শেখর ভট্টাচার্য

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র কতিপয় মানুষের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এই আপাত অসম, অসম্ভব জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো প্রান্তিক কৃষক, জেলে, মজুর, ছাত্র-ছাত্রী, ধর্ম , বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ
উনিশ’শ একাত্তর শুধু হাহাকারের বছর নয়।একাত্তরের মতো গৌরবময়য় বেদনাবহ বছর বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিরল। মুক্তির চেতনা যখন জাতির জীবন ধারায় গভীর ভাবে প্রবাহিত হয় তখন জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রকৃত অর্থে ইস্পাত কঠিন রূপ লাভ করে। পলিমাটি বিধৌত সবুজ, শ্যামল বাংলার মানূষ প্রকৃতিগতভাবে নিরীহ, নির্লিপ্ত, উদার মানসিকতার ধারক। একাত্তরের জনযুদ্ধে এই কোমল সুবর্ণভূমির মানুষ শত্রুর জন্য হয়ে উঠেছিলো ভয়ঙ্কর রকমের যোদ্ধা। প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথমে বাঁশের লাঠি পরবর্তীতে হালকা অস্ত্র ব্যবহার করে এতো বড় বিজয় কীভাবে ছিনিয়ে নিয়ে আসলো বাঙালি, এটি বিশ্বের অনেক মানুষের কাছে এখনও বিস্ময়কর বিজয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বাঙালির এই অর্জন অনেকের কাছে বিস্ময় সৃষ্টিকারী বিজয় হলেও আমরা যারা স্বাধীনতার সমবয়সী নাগরিক, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমরা জানি মানুষের অন্তরে কী অদম্য দেশপ্রেমের জন্ম হয়েছিলো একাত্তরের প্রাক্কালে। এই দেশপ্রেমই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে প্রকৃত অর্থে জনযুদ্ধের রূপ দিতে সমর্থ হয়েছিলো। স্বাধীনতার জন্য অন্তরের ডাক যখন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে তখন পৃথিবীর কোন মারণাস্ত্রই সেই দেশপ্রেমিক মানুষের সামনে দাঁড়াতে পারে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র কতিপয় মানুষের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এই আপাত অসম, অসম্ভব জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো প্রান্তিক কৃষক, জেলে, মজুর, ছাত্র-ছাত্রী, ধর্ম , বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ।
একাডেমিক এবং ব্যবহারিক আলোচনায় তাই এটি বিশ্বের অন্যতম গৌরবময় জনযুদ্ধ। মুক্তি সংগ্রামের গবেষকরা তাই কথাটিকে গুছিয়ে বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেছিল বিধায় এ যুদ্ধকে গণযুদ্ধ বলা হয়।” ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শুধু সাধারণ জনগণই নয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, সাংস্কৃতিক কর্মী নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এরকম সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছাড়া অন্যকোন জনযুদ্ধে দেখতে পাওয়া যায় না।
বাঙালিকে পাকিস্তানিরা অভিহিত করতো ভেতো, ভীতু মানুষ হিসেবে। যুদ্ধবিদ্যা বাঙালির জন্য নয় এরা কাপুরুষ, কর্মবিমুখ, অলস, এবং যুদ্ধ বিদ্যায় অনভিজ্ঞ। এই কাপুরুষ বাঙালির সম্মিলিত যুদ্ধ, যেখানে ঐক্য সংহতির মধ্যে কোন ফাটল নেই সেরকম প্রতিরোধে বাঙালি কতোটুকু বিপদজনক হয়ে ওঠে তা’ নয়মাসের প্রাণপণ লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করে পাকিস্তানি এবং বিশ্ববাসীদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো বাঙালি। এক্ষেত্রে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম সমগ্র বিশ্বে এক এবং অনন্য গৌরবের অর্জন যা আমাদের অস্তিত্ব এবং ঐতিহ্যকে সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছে।
বাঙালির জনযুদ্ধের ভেতরের চেতনাকে কিছুটা অনুধাবন করতে হলে রণাঙ্গণ থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি যে কোন পাঠককে সহায়তা করতে পারে। এই চিঠির সংকলনকে “একাত্তরের চিঠি” শিরোঁনামে গ্রন্থিত করা হয়েছে। জনযুদ্ধের এই অমর দলিল থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিলে জনযুদ্ধের চেতনার অন্তর্নিহিত বাণীকে সামান্য হলেও উপস্থাপন করা যেতে পারে।
‘একাত্তরের চিঠি’ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের পত্র সংকলন। এই অমূল্য চিঠিগুলো সংকলিত করে প্রথম প্রকাশ করা হয়েছিলো ২০০৯ সালে। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ‘একাত্তরের চিঠি’ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা সেই চিঠিগুলো পাঠ করছিলাম। এই গ্রন্থটি আমার হাতের কাছে সব সময়ই থাকে। সামাজিক সংকীর্ণতা এবং দেশ-প্রেমহীন মানুষের অনৈতিক কর্মকান্ড দেখে মন যখন কিছুটা বিষন্ন হয়ে ওঠে, তখন এই মহৎ গ্রন্থটি পাঠ করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করি। এ গ্রন্থে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার চিঠি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন।
প্রিয় পাঠক- বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার শপথ এবং বাঁধভাঙা আবেগের অসামান্য অনুভূতিকে অনুভব করার জন্য রণাঙ্গন থেকে পাঠানো শহীদ জিন্নাত আলীর একটি চিঠি পাঠ করা আবশ্যক। চিঠিটি লেখা হয়েছিলো ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৯ দিন পর। জিন্নাত আলী তার মাকে লিখছেন- ‘মা, আমার সালাম গ্রহণ করবেন। পরসংবাদ, আমি আপনাদের দোয়ায় এখনও পর্যন্ত ভালো আছি; কিন্তু কত দিন থাকতে পারব বলা যায় না। বাংলা মাকে বাঁচাতে যে ভূমিতে আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে ভাষায় কথা শিখিয়েছেন, সেই ভাষাকে, সেই জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হলে আমার মতো অনেক জিন্নার প্রাণ দিতে হবে। দুঃখ করবেন না মা। আপনার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে যদি আপনার এই নগণ্য ছেলের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়, সে রক্ত ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দিবে যে, বাঙালি এখনও মাতৃভূমি রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত বুলেটের সামনে পেতে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।’ মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে লড়াই করা বলতে যা বুঝায় আমরা জিন্নাহর চিঠি পাঠ করলে অন্তর দিয়ে অনুধাবন করতে পারি। রনাঙ্গণ থেকে পাঠানো এই চিঠি কোন রূপকথা নয়। প্রিয় পাঠক আবার পাঠ করুন, “...জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হলে আমার মতো অনেক জিন্নার প্রাণ দিতে হবে। দুঃখ করবেন না মা।“
৫ এপ্রিল, ১৯৭১ সালের আর একটি চিঠি যিনি হতভাগা ছেলে হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন সেখানে কী বলা হয়েছে। “ মাগো, তুমি যখন এ’পত্র পাবে, আমি তখন তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে থাকব। মা, আমি জানি তুমি আমাকে যেতে দিবে না, তাই তোমাকে না বলে চলে যাচ্ছি। তবে, যেদিন মা, বোনের ইজ্জতের প্রতিশোধ এবং এই মাতৃভূমি সোনার বাংলাকে শত্রু মুক্ত করতে পারব, সেদিন তোমার ছেলে তোমার কোলে ফিরে আসবে। দোয়া করবে মা, আমার আশা যেন পূর্ণ হয়। ইতি তোমারই হতভাগ্য ছেলে। জানি না হতভাগ্য ছেলে, বীর মুক্তিযোদ্ধা তার মায়ের কোলে ফিরতে পেরেছিলেন কী না। চিঠিটিতে প্রকাশিত নিবেদন এবং দৃঢ়তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সাহসী করে তুলবে এ’কথাটি নিশ্চিত করে বলা যায়। “... তবে, যেদিন মা, বোনের ইজ্জতের প্রতিশোধ এবং এই মাতৃভূমি সোনার বাংলাকে শত্রু মুক্ত করতে পারব, সেদিন তোমার ছেলে তোমার কোলে ফিরে আসবে।“ কী অকুতোভয় প্রত্যয়। কী উচ্চমাত্রার দেশপ্রেম প্রতিটি শব্দে , বাক্যে প্রকাশিত হয়েছে।
২৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে, মা রাহেলা খাতুনকে লেখা চিঠিটি পাঠ করলে দেশ প্রেমে উদ্বেলিত সন্তানের দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রত্যয়কে আমরা অনুধাবন করতে পারি। ‘ মা, দোয়া করো। তোমার ছেলে আজ তোমার সন্তানদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে চলেছে। বর্বর পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী আজ তোমার সন্তানদের ওপর নির্বিচারে অত্যচার চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে তোমার সন্তানদের ইজ্জতের ওপর আঘাত করেছে, সেখানে তো আর তোমার সন্তানেরা চুপ করে থাকতে পারে না, তাই আজ তোমার হাজার হাজার বীর সন্তানেরা বাঁচার দাবি নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তোমার নগন্য ছেলে তাদের মধ্যে একজন।“ পাকিস্তানিরা বলতো ভেতো, ভীতু, কাপুরুষ বাঙালি। এই চিঠিটি ইতিহাসে স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে যেখানে বাঙালি যোদ্ধা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য জীবনকে তুচ্ছ করে মা এবং মাতৃভূমির রক্ষায় অতন্দ্র সেনার ভূমিকা পালন করেছিলো।
এরকম অসংখ্য চিঠি আছে এ অনন্য সাধারণ গ্রন্থটিতে। যে চিঠিগুলো পাঠ করলে গণসংগীত শিল্পী ও গীতিকার আবদুল লতিফের সেই অমর গানটির কথা মনে হয়- ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারো দানে পাওয়া নয়/দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি/জানা আছে জগৎময়/’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধিকারের লড়াই শুরু হয়েছিলো মধ্যযুগ থেকে। তবে সেই স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার লড়াই মূলত ভাষা কেন্দ্রিক ছিলো। আমরা চৌদ্দশত শতকে আবদুল হাকিমের কণ্ঠ থেকে শুনতে পাই, “যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায় নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়”। আবদুল হাকিমের এই স্বকীয়তার প্রত্যয় ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো বাংলার অতি সাধারণ মানুষের চেতনায়। সে চেতনা আমাদেরকে বায়ান্ন দিয়েছিলো। উনসত্তরের অভ্যুত্থানের বিজয় দিয়েছিলো। প্রতিটি আন্দোলনে যখন জন্মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছে তখন কোন শক্তিই বাঙালিকে রুখতে সক্ষম হয়নি। আমাদের মুক্তির আন্দোলন তাই অব্যাহত আছে, একাত্তরের চেতনার বহ্নিশিখার আলোয় মাঝে।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
শেখর ভট্টাচার্য

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র কতিপয় মানুষের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এই আপাত অসম, অসম্ভব জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো প্রান্তিক কৃষক, জেলে, মজুর, ছাত্র-ছাত্রী, ধর্ম , বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ
মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫
উনিশ’শ একাত্তর শুধু হাহাকারের বছর নয়।একাত্তরের মতো গৌরবময়য় বেদনাবহ বছর বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিরল। মুক্তির চেতনা যখন জাতির জীবন ধারায় গভীর ভাবে প্রবাহিত হয় তখন জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রকৃত অর্থে ইস্পাত কঠিন রূপ লাভ করে। পলিমাটি বিধৌত সবুজ, শ্যামল বাংলার মানূষ প্রকৃতিগতভাবে নিরীহ, নির্লিপ্ত, উদার মানসিকতার ধারক। একাত্তরের জনযুদ্ধে এই কোমল সুবর্ণভূমির মানুষ শত্রুর জন্য হয়ে উঠেছিলো ভয়ঙ্কর রকমের যোদ্ধা। প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথমে বাঁশের লাঠি পরবর্তীতে হালকা অস্ত্র ব্যবহার করে এতো বড় বিজয় কীভাবে ছিনিয়ে নিয়ে আসলো বাঙালি, এটি বিশ্বের অনেক মানুষের কাছে এখনও বিস্ময়কর বিজয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বাঙালির এই অর্জন অনেকের কাছে বিস্ময় সৃষ্টিকারী বিজয় হলেও আমরা যারা স্বাধীনতার সমবয়সী নাগরিক, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমরা জানি মানুষের অন্তরে কী অদম্য দেশপ্রেমের জন্ম হয়েছিলো একাত্তরের প্রাক্কালে। এই দেশপ্রেমই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে প্রকৃত অর্থে জনযুদ্ধের রূপ দিতে সমর্থ হয়েছিলো। স্বাধীনতার জন্য অন্তরের ডাক যখন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে তখন পৃথিবীর কোন মারণাস্ত্রই সেই দেশপ্রেমিক মানুষের সামনে দাঁড়াতে পারে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র কতিপয় মানুষের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এই আপাত অসম, অসম্ভব জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো প্রান্তিক কৃষক, জেলে, মজুর, ছাত্র-ছাত্রী, ধর্ম , বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ।
একাডেমিক এবং ব্যবহারিক আলোচনায় তাই এটি বিশ্বের অন্যতম গৌরবময় জনযুদ্ধ। মুক্তি সংগ্রামের গবেষকরা তাই কথাটিকে গুছিয়ে বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেছিল বিধায় এ যুদ্ধকে গণযুদ্ধ বলা হয়।” ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শুধু সাধারণ জনগণই নয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, সাংস্কৃতিক কর্মী নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এরকম সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছাড়া অন্যকোন জনযুদ্ধে দেখতে পাওয়া যায় না।
বাঙালিকে পাকিস্তানিরা অভিহিত করতো ভেতো, ভীতু মানুষ হিসেবে। যুদ্ধবিদ্যা বাঙালির জন্য নয় এরা কাপুরুষ, কর্মবিমুখ, অলস, এবং যুদ্ধ বিদ্যায় অনভিজ্ঞ। এই কাপুরুষ বাঙালির সম্মিলিত যুদ্ধ, যেখানে ঐক্য সংহতির মধ্যে কোন ফাটল নেই সেরকম প্রতিরোধে বাঙালি কতোটুকু বিপদজনক হয়ে ওঠে তা’ নয়মাসের প্রাণপণ লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করে পাকিস্তানি এবং বিশ্ববাসীদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো বাঙালি। এক্ষেত্রে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম সমগ্র বিশ্বে এক এবং অনন্য গৌরবের অর্জন যা আমাদের অস্তিত্ব এবং ঐতিহ্যকে সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছে।
বাঙালির জনযুদ্ধের ভেতরের চেতনাকে কিছুটা অনুধাবন করতে হলে রণাঙ্গণ থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি যে কোন পাঠককে সহায়তা করতে পারে। এই চিঠির সংকলনকে “একাত্তরের চিঠি” শিরোঁনামে গ্রন্থিত করা হয়েছে। জনযুদ্ধের এই অমর দলিল থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিলে জনযুদ্ধের চেতনার অন্তর্নিহিত বাণীকে সামান্য হলেও উপস্থাপন করা যেতে পারে।
‘একাত্তরের চিঠি’ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের পত্র সংকলন। এই অমূল্য চিঠিগুলো সংকলিত করে প্রথম প্রকাশ করা হয়েছিলো ২০০৯ সালে। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ‘একাত্তরের চিঠি’ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা সেই চিঠিগুলো পাঠ করছিলাম। এই গ্রন্থটি আমার হাতের কাছে সব সময়ই থাকে। সামাজিক সংকীর্ণতা এবং দেশ-প্রেমহীন মানুষের অনৈতিক কর্মকান্ড দেখে মন যখন কিছুটা বিষন্ন হয়ে ওঠে, তখন এই মহৎ গ্রন্থটি পাঠ করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করি। এ গ্রন্থে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার চিঠি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন।
প্রিয় পাঠক- বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার শপথ এবং বাঁধভাঙা আবেগের অসামান্য অনুভূতিকে অনুভব করার জন্য রণাঙ্গন থেকে পাঠানো শহীদ জিন্নাত আলীর একটি চিঠি পাঠ করা আবশ্যক। চিঠিটি লেখা হয়েছিলো ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৯ দিন পর। জিন্নাত আলী তার মাকে লিখছেন- ‘মা, আমার সালাম গ্রহণ করবেন। পরসংবাদ, আমি আপনাদের দোয়ায় এখনও পর্যন্ত ভালো আছি; কিন্তু কত দিন থাকতে পারব বলা যায় না। বাংলা মাকে বাঁচাতে যে ভূমিতে আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে ভাষায় কথা শিখিয়েছেন, সেই ভাষাকে, সেই জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হলে আমার মতো অনেক জিন্নার প্রাণ দিতে হবে। দুঃখ করবেন না মা। আপনার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে যদি আপনার এই নগণ্য ছেলের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়, সে রক্ত ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দিবে যে, বাঙালি এখনও মাতৃভূমি রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত বুলেটের সামনে পেতে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।’ মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে লড়াই করা বলতে যা বুঝায় আমরা জিন্নাহর চিঠি পাঠ করলে অন্তর দিয়ে অনুধাবন করতে পারি। রনাঙ্গণ থেকে পাঠানো এই চিঠি কোন রূপকথা নয়। প্রিয় পাঠক আবার পাঠ করুন, “...জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হলে আমার মতো অনেক জিন্নার প্রাণ দিতে হবে। দুঃখ করবেন না মা।“
৫ এপ্রিল, ১৯৭১ সালের আর একটি চিঠি যিনি হতভাগা ছেলে হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন সেখানে কী বলা হয়েছে। “ মাগো, তুমি যখন এ’পত্র পাবে, আমি তখন তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে থাকব। মা, আমি জানি তুমি আমাকে যেতে দিবে না, তাই তোমাকে না বলে চলে যাচ্ছি। তবে, যেদিন মা, বোনের ইজ্জতের প্রতিশোধ এবং এই মাতৃভূমি সোনার বাংলাকে শত্রু মুক্ত করতে পারব, সেদিন তোমার ছেলে তোমার কোলে ফিরে আসবে। দোয়া করবে মা, আমার আশা যেন পূর্ণ হয়। ইতি তোমারই হতভাগ্য ছেলে। জানি না হতভাগ্য ছেলে, বীর মুক্তিযোদ্ধা তার মায়ের কোলে ফিরতে পেরেছিলেন কী না। চিঠিটিতে প্রকাশিত নিবেদন এবং দৃঢ়তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সাহসী করে তুলবে এ’কথাটি নিশ্চিত করে বলা যায়। “... তবে, যেদিন মা, বোনের ইজ্জতের প্রতিশোধ এবং এই মাতৃভূমি সোনার বাংলাকে শত্রু মুক্ত করতে পারব, সেদিন তোমার ছেলে তোমার কোলে ফিরে আসবে।“ কী অকুতোভয় প্রত্যয়। কী উচ্চমাত্রার দেশপ্রেম প্রতিটি শব্দে , বাক্যে প্রকাশিত হয়েছে।
২৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে, মা রাহেলা খাতুনকে লেখা চিঠিটি পাঠ করলে দেশ প্রেমে উদ্বেলিত সন্তানের দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রত্যয়কে আমরা অনুধাবন করতে পারি। ‘ মা, দোয়া করো। তোমার ছেলে আজ তোমার সন্তানদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে চলেছে। বর্বর পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী আজ তোমার সন্তানদের ওপর নির্বিচারে অত্যচার চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে তোমার সন্তানদের ইজ্জতের ওপর আঘাত করেছে, সেখানে তো আর তোমার সন্তানেরা চুপ করে থাকতে পারে না, তাই আজ তোমার হাজার হাজার বীর সন্তানেরা বাঁচার দাবি নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তোমার নগন্য ছেলে তাদের মধ্যে একজন।“ পাকিস্তানিরা বলতো ভেতো, ভীতু, কাপুরুষ বাঙালি। এই চিঠিটি ইতিহাসে স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে যেখানে বাঙালি যোদ্ধা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য জীবনকে তুচ্ছ করে মা এবং মাতৃভূমির রক্ষায় অতন্দ্র সেনার ভূমিকা পালন করেছিলো।
এরকম অসংখ্য চিঠি আছে এ অনন্য সাধারণ গ্রন্থটিতে। যে চিঠিগুলো পাঠ করলে গণসংগীত শিল্পী ও গীতিকার আবদুল লতিফের সেই অমর গানটির কথা মনে হয়- ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারো দানে পাওয়া নয়/দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি/জানা আছে জগৎময়/’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধিকারের লড়াই শুরু হয়েছিলো মধ্যযুগ থেকে। তবে সেই স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার লড়াই মূলত ভাষা কেন্দ্রিক ছিলো। আমরা চৌদ্দশত শতকে আবদুল হাকিমের কণ্ঠ থেকে শুনতে পাই, “যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায় নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়”। আবদুল হাকিমের এই স্বকীয়তার প্রত্যয় ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো বাংলার অতি সাধারণ মানুষের চেতনায়। সে চেতনা আমাদেরকে বায়ান্ন দিয়েছিলো। উনসত্তরের অভ্যুত্থানের বিজয় দিয়েছিলো। প্রতিটি আন্দোলনে যখন জন্মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছে তখন কোন শক্তিই বাঙালিকে রুখতে সক্ষম হয়নি। আমাদের মুক্তির আন্দোলন তাই অব্যাহত আছে, একাত্তরের চেতনার বহ্নিশিখার আলোয় মাঝে।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]