মিহির কুমার রায়
যেকোনো দেশই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকতে চায়, আর এই টিকে থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান বিদেশি বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু একটি মৌলিক শর্ত ছাড়া বৈশ্বিক পুঁজির প্রবাহ কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করে না-তা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন।
পুঁজির নিজস্ব কোনো জাতি, ধর্ম বা ভাষা নেই-সে শুধু স্থিতিশীলতা খোঁজে। তাই যে দেশে আইনের শাসন দুর্বল, সেখানে বিনিয়োগকারীর আস্থা গড়ে ওঠে না
বিনিয়োগকারীরা শুধুমাত্র প্রণোদনা, করমুক্ত সুবিধা বা বাজার সম্প্রসারণের সুযোগের দিকে তাকান না। তারা খোঁজেন নিরাপদ পরিবেশ, পূর্বাভাসযোগ্য নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া এবং সামাজিক আস্থার নিশ্চয়তা। পুঁজির নিজস্ব কোনো জাতি, ধর্ম বা ভাষা নেই-সে শুধু স্থিতিশীলতা খোঁজে। তাই যে দেশে আইনের শাসন দুর্বল, সেখানে বিনিয়োগকারীর আস্থা গড়ে ওঠে না।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এই আস্থার ঘাটতির বিষয়টি দিনে দিনে বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক অস্থিরতা, গুজবের ভিত্তিতে সহিংসতা, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া এবং ভাঙচুরসহ নানা ঘটনা বারবার এমন এক চিত্র তুলে ধরেছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করে। যে দেশে একজন নিরীহ মানুষও গুজবের কারণে গণপিটুনির শিকার হতে পারে, সে দেশে ব্যবসা, কারখানা কিংবা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ-এই প্রশ্ন বিদেশি বিনিয়োগকারীর মনের গভীরে অনিবার্যভাবেই জন্ম নেয়।
বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সামাজিক অস্থিরতার চিত্র ফুটে উঠেছে-কখনও সামান্য চুরির অভিযোগে, কখনও ধর্মীয় গুজব ছড়িয়ে-তা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
গুজবের ভিত্তিতে গণপিটুনির ঘটনা বা ভাঙচুর শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের বিপর্যয় নয়; এটি গোটা সমাজের মানসিক কাঠামোতে এক ধরনের বিশ্বাসের সংকট তৈরি করে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এসব ঘটনাকে শুধু সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখেন না; তারা এগুলোকে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক সক্ষমতার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করেন।
একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন-তা বিনিয়োগকারীর কাছে অর্থনৈতিক সূচকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা কাঠামো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।
এ বাস্তবতা বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো-যেমন ভারত, ভিয়েতনাম, চীন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া-গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। তারা বিনিয়োগকারীদের জন্য আইনশৃঙ্খলা, আদালতের দক্ষতা, পুলিশের পেশাদারিত্ব এবং দুর্নীতিবিরোধী সিস্টেমকে দ্রুত শক্তিশালী করে তুলেছে। ফলে এসব দেশ বৈশ্বিক বিনিয়োগের বড় অংশ নিজেদের দিকে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ যদি একই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়, তবে বিনিয়োগকারীরা বর্তমান সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অন্য দেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখাবে-যা চাকরি, রপ্তানি এবং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন কোনো দেশে কারখানা স্থাপন বা ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করেন, তারা প্রথমেই যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেন- সামাজিক স্থিরতা; রাজনৈতিক পূর্বাভাসযোগ্যতা; বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা; প্রশাসনের জবাবদিহি; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেশাদারিত্ব।
একজন বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো অর্থনৈতিক সূচকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিনিয়োগ কোনো শুধু অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি আস্থার বিনিয়োগ। যেখানে সরকার নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক, সেখানে বিনিয়োগকারীর আগ্রহ বাড়ে। কিন্তু যেখানে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল এবং সামাজিক অশান্তি নিয়মিত খবরের শিরোনাম হয়, সেখানে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই ক্ষতি সরাসরি টাকার অঙ্কে মাপা না গেলেও-দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি-উন্নয়ন খাতে এর প্রভাব গভীর।
যদিও গত এক দশকে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, পোশাক রপ্তানি, মেট্রোরেল, সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে-তবুও সাম্প্রতিক তথ্য বিনিয়োগের স্থবিরতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ২৫% কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি এক-চতুর্থাংশ কমে গেছে। এটি শিল্পায়ন ধীর হওয়ার ইঙ্গিত দেয়, কারণ নতুন কারখানা বা উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করতে হলে যন্ত্রপাতির আমদানি বৃদ্ধি পাওয়া উচিত।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি ৭%-এর নিচে। ব্যাংক ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহ হারাচ্ছেন। গত কয়েক মাসে ঋণপ্রবাহের নিম্নমুখী ধারা বিনিয়োগের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডলার সংকট ও অবমূল্যায়ন বড় সমস্যা। টাকার অবমূল্যায়ন এবং ডলার সংকট আমদানি নির্ভর শিল্পে খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
চার বছর ধরে কঠোর মুদ্রানীতি ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় তারল্য কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব কর্মসংস্থানেও পড়ছে।
সাম্প্রতিক প্রান্তিকে নতুন এফডিআই বা ইক্যুইটি বিনিয়োগ কমেছে। যদিও পুনঃবিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে, তবুও নতুন বিনিয়োগ না বাড়লে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
শিক্ষিত বেকারত্বের বিস্তার বিনিয়োগ স্থবিরতার সরাসরি ফল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী- দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ২০ হাজার, স্নাতক ডিগ্রিধারীদের বেকারত্ব ১৩.৫%, উচ্চমাধ্যমিক পাশ ব্যক্তিদের বেকারত্ব ৭.১৩%। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন বেকারের একজন বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী। এটি শ্রমবাজারে চাহিদা-সরবরাহের অসামঞ্জস্যকে স্পষ্ট করে। প্রতি বছর ২০-২৪ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও তাদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিকল্পনা নেই। নতুন শিল্পায়ন ধীর গতির। উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য টেকসই সহায়তা নেই। চাকরিবাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কাঠামো গড়ে ওঠেনি। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেলে বেকারত্ব আরও বাড়বে-যা সামাজিক অস্থিরতাকে আরও ঘনীভূত করবে।
বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা সহজে দেশে পাঠানোর নীতিমালা করা হয়েছে। এর ফলে বিদেশি উদ্যোক্তাদের আস্থায় ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কর-প্রণোদনা, ট্যাক্স হলিডে ও বিনিয়োগ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এসব সুবিধা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ।
বিনিয়োগকারীদের জন্য শক্তিশালী ডেটাবেজ তৈরি ও হিটম্যাপ প্রকাশ করা হয়। এটি বিনিয়োগ সম্ভাবনা চিহ্নিতকরণে সহায়ক হবে। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের (ওএসএস) ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। ৪৩টি সংস্থার ১৩৪টি সেবা এখন অনলাইনে পাওয়া যায়-যা ব্যবসা শুরু করা সহজ করেছে।
বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছে। বিভিন্ন সার্টিফিকেট, লাইসেন্স, পারমিট ও নিয়মকানুন এক প্ল্যাটফর্মে আনা হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ইনভেস্টমেন্ট পাইপলাইন চালু হয়েছে। বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতিকে ট্র?্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ব্যবস্থা। নতুন এফডিআই আনলে ১.৫% প্রণোদনা দেওয়া হয়। কমপক্ষে ১০ লাখ ডলার ইক্যুইটি বিনিয়োগ নিশ্চিত করলে এ সুবিধা পাওয়া যাবে।
এসব উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু মূল বাধা-আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা-যদি দুর্বল থাকে, তবে এসব উদ্যোগ প্রত্যাশিত সুফল দিতে পারবে না।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে- দ্রুত ও দৃশ্যমান বিচার করতে হবে। গণপিটুনি, ভাঙচুর বা অরাজকতায় জড়িতদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। পুলিশ ও প্রশাসনের জবাবদিহি বাড়াতে হবে এবং পেশাদারিত্ব উন্নত করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গুজব প্রতিরোধে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সরকারি–বেসরকারি প্রচার চালাতে হবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। বিচারব্যবস্থায় বিলম্ব কমানো এবং দুর্নীতি রোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে বিদেশি বিনিয়োগের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, দক্ষ শ্রমশক্তি, রপ্তানি সম্ভাবনা, অবকাঠামো এবং বাজার-সবকিছুই আমাদের পক্ষে। কিন্তু আইনের শাসন দুর্বল হলে, কোনো সুবিধাই বিনিয়োগকারীদের মন টানতে পারে না। অতএব, আইনের শাসনই হতে হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি।
কার্যকর পদক্ষেপ, দ্রুত বিচার, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং আস্থার পুনর্গঠনই পারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে। সরকার যদি এসব ক্ষেত্রে সক্ষম হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, শিল্পায়ন দ্রুত এগোবে, অর্থনীতি দাঁড়াবে আরও মজবুত ভিত্তির ওপর, এবং ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আরও বাস্তব হয়ে উঠবে।
[লেখক: সাবেক ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মিহির কুমার রায়
শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
যেকোনো দেশই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকতে চায়, আর এই টিকে থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান বিদেশি বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু একটি মৌলিক শর্ত ছাড়া বৈশ্বিক পুঁজির প্রবাহ কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করে না-তা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন।
পুঁজির নিজস্ব কোনো জাতি, ধর্ম বা ভাষা নেই-সে শুধু স্থিতিশীলতা খোঁজে। তাই যে দেশে আইনের শাসন দুর্বল, সেখানে বিনিয়োগকারীর আস্থা গড়ে ওঠে না
বিনিয়োগকারীরা শুধুমাত্র প্রণোদনা, করমুক্ত সুবিধা বা বাজার সম্প্রসারণের সুযোগের দিকে তাকান না। তারা খোঁজেন নিরাপদ পরিবেশ, পূর্বাভাসযোগ্য নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া এবং সামাজিক আস্থার নিশ্চয়তা। পুঁজির নিজস্ব কোনো জাতি, ধর্ম বা ভাষা নেই-সে শুধু স্থিতিশীলতা খোঁজে। তাই যে দেশে আইনের শাসন দুর্বল, সেখানে বিনিয়োগকারীর আস্থা গড়ে ওঠে না।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এই আস্থার ঘাটতির বিষয়টি দিনে দিনে বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক অস্থিরতা, গুজবের ভিত্তিতে সহিংসতা, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া এবং ভাঙচুরসহ নানা ঘটনা বারবার এমন এক চিত্র তুলে ধরেছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করে। যে দেশে একজন নিরীহ মানুষও গুজবের কারণে গণপিটুনির শিকার হতে পারে, সে দেশে ব্যবসা, কারখানা কিংবা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ-এই প্রশ্ন বিদেশি বিনিয়োগকারীর মনের গভীরে অনিবার্যভাবেই জন্ম নেয়।
বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সামাজিক অস্থিরতার চিত্র ফুটে উঠেছে-কখনও সামান্য চুরির অভিযোগে, কখনও ধর্মীয় গুজব ছড়িয়ে-তা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
গুজবের ভিত্তিতে গণপিটুনির ঘটনা বা ভাঙচুর শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের বিপর্যয় নয়; এটি গোটা সমাজের মানসিক কাঠামোতে এক ধরনের বিশ্বাসের সংকট তৈরি করে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এসব ঘটনাকে শুধু সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখেন না; তারা এগুলোকে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক সক্ষমতার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করেন।
একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন-তা বিনিয়োগকারীর কাছে অর্থনৈতিক সূচকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা কাঠামো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।
এ বাস্তবতা বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো-যেমন ভারত, ভিয়েতনাম, চীন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া-গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। তারা বিনিয়োগকারীদের জন্য আইনশৃঙ্খলা, আদালতের দক্ষতা, পুলিশের পেশাদারিত্ব এবং দুর্নীতিবিরোধী সিস্টেমকে দ্রুত শক্তিশালী করে তুলেছে। ফলে এসব দেশ বৈশ্বিক বিনিয়োগের বড় অংশ নিজেদের দিকে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ যদি একই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়, তবে বিনিয়োগকারীরা বর্তমান সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অন্য দেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখাবে-যা চাকরি, রপ্তানি এবং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন কোনো দেশে কারখানা স্থাপন বা ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করেন, তারা প্রথমেই যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেন- সামাজিক স্থিরতা; রাজনৈতিক পূর্বাভাসযোগ্যতা; বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা; প্রশাসনের জবাবদিহি; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেশাদারিত্ব।
একজন বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো অর্থনৈতিক সূচকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিনিয়োগ কোনো শুধু অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি আস্থার বিনিয়োগ। যেখানে সরকার নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক, সেখানে বিনিয়োগকারীর আগ্রহ বাড়ে। কিন্তু যেখানে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল এবং সামাজিক অশান্তি নিয়মিত খবরের শিরোনাম হয়, সেখানে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই ক্ষতি সরাসরি টাকার অঙ্কে মাপা না গেলেও-দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি-উন্নয়ন খাতে এর প্রভাব গভীর।
যদিও গত এক দশকে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, পোশাক রপ্তানি, মেট্রোরেল, সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে-তবুও সাম্প্রতিক তথ্য বিনিয়োগের স্থবিরতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ২৫% কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি এক-চতুর্থাংশ কমে গেছে। এটি শিল্পায়ন ধীর হওয়ার ইঙ্গিত দেয়, কারণ নতুন কারখানা বা উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করতে হলে যন্ত্রপাতির আমদানি বৃদ্ধি পাওয়া উচিত।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি ৭%-এর নিচে। ব্যাংক ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহ হারাচ্ছেন। গত কয়েক মাসে ঋণপ্রবাহের নিম্নমুখী ধারা বিনিয়োগের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডলার সংকট ও অবমূল্যায়ন বড় সমস্যা। টাকার অবমূল্যায়ন এবং ডলার সংকট আমদানি নির্ভর শিল্পে খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
চার বছর ধরে কঠোর মুদ্রানীতি ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় তারল্য কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব কর্মসংস্থানেও পড়ছে।
সাম্প্রতিক প্রান্তিকে নতুন এফডিআই বা ইক্যুইটি বিনিয়োগ কমেছে। যদিও পুনঃবিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে, তবুও নতুন বিনিয়োগ না বাড়লে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
শিক্ষিত বেকারত্বের বিস্তার বিনিয়োগ স্থবিরতার সরাসরি ফল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী- দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ২০ হাজার, স্নাতক ডিগ্রিধারীদের বেকারত্ব ১৩.৫%, উচ্চমাধ্যমিক পাশ ব্যক্তিদের বেকারত্ব ৭.১৩%। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন বেকারের একজন বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী। এটি শ্রমবাজারে চাহিদা-সরবরাহের অসামঞ্জস্যকে স্পষ্ট করে। প্রতি বছর ২০-২৪ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও তাদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিকল্পনা নেই। নতুন শিল্পায়ন ধীর গতির। উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য টেকসই সহায়তা নেই। চাকরিবাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কাঠামো গড়ে ওঠেনি। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেলে বেকারত্ব আরও বাড়বে-যা সামাজিক অস্থিরতাকে আরও ঘনীভূত করবে।
বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা সহজে দেশে পাঠানোর নীতিমালা করা হয়েছে। এর ফলে বিদেশি উদ্যোক্তাদের আস্থায় ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কর-প্রণোদনা, ট্যাক্স হলিডে ও বিনিয়োগ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এসব সুবিধা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ।
বিনিয়োগকারীদের জন্য শক্তিশালী ডেটাবেজ তৈরি ও হিটম্যাপ প্রকাশ করা হয়। এটি বিনিয়োগ সম্ভাবনা চিহ্নিতকরণে সহায়ক হবে। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের (ওএসএস) ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। ৪৩টি সংস্থার ১৩৪টি সেবা এখন অনলাইনে পাওয়া যায়-যা ব্যবসা শুরু করা সহজ করেছে।
বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছে। বিভিন্ন সার্টিফিকেট, লাইসেন্স, পারমিট ও নিয়মকানুন এক প্ল্যাটফর্মে আনা হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ইনভেস্টমেন্ট পাইপলাইন চালু হয়েছে। বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতিকে ট্র?্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ব্যবস্থা। নতুন এফডিআই আনলে ১.৫% প্রণোদনা দেওয়া হয়। কমপক্ষে ১০ লাখ ডলার ইক্যুইটি বিনিয়োগ নিশ্চিত করলে এ সুবিধা পাওয়া যাবে।
এসব উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু মূল বাধা-আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা-যদি দুর্বল থাকে, তবে এসব উদ্যোগ প্রত্যাশিত সুফল দিতে পারবে না।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে- দ্রুত ও দৃশ্যমান বিচার করতে হবে। গণপিটুনি, ভাঙচুর বা অরাজকতায় জড়িতদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। পুলিশ ও প্রশাসনের জবাবদিহি বাড়াতে হবে এবং পেশাদারিত্ব উন্নত করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গুজব প্রতিরোধে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সরকারি–বেসরকারি প্রচার চালাতে হবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। বিচারব্যবস্থায় বিলম্ব কমানো এবং দুর্নীতি রোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে বিদেশি বিনিয়োগের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, দক্ষ শ্রমশক্তি, রপ্তানি সম্ভাবনা, অবকাঠামো এবং বাজার-সবকিছুই আমাদের পক্ষে। কিন্তু আইনের শাসন দুর্বল হলে, কোনো সুবিধাই বিনিয়োগকারীদের মন টানতে পারে না। অতএব, আইনের শাসনই হতে হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি।
কার্যকর পদক্ষেপ, দ্রুত বিচার, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং আস্থার পুনর্গঠনই পারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে। সরকার যদি এসব ক্ষেত্রে সক্ষম হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, শিল্পায়ন দ্রুত এগোবে, অর্থনীতি দাঁড়াবে আরও মজবুত ভিত্তির ওপর, এবং ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আরও বাস্তব হয়ে উঠবে।
[লেখক: সাবেক ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]