খন রঞ্জন রায় ও আবুল হাসান
রক্ত মানুষের জন্মরহস্যের এক অভিনব অপার্থিব বস্তু। সাদা-কালো পিত হলেও ভিতরে সবার সমান রাঙা। রক্ত হলো একটি বিশেষ তরল যা মানুষের এবং অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের সংবহনতন্ত্রে থাকে। এটি কোষগুলিতে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং বর্জ্য পদার্থ যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বহন করে। এটি রক্তের প্লাজমা নামক তরল অংশে ভাসমান লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং অণুচক্রিকা দ্বারা গঠিত একটি যোজক টিস্যু।
রক্ত দুটি প্রধান উপাদান দিয়ে গঠিত: রক্তরস প্রায় ৫৫% ভাগ এবং রক্তকণিকা যারা কোষে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করে। কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনে সহায়তা করে। হরমোন, ভিটামিন এবং অ্যান্টিবডি বহন করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে ৫-৬লিটার রক্ত থাকে। রক্ত সামান্য ক্ষারীয়।
রক্ত সঞ্চালনের ইতিহাসে বাঁকবদল ঘটে ১৯০০ সালে যখন ট্রান্সফিউশন মেডিসিনের জনক নোবেলজয়ী জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসক কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার প্রথম রক্তের গ্রুপ সিস্টেম আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়াটি নিরাপদ হয়। তার আগ পর্যন্ত অজানা ছিল কেন সবার রক্ত সবার শরীর খাটে না।
১৯৩৭ খ্রি. ল্যান্ডস্টেইনার এবং আলেকজান্ডার এস. উইনার যৌথভাবে আরএইচ ফ্যাক্টর আবিষ্কার করেন, যা রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করে। এই আরএইচ ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে প্রধান চারটি রক্তের গ্রুপকে আট ভাগে ভাগ করা হয়। বেবিমেড ডটকমের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার রক্তের গ্রুপের অবস্থান নিম্নরূপ:
‘ও’ পজেটিভ ৩১.১৮%, ‘ও’ নেগেটিভ ১.৩৯%, ‘এ’ পজেটিভ ২১.৪৪%, ‘এ’ নেগেটিভ ০.৯৬%, ‘বি’ পজেটিভ ৩৪.৫৮%, ‘বি’ নেগেটিভ ০.৯৬%, ‘এবি’ পজেটিভ ৮.৮৫%, ‘এবি’ নেগেটিভ ০.৬৪%
এমন অনেক মানুষ আছে, যাদের রক্তে কোনো আরএইচ অ্যান্টিজেন থাকে না। এ ধরনের রক্তকে বলে আরএইচনাল। প্রায় ৫০ বছর আগে অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম এ রক্তের গ্রুপ দেখা গেছে। তবে এটা খুব বিরল। সারা পৃথিবীতে মাত্র ৫০ জন বা তার চেয়ে কম মানুষ এই বিরল রক্তের মালিক। এ জন্য এই গ্রুপের রক্তকে বলে গোল্ডেন ব্লাড। আসলে স্বর্ণের চেয়ে দামি এ রক্ত। বিরল এই ব্যক্তির সংখ্যা ভবিষ্যতে বেড়ে যেতে পারে। অথবা এর চেয়ে বিরল কোনো রক্তের গ্রুপও আবিষ্কার হতে পারে। এইজন্য শতভাগ মানুষের রক্তের গ্রুপ জানা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বেচ্ছায় রক্তদান মানবকল্যাণের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত এবং যে-কোনো দেশের নিরাপদ রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এটি এমন একটি উপহার, যা গ্রহীতার জীবন রক্ষা করে, কিন্তু দাতার কোনো ক্ষতি না করে। প্রথমবারের মতো সফল রক্ত পরিসঞ্চালনের পরীক্ষা চালান তরুণ চিকিৎসক ডা. রিচার্ড লোয়ার। তবে মানুষের নয়, কুকুরের। ১৬৬৫ সালে একটি কুকুরের ধমনী থেকে আরেকটি কুকুরের শিরায় সফলভাবে তিনি রক্ত পরিসঞ্চালন করেন।
১৬৬৭ সালে ফরাসী চিকিৎসক জ্যঁ ব্যাপ্টিস্ট ডেনিক ভেড়ার দেহ থেকে নয় আউন্স পরিমাণ রক্ত নিয়ে প্রবেশ করান দীর্ঘদিন ধরে জ¦রে ভুগছে এমন এক কিশোরের দেহে। একই পরীক্ষা আরো কয়েকজনের ওপর চালিয়ে সফল হলেও বাছুরের রক্ত ঢোকাতে গিয়ে মারা যান এ পরীক্ষার সর্বশেষ শিকার এন্টটি মৌরী।
সফলভাবে মানবদেহ থেকে মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের পথটি দেখিয়েছিলেন ব্রিটিশ ধাত্রীবিদ্যা বিশারদ ডা. জেমস ব্লান্ডেল। ১৮১৮ সালে, ডা. ব্লান্ডেল প্রথমবারের মতো সফলভাবে এক নারীর প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ চিকিৎসার জন্য তার স্বামীর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে তার দেহে সঞ্চালন করেন। সেই থেকে শুরু। বিজ্ঞান এগিয়েছে। রক্তবিজ্ঞানও যথাযথভাবে এগিয়েছে বরং আরও এক ডিগ্রি বেশি এগিয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান নির্ভর করে তার নিরাপদ রক্তের মজুতের ওপর। বিশ্বে স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুসারে, একটি দেশের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ৩ শতাংশ যদি নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদান করে, তবে সেই দেশের রক্তের চাহিদা মিটে যায়। বাংলাদেশে সরকারিভাবে ১৯৯৬ সারে গঠিত হয় ‘ব্লাড ট্রান্সফিউশন কমিটি’ যাদের কাছ ছিল রক্তদাতা নির্বাচনের মাপকাঠি নিরূপণ, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন এবং রক্তের স্ক্রিনিং ও এ সম্পর্কিত প্রযুক্তি ব্যবহার কীভাবে করা যাবে তার প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয়া।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন সার্জারি, সড়ক দুর্ঘটনা, জটিল প্রসকালীন পরিস্থিতি এবং থ্যালাসেমিয়াসহ অন্যান্য রক্তজনিত রোগের চিকিৎসার জন্যে প্রায় ৮-১০ লক্ষ ইউনিট (ব্যাগ) রক্তের প্রয়োজন হয়। বেঁচে থাকার জন্যে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিত রক্ত লাগে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন কর্মসূচির তথ্য এবং বিভিন্ন বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট সংগৃহীত রক্তের মাত্র ৩০-৩৫% আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে।
আমাদের দেশের তরুণদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। তাদের মধ্যে ২ শতাংশ যদি বছরে মাত্র একবারও রক্ত দেন, তাহলেই মিটবে রক্তের চাহিদা, রক্তের অভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে না কোনো মুমূর্ষ রোগীকে। আর এই কাজে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের রক্তের গ্রুপ জানা। রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করার জন্য সাধারণত একটি ল্যাব পরীক্ষা করা হয়, যেখানে আঙুলের ডগা বা শিরা থেকে রক্তের নমুনা নেওয়া হয়। এই পরীক্ষায় লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে থাকা নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন এবং প্লাজমার অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে রক্তের ধরণ নির্ধারণ করা হয়। এই পরীক্ষাটি একটি সহজ পদ্ধতি এবং তার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির অন্যান্য রক্তের ধরণ জানা যায়।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ (ত্রিশ) লক্ষ নতুন মুখ মোট জনসংখ্যার সাথে সংযোগ ঘটে। ৩০ লক্ষ অনাগত অতিথিকে প্রাইমারী স্কুলেই ৫-১০ বয়সের মধ্যে রক্ত গ্রুপ নির্ণয় করে দিলে বিশ্বের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হবে। প্রতিটি নাগরিক তার প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ রক্ত গ্রহণ প্রদান করতে পারে। দাম্পত্য জীবনে ও সন্তান জন্ম দানে রক্তের গ্রুপের জটিলতা দূর হবে। এদেশের কোনো লোকেরই রক্তের অভাবে মৃত্যু ঘটবে না।
এই মহতি কাজের জন্য জাতীয়ভাবে প্রতিবছর একদিন দেশব্যাপি রক্ত গ্রুপ নির্ণয় ক্যাম্পিং প্রয়োজন। ৭ই ডিসেম্বর ২০২৫ রোজ রবিবার জাতীয় রক্ত গ্রুপ নির্ণয় দিবস । স্বাধীন কেন্দ্রীয় পরিষদ ১ম বারের মত জানা থাকলে রক্তের গ্রুপ জরুরি দরকারে লাগবে খুব স্লোগান নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় রক্ত গ্রুপ নির্ণয় দিবস ঘোষণা করেছে। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে আগ্রহী তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তগ্রুপ নির্ণয়ে উৎসাহিত করাই এই দিবসের মূল লক্ষ্য।
[লেখকদ্বয় যথাক্রমে জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস উদযাপন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ও আহ্বায়ক]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
খন রঞ্জন রায় ও আবুল হাসান
শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫
রক্ত মানুষের জন্মরহস্যের এক অভিনব অপার্থিব বস্তু। সাদা-কালো পিত হলেও ভিতরে সবার সমান রাঙা। রক্ত হলো একটি বিশেষ তরল যা মানুষের এবং অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের সংবহনতন্ত্রে থাকে। এটি কোষগুলিতে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং বর্জ্য পদার্থ যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বহন করে। এটি রক্তের প্লাজমা নামক তরল অংশে ভাসমান লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং অণুচক্রিকা দ্বারা গঠিত একটি যোজক টিস্যু।
রক্ত দুটি প্রধান উপাদান দিয়ে গঠিত: রক্তরস প্রায় ৫৫% ভাগ এবং রক্তকণিকা যারা কোষে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করে। কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনে সহায়তা করে। হরমোন, ভিটামিন এবং অ্যান্টিবডি বহন করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে ৫-৬লিটার রক্ত থাকে। রক্ত সামান্য ক্ষারীয়।
রক্ত সঞ্চালনের ইতিহাসে বাঁকবদল ঘটে ১৯০০ সালে যখন ট্রান্সফিউশন মেডিসিনের জনক নোবেলজয়ী জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসক কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার প্রথম রক্তের গ্রুপ সিস্টেম আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়াটি নিরাপদ হয়। তার আগ পর্যন্ত অজানা ছিল কেন সবার রক্ত সবার শরীর খাটে না।
১৯৩৭ খ্রি. ল্যান্ডস্টেইনার এবং আলেকজান্ডার এস. উইনার যৌথভাবে আরএইচ ফ্যাক্টর আবিষ্কার করেন, যা রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করে। এই আরএইচ ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে প্রধান চারটি রক্তের গ্রুপকে আট ভাগে ভাগ করা হয়। বেবিমেড ডটকমের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার রক্তের গ্রুপের অবস্থান নিম্নরূপ:
‘ও’ পজেটিভ ৩১.১৮%, ‘ও’ নেগেটিভ ১.৩৯%, ‘এ’ পজেটিভ ২১.৪৪%, ‘এ’ নেগেটিভ ০.৯৬%, ‘বি’ পজেটিভ ৩৪.৫৮%, ‘বি’ নেগেটিভ ০.৯৬%, ‘এবি’ পজেটিভ ৮.৮৫%, ‘এবি’ নেগেটিভ ০.৬৪%
এমন অনেক মানুষ আছে, যাদের রক্তে কোনো আরএইচ অ্যান্টিজেন থাকে না। এ ধরনের রক্তকে বলে আরএইচনাল। প্রায় ৫০ বছর আগে অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম এ রক্তের গ্রুপ দেখা গেছে। তবে এটা খুব বিরল। সারা পৃথিবীতে মাত্র ৫০ জন বা তার চেয়ে কম মানুষ এই বিরল রক্তের মালিক। এ জন্য এই গ্রুপের রক্তকে বলে গোল্ডেন ব্লাড। আসলে স্বর্ণের চেয়ে দামি এ রক্ত। বিরল এই ব্যক্তির সংখ্যা ভবিষ্যতে বেড়ে যেতে পারে। অথবা এর চেয়ে বিরল কোনো রক্তের গ্রুপও আবিষ্কার হতে পারে। এইজন্য শতভাগ মানুষের রক্তের গ্রুপ জানা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বেচ্ছায় রক্তদান মানবকল্যাণের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত এবং যে-কোনো দেশের নিরাপদ রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এটি এমন একটি উপহার, যা গ্রহীতার জীবন রক্ষা করে, কিন্তু দাতার কোনো ক্ষতি না করে। প্রথমবারের মতো সফল রক্ত পরিসঞ্চালনের পরীক্ষা চালান তরুণ চিকিৎসক ডা. রিচার্ড লোয়ার। তবে মানুষের নয়, কুকুরের। ১৬৬৫ সালে একটি কুকুরের ধমনী থেকে আরেকটি কুকুরের শিরায় সফলভাবে তিনি রক্ত পরিসঞ্চালন করেন।
১৬৬৭ সালে ফরাসী চিকিৎসক জ্যঁ ব্যাপ্টিস্ট ডেনিক ভেড়ার দেহ থেকে নয় আউন্স পরিমাণ রক্ত নিয়ে প্রবেশ করান দীর্ঘদিন ধরে জ¦রে ভুগছে এমন এক কিশোরের দেহে। একই পরীক্ষা আরো কয়েকজনের ওপর চালিয়ে সফল হলেও বাছুরের রক্ত ঢোকাতে গিয়ে মারা যান এ পরীক্ষার সর্বশেষ শিকার এন্টটি মৌরী।
সফলভাবে মানবদেহ থেকে মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের পথটি দেখিয়েছিলেন ব্রিটিশ ধাত্রীবিদ্যা বিশারদ ডা. জেমস ব্লান্ডেল। ১৮১৮ সালে, ডা. ব্লান্ডেল প্রথমবারের মতো সফলভাবে এক নারীর প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ চিকিৎসার জন্য তার স্বামীর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে তার দেহে সঞ্চালন করেন। সেই থেকে শুরু। বিজ্ঞান এগিয়েছে। রক্তবিজ্ঞানও যথাযথভাবে এগিয়েছে বরং আরও এক ডিগ্রি বেশি এগিয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান নির্ভর করে তার নিরাপদ রক্তের মজুতের ওপর। বিশ্বে স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুসারে, একটি দেশের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ৩ শতাংশ যদি নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদান করে, তবে সেই দেশের রক্তের চাহিদা মিটে যায়। বাংলাদেশে সরকারিভাবে ১৯৯৬ সারে গঠিত হয় ‘ব্লাড ট্রান্সফিউশন কমিটি’ যাদের কাছ ছিল রক্তদাতা নির্বাচনের মাপকাঠি নিরূপণ, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন এবং রক্তের স্ক্রিনিং ও এ সম্পর্কিত প্রযুক্তি ব্যবহার কীভাবে করা যাবে তার প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয়া।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন সার্জারি, সড়ক দুর্ঘটনা, জটিল প্রসকালীন পরিস্থিতি এবং থ্যালাসেমিয়াসহ অন্যান্য রক্তজনিত রোগের চিকিৎসার জন্যে প্রায় ৮-১০ লক্ষ ইউনিট (ব্যাগ) রক্তের প্রয়োজন হয়। বেঁচে থাকার জন্যে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিত রক্ত লাগে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন কর্মসূচির তথ্য এবং বিভিন্ন বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট সংগৃহীত রক্তের মাত্র ৩০-৩৫% আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে।
আমাদের দেশের তরুণদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। তাদের মধ্যে ২ শতাংশ যদি বছরে মাত্র একবারও রক্ত দেন, তাহলেই মিটবে রক্তের চাহিদা, রক্তের অভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে না কোনো মুমূর্ষ রোগীকে। আর এই কাজে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের রক্তের গ্রুপ জানা। রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করার জন্য সাধারণত একটি ল্যাব পরীক্ষা করা হয়, যেখানে আঙুলের ডগা বা শিরা থেকে রক্তের নমুনা নেওয়া হয়। এই পরীক্ষায় লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে থাকা নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন এবং প্লাজমার অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে রক্তের ধরণ নির্ধারণ করা হয়। এই পরীক্ষাটি একটি সহজ পদ্ধতি এবং তার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির অন্যান্য রক্তের ধরণ জানা যায়।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ (ত্রিশ) লক্ষ নতুন মুখ মোট জনসংখ্যার সাথে সংযোগ ঘটে। ৩০ লক্ষ অনাগত অতিথিকে প্রাইমারী স্কুলেই ৫-১০ বয়সের মধ্যে রক্ত গ্রুপ নির্ণয় করে দিলে বিশ্বের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হবে। প্রতিটি নাগরিক তার প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ রক্ত গ্রহণ প্রদান করতে পারে। দাম্পত্য জীবনে ও সন্তান জন্ম দানে রক্তের গ্রুপের জটিলতা দূর হবে। এদেশের কোনো লোকেরই রক্তের অভাবে মৃত্যু ঘটবে না।
এই মহতি কাজের জন্য জাতীয়ভাবে প্রতিবছর একদিন দেশব্যাপি রক্ত গ্রুপ নির্ণয় ক্যাম্পিং প্রয়োজন। ৭ই ডিসেম্বর ২০২৫ রোজ রবিবার জাতীয় রক্ত গ্রুপ নির্ণয় দিবস । স্বাধীন কেন্দ্রীয় পরিষদ ১ম বারের মত জানা থাকলে রক্তের গ্রুপ জরুরি দরকারে লাগবে খুব স্লোগান নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় রক্ত গ্রুপ নির্ণয় দিবস ঘোষণা করেছে। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে আগ্রহী তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তগ্রুপ নির্ণয়ে উৎসাহিত করাই এই দিবসের মূল লক্ষ্য।
[লেখকদ্বয় যথাক্রমে জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস উদযাপন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ও আহ্বায়ক]