সৈয়দ আমিরুজ্জামান
“বুদ্ধিজীবী ছাড়া যেমন কোনো বড় ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, তেমনি তাদের ছাড়া কোনো প্রতিবিপ্লবও হয়নি। এক কথায়, তারাই হচ্ছেন বিপ্লবের প্রাণ।” -এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ
জাতির সূর্য সন্তান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ ও সকল শহীদ বুদ্ধিজীবী, সম্ভ্রম হারানো ২ লক্ষ মা-বোন, নির্যাতিত পনের লাখেরও বেশি মানুষ, সর্বস্ব হারানো ১ কোটি মানুষসহ গোটা জনগণের লড়াই-সংগ্রাম-ত্যাগ তিতিক্ষা আর অবদানের জন্য তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।
১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির একাংশের নেতৃত্বে পল্টনের বিশাল জনসভা থেকে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র কর্মসূচি ও ঘোষণা প্রকাশ্যে উত্থাপন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দলন ও বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের প্রতি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর একাত্মতা ঘোষণার পর জাতিগত নিপীড়ন-শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার মুক্তিপাগল বাঙালি যুদ্ধের জন্য তৈরিই ছিলো বলা যায়।
১৯৭১ সালের ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় যুদ্ধরত কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দল এবং গণসংগঠনসমূহ মিলিত হয়ে গঠন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। এ সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণাপত্র তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করেই সমন্বয় কমিটি সরকারকে সহযোগিতাও যেমন করবে, তেমনি স্বতন্ত্রভাবেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবে। এ সমন্বয় কমিটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দল ছিল ন্যাপ (ভাসানী) ও ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ যার নেতৃত্বে সারাদেশে ১৪টি সশস্ত্র ঘাটি এলাকা ছিল।
একাত্তরে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে গণহত্যা শুরু হয়, তার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। তাই প্রথম রাত থেকে শুরু করে একেবারে শেষদিন পর্যন্ত এ নিধন-প্রক্রিয়া চলেছে সংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে।
‘বুদ্ধিজীবী’র সংজ্ঞায়ন নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও প্রচুর তর্ক-বিতর্ক-আলাপ-আলোচনা বিদ্যমান, তবু আমরা সে পথে হাঁটব না। যেহেতু একটা নির্দিষ্ট দেশের নির্দিষ্ট এক ঘটনার প্রেক্ষিতে এই আলোচনা, তাই আমরা সে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারিত সংজ্ঞাটি আমাদের পাথেয় বলে মেনে নেব।
বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থ অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী অর্থ ‘লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সমাজসেবী ও সংস্কৃতি সেবী’।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের মতে, বুদ্ধিজীবী ছাড়া যেমন কোনো বড় ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, তেমনি তাদের ছাড়া কোনো প্রতিবিপ্লবও হয়নি। এক কথায়, তারাই হচ্ছেন বিপ্লবের প্রাণ। শাসকগোষ্ঠীর টিকে থাকার জন্যে যেমন এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর প্রয়োজন পড়ে, তেমনি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যেও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সক্রিয় থাকেন। ‘বিরুদ্ধে’ অবস্থানকারী এই বুদ্ধিজীবীদের প্রায়শই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়, জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়, এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হয়। এ কারণেই দেখা যায় যে, গত শতাব্দীর শুরুতে আর্মেনিয়ায় গণহত্যা শুরু হয়েছিল ২৫০ জন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার ও হত্যার মাধ্যমে। হিটলার ও নাৎসি বাহিনীও পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল।
সে সব বিবেচনা করলে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মোটেই নতুন কিছু নয় বরং প্রকৃতিগত দিক হতে পূর্বের গণহত্যাগুলোর সঙ্গে এটা সাদৃশ্যপূর্ণই বটে।
২৫ মার্চের রাত থেকেই শুরু হয় মূলত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ এবং ১৪ ডিসেম্বর সেটার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাপিডিয়ার সূত্রমতে, এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন।
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটন করতে হলে পাকিস্তান আমলের সেই পঁচিশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সাধারণ জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অনুধাবন করতে হবে। ১৯৪৭ থেকে ’৭১-এ সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখজনক পরিবর্তন ঘটে। জমিদারি প্রথার অবসান ঘটার ফলে ধীরে ধীরে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটেছে। সেই সঙ্গে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও জন্ম হতে থাকে। তাদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। ‘সমাজের ভেতর এই মৌলিক পরিবর্তনের ধারা আমাদের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে।’
পরিবর্তনের এই ধারাবাহিকতায় বাঙালিরা বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের গণ্ডি থেকে বের হয়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’ প্রবেশ করে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের দ্বারা এই জাতীয়তাবোধের যে উন্মেষ ঘটেছিল, পরবর্তীতে সেটার অগ্রগতিতে মূল অবদান ছিল তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদেরই। উর্দু-ফারসি-আরবি শব্দ মিলিয়ে বাংলা ভাষাকে মুসলমানি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলনের চেষ্টার বিরুদ্ধেও বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন সরব। এমনকি পাকিস্তান জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অনেক কবিও ব্যঙ্গাত্মক কবিতার মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আমলে প্রথমে আঘাত আসে সংবাদপত্রের ওপর, শাসকচক্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সাংবাদিকরা দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন। সামরিক শাসনবিরোধী সাংবাদিকদের বিদেশ গমনেও বাধা দেওয়া হয়। তবু ‘ইত্তেফাক’ কিংবা ‘সংবাদ’ ক্ষমতাসীনদের কাছে খুব একটা নতি স্বীকার করেনি।
তৎকালীন সামরিক শাসকচক্র বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর সর্বাধিক নোংরা আক্রমণ চালায়; পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান-– এই দুই অঞ্চলের সংহতি বৃদ্ধির অজুহাতে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হয়। বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন এই ভাষা-সংস্কারের তীব্র প্রতিবাদ জানান। রবীন্দ্রনাথ ও তার সাহিত্যের ওপর আসে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ। তাকে চিহ্নিত করা হয় হিন্দু কবি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে। এই ‘হিন্দুয়ানি’র অভিযোগ তুলে নজরুলের কবিতা থেকেও ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ছাত্রীদের কপালে টিপ দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ জারি করা হয়। কেউ টিপ দিয়ে গেলে তাকে কর্তৃপক্ষের হাতে হেনস্থা হতে হত।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে সামরিক সরকার আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করে যে, রবীন্দ্রনাথ আসলে পাকিস্তান আদর্শবিরোধী। প্রতিবাদস্বরূপ এগিয়ে আসেন বুদ্ধিজীবীরা। বিভিন্ন জায়গায় রবীন্দ্রজয়ন্তী কমিটি গঠন করে অনুষ্ঠান আয়োজন করা শুরু হয়। মেয়েরা কপালে টিপ দেওয়া শুরু করেন। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুন হকের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ছায়ানট’। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বুদ্ধিজীবীদের এমন সাহসী প্রতিবাদ ‘ধর্মনিরপেক্ষ পূর্ব বাংলার স্বাতন্ত্র্য চেতনা’র বিকাশে সাহায্য করেছিল তুমুলভাবে।
১৯৬৭ সালে মুসলিম লীগের খান এ সবুর পয়লা বৈশাখ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনকে বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বলে মন্তব্য করেন। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনও এরকম মন্তব্য করে বলেন যে, পাকিস্তানি আদর্শের সঙ্গে না মিললে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাদের পক্ষে তখন সক্রিয় হয়ে ওঠেন পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীরা। দৈনিক আজাদ তখন লিখেছিল, “রবীন্দ্রনাথ বহু সঙ্গীতে মুসলিম তমুদ্দনকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া হিন্দু সংস্কৃতির জয়গান গাহিয়াছেন।”
সেই সঙ্গে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রশংসাও করেছিল। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী তখন একসঙ্গে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে সামরিক সরকার আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করে যে, রবীন্দ্রনাথ আসলে পাকিস্তান আদর্শবিরোধী।
১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হামুদুর রহমান আরবি হরফে বাংলা ও উর্দু লেখার সুপারিশ করলে সেটারও প্রতিবাদ জানান বুদ্ধিজীবীরা। এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে গবেষক মুনতাসীর মামুন বলেন, “রাজনৈতিক ফ্রন্টের ঘটনাবলীর সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এ সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা পূর্ব বঙ্গবাসীর বাঙালিবোধকে তীব্র ও সংহত করে তোলে এবং এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীরা।”
অনেকটা একই রকম মন্তব্য করেন গবেষক ও তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরও। তিনি বলেন, “পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের গোঁড়া পর্যন্ত এদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুবিধাবাদী লোক থাকলেও তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অভাব ছিল না। সেটা না হলে সেই পর্যায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অগ্রসর হত না এবং স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধত না।”
সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে এমন প্রতিবাদ পাকিস্তানিদের দৃষ্টি মোটেও এড়িয়ে যায়নি। শাসকচক্র ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশে এই ঘটনাগুলো মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বুদ্ধিজীবী কিংবা সে সময়কার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর দিকে ইঙ্গিত দিয়ে পাকিস্তানি একজন জেনারেল লিখেছিলেন,
ষাটের দশকে এই সংগঠনগুলো পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষকে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলে।
ইতিহাস আমাদের বলে যে, খুব একটা ভুল বলেননি এই জেনারেল সাহেব।
ডিসেম্বরে, বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, সে সম্পর্কে যখনই কোনো পত্রিকা রিপোর্ট করে তখন নিহত বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ যে বামপন্থী সেটা উল্লেখ করতে ভুলে না। প্রাসঙ্গিক কারণেই তাই জাতীয়তাবাদী ধারার আন্দোলনের পাশাপাশি সে সময়ের বাম রাজনীতি নিয়েও কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
মতাদর্শিক জেরে আন্তর্জাতিক বিভক্তির প্রভাবে এখানকার বামপন্থী দলগুলোও অনেকগুলো ধারায় ভাগ হয়ে যাওয়ায় ফলে অনেক সময় তারা রাজনৈতিকভাবে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবু স্বীকার করতে হয়, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার কথা প্রথমত তারাই জোরেশোরে উচ্চারণ করেছিল। তাদের প্রভাবেই ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলার তৎকালীন রাজনীতি সাম্প্রদায়িক চরিত্র বর্জন করছিল। পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, যখনই কেউ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, তাকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে গালি দেওয়া হয়েছে। এমনকি দক্ষিণপন্থী নেতাদেরকেও, যদি তারা কোনোভাবে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন, ‘কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন’ কিংবা ‘কমিউনিস্ট দ্বারা প্রভাবিত’ বলে চিহ্নিত করা হত।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের একটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল শ্রমিকশ্রেণির উত্থান ও গ্রামাঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহ। এ দুই জায়গাতেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্টরা। বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে হাজার হাজার বাম কমিউনিস্ট কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শ্রমিক কৃষক আন্দোলনে, যা শাসকগোষ্ঠীকে ব্যাপক বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত টঙ্গীর শিল্প এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় গণ আন্দোলনের মুখে পশ্চিমা শিল্পপতিরা বেশ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। সে সময় স্মরণ করে কমরেড হায়দার আকবর খান রনো বলেছিলেন, “সেদিন শিল্প এলাকায় যেন শ্রমিক শ্রেণির রাজত্ব কায়েম হয়েছিল।”
বামপন্থী কর্মীদের অবদান বিষয়ে আহমদ ছফা তার এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, “বাংলাদেশি রাজনীতি সংস্কৃতির যা কিছু উজ্জ্বল অংশ তার সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতির অবদান। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে। সামন্ত সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত একটি নতুনতর সংস্কৃতির উন্মেষ বিকাশ লালনে বামপন্থী সংস্কৃতিসেবীদের যে বিরাট সাফল্য এবং ত্যাগ; তিল তিল করে সংস্কৃতির আসল চেহারাটি ফুটিয়ে তোলার কাজে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা যে শ্রম, মেধা এবং যতœ ব্যয় করেছেন যে কাহিনী এখন প্রায় বিস্মৃতিতে বিলীন হতে চলেছে। ... বাঙালি জাতীয়তার প্রাথমিক সোপানগুলো বামপন্থী রাজনীতির নেতাকর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন। সেজন্য তাদের জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন কম সহ্য করতে হয়নি”।
(চলবে)
[লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি; সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
“বুদ্ধিজীবী ছাড়া যেমন কোনো বড় ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, তেমনি তাদের ছাড়া কোনো প্রতিবিপ্লবও হয়নি। এক কথায়, তারাই হচ্ছেন বিপ্লবের প্রাণ।” -এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ
জাতির সূর্য সন্তান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ ও সকল শহীদ বুদ্ধিজীবী, সম্ভ্রম হারানো ২ লক্ষ মা-বোন, নির্যাতিত পনের লাখেরও বেশি মানুষ, সর্বস্ব হারানো ১ কোটি মানুষসহ গোটা জনগণের লড়াই-সংগ্রাম-ত্যাগ তিতিক্ষা আর অবদানের জন্য তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।
১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির একাংশের নেতৃত্বে পল্টনের বিশাল জনসভা থেকে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র কর্মসূচি ও ঘোষণা প্রকাশ্যে উত্থাপন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দলন ও বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের প্রতি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর একাত্মতা ঘোষণার পর জাতিগত নিপীড়ন-শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার মুক্তিপাগল বাঙালি যুদ্ধের জন্য তৈরিই ছিলো বলা যায়।
১৯৭১ সালের ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় যুদ্ধরত কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দল এবং গণসংগঠনসমূহ মিলিত হয়ে গঠন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। এ সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণাপত্র তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করেই সমন্বয় কমিটি সরকারকে সহযোগিতাও যেমন করবে, তেমনি স্বতন্ত্রভাবেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবে। এ সমন্বয় কমিটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দল ছিল ন্যাপ (ভাসানী) ও ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ যার নেতৃত্বে সারাদেশে ১৪টি সশস্ত্র ঘাটি এলাকা ছিল।
একাত্তরে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে গণহত্যা শুরু হয়, তার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। তাই প্রথম রাত থেকে শুরু করে একেবারে শেষদিন পর্যন্ত এ নিধন-প্রক্রিয়া চলেছে সংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে।
‘বুদ্ধিজীবী’র সংজ্ঞায়ন নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও প্রচুর তর্ক-বিতর্ক-আলাপ-আলোচনা বিদ্যমান, তবু আমরা সে পথে হাঁটব না। যেহেতু একটা নির্দিষ্ট দেশের নির্দিষ্ট এক ঘটনার প্রেক্ষিতে এই আলোচনা, তাই আমরা সে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারিত সংজ্ঞাটি আমাদের পাথেয় বলে মেনে নেব।
বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থ অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী অর্থ ‘লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সমাজসেবী ও সংস্কৃতি সেবী’।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের মতে, বুদ্ধিজীবী ছাড়া যেমন কোনো বড় ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, তেমনি তাদের ছাড়া কোনো প্রতিবিপ্লবও হয়নি। এক কথায়, তারাই হচ্ছেন বিপ্লবের প্রাণ। শাসকগোষ্ঠীর টিকে থাকার জন্যে যেমন এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর প্রয়োজন পড়ে, তেমনি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যেও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সক্রিয় থাকেন। ‘বিরুদ্ধে’ অবস্থানকারী এই বুদ্ধিজীবীদের প্রায়শই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়, জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়, এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হয়। এ কারণেই দেখা যায় যে, গত শতাব্দীর শুরুতে আর্মেনিয়ায় গণহত্যা শুরু হয়েছিল ২৫০ জন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার ও হত্যার মাধ্যমে। হিটলার ও নাৎসি বাহিনীও পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল।
সে সব বিবেচনা করলে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মোটেই নতুন কিছু নয় বরং প্রকৃতিগত দিক হতে পূর্বের গণহত্যাগুলোর সঙ্গে এটা সাদৃশ্যপূর্ণই বটে।
২৫ মার্চের রাত থেকেই শুরু হয় মূলত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ এবং ১৪ ডিসেম্বর সেটার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাপিডিয়ার সূত্রমতে, এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন।
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটন করতে হলে পাকিস্তান আমলের সেই পঁচিশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সাধারণ জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অনুধাবন করতে হবে। ১৯৪৭ থেকে ’৭১-এ সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখজনক পরিবর্তন ঘটে। জমিদারি প্রথার অবসান ঘটার ফলে ধীরে ধীরে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটেছে। সেই সঙ্গে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও জন্ম হতে থাকে। তাদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। ‘সমাজের ভেতর এই মৌলিক পরিবর্তনের ধারা আমাদের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে।’
পরিবর্তনের এই ধারাবাহিকতায় বাঙালিরা বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের গণ্ডি থেকে বের হয়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’ প্রবেশ করে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের দ্বারা এই জাতীয়তাবোধের যে উন্মেষ ঘটেছিল, পরবর্তীতে সেটার অগ্রগতিতে মূল অবদান ছিল তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদেরই। উর্দু-ফারসি-আরবি শব্দ মিলিয়ে বাংলা ভাষাকে মুসলমানি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলনের চেষ্টার বিরুদ্ধেও বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন সরব। এমনকি পাকিস্তান জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অনেক কবিও ব্যঙ্গাত্মক কবিতার মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আমলে প্রথমে আঘাত আসে সংবাদপত্রের ওপর, শাসকচক্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সাংবাদিকরা দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন। সামরিক শাসনবিরোধী সাংবাদিকদের বিদেশ গমনেও বাধা দেওয়া হয়। তবু ‘ইত্তেফাক’ কিংবা ‘সংবাদ’ ক্ষমতাসীনদের কাছে খুব একটা নতি স্বীকার করেনি।
তৎকালীন সামরিক শাসকচক্র বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর সর্বাধিক নোংরা আক্রমণ চালায়; পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান-– এই দুই অঞ্চলের সংহতি বৃদ্ধির অজুহাতে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হয়। বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন এই ভাষা-সংস্কারের তীব্র প্রতিবাদ জানান। রবীন্দ্রনাথ ও তার সাহিত্যের ওপর আসে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ। তাকে চিহ্নিত করা হয় হিন্দু কবি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে। এই ‘হিন্দুয়ানি’র অভিযোগ তুলে নজরুলের কবিতা থেকেও ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ছাত্রীদের কপালে টিপ দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ জারি করা হয়। কেউ টিপ দিয়ে গেলে তাকে কর্তৃপক্ষের হাতে হেনস্থা হতে হত।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে সামরিক সরকার আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করে যে, রবীন্দ্রনাথ আসলে পাকিস্তান আদর্শবিরোধী। প্রতিবাদস্বরূপ এগিয়ে আসেন বুদ্ধিজীবীরা। বিভিন্ন জায়গায় রবীন্দ্রজয়ন্তী কমিটি গঠন করে অনুষ্ঠান আয়োজন করা শুরু হয়। মেয়েরা কপালে টিপ দেওয়া শুরু করেন। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুন হকের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ছায়ানট’। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বুদ্ধিজীবীদের এমন সাহসী প্রতিবাদ ‘ধর্মনিরপেক্ষ পূর্ব বাংলার স্বাতন্ত্র্য চেতনা’র বিকাশে সাহায্য করেছিল তুমুলভাবে।
১৯৬৭ সালে মুসলিম লীগের খান এ সবুর পয়লা বৈশাখ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনকে বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বলে মন্তব্য করেন। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনও এরকম মন্তব্য করে বলেন যে, পাকিস্তানি আদর্শের সঙ্গে না মিললে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাদের পক্ষে তখন সক্রিয় হয়ে ওঠেন পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীরা। দৈনিক আজাদ তখন লিখেছিল, “রবীন্দ্রনাথ বহু সঙ্গীতে মুসলিম তমুদ্দনকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া হিন্দু সংস্কৃতির জয়গান গাহিয়াছেন।”
সেই সঙ্গে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রশংসাও করেছিল। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী তখন একসঙ্গে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে সামরিক সরকার আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করে যে, রবীন্দ্রনাথ আসলে পাকিস্তান আদর্শবিরোধী।
১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হামুদুর রহমান আরবি হরফে বাংলা ও উর্দু লেখার সুপারিশ করলে সেটারও প্রতিবাদ জানান বুদ্ধিজীবীরা। এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে গবেষক মুনতাসীর মামুন বলেন, “রাজনৈতিক ফ্রন্টের ঘটনাবলীর সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এ সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা পূর্ব বঙ্গবাসীর বাঙালিবোধকে তীব্র ও সংহত করে তোলে এবং এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীরা।”
অনেকটা একই রকম মন্তব্য করেন গবেষক ও তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরও। তিনি বলেন, “পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের গোঁড়া পর্যন্ত এদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুবিধাবাদী লোক থাকলেও তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অভাব ছিল না। সেটা না হলে সেই পর্যায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অগ্রসর হত না এবং স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধত না।”
সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে এমন প্রতিবাদ পাকিস্তানিদের দৃষ্টি মোটেও এড়িয়ে যায়নি। শাসকচক্র ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশে এই ঘটনাগুলো মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বুদ্ধিজীবী কিংবা সে সময়কার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর দিকে ইঙ্গিত দিয়ে পাকিস্তানি একজন জেনারেল লিখেছিলেন,
ষাটের দশকে এই সংগঠনগুলো পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষকে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলে।
ইতিহাস আমাদের বলে যে, খুব একটা ভুল বলেননি এই জেনারেল সাহেব।
ডিসেম্বরে, বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, সে সম্পর্কে যখনই কোনো পত্রিকা রিপোর্ট করে তখন নিহত বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ যে বামপন্থী সেটা উল্লেখ করতে ভুলে না। প্রাসঙ্গিক কারণেই তাই জাতীয়তাবাদী ধারার আন্দোলনের পাশাপাশি সে সময়ের বাম রাজনীতি নিয়েও কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
মতাদর্শিক জেরে আন্তর্জাতিক বিভক্তির প্রভাবে এখানকার বামপন্থী দলগুলোও অনেকগুলো ধারায় ভাগ হয়ে যাওয়ায় ফলে অনেক সময় তারা রাজনৈতিকভাবে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবু স্বীকার করতে হয়, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার কথা প্রথমত তারাই জোরেশোরে উচ্চারণ করেছিল। তাদের প্রভাবেই ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলার তৎকালীন রাজনীতি সাম্প্রদায়িক চরিত্র বর্জন করছিল। পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, যখনই কেউ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, তাকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে গালি দেওয়া হয়েছে। এমনকি দক্ষিণপন্থী নেতাদেরকেও, যদি তারা কোনোভাবে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন, ‘কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন’ কিংবা ‘কমিউনিস্ট দ্বারা প্রভাবিত’ বলে চিহ্নিত করা হত।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের একটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল শ্রমিকশ্রেণির উত্থান ও গ্রামাঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহ। এ দুই জায়গাতেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্টরা। বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে হাজার হাজার বাম কমিউনিস্ট কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শ্রমিক কৃষক আন্দোলনে, যা শাসকগোষ্ঠীকে ব্যাপক বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত টঙ্গীর শিল্প এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় গণ আন্দোলনের মুখে পশ্চিমা শিল্পপতিরা বেশ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। সে সময় স্মরণ করে কমরেড হায়দার আকবর খান রনো বলেছিলেন, “সেদিন শিল্প এলাকায় যেন শ্রমিক শ্রেণির রাজত্ব কায়েম হয়েছিল।”
বামপন্থী কর্মীদের অবদান বিষয়ে আহমদ ছফা তার এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, “বাংলাদেশি রাজনীতি সংস্কৃতির যা কিছু উজ্জ্বল অংশ তার সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতির অবদান। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে। সামন্ত সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত একটি নতুনতর সংস্কৃতির উন্মেষ বিকাশ লালনে বামপন্থী সংস্কৃতিসেবীদের যে বিরাট সাফল্য এবং ত্যাগ; তিল তিল করে সংস্কৃতির আসল চেহারাটি ফুটিয়ে তোলার কাজে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা যে শ্রম, মেধা এবং যতœ ব্যয় করেছেন যে কাহিনী এখন প্রায় বিস্মৃতিতে বিলীন হতে চলেছে। ... বাঙালি জাতীয়তার প্রাথমিক সোপানগুলো বামপন্থী রাজনীতির নেতাকর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন। সেজন্য তাদের জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন কম সহ্য করতে হয়নি”।
(চলবে)
[লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি; সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন]