গৌতম রায়
বামপন্থীদের , মূলত সি পি আই ( এম) এর উদ্যোগে ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ শুরু হয়েছে। এই যাত্রা শুরু হয়েছে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলা থেকে। শেষ হবে কলকাতার প্রান্তে কামারহাটিতে।এই যাত্রা শুরুর আগে কোচবিহারে বাংলা তথা বাঙালি র দুই স্বর্ণ সন্তান মনীষী ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা এবং কিংবদন্তী আব্বাসউদ্দিন আহমদের স্মৃতি স্মারক বক্তৃতা সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সি পি আই (এম)-এর উদ্যোগে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বছর, আব্বাসউদ্দিনের ১২৫ তম জন্ম জয়ন্তী।
ব্রতচারী আন্দোলনের স্রষ্টা স্যার গুরুসদয় দত্ত তার একটি বিখ্যাত গানে বলেছিলেন ;’ বিশ্ব মানব হবি যদি শাশ্বত বাঙ্গালি হ’ । আন্তর্জাতিকতা বোধে স্থিত হতে গেলে শিকড়ের টান , রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়,’ ফিরে চল মাটির টানে ‘ - এটা অত্যন্ত জরুরি। অনদাশঙ্কর তার ‘বিনুর বই’য়ের সূচনা পর্বে লিখছেন ; জল না পেলে জীবন শুকিয়ে যায় ।রস না পেলে গাছ।
আমাদের কাছে যদি নিজের দেশ কে না জেনে বহিঃবিশ্বকে জানবার মানসিকতাটা সব থেকে বড় হয়ে ওঠে ,তবে আমরা না জানতে পারব নিজের দেশকে । না বুঝতে পারব নিজের দেশের মানুষকে ।বিশ্বকে বুঝতে পারা তো অনেক দূরের কথা। আন্তর্জাতিকতা বোধে স্থিত হতে গেলে, দেশের শিকড় কে ভালো করে জানতে হবে। আর সেই দেশের শিকড়কে ভালো করে জানতে গেলে সমকালের এক কবির ভাষায় বলতেই হবে ; তোমাকে ফিরতেই হবে রবীন্দ্রনাথে। তোমাকে ফিরতেই হবে কণিকার গানে।
জন্মলগ্ন থেকেই ভারতে বামপন্থী দল তাদের আদর্শগতভিত্তির অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে ভারতীয় প্রেক্ষিতকে যতো না গুরুত্ব আরোপ করেছে, তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে যেসব দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটেছে , বামপন্থী আন্দোলন অনেক বেশি সক্রিয় থেকেছে, সেই সব দেশ গুলির প্রতি। তা বলে তারা যে একেবারেই ভারতকে বা প্রাদেশিক সংস্কৃতিকে অস্বীকার করেছে— একথা বলতে পারা যায় না। অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা - যেসব অঞ্চলে একটা সময় বামপন্থী আন্দোলন খুব বিশেষভাবে পল্লবিত হয়েছিল, সেই সব এলাকাগুলিতে, সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে, সেই সেই রাজ্যগুলিতে বামপন্থীরা যথেষ্ট সক্রিয়তার পরিচয় দিয়েছেন। একই কথা বলতে হয় কেরালাতে বামপন্থীদের ভূমিকা এবং অবদান সম্পর্কে। কেরালার ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ যে ঐতিহাসিক গ্রন্থটি রচনা করে গেছেন, সেটি আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি আকর গ্রন্থ।
বাংলার ক্ষেত্রেও এককালে এই ধরনের আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ভেতর দিয়ে সংস্কৃতির শিকড় খুঁজবার কাজটি অসামান্যভাবে করেছিলেন রাধারমন মিত্রের মত বামপন্থী মতাদর্শে, বিশ্বাসী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভের মত মানুষেরা তার ‘কলকাতা দর্পণ’ কলকাতার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি আকর গ্রন্থ। রাধারমন মিত্র যখন কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে এই আকর গ্রন্থটির রচনার উদ্দেশ্যে ক্ষেত্র সমীক্ষা চালাচ্ছেন, প্রমোদ দাশগুপ্তের নির্দেশে তখন তার গবেষণা সহায়ক হয়েছিলেন তরুণ মোহাম্মদ সেলিম। হয়তো রাধারমন মিত্র এবং আবু সঈদ আইয়ুবের সহচর্য ,একাধারে শেকরের টান, সেইসঙ্গে দর্শন চিন্তার গভীরতায় ঢুকে যাওয়া- এই দুইয়ের সমন্বয় সেলিমের মধ্যে নির্মিত হয়েছে একটা বিশেষ বোধ। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি এই ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ র মধ্যে দিয়ে।
রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বোধের এই যে সম্মিলন ,’বাংলা বাঁচাও যাত্রা’র মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি- এমনটা কিন্তু বাংলার সংস্কৃতিক বোধের সম্যক প্রকাশের ধারা, রাজনৈতিক দলগুলির কর্মকাণ্ডের মধ্যে আমরা সাম্প্রতিক অতীতে খুব একটা দেখতে পাইনি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল -তাদের ছবি বা তাদের কোনও কোনও কোটেশন , এগুলো বহু ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের লোকসংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে সম্প্রীতির মূল সুরটি প্রলেতারিয়েট স্তর থেকে তুলে আনা— এমনটা কিন্তু বাংলা বাঁচাও যাত্রা বা তার আগে মোহাম্মদ সেলিমের নেতৃত্বেই সিপিআই (এম) দলের যুব সংগঠন ডি ওয়াই এফ আই, তাদের,’ ইনসাফ যাত্রা’ - এসব কর্মসূচির আগে সেভাবে আমরা দেখিনি।
এই ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’, গোটা পশ্চিমবঙ্গের যে যে অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর সার্বিক চর্চার পাশাপাশি, একেবারে ভুমিস্তরে মানুষের রুটি- রুজির সমস্যা এবং সেগুলি নিয়ে যুব বামপন্থী কর্মীদের আঞ্চলিক স্তরের মানুষদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা —এমন অভিনব জনসংযোগ এই ‘ইনসাফ যাত্রা’ বা ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ র আগে আমরা কিন্তু বাংলার বুকে ,জাতীয় আন্দোলনের সময়কাল ছাড়া আর কখনো দেখতে পাইনি। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে বামপন্থী নেতারা এই যাত্রাপথে যেভাবে আলাপচারিতা করছেন, সমাজমাধ্যমে তার যে ছবি ফুটে উঠছে, সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নানা ধরনের তাত্ত্বিক অবস্থান ,জাতীয় রাজনীতি -আন্তর্জাতিক রাজনীতির কচকচানি — এ সমস্ত কিছুর পরিবর্তে মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, তার রুটি- রুজির সমস্যা কি , সে বিষয়ে। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, তার বেঁচে থাকার লড়াইকে শক্তিশালী করবার জন্যে কি ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে হবে। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে হিন্দু- মুসলমান, বাঙালি ও বাঙালি -নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ একসঙ্গে জোট হয়ে যদি আমরা ,আমাদের জীবনকে জীবিকাকে, পারিপার্শ্বিকতাকে পরিচালিত করি — তাহলে যেকোনও ধরনের শত্রুর মোকাবিলা করতে আমরা সক্ষম হব। আমরা যদি জোট বেঁধে থাকি ,তাহলে ধর্মের দোহাই দিয়ে দ,লীয় রাজনীতির দোহাই দিয়ে শাসক পারবে না মানুষের রুটি রুজি কেড়ে নিতে। শাসক পারবে না মানুষের জীবনযাপনের যে মূল সত্য ,তাকে বিভ্রান্ত করতে।
আমরা অতীতে এমনভাবে নিবিড় গণসংযোগ ভারতে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলনের সময়কালে দেখেছি। তার পরবর্তীকালেও বামপন্থীরা জীবন জীবিকার স্বার্থে নানা ধরনের আন্দোলন করেছেন। বহু ধরনের পদযাত্রা হয়েছে। সেদিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একরকম ছিল। বহু ক্ষেত্রে বামপন্থীরা শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্যা আজকের মত আকাশ বাতাসকে কলুষিত করে তোলেনি। সেদিন সেই অবস্থায় রাজনৈতিক পর্যায়ক্রম যা ছিল, আজ যে তার থেকে পর্যায়ক্রমের অনেকখানি বদল ঘটেছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ যে যে অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছে ,সেখানে যে কেবলমাত্র জনসভা হচ্ছে বা কেবলমাত্র স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে একদম সেকালের গ্রামের চন্ডীমণ্ডপে যেরকম ভাবে আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া চেষ্টা করা হতো, তারই একটি আধুনিক পর্যায়ে রচিত হচ্ছে, তা নয়। প্রতিটি এলাকার যে আঞ্চলিক সংস্কৃতি তার অনুসন্ধান এই’ বাংলা বাঁচাও যাত্রা’র একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি এলাকার লোকসংস্কৃতির নানা ধরনের পল্লবিত ধারা, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে বাংলার বৈচিত্র?্যময়, সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির মূলসুরটি, সেটিকে অনুসন্ধান করাই কেবল নয়। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেই সুরটি যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের মধ্যে প্রবাহিত হতে পারে তার প্রচেষ্টাও কিন্তু এই ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’র অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য।
বাংলা তথা বাঙালি সংস্কৃতি মানে কেবলমাত্র আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে ইঁদুর ভক্ষণ করা বা ছাদের টবে লাউ গাছ লাগিয়ে কৃষিকে উৎসাহ দেওয়া বা পায়েস রেঁধে জন্মদিন পালন করা নয়। বাংলার সংস্কৃতির মূল সুর যুগ যুগ ধরে, আউল- বাউল- ফকিরি- মারফতি,মুর্শিদি- টুসু - ভাদু, মাদার শা ফকিরের বিয়ের মেলা, পাথরচাপড়ির মেলা, গোপীচাঁদের মেলা, দধিয়া বৈরাগীতলার মেলা, ঘুটিয়ারী শরিফের উরস, চশমাবাবার মাজার, জল্পেশের মেলা ইত্যাদির সুরের মধ্যে দিয়ে, ভাবের মধ্যে দিয়ে ,মানুষের সঙ্গে মানুষের যে নিবিড় সংযোগ - তাকে অনুসন্ধানী ই শুধু নয়।বুকের মধ্যে তাকে ধারণ করে শহুরে সংস্কৃতির যে ভিত্তি , যা লুকিয়ে আছে মাটির রসের মধ্যে, গাছের পাতার মধ্যে , তাকে নিবিড়ভাবে যেন ফিরে পাওয়ার একটা আকাক্সক্ষা উচ্চারিত হচ্ছে। বামপন্থীদের’ বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ র গোটা কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে , সেই সুরটিই উচ্চারিত হচ্ছে।
[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
গৌতম রায়
শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
বামপন্থীদের , মূলত সি পি আই ( এম) এর উদ্যোগে ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ শুরু হয়েছে। এই যাত্রা শুরু হয়েছে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলা থেকে। শেষ হবে কলকাতার প্রান্তে কামারহাটিতে।এই যাত্রা শুরুর আগে কোচবিহারে বাংলা তথা বাঙালি র দুই স্বর্ণ সন্তান মনীষী ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা এবং কিংবদন্তী আব্বাসউদ্দিন আহমদের স্মৃতি স্মারক বক্তৃতা সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সি পি আই (এম)-এর উদ্যোগে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বছর, আব্বাসউদ্দিনের ১২৫ তম জন্ম জয়ন্তী।
ব্রতচারী আন্দোলনের স্রষ্টা স্যার গুরুসদয় দত্ত তার একটি বিখ্যাত গানে বলেছিলেন ;’ বিশ্ব মানব হবি যদি শাশ্বত বাঙ্গালি হ’ । আন্তর্জাতিকতা বোধে স্থিত হতে গেলে শিকড়ের টান , রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়,’ ফিরে চল মাটির টানে ‘ - এটা অত্যন্ত জরুরি। অনদাশঙ্কর তার ‘বিনুর বই’য়ের সূচনা পর্বে লিখছেন ; জল না পেলে জীবন শুকিয়ে যায় ।রস না পেলে গাছ।
আমাদের কাছে যদি নিজের দেশ কে না জেনে বহিঃবিশ্বকে জানবার মানসিকতাটা সব থেকে বড় হয়ে ওঠে ,তবে আমরা না জানতে পারব নিজের দেশকে । না বুঝতে পারব নিজের দেশের মানুষকে ।বিশ্বকে বুঝতে পারা তো অনেক দূরের কথা। আন্তর্জাতিকতা বোধে স্থিত হতে গেলে, দেশের শিকড় কে ভালো করে জানতে হবে। আর সেই দেশের শিকড়কে ভালো করে জানতে গেলে সমকালের এক কবির ভাষায় বলতেই হবে ; তোমাকে ফিরতেই হবে রবীন্দ্রনাথে। তোমাকে ফিরতেই হবে কণিকার গানে।
জন্মলগ্ন থেকেই ভারতে বামপন্থী দল তাদের আদর্শগতভিত্তির অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে ভারতীয় প্রেক্ষিতকে যতো না গুরুত্ব আরোপ করেছে, তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে যেসব দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটেছে , বামপন্থী আন্দোলন অনেক বেশি সক্রিয় থেকেছে, সেই সব দেশ গুলির প্রতি। তা বলে তারা যে একেবারেই ভারতকে বা প্রাদেশিক সংস্কৃতিকে অস্বীকার করেছে— একথা বলতে পারা যায় না। অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা - যেসব অঞ্চলে একটা সময় বামপন্থী আন্দোলন খুব বিশেষভাবে পল্লবিত হয়েছিল, সেই সব এলাকাগুলিতে, সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে, সেই সেই রাজ্যগুলিতে বামপন্থীরা যথেষ্ট সক্রিয়তার পরিচয় দিয়েছেন। একই কথা বলতে হয় কেরালাতে বামপন্থীদের ভূমিকা এবং অবদান সম্পর্কে। কেরালার ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ যে ঐতিহাসিক গ্রন্থটি রচনা করে গেছেন, সেটি আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি আকর গ্রন্থ।
বাংলার ক্ষেত্রেও এককালে এই ধরনের আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ভেতর দিয়ে সংস্কৃতির শিকড় খুঁজবার কাজটি অসামান্যভাবে করেছিলেন রাধারমন মিত্রের মত বামপন্থী মতাদর্শে, বিশ্বাসী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভের মত মানুষেরা তার ‘কলকাতা দর্পণ’ কলকাতার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি আকর গ্রন্থ। রাধারমন মিত্র যখন কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে এই আকর গ্রন্থটির রচনার উদ্দেশ্যে ক্ষেত্র সমীক্ষা চালাচ্ছেন, প্রমোদ দাশগুপ্তের নির্দেশে তখন তার গবেষণা সহায়ক হয়েছিলেন তরুণ মোহাম্মদ সেলিম। হয়তো রাধারমন মিত্র এবং আবু সঈদ আইয়ুবের সহচর্য ,একাধারে শেকরের টান, সেইসঙ্গে দর্শন চিন্তার গভীরতায় ঢুকে যাওয়া- এই দুইয়ের সমন্বয় সেলিমের মধ্যে নির্মিত হয়েছে একটা বিশেষ বোধ। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি এই ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ র মধ্যে দিয়ে।
রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বোধের এই যে সম্মিলন ,’বাংলা বাঁচাও যাত্রা’র মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি- এমনটা কিন্তু বাংলার সংস্কৃতিক বোধের সম্যক প্রকাশের ধারা, রাজনৈতিক দলগুলির কর্মকাণ্ডের মধ্যে আমরা সাম্প্রতিক অতীতে খুব একটা দেখতে পাইনি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল -তাদের ছবি বা তাদের কোনও কোনও কোটেশন , এগুলো বহু ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের লোকসংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে সম্প্রীতির মূল সুরটি প্রলেতারিয়েট স্তর থেকে তুলে আনা— এমনটা কিন্তু বাংলা বাঁচাও যাত্রা বা তার আগে মোহাম্মদ সেলিমের নেতৃত্বেই সিপিআই (এম) দলের যুব সংগঠন ডি ওয়াই এফ আই, তাদের,’ ইনসাফ যাত্রা’ - এসব কর্মসূচির আগে সেভাবে আমরা দেখিনি।
এই ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’, গোটা পশ্চিমবঙ্গের যে যে অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর সার্বিক চর্চার পাশাপাশি, একেবারে ভুমিস্তরে মানুষের রুটি- রুজির সমস্যা এবং সেগুলি নিয়ে যুব বামপন্থী কর্মীদের আঞ্চলিক স্তরের মানুষদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা —এমন অভিনব জনসংযোগ এই ‘ইনসাফ যাত্রা’ বা ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ র আগে আমরা কিন্তু বাংলার বুকে ,জাতীয় আন্দোলনের সময়কাল ছাড়া আর কখনো দেখতে পাইনি। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে বামপন্থী নেতারা এই যাত্রাপথে যেভাবে আলাপচারিতা করছেন, সমাজমাধ্যমে তার যে ছবি ফুটে উঠছে, সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নানা ধরনের তাত্ত্বিক অবস্থান ,জাতীয় রাজনীতি -আন্তর্জাতিক রাজনীতির কচকচানি — এ সমস্ত কিছুর পরিবর্তে মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, তার রুটি- রুজির সমস্যা কি , সে বিষয়ে। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, তার বেঁচে থাকার লড়াইকে শক্তিশালী করবার জন্যে কি ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে হবে। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে হিন্দু- মুসলমান, বাঙালি ও বাঙালি -নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ একসঙ্গে জোট হয়ে যদি আমরা ,আমাদের জীবনকে জীবিকাকে, পারিপার্শ্বিকতাকে পরিচালিত করি — তাহলে যেকোনও ধরনের শত্রুর মোকাবিলা করতে আমরা সক্ষম হব। আমরা যদি জোট বেঁধে থাকি ,তাহলে ধর্মের দোহাই দিয়ে দ,লীয় রাজনীতির দোহাই দিয়ে শাসক পারবে না মানুষের রুটি রুজি কেড়ে নিতে। শাসক পারবে না মানুষের জীবনযাপনের যে মূল সত্য ,তাকে বিভ্রান্ত করতে।
আমরা অতীতে এমনভাবে নিবিড় গণসংযোগ ভারতে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলনের সময়কালে দেখেছি। তার পরবর্তীকালেও বামপন্থীরা জীবন জীবিকার স্বার্থে নানা ধরনের আন্দোলন করেছেন। বহু ধরনের পদযাত্রা হয়েছে। সেদিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একরকম ছিল। বহু ক্ষেত্রে বামপন্থীরা শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্যা আজকের মত আকাশ বাতাসকে কলুষিত করে তোলেনি। সেদিন সেই অবস্থায় রাজনৈতিক পর্যায়ক্রম যা ছিল, আজ যে তার থেকে পর্যায়ক্রমের অনেকখানি বদল ঘটেছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ যে যে অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছে ,সেখানে যে কেবলমাত্র জনসভা হচ্ছে বা কেবলমাত্র স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে একদম সেকালের গ্রামের চন্ডীমণ্ডপে যেরকম ভাবে আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া চেষ্টা করা হতো, তারই একটি আধুনিক পর্যায়ে রচিত হচ্ছে, তা নয়। প্রতিটি এলাকার যে আঞ্চলিক সংস্কৃতি তার অনুসন্ধান এই’ বাংলা বাঁচাও যাত্রা’র একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি এলাকার লোকসংস্কৃতির নানা ধরনের পল্লবিত ধারা, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে বাংলার বৈচিত্র?্যময়, সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির মূলসুরটি, সেটিকে অনুসন্ধান করাই কেবল নয়। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেই সুরটি যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের মধ্যে প্রবাহিত হতে পারে তার প্রচেষ্টাও কিন্তু এই ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’র অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য।
বাংলা তথা বাঙালি সংস্কৃতি মানে কেবলমাত্র আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে ইঁদুর ভক্ষণ করা বা ছাদের টবে লাউ গাছ লাগিয়ে কৃষিকে উৎসাহ দেওয়া বা পায়েস রেঁধে জন্মদিন পালন করা নয়। বাংলার সংস্কৃতির মূল সুর যুগ যুগ ধরে, আউল- বাউল- ফকিরি- মারফতি,মুর্শিদি- টুসু - ভাদু, মাদার শা ফকিরের বিয়ের মেলা, পাথরচাপড়ির মেলা, গোপীচাঁদের মেলা, দধিয়া বৈরাগীতলার মেলা, ঘুটিয়ারী শরিফের উরস, চশমাবাবার মাজার, জল্পেশের মেলা ইত্যাদির সুরের মধ্যে দিয়ে, ভাবের মধ্যে দিয়ে ,মানুষের সঙ্গে মানুষের যে নিবিড় সংযোগ - তাকে অনুসন্ধানী ই শুধু নয়।বুকের মধ্যে তাকে ধারণ করে শহুরে সংস্কৃতির যে ভিত্তি , যা লুকিয়ে আছে মাটির রসের মধ্যে, গাছের পাতার মধ্যে , তাকে নিবিড়ভাবে যেন ফিরে পাওয়ার একটা আকাক্সক্ষা উচ্চারিত হচ্ছে। বামপন্থীদের’ বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ র গোটা কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে , সেই সুরটিই উচ্চারিত হচ্ছে।
[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]