alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

মতিউর রহমান

: বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলার মাটি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো গুড়। এটি নিছক একটি মিষ্টান্ন নয়, বরং এই জনপদের কৃষি-ঐতিহ্য, ঋতু-বৈচিত্র্য এবং লোক-উৎসবের এক সজীব প্রতিচ্ছবি। শীতের ভোরে খেজুরের রসে অথবা আখের মাড়াইয়ের কলে যে গুড় তৈরি হয়, তার প্রতিটি কণা ধারণ করে আছে মাঠের হিমশীতলতা, কৃষকের নিরলস শ্রম এবং বাঙালি জীবনের স্নিগ্ধ মাধুর্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই অমৃততুল্য প্রাকৃতিক গুড় আজ ভেজাল নামক এক নীরব মারণফাঁদে পর্যবসিত।

প্রশ্ন জাগে, এই ভয়াবহ ভেজাল কেন থামছে না? এর উত্তর নিহিত আছে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার গভীর দুর্বলতা ও সর্বব্যাপী দুর্নীতিতে। বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল রোধে আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলেও তার প্রয়োগ চরম দুর্বল। ভেজাল বিরোধী অভিযান প্রায়শই হয় মিডিয়া শো বা মৌসুমি কার্যকলাপ, যা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়

ভেজালের এই জঘন্য দুর্বৃত্তায়ন কেবল প্রাকৃতিক ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যকেই দূষিত করছে না; এটি বাঙালির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য এবং পরস্পরের প্রতি সামাজিক বিশ্বাসে এক সুপরিকল্পিত আঘাত হানছে। এই ভয়াবহ সংকট কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং এটি একটি পদ্ধতিগত ও কাঠামোগত অবক্ষয়ের ফল, যেখানে অনৈতিক মুনাফার চরম লোভ, শিথিল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান নৈতিক স্খলন একত্রিত হয়ে আমাদের সমগ্র খাদ্যব্যবস্থাকে বিষাক্ত করে তুলছে।

গুড় বাঙালির খাদ্য ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শীতকাল মানেই খেজুরের গুড়ের পায়েশ, পিঠা-পুলি আর নলেন গুড়ের ভাপা। শুধু স্বাদেই নয়, আয়ুর্বেদ ও লোকাচার মতে, গুড়ের রয়েছে অসামান্য পুষ্টিগুণ। এটি আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও বিভিন্ন ভিটামিনের প্রাকৃতিক উৎস, যা রক্তস্বল্পতা দূর করে, হজমে সহায়তা করে এবং শরীরে তাপ উৎপাদন করে। শিল্পোত্তর যুগে পরিশোধিত চিনির বিপদ যখন স্পষ্ট, তখন গুড় হয়ে ওঠে তার প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর বিকল্প। কিন্তু এই ঐতিহ্য ও স্বাস্থ্যগত মূল্যবোধই আজ ভেজালের করালগ্রাসে পড়ে বিপন্ন। ভেজাল কেবল একটি পণ্যকে বিকৃত করছে না, এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রথা, একটি কৃষিভিত্তিক জ্ঞান ও একটি স্থানীয় অর্থনীতির উপর সরাসরি আঘাত হানছে।

ভেজালের মূল উদ্দেশ্য হলো অতি দ্রুত ও অল্প বিনিয়োগে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। খাঁটি গুড় উৎপাদন একটি শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। খেজুরের রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে জ্বাল দেওয়া, ঘন করা ও ঠিক মতো জমাট বাধানো-প্রতিটি ধাপেই প্রয়োজন সযত্ন মনোযোগ। কিন্তু অসাধু উৎপাদক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে ‘গুড়’ তৈরি করছেন। এখানে চিনি বা চিনির সিরাপ ভিত্তিক মিশ্রণকে রাসায়নিকের সাহায্যে গুড়ের রূপ দেওয়া হয়।

সবচেয়ে ভয়াবহ যে রাসায়নিকটি ব্যবহার করা হয় তা হলো সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইট, যা স্থানীয়ভাবে ‘হাইড্রোজ’ নামে কুখ্যাত। এটি মূলত টেক্সটাইল ও কাগজ শিল্পে ব্যবহার্য একটি শক্তিশালী ব্লিচিং এজেন্ট ও প্রিজারভেটিভ। এই রাসায়নিক অত্যন্ত সস্তা এবং অল্প পরিমাণেই কোনো দ্রব্যকে সাদা বা উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। গুড়ে এর ব্যবহার করা হয় তাকে আকর্ষণীয় সোনালি-সাদা বা পাটালি রঙ দিতে। সমস্যা হলো, এই রাসায়নিক খাদ্যের সাথে মিশলে তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত। এটি পাকস্থলী ও অন্ত্রের আবরণীকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলিউর এমনকি ক্যান্সারেরও কারণ হতে পারে। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এই ঝুঁকি বহুগুণ বেশি।

‘হাইড্রোজ’-এর পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় নানা রকমের অননুমোদিত কৃত্রিম রং, যেমন টারট্রাজিন, সানসেট ইয়েলো ইত্যাদি। এসব রং লিভার ও কিডনির জন্য ক্ষতিকর এবং অনেকগুলোই কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া, গুড়ের ওজন ও ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য মেশানো হয় স্টার্চ, ময়দা, চক পাউডার, এমনকি কাঠের গুঁড়ো। চক পাউডার (ক্যালসিয়াম কার্বনেট) অদ্রবণীয় পদার্থ হিসেবে পেটে জমা হতে পারে এবং অম্লের সাথে বিক্রিয়া করে সমস্যা তৈরি করতে পারে। কাঠের গুঁড়ো বা অন্যান্য অজৈব পদার্থ সরাসরি পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি করে। এইভাবে, একটি প্রাকৃতিক পুষ্টিকর খাবার পরিণত হচ্ছে রাসায়নিক ও ক্ষতিকর নানা উপাদানের এক জটিল মিশ্রণে, যা মানবদেহে প্রবেশ করছে একধরনের ‘স্লো পয়জন’-এর মতো।

ভেজাল গুড়ের স্বাস্থ্যগত প্রভাব তাত্ক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদী-দুই রকমেরই। তাত্ক্ষণিক প্রভাব হিসেবে পেটব্যথা, বমি, মাথাঘোরা, ডায়রিয়া, অ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ হলো দীর্ঘমেয়াদে অজান্তেই শরীরে জমা হওয়া রাসায়নিকগুলোর ক্রিয়া। সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইট দীর্ঘদিন ধরে সেবনে লিভার ও কিডনি তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায়, যার ফলশ্রুতিতে অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। অননুমোদিত রং ও প্রিজারভেটিভ নিউরোটক্সিসিটি বা স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের বিকাশমান মস্তিষ্কের জন্য এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটি ক্যান্সার সেল সৃষ্টিরও কারণ হতে পারে।

একটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক দিক হলো, যারা ডায়াবেটিস বা ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য চিনির বিকল্প হিসেবে গুড়কে বেছে নেন, তারা ভেজাল গুড়ের মাধ্যমে আসলে পরিশোধিত চিনি এবং তার চেয়েও ক্ষতিকর রাসায়নিক গ্রহণ করেন। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য সচেতনতার নামে তারা একটি গভীর স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে এগিয়ে যান। এভাবে ভেজাল গুড় জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি নীরব মহামারীর রূপ নিচ্ছে, যার প্রকৃত মাত্রা অফিসিয়াল পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না, কারণ এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে এবং অন্যান্য রোগের আড়ালে প্রকাশ পায়।

ভেজাল গুড়ের প্রভাব কেবল স্বাস্থ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক বন্ধনের মূলে আঘাত হানছে। গুড় তৈরি একটি পারিবারিক ও সমবায় ভিত্তির পেশা। গ্রাম বাংলার হাজার হাজার পরিবার শীত মৌসুমে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি করে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ অর্জন করে। কিন্তু ভেজালের কারণে বাজারে খাঁটি গুড়ের দাম ন্যায্য হারে স্থির থাকতে পারে না। অসাধু ব্যক্তিরা রাসায়নিক দিয়ে তৈরি সস্তা ‘গুড়’ বাজারে ছাড়লে খাঁটি গুড় উৎপাদকরা তাদের উৎপাদন খরচও তুলতে পারেন না। ফলে তারা ক্রমাগত অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি হন। অনেক গাছি ও ক্ষুদ্র উৎপাদক এই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে একটি ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প ও কৃষিভিত্তিক পেশা বিলুপ্তির পথে।

অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়েও বড় ক্ষতি হচ্ছে সামাজিক আস্থার। গুড় শুধু একটি খাদ্য নয়; এটি উৎসব, আত্মীয়তা ও ভালোবাসার বিনিময়ের মাধ্যম। পিঠা উৎসব বা গৃহে অতিথি আপ্যায়নে গুড়ের ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু যখন ক্রমাগত ভেজালের অভিযোগ ওঠে, তখন মানুষ এই মূল্যবান সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানেও সন্দিহান হয়ে পড়েন। তারা গুড় কিনতে বা গ্রহণ করতে ভয় পান। এই আস্থার সংকট কেবল গুড়ের বাজারই সংকুচিত করছে না, এটি সামগ্রিকভাবে উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যকার বিশ্বাসের বন্ধনেও ফাটল ধরাচ্ছে। একটি সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাস ও সামাজিক রীতিতে যখন এমন মৌলিক আঘাত লাগে, তা সেই সমাজের সাংস্কৃতিক টেকসইতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

প্রশ্ন জাগে, এই ভয়াবহ ভেজাল কেন থামছে না? এর উত্তর নিহিত আছে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার গভীর দুর্বলতা ও সর্বব্যাপী দুর্নীতিতে। বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল রোধে আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলেও তার প্রয়োগ চরম দুর্বল। ভেজাল বিরোধী অভিযান প্রায়শই হয় মিডিয়া শো বা মৌসুমি কার্যকলাপ, যা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রায়ই স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে অসৎ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যান। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে ভেজালের তথ্য আগে থেকেই জানা সত্ত্বেও স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা ক্ষমতার প্রভাবে তা উপেক্ষা করা হয়। তদুপরি, ভেজাল শনাক্তকরণের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক ল্যাবরেটরি ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে। অনেক জায়গায় সরবরাহ করা নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসতেই মাসের পর মাস লেগে যায়, তার মধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্ত পণ্য বিক্রি করে দেন।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো বাজার নিয়ন্ত্রণের বিভক্তি। গুড় উৎপাদন হয় গ্রামে, সরবরাহ চলে জেলা ও বিভাগীয় শহরে, আর বাজারজাতকরণ হয় দেশজুড়ে। এই দীর্ঘ সরবরাহ শৃঙ্খলের যেকোনো পর্যায়ে ভেজাল ঘটতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে খাঁটি গুড়ের সাথে পরে ভেজাল মেশানো হয়, যা উৎস শনাক্তকরণকে আরও জটিল করে তোলে। এই বিশৃঙ্খল ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই ভেজালকারীদের জন্য একধরনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করে দিয়েছে।

এই ভয়াবহ সংকট থেকে উত্তরণের পথ সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। এজন্য প্রয়োজন বহুমুখী, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ।

প্রথমত, প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ জরুরি। ভেজালবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ভেজালকারীদের জন্য শাস্তি কেবল জরিমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং কারাদণ্ডের বিধান রাখতে হবে। গুড় উৎপাদন, সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের পুরো প্রক্রিয়ার একটি লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যেখানে প্রতিটি ধাপে গুণগত মান নিশ্চিত করা হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ মোবাইল ল্যাব স্থাপন করে দ্রুত নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, খাঁটি গুড় উৎপাদকদের সহায়তা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিপণনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। ‘খাঁটি গুড়’ সনদ বা জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) সনদের মাধ্যমে তাদের পণ্যকে স্বতন্ত্র ও মূল্যবান হিসেবে চিহ্নিত করে বাজার তৈরি করতে হবে। এতে খাঁটি গুড়ের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে এবং উৎপাদকরা উৎসাহিত হবেন।

তৃতীয়ত, জনসচেতনতা তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে ভেজাল গুড়ের ক্ষতিকর দিক এবং খাঁটি গুড় চেনার সহজ কৌশল সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। খাঁটি গুড়ের রঙ একটু ম্লান, এর গন্ধ হবে প্রাকৃতিক মিষ্টি ও ধোঁয়াটে, এটি জলে দ্রবীভূত করলে তলানিতে কাদা বা বালির মতো অমেধ্য জমবে না, এবং এটি অতিরিক্ত কঠিন বা অতিরিক্ত তরল হবে না। ভোক্তাদের উচিত বিশ্বস্ত ও প্রমাণিত উৎস থেকে গুড় কেনা।

চতুর্থত ও সর্বোপরি, নৈতিকতার পুনরুদ্ধার আবশ্যক। আমাদের বুঝতে হবে যে খাদ্য শুধু পণ্য নয়; এটি জীবন, স্বাস্থ্য ও আস্থার বাহন। নারীবাদী দর্শনের ‘যতেœর নীতির’ মতো একটি নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখানে প্রযোজ্য, যেখানে আমরা অপরের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রতি দায়বদ্ধতা বোধ করি। উৎপাদক, ব্যবসায়ী, নিয়ন্ত্রক এবং ভোক্তা-সকলকেই এই নৈতিক দায়িত্বের অংশীদার হতে হবে। মুনাফা সর্বোচ্চকরণের নীতি যখন মানবজীবনের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তখন সমাজ এইরকম মরণফাঁদই তৈরি করে।

ভেজাল গুড়ের সমস্যা কেবল একটি বাজারজাত পণ্যের গুণগত মানের সংকট নয়; এটি আমাদের সামাজিক নৈতিকতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সাংস্কৃতিক টেকসইতার জন্য এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। এটি আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করে: আমরা কী ধরনের সমাজ গড়তে চাই? একটি সমাজ যেখানে লোভ ও লাভের কাছে মানুষের জীবন ও ঐতিহ্য বলি হয়, নাকি একটি সমাজ যেখানে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও যতেœর সংস্কৃতি প্রাধান্য পায়?

গুড়কে রক্ষা করা মানে কেবল একটি মিষ্টি দ্রব্যকে রক্ষা করা নয়; এটি বাংলার গ্রামীণ জীবনবোধ, কৃষকের শ্রমের মর্যাদা, উৎসবের রসাস্বাদন এবং সর্বোপরি, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস রক্ষা করা। এই রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের একার নয়; এটি আমাদের সকলের। সচেতনতা, দৃঢ় প্রতিরোধ ও নৈতিক জাগরণের মাধ্যমেই কেবল আমরা এই মরণফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং বাঙালির এই সোনালি ঐতিহ্যকে আবারও উজ্জ্বল করে তুলতে পারি।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

মতিউর রহমান

বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলার মাটি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো গুড়। এটি নিছক একটি মিষ্টান্ন নয়, বরং এই জনপদের কৃষি-ঐতিহ্য, ঋতু-বৈচিত্র্য এবং লোক-উৎসবের এক সজীব প্রতিচ্ছবি। শীতের ভোরে খেজুরের রসে অথবা আখের মাড়াইয়ের কলে যে গুড় তৈরি হয়, তার প্রতিটি কণা ধারণ করে আছে মাঠের হিমশীতলতা, কৃষকের নিরলস শ্রম এবং বাঙালি জীবনের স্নিগ্ধ মাধুর্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই অমৃততুল্য প্রাকৃতিক গুড় আজ ভেজাল নামক এক নীরব মারণফাঁদে পর্যবসিত।

প্রশ্ন জাগে, এই ভয়াবহ ভেজাল কেন থামছে না? এর উত্তর নিহিত আছে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার গভীর দুর্বলতা ও সর্বব্যাপী দুর্নীতিতে। বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল রোধে আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলেও তার প্রয়োগ চরম দুর্বল। ভেজাল বিরোধী অভিযান প্রায়শই হয় মিডিয়া শো বা মৌসুমি কার্যকলাপ, যা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়

ভেজালের এই জঘন্য দুর্বৃত্তায়ন কেবল প্রাকৃতিক ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যকেই দূষিত করছে না; এটি বাঙালির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য এবং পরস্পরের প্রতি সামাজিক বিশ্বাসে এক সুপরিকল্পিত আঘাত হানছে। এই ভয়াবহ সংকট কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং এটি একটি পদ্ধতিগত ও কাঠামোগত অবক্ষয়ের ফল, যেখানে অনৈতিক মুনাফার চরম লোভ, শিথিল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান নৈতিক স্খলন একত্রিত হয়ে আমাদের সমগ্র খাদ্যব্যবস্থাকে বিষাক্ত করে তুলছে।

গুড় বাঙালির খাদ্য ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শীতকাল মানেই খেজুরের গুড়ের পায়েশ, পিঠা-পুলি আর নলেন গুড়ের ভাপা। শুধু স্বাদেই নয়, আয়ুর্বেদ ও লোকাচার মতে, গুড়ের রয়েছে অসামান্য পুষ্টিগুণ। এটি আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও বিভিন্ন ভিটামিনের প্রাকৃতিক উৎস, যা রক্তস্বল্পতা দূর করে, হজমে সহায়তা করে এবং শরীরে তাপ উৎপাদন করে। শিল্পোত্তর যুগে পরিশোধিত চিনির বিপদ যখন স্পষ্ট, তখন গুড় হয়ে ওঠে তার প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর বিকল্প। কিন্তু এই ঐতিহ্য ও স্বাস্থ্যগত মূল্যবোধই আজ ভেজালের করালগ্রাসে পড়ে বিপন্ন। ভেজাল কেবল একটি পণ্যকে বিকৃত করছে না, এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রথা, একটি কৃষিভিত্তিক জ্ঞান ও একটি স্থানীয় অর্থনীতির উপর সরাসরি আঘাত হানছে।

ভেজালের মূল উদ্দেশ্য হলো অতি দ্রুত ও অল্প বিনিয়োগে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। খাঁটি গুড় উৎপাদন একটি শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। খেজুরের রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে জ্বাল দেওয়া, ঘন করা ও ঠিক মতো জমাট বাধানো-প্রতিটি ধাপেই প্রয়োজন সযত্ন মনোযোগ। কিন্তু অসাধু উৎপাদক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে ‘গুড়’ তৈরি করছেন। এখানে চিনি বা চিনির সিরাপ ভিত্তিক মিশ্রণকে রাসায়নিকের সাহায্যে গুড়ের রূপ দেওয়া হয়।

সবচেয়ে ভয়াবহ যে রাসায়নিকটি ব্যবহার করা হয় তা হলো সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইট, যা স্থানীয়ভাবে ‘হাইড্রোজ’ নামে কুখ্যাত। এটি মূলত টেক্সটাইল ও কাগজ শিল্পে ব্যবহার্য একটি শক্তিশালী ব্লিচিং এজেন্ট ও প্রিজারভেটিভ। এই রাসায়নিক অত্যন্ত সস্তা এবং অল্প পরিমাণেই কোনো দ্রব্যকে সাদা বা উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। গুড়ে এর ব্যবহার করা হয় তাকে আকর্ষণীয় সোনালি-সাদা বা পাটালি রঙ দিতে। সমস্যা হলো, এই রাসায়নিক খাদ্যের সাথে মিশলে তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত। এটি পাকস্থলী ও অন্ত্রের আবরণীকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলিউর এমনকি ক্যান্সারেরও কারণ হতে পারে। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এই ঝুঁকি বহুগুণ বেশি।

‘হাইড্রোজ’-এর পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় নানা রকমের অননুমোদিত কৃত্রিম রং, যেমন টারট্রাজিন, সানসেট ইয়েলো ইত্যাদি। এসব রং লিভার ও কিডনির জন্য ক্ষতিকর এবং অনেকগুলোই কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া, গুড়ের ওজন ও ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য মেশানো হয় স্টার্চ, ময়দা, চক পাউডার, এমনকি কাঠের গুঁড়ো। চক পাউডার (ক্যালসিয়াম কার্বনেট) অদ্রবণীয় পদার্থ হিসেবে পেটে জমা হতে পারে এবং অম্লের সাথে বিক্রিয়া করে সমস্যা তৈরি করতে পারে। কাঠের গুঁড়ো বা অন্যান্য অজৈব পদার্থ সরাসরি পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি করে। এইভাবে, একটি প্রাকৃতিক পুষ্টিকর খাবার পরিণত হচ্ছে রাসায়নিক ও ক্ষতিকর নানা উপাদানের এক জটিল মিশ্রণে, যা মানবদেহে প্রবেশ করছে একধরনের ‘স্লো পয়জন’-এর মতো।

ভেজাল গুড়ের স্বাস্থ্যগত প্রভাব তাত্ক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদী-দুই রকমেরই। তাত্ক্ষণিক প্রভাব হিসেবে পেটব্যথা, বমি, মাথাঘোরা, ডায়রিয়া, অ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ হলো দীর্ঘমেয়াদে অজান্তেই শরীরে জমা হওয়া রাসায়নিকগুলোর ক্রিয়া। সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইট দীর্ঘদিন ধরে সেবনে লিভার ও কিডনি তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায়, যার ফলশ্রুতিতে অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। অননুমোদিত রং ও প্রিজারভেটিভ নিউরোটক্সিসিটি বা স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের বিকাশমান মস্তিষ্কের জন্য এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটি ক্যান্সার সেল সৃষ্টিরও কারণ হতে পারে।

একটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক দিক হলো, যারা ডায়াবেটিস বা ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য চিনির বিকল্প হিসেবে গুড়কে বেছে নেন, তারা ভেজাল গুড়ের মাধ্যমে আসলে পরিশোধিত চিনি এবং তার চেয়েও ক্ষতিকর রাসায়নিক গ্রহণ করেন। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য সচেতনতার নামে তারা একটি গভীর স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে এগিয়ে যান। এভাবে ভেজাল গুড় জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি নীরব মহামারীর রূপ নিচ্ছে, যার প্রকৃত মাত্রা অফিসিয়াল পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না, কারণ এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে এবং অন্যান্য রোগের আড়ালে প্রকাশ পায়।

ভেজাল গুড়ের প্রভাব কেবল স্বাস্থ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক বন্ধনের মূলে আঘাত হানছে। গুড় তৈরি একটি পারিবারিক ও সমবায় ভিত্তির পেশা। গ্রাম বাংলার হাজার হাজার পরিবার শীত মৌসুমে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি করে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ অর্জন করে। কিন্তু ভেজালের কারণে বাজারে খাঁটি গুড়ের দাম ন্যায্য হারে স্থির থাকতে পারে না। অসাধু ব্যক্তিরা রাসায়নিক দিয়ে তৈরি সস্তা ‘গুড়’ বাজারে ছাড়লে খাঁটি গুড় উৎপাদকরা তাদের উৎপাদন খরচও তুলতে পারেন না। ফলে তারা ক্রমাগত অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি হন। অনেক গাছি ও ক্ষুদ্র উৎপাদক এই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে একটি ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প ও কৃষিভিত্তিক পেশা বিলুপ্তির পথে।

অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়েও বড় ক্ষতি হচ্ছে সামাজিক আস্থার। গুড় শুধু একটি খাদ্য নয়; এটি উৎসব, আত্মীয়তা ও ভালোবাসার বিনিময়ের মাধ্যম। পিঠা উৎসব বা গৃহে অতিথি আপ্যায়নে গুড়ের ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু যখন ক্রমাগত ভেজালের অভিযোগ ওঠে, তখন মানুষ এই মূল্যবান সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানেও সন্দিহান হয়ে পড়েন। তারা গুড় কিনতে বা গ্রহণ করতে ভয় পান। এই আস্থার সংকট কেবল গুড়ের বাজারই সংকুচিত করছে না, এটি সামগ্রিকভাবে উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যকার বিশ্বাসের বন্ধনেও ফাটল ধরাচ্ছে। একটি সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাস ও সামাজিক রীতিতে যখন এমন মৌলিক আঘাত লাগে, তা সেই সমাজের সাংস্কৃতিক টেকসইতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

প্রশ্ন জাগে, এই ভয়াবহ ভেজাল কেন থামছে না? এর উত্তর নিহিত আছে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার গভীর দুর্বলতা ও সর্বব্যাপী দুর্নীতিতে। বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল রোধে আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলেও তার প্রয়োগ চরম দুর্বল। ভেজাল বিরোধী অভিযান প্রায়শই হয় মিডিয়া শো বা মৌসুমি কার্যকলাপ, যা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রায়ই স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে অসৎ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যান। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে ভেজালের তথ্য আগে থেকেই জানা সত্ত্বেও স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা ক্ষমতার প্রভাবে তা উপেক্ষা করা হয়। তদুপরি, ভেজাল শনাক্তকরণের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক ল্যাবরেটরি ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে। অনেক জায়গায় সরবরাহ করা নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসতেই মাসের পর মাস লেগে যায়, তার মধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্ত পণ্য বিক্রি করে দেন।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো বাজার নিয়ন্ত্রণের বিভক্তি। গুড় উৎপাদন হয় গ্রামে, সরবরাহ চলে জেলা ও বিভাগীয় শহরে, আর বাজারজাতকরণ হয় দেশজুড়ে। এই দীর্ঘ সরবরাহ শৃঙ্খলের যেকোনো পর্যায়ে ভেজাল ঘটতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে খাঁটি গুড়ের সাথে পরে ভেজাল মেশানো হয়, যা উৎস শনাক্তকরণকে আরও জটিল করে তোলে। এই বিশৃঙ্খল ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই ভেজালকারীদের জন্য একধরনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করে দিয়েছে।

এই ভয়াবহ সংকট থেকে উত্তরণের পথ সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। এজন্য প্রয়োজন বহুমুখী, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ।

প্রথমত, প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ জরুরি। ভেজালবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ভেজালকারীদের জন্য শাস্তি কেবল জরিমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং কারাদণ্ডের বিধান রাখতে হবে। গুড় উৎপাদন, সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের পুরো প্রক্রিয়ার একটি লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যেখানে প্রতিটি ধাপে গুণগত মান নিশ্চিত করা হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ মোবাইল ল্যাব স্থাপন করে দ্রুত নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, খাঁটি গুড় উৎপাদকদের সহায়তা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিপণনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। ‘খাঁটি গুড়’ সনদ বা জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) সনদের মাধ্যমে তাদের পণ্যকে স্বতন্ত্র ও মূল্যবান হিসেবে চিহ্নিত করে বাজার তৈরি করতে হবে। এতে খাঁটি গুড়ের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে এবং উৎপাদকরা উৎসাহিত হবেন।

তৃতীয়ত, জনসচেতনতা তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে ভেজাল গুড়ের ক্ষতিকর দিক এবং খাঁটি গুড় চেনার সহজ কৌশল সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। খাঁটি গুড়ের রঙ একটু ম্লান, এর গন্ধ হবে প্রাকৃতিক মিষ্টি ও ধোঁয়াটে, এটি জলে দ্রবীভূত করলে তলানিতে কাদা বা বালির মতো অমেধ্য জমবে না, এবং এটি অতিরিক্ত কঠিন বা অতিরিক্ত তরল হবে না। ভোক্তাদের উচিত বিশ্বস্ত ও প্রমাণিত উৎস থেকে গুড় কেনা।

চতুর্থত ও সর্বোপরি, নৈতিকতার পুনরুদ্ধার আবশ্যক। আমাদের বুঝতে হবে যে খাদ্য শুধু পণ্য নয়; এটি জীবন, স্বাস্থ্য ও আস্থার বাহন। নারীবাদী দর্শনের ‘যতেœর নীতির’ মতো একটি নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখানে প্রযোজ্য, যেখানে আমরা অপরের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রতি দায়বদ্ধতা বোধ করি। উৎপাদক, ব্যবসায়ী, নিয়ন্ত্রক এবং ভোক্তা-সকলকেই এই নৈতিক দায়িত্বের অংশীদার হতে হবে। মুনাফা সর্বোচ্চকরণের নীতি যখন মানবজীবনের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তখন সমাজ এইরকম মরণফাঁদই তৈরি করে।

ভেজাল গুড়ের সমস্যা কেবল একটি বাজারজাত পণ্যের গুণগত মানের সংকট নয়; এটি আমাদের সামাজিক নৈতিকতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সাংস্কৃতিক টেকসইতার জন্য এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। এটি আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করে: আমরা কী ধরনের সমাজ গড়তে চাই? একটি সমাজ যেখানে লোভ ও লাভের কাছে মানুষের জীবন ও ঐতিহ্য বলি হয়, নাকি একটি সমাজ যেখানে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও যতেœর সংস্কৃতি প্রাধান্য পায়?

গুড়কে রক্ষা করা মানে কেবল একটি মিষ্টি দ্রব্যকে রক্ষা করা নয়; এটি বাংলার গ্রামীণ জীবনবোধ, কৃষকের শ্রমের মর্যাদা, উৎসবের রসাস্বাদন এবং সর্বোপরি, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস রক্ষা করা। এই রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের একার নয়; এটি আমাদের সকলের। সচেতনতা, দৃঢ় প্রতিরোধ ও নৈতিক জাগরণের মাধ্যমেই কেবল আমরা এই মরণফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং বাঙালির এই সোনালি ঐতিহ্যকে আবারও উজ্জ্বল করে তুলতে পারি।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top