alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

: রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে প্রতিদিন যে শত শত মানুষ আদালতের দ্বারে হাজির হন, তাদের একটি বড় অংশ আসে জমি নিয়ে বিরোধের কারণে।

ভূমি জরিপ একদিকে যেমন ভূমির মালিকানা নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সহায়ক, অন্যদিকে এটি ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, কর নির্ধারণ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত

জমির সীমানা কোথায়, কার নামে খতিয়ান, কোন দলিল বৈধ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বছরের পর বছর কেটে যায়। অথচ এসবের মূলে রয়েছে একটি সহজ কিন্তু দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত প্রক্রিয়া—ভূমি জরিপ। যে জরিপ সঠিক হলে জমির মালিকানা নির্দিষ্ট হয়, বিরোধ কমে, আইনি নিশ্চয়তা মেলে এবং ব্যক্তি মালিকানা রক্ষা পায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে ভূমি জরিপের দীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ভূমি রেকর্ড এখনো সবার নাগালে নয়। প্রাচীন মিসর থেকে শুরু করে উপমহাদেশের মোগল শাসনকাল এবং ব্রিটিশ আমলের জেমস রেনেল, রাজা টোডরমল থেকে শুরু করে আজকের বিডিএস বা ডিজিটাল জরিপ—ভূমি জরিপ পদ্ধতির এই পরিবর্তনশীল যাত্রা শুধুই প্রযুক্তির রূপান্তর নয়, বরং এটি জমির মালিকানা, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং জনগণের ন্যায়বিচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান ও ভূমি-নির্ভর সমাজব্যবস্থায় ভূমি ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা সংক্রান্ত প্রশ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ইস্যু। এই প্রেক্ষাপটে ‘ভূমি জরিপ’ একটি অনিবার্য বিষয়, যা শুধুমাত্র জমির পরিমাপ বা সীমানা নির্ধারণের প্রযুক্তিগত পদ্ধতি নয়—বরং এটি ইতিহাস, প্রশাসন, আইন এবং ন্যায়বিচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভূমি জরিপ একদিকে যেমন ভূমির মালিকানা নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সহায়ক, অন্যদিকে এটি ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, কর নির্ধারণ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। ‘ভূমি জরিপ’ বলতে আমরা মূলত একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভূমির পরিমাণ, সীমানা, মালিকানা এবং ব্যবহার নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে বুঝি। জরিপ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো সার্ভে, যা বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হলেও ভূমি জরিপ একটি নির্দিষ্ট টার্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি মৌজাভিত্তিক মানচিত্র (নকশা) এবং ভূমির মালিকানাসূচক নথি (খতিয়ান) প্রণয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে। সার্ভে আইন, ১৮৭৫–এর ২ ধারা অনুযায়ী, ‘জরিপ’ বলতে বোঝায় ভূমির সীমানা নির্ধারণ, নদীতীরবর্তী ভূমির পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম—যা সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়।

ভূমি জরিপের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় নীল নদের বার্ষিক বন্যায় জমির সীমানা মুছে যেত। ফলে দড়ি, খুঁটি এবং পরিমাপক পদ্ধতির সাহায্যে নতুন করে জমির পরিমাপ ও সীমানা নির্ধারণ করা হতো। এটি ছিল জরিপের আদিম রূপ। ভূমি কর নির্ধারণ, মালিকানা নিরূপণ এবং কৃষি উৎপাদন পর্যবেক্ষণের জন্য মিসরীয়রা ব্যাপক ভূমি জরিপ পরিচালনা করত। উপমহাদেশে ভূমি জরিপের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা ঘটে পাঠান শাসক শেরশাহের আমলে। তিনি ‘সরকারি রেকর্ড’ সংরক্ষণের জন্য ভূমি পরিমাপ ও শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থা চালু করেন। পরবর্তীতে মোগল সম্রাট আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী রাজা টোডরমল ভূমির পরিমাপ ও মূল্যায়নভিত্তিক একটি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করেন। যদিও তৎকালীন জরিপ কার্যক্রম আধুনিক জরিপের তুলনায় পরিপূর্ণ ছিল না, তথাপি এটি একটি কাঠামোগত উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে ভূমি জরিপ পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ও পেশাগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৭৪ সালে জেমস রেনেল ভারতবর্ষের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৭৮০ সালে তিনি প্রথম ভারতবর্ষের সাধারণ মানচিত্র প্রস্তুত করেন। ১৮০২ সালে উইলিয়াম ল্যাম্বটনের নেতৃত্বে ‘ত্রিকোণমিতিক জরিপ’ শুরু হয়, যার মাধ্যমে উপমহাদেশের বিস্তৃত এলাকার নির্ভুল মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে চালু হয় ‘মঘী জরিপ’ (১৮৩২-১৮৪৮), ‘থাকবাস্তু জরিপ’ (জমিদারদের তত্ত্বাবধানে), এবং ‘রাজস্ব জরিপ’ (১৮৪৭-১৮৭৮), যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল স্মিথ। এই জরিপগুলোতে জমির দখলদার, ভূমির শ্রেণিবিন্যাস ও রাজস্ব পরিমাণ নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক জরিপ হিসেবে বিবেচিত হয় ‘সি.এস জরিপ’, যা ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এই জরিপের মাধ্যমে বাংলাদেশ অঞ্চলের ভূমির সীমানা, মালিকানা ও শ্রেণি নির্ধারণ করে খতিয়ান ও নকশা তৈরি করা হয়। অধিকাংশ জমির মামলার মূলে আজও এই সি.এস রেকর্ডের গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর জরিপ পদ্ধতিতে নতুন পরিবর্তন আসে। ভূমির উপর সরকারের সরাসরি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৫৬ সালে ‘এস.এ জরিপ’ চালু করা হয়। এই জরিপের মাধ্যমে রায়তদের রেকর্ড প্রস্তুত ও জমিদারদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়। পরে শুরু হয় ‘পি.এস জরিপ’ এবং ‘আর.এস জরিপ’। এগুলোর লক্ষ্য ছিল পূর্ববর্তী জরিপগুলোর ভুল সংশোধন ও হালনাগাদ রেকর্ড তৈরি করা। পাশাপাশি নদী গতি পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নতুন জমির জন্য ‘দিয়ারা জরিপ’, শহরাঞ্চলের জন্য ‘সিটি জরিপ’, এবং পরবর্তীতে ‘বিএস/বিআরএস জরিপ’ পরিচালিত হয়। বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে চালু হয়েছে ‘বিডিএস জরিপ’। এর মাধ্যমে জিপিএস, জিআইএস, ড্রোন ও স্যাটেলাইট চিত্রের সাহায্যে জমির ডিজিটাল নকশা ও রেকর্ড তৈরি করা হচ্ছে। এতে সীমানা নির্ধারণে নির্ভুলতা ও স্বচ্ছতা বাড়ছে এবং জমি সংক্রান্ত মামলা-জট হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

ভূমি জরিপ শুধু প্রযুক্তিগত একটি প্রক্রিয়া নয়—এটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, ন্যায়বিচারের অংশ এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষার একটি অপরিহার্য উপাদান। বর্তমানে ভূমি সংক্রান্ত অধিকাংশ মামলার মূল কারণ হলো জমির সীমানা ও মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ, যার পেছনে জরিপের ভুল, অনুপস্থিতি বা জালিয়াতি কাজ করছে। সঠিক জরিপ ছাড়া ভূমি কর নির্ধারণ, দলিল রেজিস্ট্রেশন, জমি হস্তান্তর ও প্রজাস্বত্ব নিশ্চিত করা যায় না। ভূমি জরিপ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা আনতে হলে প্রযুক্তির সঙ্গে দক্ষ জনবল, যথাযথ তদারকি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা জরুরি। ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রমকে সফল করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা, তথ্যভিত্তিক বিরোধ এবং মাঠপর্যায়ের দুর্নীতি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনসচেতনতা, তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ এবং আইনি সংস্কার প্রয়োজন।

ভূমি জরিপ কোনো নিছক প্রযুক্তিগত পরিমাপের বিষয় নয়; এটি একটি জাতির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম মৌলিক উপাদান। সীমানা নির্ধারণের দড়ি যতটা মাটি ছোঁয়, তার চেয়েও বেশি ছুঁয়ে যায় মানুষের অধিকারবোধ, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের আকাঙক্ষা। অতীতের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, বারবারের ভুল এবং দেরিতে হলেও গৃহীত সংশোধনমূলক পদক্ষেপগুলো আমাদের সামনে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে—জমির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে জরিপ ব্যবস্থাকে হতে হবে আধুনিক, স্বচ্ছ ও টেকসই। তাই ভবিষ্যৎ ভূমি ব্যবস্থাপনার ভিত্তি হিসেবে একটি যুগোপযোগী, তথ্যভিত্তিক ও জনগণের আস্থাভাজন জরিপ কাঠামো গড়ে তোলা শুধু প্রশাসনিক সংস্কার নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ জনবল, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং সর্বোপরি, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। কারণ ভূমির প্রশ্নে ন্যায়বিচার শুধু আদালতে নয়, শুরু হয় সঠিক জরিপের রেখায়।

[লেখক: আইনজীবী]

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে প্রতিদিন যে শত শত মানুষ আদালতের দ্বারে হাজির হন, তাদের একটি বড় অংশ আসে জমি নিয়ে বিরোধের কারণে।

ভূমি জরিপ একদিকে যেমন ভূমির মালিকানা নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সহায়ক, অন্যদিকে এটি ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, কর নির্ধারণ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত

জমির সীমানা কোথায়, কার নামে খতিয়ান, কোন দলিল বৈধ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বছরের পর বছর কেটে যায়। অথচ এসবের মূলে রয়েছে একটি সহজ কিন্তু দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত প্রক্রিয়া—ভূমি জরিপ। যে জরিপ সঠিক হলে জমির মালিকানা নির্দিষ্ট হয়, বিরোধ কমে, আইনি নিশ্চয়তা মেলে এবং ব্যক্তি মালিকানা রক্ষা পায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে ভূমি জরিপের দীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ভূমি রেকর্ড এখনো সবার নাগালে নয়। প্রাচীন মিসর থেকে শুরু করে উপমহাদেশের মোগল শাসনকাল এবং ব্রিটিশ আমলের জেমস রেনেল, রাজা টোডরমল থেকে শুরু করে আজকের বিডিএস বা ডিজিটাল জরিপ—ভূমি জরিপ পদ্ধতির এই পরিবর্তনশীল যাত্রা শুধুই প্রযুক্তির রূপান্তর নয়, বরং এটি জমির মালিকানা, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং জনগণের ন্যায়বিচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান ও ভূমি-নির্ভর সমাজব্যবস্থায় ভূমি ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা সংক্রান্ত প্রশ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ইস্যু। এই প্রেক্ষাপটে ‘ভূমি জরিপ’ একটি অনিবার্য বিষয়, যা শুধুমাত্র জমির পরিমাপ বা সীমানা নির্ধারণের প্রযুক্তিগত পদ্ধতি নয়—বরং এটি ইতিহাস, প্রশাসন, আইন এবং ন্যায়বিচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভূমি জরিপ একদিকে যেমন ভূমির মালিকানা নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সহায়ক, অন্যদিকে এটি ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, কর নির্ধারণ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। ‘ভূমি জরিপ’ বলতে আমরা মূলত একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভূমির পরিমাণ, সীমানা, মালিকানা এবং ব্যবহার নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে বুঝি। জরিপ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো সার্ভে, যা বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হলেও ভূমি জরিপ একটি নির্দিষ্ট টার্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি মৌজাভিত্তিক মানচিত্র (নকশা) এবং ভূমির মালিকানাসূচক নথি (খতিয়ান) প্রণয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে। সার্ভে আইন, ১৮৭৫–এর ২ ধারা অনুযায়ী, ‘জরিপ’ বলতে বোঝায় ভূমির সীমানা নির্ধারণ, নদীতীরবর্তী ভূমির পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম—যা সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়।

ভূমি জরিপের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় নীল নদের বার্ষিক বন্যায় জমির সীমানা মুছে যেত। ফলে দড়ি, খুঁটি এবং পরিমাপক পদ্ধতির সাহায্যে নতুন করে জমির পরিমাপ ও সীমানা নির্ধারণ করা হতো। এটি ছিল জরিপের আদিম রূপ। ভূমি কর নির্ধারণ, মালিকানা নিরূপণ এবং কৃষি উৎপাদন পর্যবেক্ষণের জন্য মিসরীয়রা ব্যাপক ভূমি জরিপ পরিচালনা করত। উপমহাদেশে ভূমি জরিপের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা ঘটে পাঠান শাসক শেরশাহের আমলে। তিনি ‘সরকারি রেকর্ড’ সংরক্ষণের জন্য ভূমি পরিমাপ ও শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থা চালু করেন। পরবর্তীতে মোগল সম্রাট আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী রাজা টোডরমল ভূমির পরিমাপ ও মূল্যায়নভিত্তিক একটি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করেন। যদিও তৎকালীন জরিপ কার্যক্রম আধুনিক জরিপের তুলনায় পরিপূর্ণ ছিল না, তথাপি এটি একটি কাঠামোগত উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে ভূমি জরিপ পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ও পেশাগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৭৪ সালে জেমস রেনেল ভারতবর্ষের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৭৮০ সালে তিনি প্রথম ভারতবর্ষের সাধারণ মানচিত্র প্রস্তুত করেন। ১৮০২ সালে উইলিয়াম ল্যাম্বটনের নেতৃত্বে ‘ত্রিকোণমিতিক জরিপ’ শুরু হয়, যার মাধ্যমে উপমহাদেশের বিস্তৃত এলাকার নির্ভুল মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে চালু হয় ‘মঘী জরিপ’ (১৮৩২-১৮৪৮), ‘থাকবাস্তু জরিপ’ (জমিদারদের তত্ত্বাবধানে), এবং ‘রাজস্ব জরিপ’ (১৮৪৭-১৮৭৮), যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল স্মিথ। এই জরিপগুলোতে জমির দখলদার, ভূমির শ্রেণিবিন্যাস ও রাজস্ব পরিমাণ নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক জরিপ হিসেবে বিবেচিত হয় ‘সি.এস জরিপ’, যা ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এই জরিপের মাধ্যমে বাংলাদেশ অঞ্চলের ভূমির সীমানা, মালিকানা ও শ্রেণি নির্ধারণ করে খতিয়ান ও নকশা তৈরি করা হয়। অধিকাংশ জমির মামলার মূলে আজও এই সি.এস রেকর্ডের গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর জরিপ পদ্ধতিতে নতুন পরিবর্তন আসে। ভূমির উপর সরকারের সরাসরি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৫৬ সালে ‘এস.এ জরিপ’ চালু করা হয়। এই জরিপের মাধ্যমে রায়তদের রেকর্ড প্রস্তুত ও জমিদারদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়। পরে শুরু হয় ‘পি.এস জরিপ’ এবং ‘আর.এস জরিপ’। এগুলোর লক্ষ্য ছিল পূর্ববর্তী জরিপগুলোর ভুল সংশোধন ও হালনাগাদ রেকর্ড তৈরি করা। পাশাপাশি নদী গতি পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নতুন জমির জন্য ‘দিয়ারা জরিপ’, শহরাঞ্চলের জন্য ‘সিটি জরিপ’, এবং পরবর্তীতে ‘বিএস/বিআরএস জরিপ’ পরিচালিত হয়। বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে চালু হয়েছে ‘বিডিএস জরিপ’। এর মাধ্যমে জিপিএস, জিআইএস, ড্রোন ও স্যাটেলাইট চিত্রের সাহায্যে জমির ডিজিটাল নকশা ও রেকর্ড তৈরি করা হচ্ছে। এতে সীমানা নির্ধারণে নির্ভুলতা ও স্বচ্ছতা বাড়ছে এবং জমি সংক্রান্ত মামলা-জট হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

ভূমি জরিপ শুধু প্রযুক্তিগত একটি প্রক্রিয়া নয়—এটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, ন্যায়বিচারের অংশ এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষার একটি অপরিহার্য উপাদান। বর্তমানে ভূমি সংক্রান্ত অধিকাংশ মামলার মূল কারণ হলো জমির সীমানা ও মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ, যার পেছনে জরিপের ভুল, অনুপস্থিতি বা জালিয়াতি কাজ করছে। সঠিক জরিপ ছাড়া ভূমি কর নির্ধারণ, দলিল রেজিস্ট্রেশন, জমি হস্তান্তর ও প্রজাস্বত্ব নিশ্চিত করা যায় না। ভূমি জরিপ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা আনতে হলে প্রযুক্তির সঙ্গে দক্ষ জনবল, যথাযথ তদারকি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা জরুরি। ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রমকে সফল করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা, তথ্যভিত্তিক বিরোধ এবং মাঠপর্যায়ের দুর্নীতি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনসচেতনতা, তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ এবং আইনি সংস্কার প্রয়োজন।

ভূমি জরিপ কোনো নিছক প্রযুক্তিগত পরিমাপের বিষয় নয়; এটি একটি জাতির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম মৌলিক উপাদান। সীমানা নির্ধারণের দড়ি যতটা মাটি ছোঁয়, তার চেয়েও বেশি ছুঁয়ে যায় মানুষের অধিকারবোধ, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের আকাঙক্ষা। অতীতের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, বারবারের ভুল এবং দেরিতে হলেও গৃহীত সংশোধনমূলক পদক্ষেপগুলো আমাদের সামনে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে—জমির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে জরিপ ব্যবস্থাকে হতে হবে আধুনিক, স্বচ্ছ ও টেকসই। তাই ভবিষ্যৎ ভূমি ব্যবস্থাপনার ভিত্তি হিসেবে একটি যুগোপযোগী, তথ্যভিত্তিক ও জনগণের আস্থাভাজন জরিপ কাঠামো গড়ে তোলা শুধু প্রশাসনিক সংস্কার নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ জনবল, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং সর্বোপরি, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। কারণ ভূমির প্রশ্নে ন্যায়বিচার শুধু আদালতে নয়, শুরু হয় সঠিক জরিপের রেখায়।

[লেখক: আইনজীবী]

back to top