alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

গাজী তারেক আজিজ

: সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোটের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক বলয়, অন্যদিকে ইসলামী দলগুলোর জোটমুখী সমাবেশ।

পক্ষে-বিপক্ষের মত যা-ই থাকুক এত প্রাণ বলিদান করেও যদি বৈষম্যকে বৈষম্য দিয়েই পোক্ত করা লাগে তবে আন্দোলন বা আত্মবলিদান কেন?

এই দুই বিপরীতধারার মধ্যে দ্বন্দ্ব, দ্বিধা ও দ্বৈত অবস্থান ভোটের রাজনীতিকে জটিল করে তুলেছে। তবে সকল ইসলামীপন্থী রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে নয়। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান পরবর্তী কিছু দলের রাজনৈতিক দর্শন কতটা বাংলাদেশপন্থী তা নিয়েও আলোচনা সমালোচনা ছাপিয়ে বিতর্কের তুঙ্গে অবস্থান করায় স্পষ্ট হতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা বাংলাদেশ আর জনগণ নিয়ে চিন্তা করে।

তবে অতিরিক্ত নাটকীয়তা এসেছে জামায়াতে ইসলামী থেকে। তারা এবার মনোনয়ন দিয়েছে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রার্থী, কৃষ্ণ নন্দীকে। শুধু প্রার্থীর নাম নয়, এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনেরও প্রতিফলন। প্রশ্ন থেকে যায়, জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, বাংলাদেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে? তার ওপর সনাতন ধর্মালম্বী জামায়াত প্রার্থী কৃষ্ণ নন্দীর মুখে যখন শোভা পায় সম্পূর্ণ নতুন এবং ভিন্নধর্মী এক স্লোগান ‘হরে কৃষ্ণ হরি বোল, দাঁড়িপাল্লা টেনে তোল’তখন এই সময়ে তুমুল আলোচনায় থাকা দলটি কি বৈচিত্র?্য আনতেই ভিন্নধর্মীকে প্রার্থী করেছে, নাকি সনাতনী ভোটারই তাদের টার্গেট? আর এই কৃষ্ণ নন্দীকে জামায়াতের ঠিক কোন দর্শনটি আকৃষ্ট করেছে তা জানা যায়নি। নচেৎ কথায় কথায় ভিন্নধর্মীদের টার্গেট করার পরও কেন বা কিভাবে সনাতনী প্রার্থী কৃষ্ণ নন্দী এতটা উন্মুখ হলেন ইসলামী বলের জোটে খুব সম্ভব একা একমাত্র প্রার্থী হতে। নাকি তিনিও আলোচনার খোরাক হতে চাইছেন? এটা কী তার জন্য একটা সুযোগ! তাহলে জামায়াত যে এতদিন প্রচার করে আসছিল ইসলামের হেফাজতকারী দল তারা- সেটার কি ব্যত্যয় ঘটলো না! এ বিষয়ে জোটসঙ্গী অপরাপর দলগুলোর প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট নয়। তবে ইসলামী বক্তারা জামায়াত নামক দলটির সমালোচনা করছেন। যা সোস্যাল মিডিয়ার বরাতে সকলের জানা। কৃষ্ণ নন্দীর আসনটি কি জামায়াতের ট্রাম্প কার্ড? সগোত্রীয় ভোটার টানতে কতটা সিদ্ধহস্ত হবেন? সে আসনে জামায়াত জোটের বাকি দলগুলোর ভোট পেতে তার প্রচার কৌশল কী হবে?

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বর্তমানে অনিশ্চিত। দলটির নিবন্ধন স্থগিত এবং প্রতীক বাতিল হওয়ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণে সংশয় দেখা দিয়েছে। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা দ্বিধাগ্রস্ত। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে। জাতীয় পার্টিকে দোষারোপ করা হচ্ছে এবং নির্বাচনে অংশ নিতে প্রতিবন্ধকতার চেষ্টা চলছে। ক্ষমতার বাইরে থাকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা জাতীয় পার্টিকে অনেকটুকু ঋদ্ধ করেছে, কিন্তু রাজনীতির বাস্তবতা তাদের সামনে আবারও জটিলতা তৈরি করছে। যা ক্ষণস্থায়ী হলেও দুর্বোধ্য নয়। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির ওপর ভর করে আওয়ামী লীগের ফিরে আসা নিয়ে শংকার কথা জানিয়েছে বিভিন্ন দল। যদিও বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের সাথে আওয়ামী লীগ দলটির জড়িত থাকার কারণেও কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা বা বিচারিক প্রক্রিয়ায় দলটিকে নিষিদ্ধ করা নিয়েও সংশয় জানিয়ে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত করা বলেই মত দিয়েছেন অনেক বিশ্লেষক। এবার কি সব তুচ্ছ করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে দলটি? এক্ষেত্রে জামায়াত যদি স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় কেন আওয়ামী লীগ পারবে না? এই প্রশ্নও অনেকের রয়েছে।

আরপিও সংশোধনের প্রভাব জোট রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশোধনের ফলে জোট থাকলেও ভোটে প্রতিটি দলকে লড়তে হবে নিজস্ব প্রতীক নিয়ে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছোট-বড় দলগুলো কতটা প্রস্তুত, তা অনিশ্চিত। নামসর্বস্ব দল এবং নেতৃত্বকেন্দ্রিক দলের উদ্বেগ তাদের চেহারায় স্পষ্ট। প্রতীক সংকট, সাংগঠনিক দুর্বলতা, মাঠপর্যায়ের লোকবল কম থাকা এবং দলীয় মতাদর্শের অনুপস্থিতি মিলিয়ে তাদের সামনে বাস্তবতা কঠিন। আর এক্ষেত্রে তাদের জন্য মোক্ষম সুযোগ হয়ে আসতে পারে প্রথম বারের মতো ‘পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ’। পরাজিত হওয়ার শংকা থাকলে জোটের কাছে তারা দাবি জানাতে পারে নিম্নকক্ষ নয় উচ্চ-কক্ষেই তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার। কারণ উচ্চকক্ষে কিছু হিসেবনিকেশ করে অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের আসন নিশ্চিতকল্পে বহুবিধ কোটা ব্যবস্থা করার প্রস্তাব সংস্কার কমিশন পেশ করেছে।

এদিকে, অনেক বিশ্লেষক বলছেন, নির্বাচনের আয়োজন নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। সভা-সমাবেশে উত্তেজনা, গুজব, রাজনৈতিক দ্বৈরথ এবং অস্থির পরিবেশ মানুষকে ভাবাচ্ছে। দৃশ্যমান উত্তাপ থেকে অদৃশ্য উত্তাপ যে কোনো সময় অস্বাভাবিক দিকে মোড় নিতে পারে। গণতন্ত্রের পথচলায় এমন সংকট আগেও এসেছে। এবার পরিস্থিতি আরও বিব্রতকর। আর নির্বাচন কমিশন বিভাগ অনুযায়ী আলাদা তারিখে ভোট আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছেন।

এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কি না, ভোটার হবেন কি না, প্রার্থীতা নেবেন কি না, এসব প্রশ্ন সাধারণ মানুষের আলোচনায় ঘুরছে। দলটি দীর্ঘদিন নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। একেক সময় একেক অবস্থান নেয়া জামায়াতও মাঠ গরমের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের বক্তব্যে মনোবাঞ্ছার প্রকাশ থাকলেও বাস্তবতা বলছে, পরিস্থিতি পুরোপুরি তাদের পক্ষে নয়। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা মনে করছেন, এটি তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো সময়। তারা বিশ্বাস করছেন এবার ক্ষমতার স্বাদ পাওয়াটা দূরের বাস্তবতা নয়। কিন্তু এ বিশ্বাসের বিপরীতে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ভোট বা জোটে তাদের আস্থা কম। বরং তারা ভরসা করছে প্রশাসনিক স্তরে নিজেদের বলয় তৈরির ওপর। আরও আছে গোপন বলয়, যাদের পরিচয় এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ থেকে বের হওয়ার সাহস দেখালেও এখনো প্রকাশ্যে আসেনি ভিন্ন দলে থাকা জামায়াতের অনুসারীদের। আর বিএনপি থেকে যদি একে একে ঘাপটি মেরে থাকা নেতা-কর্মীরা বের হয়ে প্রকাশ্যে আসা শুরু করে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। যদি তা-ই না হবে দলটির এত এত আত্মবিশ্বাসী হওয়ার পেছনের কারণ কি থাকতে পারে অনুমান করা যায় কি?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ও বিএনপি দীর্ঘ সময় আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ক্ষমতা প্রয়োগের অভিজ্ঞতা বহন করে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে চরম বৈরিতার রাজনীতি তাদের স্বাভাবিক ধারা। আকস্মিকভাবে দীর্ঘদিনের সঙ্গী দলগুলো থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে তারা এখন ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পথে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপরীতে অবস্থান নেয়া দলের সঙ্গে ঐক্য গঠন বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্রে প্রশ্ন তৈরি করছে। তাদের অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিবর্তন থেকে ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এতে করে ঠিক আস্থায় নিতে পারে না সাচ্চা ইসলামী দল দাবি করা জামায়াতে ইসলামীকে।

অন্যদিকে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা শুধু ভোটের দিনকে ঘিরে নয়, পুরো রাজনীতির গতিপথকেও ঘিরে। যদি সত্যিই নির্বাচনকালীন সহিংসতার আশঙ্কা বাস্তব হয়, তাহলে বিএনপি এবং তার মিত্র দলগুলোর ভূমিকা কি হবে, সেটি সাধারণ মানুষের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। আরও চিন্তার বিষয় হলো, যদি পরিস্থিতি ঠান্ডা রাখতে অঘোষিত সমঝোতা হয়, তার লাভবান কারা হবে তা নিয়েও শঙ্কা আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির সামনে চ্যালেঞ্জ হলো নিজের বলয় সুসংগঠিত রাখা এবং ছোট দলগুলোর দাবিকে সামাল দেয়া। এ দলগুলো কি সত্যিই জোট করে ক্ষমতার ভাগ পাবে নাকি শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি শিকেয় উঠবে?

যদি নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বড় বিঘ্ন ঘটে, মাঠের রাজনীতি ও কথার রাজনীতি নতুন সমীকরণে গড়ে উঠতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, প্রতিকূল সময় দুই বিরোধী ধারাকে কাছাকাছি আনতে পারে, যদিও বাস্তবে চিরবৈরিতা সহজে লোপ পায় না। তাই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে অস্বাভাবিকও নয়। হাজারো প্রশ্ন এখন ঘুরছে মানুষের মাথায়। রাজনীতির জটিল সমীকরণ, জোট ও ভোটের কৌশল, নেতাদের ভিন্ন অবস্থান সব মিলিয়ে নির্বাচনের চিত্র অস্পষ্ট। তবে মানুষের অভিন্ন প্রত্যাশা হলো নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর হোক। মানুষ চায় স্থিরতা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা। সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও নির্বাচন ঘিরে আশংকার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। আর প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন এবারের নির্বাচন হবে স্মরণকালের সেরা। যদি তা-ই হয় তবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে কিভাবে এবং কতটা সেরা হবে, তা নিয়েও আশান্বিত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ ৩০-৪০ শতাংশ জনসমর্থন থাকা দলের কর্মী বা জনতাকে ভোট থেকে দূরে রাখলে ঠিক কতটা গ্রহণযোগ্য আর অংশগ্রহণমূলক হবে? তা-ও স্পষ্ট নয়। তেমন নির্বাচন বহিঃ বিশ্বে কতটা সমাদৃত হবে? নাকি বাংলাদেশ পুরনো পথেই খাবি খাবে!

জোট রাজনীতি এবং ভোটের জটিলতায় বিএনপি ও তার মিত্র দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের অবস্থান এবং ছোট দলগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থ সব মিলিয়ে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখেছে। তবু আশা করা যায়, গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আকাক্সক্ষা নির্বাচনকে উৎসবমুখর এবং সুষ্ঠু করতে বাধ্য করবে। আপামর গণতন্ত্রকামী মানুষ একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। পক্ষে-বিপক্ষের মত যা-ই থাকুক এত প্রাণ বলিদান করেও যদি বৈষম্যকে বৈষম্য দিয়েই পোক্ত করা লাগে তবে আন্দোলন বা আত্মবলিদান কেন?

এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন(ইসি)। নতুন তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। ইসির তথ্য অনুযায়ী, মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন, নারী ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের(হিজড়া) ভোটার ১ হাজার ২৩৪ জন।

নির্বাচনের ফলাফল রাজনৈতিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের সূচনা হবে। জোট রাজনীতি প্রমাণ করবে দল কতটা শক্তিশালী ও কতটা প্রস্তুত। ছোট দল ও নেতৃত্বকেন্দ্রিক দলের ভেতরের সংঘাতও নির্বাচনের ধারা প্রভাবিত করতে পারে। ক্ষমতা অর্জনের জন্য রাজনৈতিক সহমর্মিতা, কৌশল ও সমঝোতা অনিবার্য। না হলে আমাদের উল্টো দৌড়ের প্রতিযোগিতায় শামিল হতে হবে। যেখানে সংঘাত অনিবার্য, অর্জন বৃথা!

বাংলাদেশে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা ভাগের লড়াই নয়, এটি গণতন্ত্রের পরীক্ষা। মানুষ প্রত্যাশা রাখে ভোটের মাধ্যমে তাদের মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত হোক। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখাচ্ছে, দলগুলো কৌশলগত জোট ও নিজস্ব শক্তির সমন্বয়ে মাঠে নামছে। যা হয়তো ইতিবাচক পরিবর্তনে সক্ষম। কিন্তু আদতে পরবর্তী কার্যকলাপই বলে দেবে কতটা দেশের আর কতটা দশের হয়ে উঠতে পেরেছে। সে অবধি দলগুলোকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো খুব কমই বিশ্বাস বা আস্থার প্রতিদান দিতে সক্ষম হয়েছে।

সবিশেষ, নির্বাচনকালীন সহিংসতা, রাজনৈতিক উত্তাপ এবং প্রশাসনিক চাপ এই সমীকরণকে জটিল করেছে। তবে দেশের জনগণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়। তারা চাই নির্বাচন হোক উৎসবের মতো, যেখানে ভোটার তাদের ভোটের অধিকার ব্যবহার করতে পারে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ় হয়। জোটের ভোট হোক বা ভোটের জোট, শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের জয় চিরন্তন। ক্ষমতার ভাগ, জোটের কৌশল, দলীয় শক্তি সব মিলিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে, কিন্তু মানুষ শান্তি চায়। তারা চায় ভোট হোক উৎসব, গণতন্ত্রের শক্তি দৃঢ় হোক। এই প্রত্যাশা বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রকে সমৃদ্ধ এবং দায়িত্বশীল করে তুলবে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

গাজী তারেক আজিজ

সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোটের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক বলয়, অন্যদিকে ইসলামী দলগুলোর জোটমুখী সমাবেশ।

পক্ষে-বিপক্ষের মত যা-ই থাকুক এত প্রাণ বলিদান করেও যদি বৈষম্যকে বৈষম্য দিয়েই পোক্ত করা লাগে তবে আন্দোলন বা আত্মবলিদান কেন?

এই দুই বিপরীতধারার মধ্যে দ্বন্দ্ব, দ্বিধা ও দ্বৈত অবস্থান ভোটের রাজনীতিকে জটিল করে তুলেছে। তবে সকল ইসলামীপন্থী রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে নয়। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান পরবর্তী কিছু দলের রাজনৈতিক দর্শন কতটা বাংলাদেশপন্থী তা নিয়েও আলোচনা সমালোচনা ছাপিয়ে বিতর্কের তুঙ্গে অবস্থান করায় স্পষ্ট হতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা বাংলাদেশ আর জনগণ নিয়ে চিন্তা করে।

তবে অতিরিক্ত নাটকীয়তা এসেছে জামায়াতে ইসলামী থেকে। তারা এবার মনোনয়ন দিয়েছে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রার্থী, কৃষ্ণ নন্দীকে। শুধু প্রার্থীর নাম নয়, এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনেরও প্রতিফলন। প্রশ্ন থেকে যায়, জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, বাংলাদেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে? তার ওপর সনাতন ধর্মালম্বী জামায়াত প্রার্থী কৃষ্ণ নন্দীর মুখে যখন শোভা পায় সম্পূর্ণ নতুন এবং ভিন্নধর্মী এক স্লোগান ‘হরে কৃষ্ণ হরি বোল, দাঁড়িপাল্লা টেনে তোল’তখন এই সময়ে তুমুল আলোচনায় থাকা দলটি কি বৈচিত্র?্য আনতেই ভিন্নধর্মীকে প্রার্থী করেছে, নাকি সনাতনী ভোটারই তাদের টার্গেট? আর এই কৃষ্ণ নন্দীকে জামায়াতের ঠিক কোন দর্শনটি আকৃষ্ট করেছে তা জানা যায়নি। নচেৎ কথায় কথায় ভিন্নধর্মীদের টার্গেট করার পরও কেন বা কিভাবে সনাতনী প্রার্থী কৃষ্ণ নন্দী এতটা উন্মুখ হলেন ইসলামী বলের জোটে খুব সম্ভব একা একমাত্র প্রার্থী হতে। নাকি তিনিও আলোচনার খোরাক হতে চাইছেন? এটা কী তার জন্য একটা সুযোগ! তাহলে জামায়াত যে এতদিন প্রচার করে আসছিল ইসলামের হেফাজতকারী দল তারা- সেটার কি ব্যত্যয় ঘটলো না! এ বিষয়ে জোটসঙ্গী অপরাপর দলগুলোর প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট নয়। তবে ইসলামী বক্তারা জামায়াত নামক দলটির সমালোচনা করছেন। যা সোস্যাল মিডিয়ার বরাতে সকলের জানা। কৃষ্ণ নন্দীর আসনটি কি জামায়াতের ট্রাম্প কার্ড? সগোত্রীয় ভোটার টানতে কতটা সিদ্ধহস্ত হবেন? সে আসনে জামায়াত জোটের বাকি দলগুলোর ভোট পেতে তার প্রচার কৌশল কী হবে?

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বর্তমানে অনিশ্চিত। দলটির নিবন্ধন স্থগিত এবং প্রতীক বাতিল হওয়ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণে সংশয় দেখা দিয়েছে। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা দ্বিধাগ্রস্ত। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে। জাতীয় পার্টিকে দোষারোপ করা হচ্ছে এবং নির্বাচনে অংশ নিতে প্রতিবন্ধকতার চেষ্টা চলছে। ক্ষমতার বাইরে থাকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা জাতীয় পার্টিকে অনেকটুকু ঋদ্ধ করেছে, কিন্তু রাজনীতির বাস্তবতা তাদের সামনে আবারও জটিলতা তৈরি করছে। যা ক্ষণস্থায়ী হলেও দুর্বোধ্য নয়। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির ওপর ভর করে আওয়ামী লীগের ফিরে আসা নিয়ে শংকার কথা জানিয়েছে বিভিন্ন দল। যদিও বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের সাথে আওয়ামী লীগ দলটির জড়িত থাকার কারণেও কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা বা বিচারিক প্রক্রিয়ায় দলটিকে নিষিদ্ধ করা নিয়েও সংশয় জানিয়ে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত করা বলেই মত দিয়েছেন অনেক বিশ্লেষক। এবার কি সব তুচ্ছ করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে দলটি? এক্ষেত্রে জামায়াত যদি স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় কেন আওয়ামী লীগ পারবে না? এই প্রশ্নও অনেকের রয়েছে।

আরপিও সংশোধনের প্রভাব জোট রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশোধনের ফলে জোট থাকলেও ভোটে প্রতিটি দলকে লড়তে হবে নিজস্ব প্রতীক নিয়ে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছোট-বড় দলগুলো কতটা প্রস্তুত, তা অনিশ্চিত। নামসর্বস্ব দল এবং নেতৃত্বকেন্দ্রিক দলের উদ্বেগ তাদের চেহারায় স্পষ্ট। প্রতীক সংকট, সাংগঠনিক দুর্বলতা, মাঠপর্যায়ের লোকবল কম থাকা এবং দলীয় মতাদর্শের অনুপস্থিতি মিলিয়ে তাদের সামনে বাস্তবতা কঠিন। আর এক্ষেত্রে তাদের জন্য মোক্ষম সুযোগ হয়ে আসতে পারে প্রথম বারের মতো ‘পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ’। পরাজিত হওয়ার শংকা থাকলে জোটের কাছে তারা দাবি জানাতে পারে নিম্নকক্ষ নয় উচ্চ-কক্ষেই তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার। কারণ উচ্চকক্ষে কিছু হিসেবনিকেশ করে অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের আসন নিশ্চিতকল্পে বহুবিধ কোটা ব্যবস্থা করার প্রস্তাব সংস্কার কমিশন পেশ করেছে।

এদিকে, অনেক বিশ্লেষক বলছেন, নির্বাচনের আয়োজন নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। সভা-সমাবেশে উত্তেজনা, গুজব, রাজনৈতিক দ্বৈরথ এবং অস্থির পরিবেশ মানুষকে ভাবাচ্ছে। দৃশ্যমান উত্তাপ থেকে অদৃশ্য উত্তাপ যে কোনো সময় অস্বাভাবিক দিকে মোড় নিতে পারে। গণতন্ত্রের পথচলায় এমন সংকট আগেও এসেছে। এবার পরিস্থিতি আরও বিব্রতকর। আর নির্বাচন কমিশন বিভাগ অনুযায়ী আলাদা তারিখে ভোট আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছেন।

এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কি না, ভোটার হবেন কি না, প্রার্থীতা নেবেন কি না, এসব প্রশ্ন সাধারণ মানুষের আলোচনায় ঘুরছে। দলটি দীর্ঘদিন নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। একেক সময় একেক অবস্থান নেয়া জামায়াতও মাঠ গরমের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের বক্তব্যে মনোবাঞ্ছার প্রকাশ থাকলেও বাস্তবতা বলছে, পরিস্থিতি পুরোপুরি তাদের পক্ষে নয়। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা মনে করছেন, এটি তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো সময়। তারা বিশ্বাস করছেন এবার ক্ষমতার স্বাদ পাওয়াটা দূরের বাস্তবতা নয়। কিন্তু এ বিশ্বাসের বিপরীতে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ভোট বা জোটে তাদের আস্থা কম। বরং তারা ভরসা করছে প্রশাসনিক স্তরে নিজেদের বলয় তৈরির ওপর। আরও আছে গোপন বলয়, যাদের পরিচয় এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ থেকে বের হওয়ার সাহস দেখালেও এখনো প্রকাশ্যে আসেনি ভিন্ন দলে থাকা জামায়াতের অনুসারীদের। আর বিএনপি থেকে যদি একে একে ঘাপটি মেরে থাকা নেতা-কর্মীরা বের হয়ে প্রকাশ্যে আসা শুরু করে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। যদি তা-ই না হবে দলটির এত এত আত্মবিশ্বাসী হওয়ার পেছনের কারণ কি থাকতে পারে অনুমান করা যায় কি?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ও বিএনপি দীর্ঘ সময় আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ক্ষমতা প্রয়োগের অভিজ্ঞতা বহন করে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে চরম বৈরিতার রাজনীতি তাদের স্বাভাবিক ধারা। আকস্মিকভাবে দীর্ঘদিনের সঙ্গী দলগুলো থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে তারা এখন ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পথে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপরীতে অবস্থান নেয়া দলের সঙ্গে ঐক্য গঠন বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্রে প্রশ্ন তৈরি করছে। তাদের অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিবর্তন থেকে ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এতে করে ঠিক আস্থায় নিতে পারে না সাচ্চা ইসলামী দল দাবি করা জামায়াতে ইসলামীকে।

অন্যদিকে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা শুধু ভোটের দিনকে ঘিরে নয়, পুরো রাজনীতির গতিপথকেও ঘিরে। যদি সত্যিই নির্বাচনকালীন সহিংসতার আশঙ্কা বাস্তব হয়, তাহলে বিএনপি এবং তার মিত্র দলগুলোর ভূমিকা কি হবে, সেটি সাধারণ মানুষের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। আরও চিন্তার বিষয় হলো, যদি পরিস্থিতি ঠান্ডা রাখতে অঘোষিত সমঝোতা হয়, তার লাভবান কারা হবে তা নিয়েও শঙ্কা আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির সামনে চ্যালেঞ্জ হলো নিজের বলয় সুসংগঠিত রাখা এবং ছোট দলগুলোর দাবিকে সামাল দেয়া। এ দলগুলো কি সত্যিই জোট করে ক্ষমতার ভাগ পাবে নাকি শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি শিকেয় উঠবে?

যদি নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বড় বিঘ্ন ঘটে, মাঠের রাজনীতি ও কথার রাজনীতি নতুন সমীকরণে গড়ে উঠতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, প্রতিকূল সময় দুই বিরোধী ধারাকে কাছাকাছি আনতে পারে, যদিও বাস্তবে চিরবৈরিতা সহজে লোপ পায় না। তাই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে অস্বাভাবিকও নয়। হাজারো প্রশ্ন এখন ঘুরছে মানুষের মাথায়। রাজনীতির জটিল সমীকরণ, জোট ও ভোটের কৌশল, নেতাদের ভিন্ন অবস্থান সব মিলিয়ে নির্বাচনের চিত্র অস্পষ্ট। তবে মানুষের অভিন্ন প্রত্যাশা হলো নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর হোক। মানুষ চায় স্থিরতা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা। সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও নির্বাচন ঘিরে আশংকার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। আর প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন এবারের নির্বাচন হবে স্মরণকালের সেরা। যদি তা-ই হয় তবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে কিভাবে এবং কতটা সেরা হবে, তা নিয়েও আশান্বিত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ ৩০-৪০ শতাংশ জনসমর্থন থাকা দলের কর্মী বা জনতাকে ভোট থেকে দূরে রাখলে ঠিক কতটা গ্রহণযোগ্য আর অংশগ্রহণমূলক হবে? তা-ও স্পষ্ট নয়। তেমন নির্বাচন বহিঃ বিশ্বে কতটা সমাদৃত হবে? নাকি বাংলাদেশ পুরনো পথেই খাবি খাবে!

জোট রাজনীতি এবং ভোটের জটিলতায় বিএনপি ও তার মিত্র দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের অবস্থান এবং ছোট দলগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থ সব মিলিয়ে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখেছে। তবু আশা করা যায়, গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আকাক্সক্ষা নির্বাচনকে উৎসবমুখর এবং সুষ্ঠু করতে বাধ্য করবে। আপামর গণতন্ত্রকামী মানুষ একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। পক্ষে-বিপক্ষের মত যা-ই থাকুক এত প্রাণ বলিদান করেও যদি বৈষম্যকে বৈষম্য দিয়েই পোক্ত করা লাগে তবে আন্দোলন বা আত্মবলিদান কেন?

এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন(ইসি)। নতুন তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। ইসির তথ্য অনুযায়ী, মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন, নারী ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের(হিজড়া) ভোটার ১ হাজার ২৩৪ জন।

নির্বাচনের ফলাফল রাজনৈতিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের সূচনা হবে। জোট রাজনীতি প্রমাণ করবে দল কতটা শক্তিশালী ও কতটা প্রস্তুত। ছোট দল ও নেতৃত্বকেন্দ্রিক দলের ভেতরের সংঘাতও নির্বাচনের ধারা প্রভাবিত করতে পারে। ক্ষমতা অর্জনের জন্য রাজনৈতিক সহমর্মিতা, কৌশল ও সমঝোতা অনিবার্য। না হলে আমাদের উল্টো দৌড়ের প্রতিযোগিতায় শামিল হতে হবে। যেখানে সংঘাত অনিবার্য, অর্জন বৃথা!

বাংলাদেশে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা ভাগের লড়াই নয়, এটি গণতন্ত্রের পরীক্ষা। মানুষ প্রত্যাশা রাখে ভোটের মাধ্যমে তাদের মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত হোক। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখাচ্ছে, দলগুলো কৌশলগত জোট ও নিজস্ব শক্তির সমন্বয়ে মাঠে নামছে। যা হয়তো ইতিবাচক পরিবর্তনে সক্ষম। কিন্তু আদতে পরবর্তী কার্যকলাপই বলে দেবে কতটা দেশের আর কতটা দশের হয়ে উঠতে পেরেছে। সে অবধি দলগুলোকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো খুব কমই বিশ্বাস বা আস্থার প্রতিদান দিতে সক্ষম হয়েছে।

সবিশেষ, নির্বাচনকালীন সহিংসতা, রাজনৈতিক উত্তাপ এবং প্রশাসনিক চাপ এই সমীকরণকে জটিল করেছে। তবে দেশের জনগণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়। তারা চাই নির্বাচন হোক উৎসবের মতো, যেখানে ভোটার তাদের ভোটের অধিকার ব্যবহার করতে পারে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ় হয়। জোটের ভোট হোক বা ভোটের জোট, শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের জয় চিরন্তন। ক্ষমতার ভাগ, জোটের কৌশল, দলীয় শক্তি সব মিলিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে, কিন্তু মানুষ শান্তি চায়। তারা চায় ভোট হোক উৎসব, গণতন্ত্রের শক্তি দৃঢ় হোক। এই প্রত্যাশা বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রকে সমৃদ্ধ এবং দায়িত্বশীল করে তুলবে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top