alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

হোসেন আবদুল মান্নান

: শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
image

মো. জমির উদ্দিন

মো. জমির উদ্দিন। ১৯৭১ সালে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন মাত্র। ঠিক আগের বছরই তিনি মেট্রিক পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রেরণা কোথায় থেকে পান তা কখনো বলতেন না। তবে নিজ পরিবার থেকে কোনো তাগিদ থাকার সুযোগ ছিল না। তাকে জিজ্ঞেস করলে শুধু মুচকি হাসতেন। এখন স্পষ্ট বোঝা যায়, সেটা কারও পরামর্শে ছিল না, ছিল এক আগুনঝরা সময়ের অদৃশ্য আহবান। মূলত একজন সচ্ছল কৃষকের সন্তান ছিলেন তিনি। সাদাসিধা সরলপ্রাণ, সদাহাস্যজ্বল, সুঠামদেহী এক সুদর্শন যুবক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বর্ষাকালে হঠাৎ সশস্ত্র হয়ে ফিরে এসে নিজের বাপের বাড়িকেই ক্যাম্প বানিয়ে নিয়েছিলেন। কৃষক বাবার অনুমতি ছাড়াই ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুকে নিয়ে বাড়ির বাংলাঘরে অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন গ্রামের মানুষ অস্ত্র হাতে তাকেই প্রথম মুক্তিবাহিনী হিসেবে দেখেছিল। তারা কোথাও কোনো অন্যায় অত্যাচারে অংশ নেয়নি। মনে পড়ে, বিজয়ের মাসের একেবারে শেষ দিকে সম্ভবত ১৩ ডিসেম্বর স্থানীয় রাজাকারসহ কয়েকজন পাক হানাদার বাহিনী কিশোরগঞ্জ ত্যাগ করে ঢাকার দিকে ফিরে যাওয়ার পথে তার সেই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিল। সারাদিন ধরে দামী কাঠের তৈরি ক্যাম্পঘরটা পুড়ছিলো। আমরা মাঠে থেকে আকাশে মিলিয়ে যাওয়া কালো ধোঁয়ার কুন্ডলি দেখেছিলাম। আবার বিজয় দিবসের পরে হাতে একটা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ে উল্লাস করতেও দেখেছিলাম।

২. এটা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার পরে সাহসী মানুষটা আকস্মিকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন বিচিত্র ধরনের পাগলামি করতে থাকে। গ্রামে যাকে সবাই পাগল বলে ডাকতো। মনে পড়ে, বর্ষাকালে পানিতে নেমে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতরাতো। বস্ত্রহীন হয়ে পড়তো। বেশ কয়েক বছর ধরে তার এমন অবস্থা চলেছিল। তখন তার মাকে দেখেছি, বড় সন্তানের জন্য কী ভালোবাসা আর আকুতি। সঙ্গে আর কেউ না থাকলেও মা পুত্রের পিছু পিছু ছুটে বেড়াতেন। নানাবিধ গ্রাম্য কবিরাজি চিকিৎসা ও পথ্য ব্যবহার করতে করতে এক পর্যায়ে মানুষটি আরোগ্য লাভ করেন। আবার ঘর সংসার সন্তান সন্ততি নিয়ে ভালোই চলছিল। পৈত্রিক জমাজমি ভাগ-বাটোয়ারা করে মোটামুটি জীবন যাপন করেছিল। যদ্দুর জানি, তার একাধিক স্ত্রী ও বেশ কয়েকজন সন্তান রয়েছে।

৩. প্রতিবেশী ছিলাম বলে সবই স্বচক্ষে দেখেছি। জীবন মৃত্যু, একাত্তর, ‘৭৪’র রাক্ষুসে বন্যা, বেড়ে ওঠা, তার বাবা-চাচা,ভাইবোন সবাইকে কাছাকাছি সময়ে পেয়েছি। একজন অকুতোভয়, নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা হলেও স্বাধীনতা উত্তর কালে এর কোনো সুফল তিনি পাননি বললেই চলে। সরকারি সুবিধা, আর্থিক দান-অনুদান তেমন বিশেষ কিছু সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। ২০০৫ সালের কথা। আমি সেদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। দুপুর বেলায় ধীর পায়ে হেঁটে আমার কাছে এসে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন,

‘বাজান, পল্লী বিদ্যুতের লোকজন আমার ঘরের লাইনটা কাইটা দিতে চায়, কী করবো’?

সম্ভবত কিছু বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় তখন তারা তার মতন একজন প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার আবাসিক সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছিল।

অথচ পরবর্তীতে দেশে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ভুয়া, অপ্রাপ্ত বয়সী, অন্যায়ভাবে সনদপত্র সংগ্রহকারী, দালাল শ্রেণির সুবিধাখোর মানুষরা নির্লজ্জ বেহায়ার মতো কত প্রকার সুবিধাই না ভোগ করলো!

৪. এদেশের জমির উদ্দিনরা কখনো সরকারি সুযোগের দিকে নজর দেন না। কপটতা করে সুবিধা আদায়ের কলা-কৌশল এদের জানা নেই। পাদপ্রদীপের আলোর বাইরেই এদের জীবনাবসান হয়ে যায়। তারা সবসময় অজান্তে অলক্ষেই হারিয়ে যায়। তবে সত্যিকার অর্থে পৃথিবীর দেশে দেশে এরাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ধ্রুবতারা। এরা বেঁচে থাকে মাটির ঘ্রাণে, পতাকার আলপনায়।

২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রায় ৫৫ বছর বয়সে স্ট্রোকজনিত কারণে তিনি আচমকা মৃত্যুবরণ করেন। বিজয়ের মাসে তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

[লেখক: গল্পকার]

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

হোসেন আবদুল মান্নান

image

মো. জমির উদ্দিন

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫

মো. জমির উদ্দিন। ১৯৭১ সালে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন মাত্র। ঠিক আগের বছরই তিনি মেট্রিক পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রেরণা কোথায় থেকে পান তা কখনো বলতেন না। তবে নিজ পরিবার থেকে কোনো তাগিদ থাকার সুযোগ ছিল না। তাকে জিজ্ঞেস করলে শুধু মুচকি হাসতেন। এখন স্পষ্ট বোঝা যায়, সেটা কারও পরামর্শে ছিল না, ছিল এক আগুনঝরা সময়ের অদৃশ্য আহবান। মূলত একজন সচ্ছল কৃষকের সন্তান ছিলেন তিনি। সাদাসিধা সরলপ্রাণ, সদাহাস্যজ্বল, সুঠামদেহী এক সুদর্শন যুবক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বর্ষাকালে হঠাৎ সশস্ত্র হয়ে ফিরে এসে নিজের বাপের বাড়িকেই ক্যাম্প বানিয়ে নিয়েছিলেন। কৃষক বাবার অনুমতি ছাড়াই ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুকে নিয়ে বাড়ির বাংলাঘরে অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন গ্রামের মানুষ অস্ত্র হাতে তাকেই প্রথম মুক্তিবাহিনী হিসেবে দেখেছিল। তারা কোথাও কোনো অন্যায় অত্যাচারে অংশ নেয়নি। মনে পড়ে, বিজয়ের মাসের একেবারে শেষ দিকে সম্ভবত ১৩ ডিসেম্বর স্থানীয় রাজাকারসহ কয়েকজন পাক হানাদার বাহিনী কিশোরগঞ্জ ত্যাগ করে ঢাকার দিকে ফিরে যাওয়ার পথে তার সেই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিল। সারাদিন ধরে দামী কাঠের তৈরি ক্যাম্পঘরটা পুড়ছিলো। আমরা মাঠে থেকে আকাশে মিলিয়ে যাওয়া কালো ধোঁয়ার কুন্ডলি দেখেছিলাম। আবার বিজয় দিবসের পরে হাতে একটা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ে উল্লাস করতেও দেখেছিলাম।

২. এটা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার পরে সাহসী মানুষটা আকস্মিকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন বিচিত্র ধরনের পাগলামি করতে থাকে। গ্রামে যাকে সবাই পাগল বলে ডাকতো। মনে পড়ে, বর্ষাকালে পানিতে নেমে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতরাতো। বস্ত্রহীন হয়ে পড়তো। বেশ কয়েক বছর ধরে তার এমন অবস্থা চলেছিল। তখন তার মাকে দেখেছি, বড় সন্তানের জন্য কী ভালোবাসা আর আকুতি। সঙ্গে আর কেউ না থাকলেও মা পুত্রের পিছু পিছু ছুটে বেড়াতেন। নানাবিধ গ্রাম্য কবিরাজি চিকিৎসা ও পথ্য ব্যবহার করতে করতে এক পর্যায়ে মানুষটি আরোগ্য লাভ করেন। আবার ঘর সংসার সন্তান সন্ততি নিয়ে ভালোই চলছিল। পৈত্রিক জমাজমি ভাগ-বাটোয়ারা করে মোটামুটি জীবন যাপন করেছিল। যদ্দুর জানি, তার একাধিক স্ত্রী ও বেশ কয়েকজন সন্তান রয়েছে।

৩. প্রতিবেশী ছিলাম বলে সবই স্বচক্ষে দেখেছি। জীবন মৃত্যু, একাত্তর, ‘৭৪’র রাক্ষুসে বন্যা, বেড়ে ওঠা, তার বাবা-চাচা,ভাইবোন সবাইকে কাছাকাছি সময়ে পেয়েছি। একজন অকুতোভয়, নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা হলেও স্বাধীনতা উত্তর কালে এর কোনো সুফল তিনি পাননি বললেই চলে। সরকারি সুবিধা, আর্থিক দান-অনুদান তেমন বিশেষ কিছু সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। ২০০৫ সালের কথা। আমি সেদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। দুপুর বেলায় ধীর পায়ে হেঁটে আমার কাছে এসে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন,

‘বাজান, পল্লী বিদ্যুতের লোকজন আমার ঘরের লাইনটা কাইটা দিতে চায়, কী করবো’?

সম্ভবত কিছু বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় তখন তারা তার মতন একজন প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার আবাসিক সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছিল।

অথচ পরবর্তীতে দেশে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ভুয়া, অপ্রাপ্ত বয়সী, অন্যায়ভাবে সনদপত্র সংগ্রহকারী, দালাল শ্রেণির সুবিধাখোর মানুষরা নির্লজ্জ বেহায়ার মতো কত প্রকার সুবিধাই না ভোগ করলো!

৪. এদেশের জমির উদ্দিনরা কখনো সরকারি সুযোগের দিকে নজর দেন না। কপটতা করে সুবিধা আদায়ের কলা-কৌশল এদের জানা নেই। পাদপ্রদীপের আলোর বাইরেই এদের জীবনাবসান হয়ে যায়। তারা সবসময় অজান্তে অলক্ষেই হারিয়ে যায়। তবে সত্যিকার অর্থে পৃথিবীর দেশে দেশে এরাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ধ্রুবতারা। এরা বেঁচে থাকে মাটির ঘ্রাণে, পতাকার আলপনায়।

২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রায় ৫৫ বছর বয়সে স্ট্রোকজনিত কারণে তিনি আচমকা মৃত্যুবরণ করেন। বিজয়ের মাসে তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

[লেখক: গল্পকার]

back to top