পিঠা-পায়েস আর কৃষকের মুখে হাসি। এই দিনটি কৃষির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণের জাতীয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। অথচ কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি হলেও কৃষক আজও সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত হলেও কৃষির জিডিপি অবদান মাত্র ১৩-১৪ শতাংশ। অর্থাৎ কৃষকের শ্রমের প্রকৃত মূল্য সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না-এ বৈষম্যই কৃষকজীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তারা ক্ষমতায় এসেই নানামুখী সংস্কারের কথা বলেছে এবং ১১টি বিষয়ে কমিশন করেছে। কিন্তু কৃষি বা কৃষক-কোনোটির জন্যই কোনো কমিশন হয়নি। সম্ভবত দু’টি কারণে: প্রথমত, এটি সরকারের অগ্রাধিকার নয়; দ্বিতীয়ত, তারা মনে করে কৃষক বা কৃষির কোনো সমস্যা নেই। অথচ কৃষি দেশের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান খাত, কিন্তু এখানে কোনো নির্ধারিত মূল্যনীতি নেই। পণ্যের অস্থির বাজারমূল্য, উৎপাদন ব্যয় না ওঠা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকের জীবন দুর্বিষহ। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক কৃষকের আত্মহত্যা এই সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ।
মেহেরপুরের পেঁয়াজ চাষি সাইফুল শেখ মাত্র ৬০০ টাকা মণে পেঁয়াজ বিক্রি করে দেখেন, সেই পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সপ্তাহ পর ২,০০০ টাকায় বিক্রি করছে। ঋণের বোঝা, মহাজন ও এনজিওর চাপ তাকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। একইভাবে রাজশাহীর বাঘায় পেঁয়াজ চাষি মীর রুহুল আমিন, মোহনপুরের পানচাষি আকবর হোসেন, কিংবা পাবার কৃষক মিনারুল-কেউই এই দুঃসহ চক্র থেকে বের হতে পারেননি। মিনারুল তো ১৪ আগস্ট স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেছেন। রেখে গেছেন চিরকুট-“আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে।”
কৃষকের মৃত্যু আমাদের সমাজকে নড়ায় না। কারণ গুরুত্বপূর্ণ হতে হলে বিপুল অর্থসম্পদ বা সংগঠিত শক্তি থাকতে হয়। কৃষকের কোনোটি নেই। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও শক্তিশালী কোনো কৃষক আন্দোলন হয়নি। ১৯৯৯ সালে প্রথম জাতীয় কৃষিনীতি প্রণীত হয়, পরে দুটি সংশোধিত সংস্করণ আসে-কিন্তু কৃষকেরা তা জানেন কি? এমনকি যারা কৃষকদের নিয়ে রাজনীতি করেন, তাঁরাও কি জানেন? আমাদের কৃষিনীতি কেবল উৎপাদনমুখী; মানুষ-অর্থাৎ কৃষক-এই নীতির বাইরে।
বিশ্বের উন্নত কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে কৃষকদের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষা কর্মসূচি থাকে। বাংলাদেশে এখনো নেই। যেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত পরিবার একসময় ছিল ৯০ শতাংশ, এখন তা নেমে এসেছে ৪৬ শতাংশে-যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কৃষি শস্য খাতে বাজেট মাত্র ৩.৪ শতাংশ। কৃষির প্রবৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের নিচে। এর পেছনে বড় কারণ-কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। মূল্যনিয়ন্ত্রণের কোনো স্বাধীন সংস্থা না থাকায় ‘কৃষি মূল্য কমিশন’ এখন সময়ের দাবি।
এই কমিশন হতে হবে সংবিধিবদ্ধ, স্বাধীন ও কার্যকর। এটি বাজারের গতিবিধি বিশ্লেষণ, উৎপাদন খরচ নির্ধারণ, এমএসপি ঘোষণা, বাজার নিয়ন্ত্রণ, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানো ও কৃষি সাবসিডি ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে। এতে কৃষক স্থিতিশীল মূল্য পাবে, জীবন-নিরাপত্তা বাড়বে, এবং গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নগাথায় ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ও আরএমজিই আলোচনায় থেকেছে। কিন্তু এই দেশের সামাজিক কাঠামোর আসল নায়ক কৃষক। দাম পাক বা না পাক-তিনিই খাদ্য জোগান দেন। তাই সরকারের এখনই প্রয়োজন সমন্বিত, জনমুখী ও কৃষককেন্দ্রিক কৃষিনীতি প্রণয়ন।
[লেখক: সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ; সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]