জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বেগম রোকেয়া
ডিসেম্বর ৯, ২০২৫। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৪৫তম জন্মবার্ষিকী ও ৯৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশের চারজন নারীর হাতে বেগম রোকেয়া পদক তুলে দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। নারী-শিক্ষায় রুভানা রাকিব, নারী-অধিকারে কল্পনা আক্তার, মানবাধিকারে নাবিলা ইদ্রিস ও নারী-জাগরণে ঋতুপর্ণা চাকমা। পুরস্কারপ্রাপ্ত কল্পনা আক্তার একজন শ্রমিক নেতা, তিনি বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটি’র নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যা- ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি। নাবিলা ইদ্রিস অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গঠিত গুম কমিশনের একজন সদস্য। রাঙ্গামাটির মেয়ে ঋতুপর্ণা চাকমা একজন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। কিন্তুরুভানা রাকিব সম্পর্কে নেট ঘেটে কোন তথ্য পাওয়া গেল না।
নারী কল্যাণ সংস্থা ১৯৯১ সন থেকে এই নামের একটি পদক প্রদান করা শুরু করে। তবে সরকারিভাবে ১৯৯৬ সন থেকে এই পদক প্রদান করা হয়। দেশের যে সকল প্রথিতযশা নারী এই পদক পেয়েছেন তাদের মধ্যে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ অন্যতম। তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি হলের নামকরণ করা হয়েছে।আরও যারা এই পদক পেয়েছেন তাদের মধ্যে বেগম সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহীম প্রায় সকলের নিকট পরিচিত। এছাড়াও ভারতবর্ষের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নুরজাহান বেগম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী হেনাদাস। নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ‘রেমন ম্যাগসেসাই পুরস্কার’ প্রাপ্ত এঞ্জেলা গোমেজ। খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা মজুমদার প্রমূখ উল্লেখযোগ্য। নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে যারা কাজ করেন, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা নারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেন, নারীদের কর্মমুখী করে যারা তাদের স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন তাদের রোকেয়া পদকে ভূষিত করে সকল নারীর জাগরণকে তরান্বিত করা হয়।
বেগম রোকেয়া দিবস বাংলাদেশে সরকারিভাবে পালিত একটি জাতীয় দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার অবদানকে স্মরণ করে তার জন্ম ও মৃত্যুদিন ৯ ডিসেম্বর ‘রোকেয়া দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। নারী শিক্ষা ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন চেয়েছিলেন সমাজে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচুক। মুসলিম নারীদের জন্য বন্ধনমুক্ত সমাজ গড়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে। তার একটি লেখার নাম ‘অবরোধবাসিনী’, এই লেখায় সেই যুগের মুসলমান নারীদের করুণ চিত্র ফুটে ওঠেছে। তিনি এই পুস্তকে লিখেছেন, ‘যিনি যত বেশি পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেঁচকের মতো লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশি শরীফ’। মেয়েদের গৃহকোণে আবদ্ধ করে রাখার ক্ষেত্রে পুরুষদের দায়ী করে তিনি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসে তার প্রতিশোধ নিয়েছেন, এই উপন্যাসে পুরুষদের গৃহের অভ্যন্তরে অলস বসিয়ে রেখে মেয়াদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুযোগ দেওয়া হলে নারীরাও যে পুরুষদের সহযোগিতা ছাড়াই রাজ্য চালাতে পারে, অফিসে পুরুষের আট ঘন্টার কাজ দুই ঘন্টায় সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে তার নিখুঁত বর্ণনা রয়েছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বইটিতে।
ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রীতিমত লড়াই করে বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করে গেছেন।মুসলিম নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার সংগ্রামে বেগম রোকেয়ার অবদান কিন্তু সর্বজন স্বীকৃত নয়। রাজশাহী বিশবিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আজ মুরতাদ কাফির বেগম রোকেয়ার জন্মদিন’। এই বিদ্বেষ শুধু শিক্ষকদের মধ্যে নয়, জুলাই অভ্যুত্থানের পর কতিপয় ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যেও তা পরিলক্ষিত হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামছুন নাহার হলের সামনের দেয়ালে বেগম রোকেয়ার একটি গ্রাফিতি’র চোখ ও মুখ কালো রঙের স্প্রে দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে, কাজটি করেছে একজন শিক্ষার্থী। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ করার দাবি জানিয়েছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। নারীদের সম্পর্কে বেগম রোকেয়া যা যা বলে গেছেন তা সম্ভবত এখনো মুসলিম নারী সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক, নতুবা বেগম রোকেয়ার প্রতি এক শ্রেণির লোক এত ক্ষেপা কেন?
ক্ষেপে যাওয়ার প্রধান কারণ ‘ভয়’। বেগম রোকেয়ার চর্চা যতবেশি হবে ততই মুসলিম নারী সমাজের চক্ষু উন্মীলিত হবে। শিক্ষার আলোয় নারীদের চক্ষু উন্মীলিত হলে তাদের গৃহকোণে আবদ্ধ রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে সব শিক্ষা নয়, সংস্কারমুক্ত প্রকৃত শিক্ষা দরকার। যারা বেগম রোকেয়ার গ্রাফিতি করেছে এবং যারা গ্রাফিতির উপর রং লাগিয়ে বেগম রোকেয়ার ছবিকে বিকৃত করেছে তাদের উভয় গ্রুপই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী- অথচ এদের একটি গ্রুপ বেগম রোকেয়ার আদর্শকে ভয় পাচ্ছে। এই গ্রুপটি বেগম রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণও পছন্দ করছে না। করার কথাও নয়, প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণকারী বেগম রোকেয়া নারীমুক্তির যে আদর্শ রেখে গেছেন তা আজও নারীদের ঘরের বাইরে এসে শিক্ষা ও কর্ম ক্ষেত্রে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করার সংগ্রামে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায়।
চব্বিশের আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে সংঘবদ্ধভাবে নারীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেগম রোকেয়া ধর্মবিরোধী ছিলেন না, ধর্মের ভেতরে অবস্থান করেই তিনি নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকারটুকু চেয়েছিলেন। তিনি পর্দা প্রথারও বিরোধী ছিলেন না, তিনি বাহ্যিক অপ্রয়োজনীয় পর্দার সঙ্গে মনের পর্দাও সরানোর কথা বলেছেন।শিকলে বন্দী নারীমুক্তির অন্তরায় শুধু কর্তৃত্ববাদী পুরুষ নয়, নারীও- এই কথাটি বেগম রোকেয়া বারবার উচ্চারণ করেছেন। তাই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি থাকা সত্বেও বেগম রোকেয়া মুসলিম সমাজের কিছু লোকের কাছে আজও সমাদৃত নন।তবে তাকে আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বাঙ্গালী জাতি। তিনি শ্রদ্ধার পাত্র না হলে ২০০৪ সনে বিবিসির জরীপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে বেগম রোকেয়া থাকতেন না। ভয়ের কারণ হচ্ছে, দেড়শত বছর আগে যে রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হয়েছে সেই মুসলিম সমাজ দিনদিন আরও বেশি রক্ষণশীল হয়ে ওঠছে। একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পন করার পরও আফগানিস্তানের মেয়েরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। শুধু মুসলিম সমাজ নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ ভৌগলিক গণ্ডির বাইরের লোককে এখন আর সহ্য করতে পারছে না।
মানবিক মর্যাদার সংগ্রামেও বেগম রোকেয়া ছিলেন অকুতোভয়।দাম্পত্য জীবনে তিনি স্বামীকে প্রভু মনে করেননি। পুরুষশাসিত রাষ্ট্র ও মানব সমাজে অহরহ মানবতার অমর্যাদা হচ্ছে।বর্তমান বিশ্বে মানবতার ধ্বজাধারী আমেরিকা বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে বহিষ্কার করছে, এমন কী বিমানের ভেতরও অভিবাসীদের শিকল পরিয়ে রাখা হচ্ছে। বেগম রোকেয়ার আমল থেকে মানবতার কোন উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে হয় না, হলে ‘বেগম রোকেয়া’ পদকদাতা এবং পদকগ্রহীতা একযোগে আমেরিকার মানবতা বিরোধী এমন নিষ্ঠুর ও অমর্যাদাকর বীভৎস আচরণের প্রতিবাদ করতো। আমাদের বাংলাদেশে মানবতার বিপর্যয় নেমে এসেছে ব্যাপক ধর্ষণ ও বলাৎকারে। শিশু শিক্ষার্থীদের উপর একশ্রেণির মাদ্রাসা শিক্ষকদের বলাৎকার মহামারি রূপে আবির্ভূত হয়েছে। অন্যদিকে নারী ধর্ষণের অমানবিক নির্যাতনকে রোকেয়া বলেছিলেন ‘পতঙ্গ-ভীতি’। নারী যাতে তার অধিকার রক্ষায় ঘরের বাইরে পা ফেলতে না পারে সেজন্য ইদানীং মেয়েদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট টার্গেট করে সাইবার বুলিংও হচ্ছে।
বেগম রোকেয়ার নামে পদক চালু করে নারীমুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হচ্ছে না।মানুষ যত পড়ছে তত অন্ধ হচ্ছে। কারণ পড়ার নির্বাচন সঠিক হচ্ছে না। তাই সব শিক্ষা মানুষকে মুক্তি দেয় না। মুক্তি দেয় না বলেই অনেক স্বামী গর্ব করে বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীকে স্বাধীনতা দিয়েছি’। এটা যে লজ্জার তাও মুসলিম সমাজ বোঝে না, বউকে স্বামীর কাছ থেকে স্বাধীনতা নিতে হয় কেন, কেন তা সহজাত নয়! আজও মেয়েদের স্বাধীনতা ও পোষাককে ধর্ষণের কারণ হিসেবে প্রচার করা হয় এবং শিশু বলাৎকারের পরও পর্দাকে নারীর সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মনে হয়, আদিম যুগের মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীন ছিল, আমাদের দাদী-নানীরাও ঢের বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। তখন নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতন হতো সংসারের অভাব-অভিযোগের কারণে, কোন ধর্মীয় বা সামাজিক সংস্কার ভাঙ্গার কারণে নয়। কোটা বা একটু বেশি সুযোগ দিয়ে নারীদের সক্ষমতা ও মনোবল বাড়ানোর যে ব্যবস্থা ছিল তাও আজ নেই, এতে বৈষম্য নির্মূলের পরিবর্তে বৈষম্যের ব্যবধান দিনদিন বাড়তেই থাকবে, নারীদের সমাজের মূল স্রোতে আসা বিলম্বিত হবে। সমাজে বিরাজমান নানাবিধ বৈষম্য নিয়ে অনেকে ফিসফিস করে কথা বলেন, কিন্তু বেগম রোকেয়া নারীমুক্তির কথা ফিসফিস করে বলেননি, বলেছেন স্পষ্ট করে, এক-দেড়শ বছর পরেও তার বইগুলো কথা বলছে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, নারীর স্বাধীনতা কোন দর কষাকষি সাপেক্ষ নয়। প্রত্যাশা আমাদের, বেগম রোকেয়ার নারীরা শারীরিক শক্তি দিয়ে নয়- বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে ওঠবে।কারণ সংস্কারমুক্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই আসল ক্ষমতা।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বেগম রোকেয়া
শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫
ডিসেম্বর ৯, ২০২৫। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৪৫তম জন্মবার্ষিকী ও ৯৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশের চারজন নারীর হাতে বেগম রোকেয়া পদক তুলে দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। নারী-শিক্ষায় রুভানা রাকিব, নারী-অধিকারে কল্পনা আক্তার, মানবাধিকারে নাবিলা ইদ্রিস ও নারী-জাগরণে ঋতুপর্ণা চাকমা। পুরস্কারপ্রাপ্ত কল্পনা আক্তার একজন শ্রমিক নেতা, তিনি বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটি’র নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যা- ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি। নাবিলা ইদ্রিস অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গঠিত গুম কমিশনের একজন সদস্য। রাঙ্গামাটির মেয়ে ঋতুপর্ণা চাকমা একজন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। কিন্তুরুভানা রাকিব সম্পর্কে নেট ঘেটে কোন তথ্য পাওয়া গেল না।
নারী কল্যাণ সংস্থা ১৯৯১ সন থেকে এই নামের একটি পদক প্রদান করা শুরু করে। তবে সরকারিভাবে ১৯৯৬ সন থেকে এই পদক প্রদান করা হয়। দেশের যে সকল প্রথিতযশা নারী এই পদক পেয়েছেন তাদের মধ্যে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ অন্যতম। তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি হলের নামকরণ করা হয়েছে।আরও যারা এই পদক পেয়েছেন তাদের মধ্যে বেগম সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহীম প্রায় সকলের নিকট পরিচিত। এছাড়াও ভারতবর্ষের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নুরজাহান বেগম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী হেনাদাস। নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ‘রেমন ম্যাগসেসাই পুরস্কার’ প্রাপ্ত এঞ্জেলা গোমেজ। খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা মজুমদার প্রমূখ উল্লেখযোগ্য। নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে যারা কাজ করেন, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা নারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেন, নারীদের কর্মমুখী করে যারা তাদের স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন তাদের রোকেয়া পদকে ভূষিত করে সকল নারীর জাগরণকে তরান্বিত করা হয়।
বেগম রোকেয়া দিবস বাংলাদেশে সরকারিভাবে পালিত একটি জাতীয় দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার অবদানকে স্মরণ করে তার জন্ম ও মৃত্যুদিন ৯ ডিসেম্বর ‘রোকেয়া দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। নারী শিক্ষা ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন চেয়েছিলেন সমাজে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচুক। মুসলিম নারীদের জন্য বন্ধনমুক্ত সমাজ গড়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে। তার একটি লেখার নাম ‘অবরোধবাসিনী’, এই লেখায় সেই যুগের মুসলমান নারীদের করুণ চিত্র ফুটে ওঠেছে। তিনি এই পুস্তকে লিখেছেন, ‘যিনি যত বেশি পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেঁচকের মতো লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশি শরীফ’। মেয়েদের গৃহকোণে আবদ্ধ করে রাখার ক্ষেত্রে পুরুষদের দায়ী করে তিনি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসে তার প্রতিশোধ নিয়েছেন, এই উপন্যাসে পুরুষদের গৃহের অভ্যন্তরে অলস বসিয়ে রেখে মেয়াদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুযোগ দেওয়া হলে নারীরাও যে পুরুষদের সহযোগিতা ছাড়াই রাজ্য চালাতে পারে, অফিসে পুরুষের আট ঘন্টার কাজ দুই ঘন্টায় সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে তার নিখুঁত বর্ণনা রয়েছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বইটিতে।
ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রীতিমত লড়াই করে বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করে গেছেন।মুসলিম নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার সংগ্রামে বেগম রোকেয়ার অবদান কিন্তু সর্বজন স্বীকৃত নয়। রাজশাহী বিশবিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আজ মুরতাদ কাফির বেগম রোকেয়ার জন্মদিন’। এই বিদ্বেষ শুধু শিক্ষকদের মধ্যে নয়, জুলাই অভ্যুত্থানের পর কতিপয় ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যেও তা পরিলক্ষিত হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামছুন নাহার হলের সামনের দেয়ালে বেগম রোকেয়ার একটি গ্রাফিতি’র চোখ ও মুখ কালো রঙের স্প্রে দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে, কাজটি করেছে একজন শিক্ষার্থী। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ করার দাবি জানিয়েছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। নারীদের সম্পর্কে বেগম রোকেয়া যা যা বলে গেছেন তা সম্ভবত এখনো মুসলিম নারী সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক, নতুবা বেগম রোকেয়ার প্রতি এক শ্রেণির লোক এত ক্ষেপা কেন?
ক্ষেপে যাওয়ার প্রধান কারণ ‘ভয়’। বেগম রোকেয়ার চর্চা যতবেশি হবে ততই মুসলিম নারী সমাজের চক্ষু উন্মীলিত হবে। শিক্ষার আলোয় নারীদের চক্ষু উন্মীলিত হলে তাদের গৃহকোণে আবদ্ধ রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে সব শিক্ষা নয়, সংস্কারমুক্ত প্রকৃত শিক্ষা দরকার। যারা বেগম রোকেয়ার গ্রাফিতি করেছে এবং যারা গ্রাফিতির উপর রং লাগিয়ে বেগম রোকেয়ার ছবিকে বিকৃত করেছে তাদের উভয় গ্রুপই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী- অথচ এদের একটি গ্রুপ বেগম রোকেয়ার আদর্শকে ভয় পাচ্ছে। এই গ্রুপটি বেগম রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণও পছন্দ করছে না। করার কথাও নয়, প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণকারী বেগম রোকেয়া নারীমুক্তির যে আদর্শ রেখে গেছেন তা আজও নারীদের ঘরের বাইরে এসে শিক্ষা ও কর্ম ক্ষেত্রে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করার সংগ্রামে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায়।
চব্বিশের আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে সংঘবদ্ধভাবে নারীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেগম রোকেয়া ধর্মবিরোধী ছিলেন না, ধর্মের ভেতরে অবস্থান করেই তিনি নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকারটুকু চেয়েছিলেন। তিনি পর্দা প্রথারও বিরোধী ছিলেন না, তিনি বাহ্যিক অপ্রয়োজনীয় পর্দার সঙ্গে মনের পর্দাও সরানোর কথা বলেছেন।শিকলে বন্দী নারীমুক্তির অন্তরায় শুধু কর্তৃত্ববাদী পুরুষ নয়, নারীও- এই কথাটি বেগম রোকেয়া বারবার উচ্চারণ করেছেন। তাই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি থাকা সত্বেও বেগম রোকেয়া মুসলিম সমাজের কিছু লোকের কাছে আজও সমাদৃত নন।তবে তাকে আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বাঙ্গালী জাতি। তিনি শ্রদ্ধার পাত্র না হলে ২০০৪ সনে বিবিসির জরীপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে বেগম রোকেয়া থাকতেন না। ভয়ের কারণ হচ্ছে, দেড়শত বছর আগে যে রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হয়েছে সেই মুসলিম সমাজ দিনদিন আরও বেশি রক্ষণশীল হয়ে ওঠছে। একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পন করার পরও আফগানিস্তানের মেয়েরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। শুধু মুসলিম সমাজ নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ ভৌগলিক গণ্ডির বাইরের লোককে এখন আর সহ্য করতে পারছে না।
মানবিক মর্যাদার সংগ্রামেও বেগম রোকেয়া ছিলেন অকুতোভয়।দাম্পত্য জীবনে তিনি স্বামীকে প্রভু মনে করেননি। পুরুষশাসিত রাষ্ট্র ও মানব সমাজে অহরহ মানবতার অমর্যাদা হচ্ছে।বর্তমান বিশ্বে মানবতার ধ্বজাধারী আমেরিকা বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে বহিষ্কার করছে, এমন কী বিমানের ভেতরও অভিবাসীদের শিকল পরিয়ে রাখা হচ্ছে। বেগম রোকেয়ার আমল থেকে মানবতার কোন উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে হয় না, হলে ‘বেগম রোকেয়া’ পদকদাতা এবং পদকগ্রহীতা একযোগে আমেরিকার মানবতা বিরোধী এমন নিষ্ঠুর ও অমর্যাদাকর বীভৎস আচরণের প্রতিবাদ করতো। আমাদের বাংলাদেশে মানবতার বিপর্যয় নেমে এসেছে ব্যাপক ধর্ষণ ও বলাৎকারে। শিশু শিক্ষার্থীদের উপর একশ্রেণির মাদ্রাসা শিক্ষকদের বলাৎকার মহামারি রূপে আবির্ভূত হয়েছে। অন্যদিকে নারী ধর্ষণের অমানবিক নির্যাতনকে রোকেয়া বলেছিলেন ‘পতঙ্গ-ভীতি’। নারী যাতে তার অধিকার রক্ষায় ঘরের বাইরে পা ফেলতে না পারে সেজন্য ইদানীং মেয়েদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট টার্গেট করে সাইবার বুলিংও হচ্ছে।
বেগম রোকেয়ার নামে পদক চালু করে নারীমুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হচ্ছে না।মানুষ যত পড়ছে তত অন্ধ হচ্ছে। কারণ পড়ার নির্বাচন সঠিক হচ্ছে না। তাই সব শিক্ষা মানুষকে মুক্তি দেয় না। মুক্তি দেয় না বলেই অনেক স্বামী গর্ব করে বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীকে স্বাধীনতা দিয়েছি’। এটা যে লজ্জার তাও মুসলিম সমাজ বোঝে না, বউকে স্বামীর কাছ থেকে স্বাধীনতা নিতে হয় কেন, কেন তা সহজাত নয়! আজও মেয়েদের স্বাধীনতা ও পোষাককে ধর্ষণের কারণ হিসেবে প্রচার করা হয় এবং শিশু বলাৎকারের পরও পর্দাকে নারীর সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মনে হয়, আদিম যুগের মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীন ছিল, আমাদের দাদী-নানীরাও ঢের বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। তখন নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতন হতো সংসারের অভাব-অভিযোগের কারণে, কোন ধর্মীয় বা সামাজিক সংস্কার ভাঙ্গার কারণে নয়। কোটা বা একটু বেশি সুযোগ দিয়ে নারীদের সক্ষমতা ও মনোবল বাড়ানোর যে ব্যবস্থা ছিল তাও আজ নেই, এতে বৈষম্য নির্মূলের পরিবর্তে বৈষম্যের ব্যবধান দিনদিন বাড়তেই থাকবে, নারীদের সমাজের মূল স্রোতে আসা বিলম্বিত হবে। সমাজে বিরাজমান নানাবিধ বৈষম্য নিয়ে অনেকে ফিসফিস করে কথা বলেন, কিন্তু বেগম রোকেয়া নারীমুক্তির কথা ফিসফিস করে বলেননি, বলেছেন স্পষ্ট করে, এক-দেড়শ বছর পরেও তার বইগুলো কথা বলছে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, নারীর স্বাধীনতা কোন দর কষাকষি সাপেক্ষ নয়। প্রত্যাশা আমাদের, বেগম রোকেয়ার নারীরা শারীরিক শক্তি দিয়ে নয়- বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে ওঠবে।কারণ সংস্কারমুক্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই আসল ক্ষমতা।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]