হোসেন আবদুল মান্নান
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বর্তমানে এক চরম নৈরাজ্য বিদ্যমান। শিক্ষা খাতে বহুমাত্রিক হতাশার মধ্যে এক ফোঁটা আলোর অন্বেষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। এমন হতাশা ও নৈরাজ্যের পরিবেশ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে ভেতর থেকে নিভৃতে ক্ষয় হয়ে আসা, পঁচেগলে আসছিল এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা। ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে অভ্যন্তরীন প্রশাসনিক কাঠামোগত অবস্থান এবং সম্পৃক্ত জনবলের মানসিক স্তরকেও। বাতাসে সংক্রমিত ভাইরাসের মতন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতির ব্যাধি
তথা নৈতিকতা বর্জিত চরিত্রের অপশিক্ষা। দুর্নীতি, প্রতারণা ও দুর্বৃত্তায়ন হয়ে ওঠেছে অনুসরণীয় অনুকরণীয় বৃত্তি। বিগত দুই দশকে দেশের শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী এবং জনবলের মধ্যেও অসাধু, অসদাচরণকারীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যা একসময়ে প্রান্তিক শিক্ষক, প্রতিষ্টান প্রধান বা সাধারণ মানুষের কল্পনার অতীত ছিল। আর সেটা সুদূর অতীতের কথা নয়। শিক্ষা মন্ত্রনালয়, অধিদপ্তর বা বোর্ডগুলোর জারীকৃত কোনো অনুশাসন ছিল সমগ্র জাতির কাছে বেদবাক্যতুল্য। রহস্যজনকভাবে আজকাল তা অনেকাংশেই শিথিল ও হালকা হয়ে গেছে। মনে হয় প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দুষ্টচক্রের কালো ছায়া নেমে এসেছে। অতীতে শিক্ষাকে মানুষ একটা পবিত্র ও নিবেদিত পেশা হিসেবে জ্ঞান করতো। একে সামাজিক মর্যাদা, সম্মানবোধ, জনহিতৈষী কর্মের কাতারে বিশেষভাবে বিবেচিত হত। সমাজে সর্বজনে মাথা উঁচু করে কথা বলার মূল শ্রেণির নাম ছিল ‘শিক্ষক’। আজকের সমাজ বাস্তবতায় এসব নীতি নৈতিকতার বাণী যেন চরম অস্তিত্বের সংকটে পড়ে আছে।
দুই.
কয়েকদিন আগে টিভিতে একটা সংবাদ প্রতিবেদন অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম। দেশের শীর্ষ স্থানীয় টিভি চ্যানেল তা প্রচার করেছিল। চ্যানেলের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদক আত্মপ্রত্যয়ী ভঙ্গিতে বলেছেন, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকার কাপাড়া আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজটি প্রতিষ্টা পায় ১৯৯৯ সালে। এর অধ্যক্ষসহ অসংখ্য শিক্ষকের শিক্ষাগত সনদপত্র জাল। এমনকি অধ্যক্ষ নিজের ঢাকা কলেজের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রির কথা বললেও সেখানে অনার্সে এমন বিষয়ই নেই। অধ্যক্ষ নিজের সনদই জাল ও স্বাক্ষর স্ক্যান করেছে। এমনই করে তারা মোট ৯০ জনকে নিয়ে তদন্ত পরিচালনা করে। হালুয়াঘাটেই ৭০ জনের মধ্যে ৫০ জনের সনদপত্র জাল বা ভুয়া হিসেবে প্রমাণ করেছে। বলা হয়েছে, তারা সরকারি কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতাদি উত্তোলন করেই ক্ষান্ত থাকেনি। একই সাথে একই সময়ে পার্শ্ববর্তী একাধিক কলেজে শিক্ষকতা করে সেখান থেকেও বেতন ভাতা নিয়েছে। যা আরেকটি বড় অপরাধ। এ-সব জাল সনদপত্রের সরবরাহদাতা চক্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামের ভয়াবহ সনদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রাইভেট কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোভনীয় অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করেছে। এতে বোঝা যায়, অপরাধ চক্র এদের অপতৎপরতা সবচেয়ে মারাত্মক ভাবে চালাচ্ছে দেশের অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ ও যোগাযোগের বিবেচনায় প্রান্তিক এলাকাগুলোতে। জানা যায়, এদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছে, পুলিশী কার্যক্রম চলমান আছে। তবে শেষাবধি হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, এদেশে যেমনটা হয়ে থাকে। তারা বহাল হয়ে শিক্ষকতার মতন সম্মানিত পদ ও পেশায় আমৃত্যু নিবেদিত থাকবে। স্হানীয় জনগণ প্রফেসর স্যার বা হেড স্যার বলেই সম্বোধন করে যাবে। এদেশে মানুষ সবকিছু দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভুলে যায়।
তিন.
জাল সনদের এমন সর্বগ্রাসী বিস্তার কেবল শিক্ষা প্রতিষ্টানে নয়। অন্যান্য বিভাগেও নীরবে নিভৃতে প্রবেশ করেছে। রাষ্ট্র ও জাতি বিধ্বংসী খেলায় মেতে ওঠেছে জালিয়াত চক্র। সরকারের কঠোর অবস্থান এবং নজরদারি না থাকলে এর বিস্তার ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। বলাবাহুল্য, এই গোপন চক্রের আশীর্বাদে কেউ কেউ বছরের পর বছর চাকরি করে চলেছে, পদোন্নতি পাচ্ছে, অফিস প্রধান হয়ে যাচ্ছে, সমাজের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হচ্ছে, দাতা, দানবীর কতকিছু হচ্ছে। ধরা পড়লে জানা হলো, না হলে দেশ ও সমাজের সফল ব্যক্তি, রতœগর্ভা মায়ের সন্তান আরও কতকিছু অর্জন করে চলেছে। আজকাল এমন ঘটনা মানুষের নজরে মূলত প্রযুক্তি এনে দেয়, একসময় তা ছিল না। তবে অপরাধও এত বহুমাত্রিক শাখায় বিস্তৃত ছিল না।
৮০’র দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এমন একটা ঘটনার কথা শুনে সেদিন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছিল। প্রভোস্ট এবং ছাত্ররা বিস্মিত হয়ে ছিলেন। তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস না করেই কয়েকজন ছাত্র অনার্স পরীক্ষা পাস করে যায়। অবশেষে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে এদের সার্টিফিকেট কেলেংকারির বিষয়টি জানাজানি হলো। দৈনিক পত্রিকায় নাম, বিভাগ ও ছবিসহ প্রকাশিত হলো। এদের সনদপত্র বাতিলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বহিস্কৃত হয়েছিল।
ফৌজদারি মামলা হয়েছিল কিনা মনে নেই। তখন এই ঘটনা ‘টক অব দি ইউনিভার্সিটি’ ছিল। এবং নিরীহ সাধারণ ছাত্ররা বেশ আনন্দিত হয়েছিল। কারণ, সেই ভুয়া ছাত্রদের মধ্যে দুই একজন হল পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা ছিল।
চার.
শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট জাল হবে এটা মনস্তাত্ত্বিকভাবে মেনে নেয়া যায় না। সমাজে যায় না। এটা আর দশটা সাধারণ মাত্রার অপরাধের বিবেচনার ভেতরে পড়ে না। দেশের কোমলমতি শিশুদের বা কিশোরদের রাষ্ট্রের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব যার হাতে তাকে অবশ্যই নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে অধিকতর অগ্রসরমান হতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে তৈরি করতে হবে অনুসরণীয় হিসেবে। জাল সনদ নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে নিজেকে কলুষিত চরিত্রের একজন বানিয়ে আর যাই হোক স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা করার অধিকার কেউ রাখতে পারে না।
শিক্ষা মন্ত্রনালয় তথা সরকারকে এখনই যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সারাদেশের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ডিগ্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সকল প্রতিষ্টানে কর্মরত শিক্ষকদের সনদপত্র যাচাইয়ের নিমিত্ত বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে উপজেলা ও জেলাওয়ারী পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জনশুমারীর মতো করে অভিযানে নামতে হবে। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হবে এবং একইসাথে সনদপত্র প্রদানকারী প্রতিষ্টানকেও কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। এমনকি সনদপত্র তৈরির জাল প্রেস বা ছাপাখানার বিরুদ্ধেও আইনী ব্যবস্হা নিতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্টানের, সরকারি ডিপার্টমেন্টের অসাধু শিক্ষক ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আরোপের আইন করতে হবে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে সকল সরকারি, বেসরকারি, এমপিও ভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্টানে লোগো ব্যবহার বিধিমালা বা নীতিমালা প্রনয়ণ করতে হবে। প্রচলিত অপরাধের শাস্তি ও জরিমানার আইনে সময়োপযোগী সংশোধন আনতে হবে। প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশনকে মাঠ পর্যায়ে কাজে লাগানো যায়। অন্যথায় জাল সনদপত্রের এমন আত্মঘাতী ও অপ্রতিরোধ্য ব্যবসা অদূর ভবিষ্যতেও দেশে চলতে থাকবে। এবং এর ফলে তৃণমূলের শিক্ষার গুণগত মান বিনষ্ট ও জাতীয় বিপর্যয় কোনোটাই রোধ করা সম্ভব হবে না। বরঞ্চ শিক্ষার এমন চিত্র জাতির ভবিষ্যৎ আশা আকাক্সক্ষা স্থল নতুন প্রজন্মের জন্যে এক অশনি সংকেত ছাড়া আর কিছু নয়।
৫.
বছরতিন পূর্বে গ্রাম এলাকায় একটা উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ প্রতিষ্টা করার পর থেকেই গ্রামীণ স্কুল,কলেজের শিক্ষার হালচাল, ভেতরের বাস্তব চিত্র, শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তি, সিলেবাস, পড়াশোনার মান ইত্যাদি সম্পর্কে খানিক অবহিত হতে থাকি। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের এক আশ্চর্য দুয়ার খুলে যায়। বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি ছাত্র ছাত্রীর সংকটও প্রবলভাবে দেখা যাচ্ছে। জানা যায়, গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলের শারিরীক শিক্ষা বা গেম টিচার হিসেবে কর্মরত শিক্ষকদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্টান থেকে সনদপত্র সংগ্রহ করে দিব্যি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন কিন্তু বাস্তবে এজাতীয় রেজিস্ট্রার্ড/ অনুমোদিত প্রতিষ্টান বা কলেজের অস্তিত্বই নেই। জাল জালিয়াতির এমন ভয়ংকর কার্যক্রম দেশে চলেছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে সরকার এখনই যদি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তবে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। সত্য- মিথ্যা, আসল-নকল, ভালো-মন্দ সব একাকার হয়ে যাবে।
[লেখক: গল্পকার ও সাবেক সচিব]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
হোসেন আবদুল মান্নান
শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বর্তমানে এক চরম নৈরাজ্য বিদ্যমান। শিক্ষা খাতে বহুমাত্রিক হতাশার মধ্যে এক ফোঁটা আলোর অন্বেষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। এমন হতাশা ও নৈরাজ্যের পরিবেশ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে ভেতর থেকে নিভৃতে ক্ষয় হয়ে আসা, পঁচেগলে আসছিল এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা। ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে অভ্যন্তরীন প্রশাসনিক কাঠামোগত অবস্থান এবং সম্পৃক্ত জনবলের মানসিক স্তরকেও। বাতাসে সংক্রমিত ভাইরাসের মতন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতির ব্যাধি
তথা নৈতিকতা বর্জিত চরিত্রের অপশিক্ষা। দুর্নীতি, প্রতারণা ও দুর্বৃত্তায়ন হয়ে ওঠেছে অনুসরণীয় অনুকরণীয় বৃত্তি। বিগত দুই দশকে দেশের শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী এবং জনবলের মধ্যেও অসাধু, অসদাচরণকারীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যা একসময়ে প্রান্তিক শিক্ষক, প্রতিষ্টান প্রধান বা সাধারণ মানুষের কল্পনার অতীত ছিল। আর সেটা সুদূর অতীতের কথা নয়। শিক্ষা মন্ত্রনালয়, অধিদপ্তর বা বোর্ডগুলোর জারীকৃত কোনো অনুশাসন ছিল সমগ্র জাতির কাছে বেদবাক্যতুল্য। রহস্যজনকভাবে আজকাল তা অনেকাংশেই শিথিল ও হালকা হয়ে গেছে। মনে হয় প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দুষ্টচক্রের কালো ছায়া নেমে এসেছে। অতীতে শিক্ষাকে মানুষ একটা পবিত্র ও নিবেদিত পেশা হিসেবে জ্ঞান করতো। একে সামাজিক মর্যাদা, সম্মানবোধ, জনহিতৈষী কর্মের কাতারে বিশেষভাবে বিবেচিত হত। সমাজে সর্বজনে মাথা উঁচু করে কথা বলার মূল শ্রেণির নাম ছিল ‘শিক্ষক’। আজকের সমাজ বাস্তবতায় এসব নীতি নৈতিকতার বাণী যেন চরম অস্তিত্বের সংকটে পড়ে আছে।
দুই.
কয়েকদিন আগে টিভিতে একটা সংবাদ প্রতিবেদন অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম। দেশের শীর্ষ স্থানীয় টিভি চ্যানেল তা প্রচার করেছিল। চ্যানেলের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদক আত্মপ্রত্যয়ী ভঙ্গিতে বলেছেন, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকার কাপাড়া আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজটি প্রতিষ্টা পায় ১৯৯৯ সালে। এর অধ্যক্ষসহ অসংখ্য শিক্ষকের শিক্ষাগত সনদপত্র জাল। এমনকি অধ্যক্ষ নিজের ঢাকা কলেজের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রির কথা বললেও সেখানে অনার্সে এমন বিষয়ই নেই। অধ্যক্ষ নিজের সনদই জাল ও স্বাক্ষর স্ক্যান করেছে। এমনই করে তারা মোট ৯০ জনকে নিয়ে তদন্ত পরিচালনা করে। হালুয়াঘাটেই ৭০ জনের মধ্যে ৫০ জনের সনদপত্র জাল বা ভুয়া হিসেবে প্রমাণ করেছে। বলা হয়েছে, তারা সরকারি কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতাদি উত্তোলন করেই ক্ষান্ত থাকেনি। একই সাথে একই সময়ে পার্শ্ববর্তী একাধিক কলেজে শিক্ষকতা করে সেখান থেকেও বেতন ভাতা নিয়েছে। যা আরেকটি বড় অপরাধ। এ-সব জাল সনদপত্রের সরবরাহদাতা চক্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামের ভয়াবহ সনদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রাইভেট কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোভনীয় অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করেছে। এতে বোঝা যায়, অপরাধ চক্র এদের অপতৎপরতা সবচেয়ে মারাত্মক ভাবে চালাচ্ছে দেশের অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ ও যোগাযোগের বিবেচনায় প্রান্তিক এলাকাগুলোতে। জানা যায়, এদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছে, পুলিশী কার্যক্রম চলমান আছে। তবে শেষাবধি হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, এদেশে যেমনটা হয়ে থাকে। তারা বহাল হয়ে শিক্ষকতার মতন সম্মানিত পদ ও পেশায় আমৃত্যু নিবেদিত থাকবে। স্হানীয় জনগণ প্রফেসর স্যার বা হেড স্যার বলেই সম্বোধন করে যাবে। এদেশে মানুষ সবকিছু দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভুলে যায়।
তিন.
জাল সনদের এমন সর্বগ্রাসী বিস্তার কেবল শিক্ষা প্রতিষ্টানে নয়। অন্যান্য বিভাগেও নীরবে নিভৃতে প্রবেশ করেছে। রাষ্ট্র ও জাতি বিধ্বংসী খেলায় মেতে ওঠেছে জালিয়াত চক্র। সরকারের কঠোর অবস্থান এবং নজরদারি না থাকলে এর বিস্তার ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। বলাবাহুল্য, এই গোপন চক্রের আশীর্বাদে কেউ কেউ বছরের পর বছর চাকরি করে চলেছে, পদোন্নতি পাচ্ছে, অফিস প্রধান হয়ে যাচ্ছে, সমাজের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হচ্ছে, দাতা, দানবীর কতকিছু হচ্ছে। ধরা পড়লে জানা হলো, না হলে দেশ ও সমাজের সফল ব্যক্তি, রতœগর্ভা মায়ের সন্তান আরও কতকিছু অর্জন করে চলেছে। আজকাল এমন ঘটনা মানুষের নজরে মূলত প্রযুক্তি এনে দেয়, একসময় তা ছিল না। তবে অপরাধও এত বহুমাত্রিক শাখায় বিস্তৃত ছিল না।
৮০’র দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এমন একটা ঘটনার কথা শুনে সেদিন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছিল। প্রভোস্ট এবং ছাত্ররা বিস্মিত হয়ে ছিলেন। তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস না করেই কয়েকজন ছাত্র অনার্স পরীক্ষা পাস করে যায়। অবশেষে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে এদের সার্টিফিকেট কেলেংকারির বিষয়টি জানাজানি হলো। দৈনিক পত্রিকায় নাম, বিভাগ ও ছবিসহ প্রকাশিত হলো। এদের সনদপত্র বাতিলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বহিস্কৃত হয়েছিল।
ফৌজদারি মামলা হয়েছিল কিনা মনে নেই। তখন এই ঘটনা ‘টক অব দি ইউনিভার্সিটি’ ছিল। এবং নিরীহ সাধারণ ছাত্ররা বেশ আনন্দিত হয়েছিল। কারণ, সেই ভুয়া ছাত্রদের মধ্যে দুই একজন হল পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা ছিল।
চার.
শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট জাল হবে এটা মনস্তাত্ত্বিকভাবে মেনে নেয়া যায় না। সমাজে যায় না। এটা আর দশটা সাধারণ মাত্রার অপরাধের বিবেচনার ভেতরে পড়ে না। দেশের কোমলমতি শিশুদের বা কিশোরদের রাষ্ট্রের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব যার হাতে তাকে অবশ্যই নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে অধিকতর অগ্রসরমান হতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে তৈরি করতে হবে অনুসরণীয় হিসেবে। জাল সনদ নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে নিজেকে কলুষিত চরিত্রের একজন বানিয়ে আর যাই হোক স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা করার অধিকার কেউ রাখতে পারে না।
শিক্ষা মন্ত্রনালয় তথা সরকারকে এখনই যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সারাদেশের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ডিগ্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সকল প্রতিষ্টানে কর্মরত শিক্ষকদের সনদপত্র যাচাইয়ের নিমিত্ত বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে উপজেলা ও জেলাওয়ারী পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জনশুমারীর মতো করে অভিযানে নামতে হবে। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হবে এবং একইসাথে সনদপত্র প্রদানকারী প্রতিষ্টানকেও কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। এমনকি সনদপত্র তৈরির জাল প্রেস বা ছাপাখানার বিরুদ্ধেও আইনী ব্যবস্হা নিতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্টানের, সরকারি ডিপার্টমেন্টের অসাধু শিক্ষক ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আরোপের আইন করতে হবে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে সকল সরকারি, বেসরকারি, এমপিও ভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্টানে লোগো ব্যবহার বিধিমালা বা নীতিমালা প্রনয়ণ করতে হবে। প্রচলিত অপরাধের শাস্তি ও জরিমানার আইনে সময়োপযোগী সংশোধন আনতে হবে। প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশনকে মাঠ পর্যায়ে কাজে লাগানো যায়। অন্যথায় জাল সনদপত্রের এমন আত্মঘাতী ও অপ্রতিরোধ্য ব্যবসা অদূর ভবিষ্যতেও দেশে চলতে থাকবে। এবং এর ফলে তৃণমূলের শিক্ষার গুণগত মান বিনষ্ট ও জাতীয় বিপর্যয় কোনোটাই রোধ করা সম্ভব হবে না। বরঞ্চ শিক্ষার এমন চিত্র জাতির ভবিষ্যৎ আশা আকাক্সক্ষা স্থল নতুন প্রজন্মের জন্যে এক অশনি সংকেত ছাড়া আর কিছু নয়।
৫.
বছরতিন পূর্বে গ্রাম এলাকায় একটা উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ প্রতিষ্টা করার পর থেকেই গ্রামীণ স্কুল,কলেজের শিক্ষার হালচাল, ভেতরের বাস্তব চিত্র, শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তি, সিলেবাস, পড়াশোনার মান ইত্যাদি সম্পর্কে খানিক অবহিত হতে থাকি। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের এক আশ্চর্য দুয়ার খুলে যায়। বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি ছাত্র ছাত্রীর সংকটও প্রবলভাবে দেখা যাচ্ছে। জানা যায়, গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলের শারিরীক শিক্ষা বা গেম টিচার হিসেবে কর্মরত শিক্ষকদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্টান থেকে সনদপত্র সংগ্রহ করে দিব্যি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন কিন্তু বাস্তবে এজাতীয় রেজিস্ট্রার্ড/ অনুমোদিত প্রতিষ্টান বা কলেজের অস্তিত্বই নেই। জাল জালিয়াতির এমন ভয়ংকর কার্যক্রম দেশে চলেছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে সরকার এখনই যদি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তবে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। সত্য- মিথ্যা, আসল-নকল, ভালো-মন্দ সব একাকার হয়ে যাবে।
[লেখক: গল্পকার ও সাবেক সচিব]