ফকর উদ্দিন মানিক
বাংলাদেশের বিজয় কোনো হঠাৎ পাওয়া সুখবর ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘ সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি। ১৯৭১ সালের আগে বাঙালির জীবন ছিল পরিসংখ্যানের বাইরে-অবমূল্যায়িত, অবহেলিত, শোষিত। ভাষা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা দিয়ে যে অন্যায় শুরু হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে রূপ নেয় রাজনৈতিক বঞ্চনায়, অর্থনৈতিক বৈষম্যে এবং সাংস্কৃতিক দমনে। একসময় স্পষ্ট হয়ে যায়-এই অবস্থা মেনে নেওয়া মানে অস্তিত্ব হারানো।
১৯৭১ সাল তাই কেবল একটি বছর নয়, এটি ছিল একটি জাতির আত্মপ্রকাশের মুহূর্ত। সেই নয় মাসে বাংলাদেশ রূপ নেয় এক বিশাল মানবযুদ্ধে। অস্ত্র হাতে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন যারা অস্ত্র ধরেননি। কেউ আশ্রয় দিয়েছেন, কেউ খাবার জুগিয়েছেন, কেউ আহতদের সেবা করেছেন, কেউ নির্যাতনের মধ্যেও মাথা নত করেননি। এই সম্মিলিত প্রতিরোধই জন্ম দিয়েছিল বিজয়ের।
বিজয় এসেছিল। পরাজিত হয়েছিল একটি সামরিক শক্তি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা-পরাজিত হয়েছিল ভয়। আকাশে উড়েছিল লাল-সবুজ পতাকা, কিন্তু সেই পতাকা উঠেছিল অসংখ্য অদেখা কবরের ওপর দাঁড়িয়ে। তাই বিজয়ের মুহূর্তে উল্লাসের পাশাপাশি ছিল কান্না। আনন্দের সঙ্গে মিশে ছিল শূন্যতার দীর্ঘশ্বাস। অনেকেই জানতেন-এই বিজয়ের দাম তারা আজীবন শোধ করতে পারবেন না।
এই বিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-এটি ছিল মানুষের মর্যাদার বিজয়। স্বাধীনতা মানে কেবল ভৌগোলিক সীমানা নয়, এটি মানুষের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। নিজের ভাষায় কথা বলা, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করা, নিজের ভবিষ্যৎ নিজে নির্ধারণ করার সাহস-এসবই ছিল স্বাধীনতার মূল সুর।
কিন্তু বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় আরেকটি অধ্যায়-ঋণের অধ্যায়। এই ঋণ কোনো আর্থিক হিসাবের খাতায় লেখা থাকে না। এই ঋণ লেখা থাকে শহীদের রক্তে, নির্যাতিত মায়ের চোখের জলে, উদ্বাস্তু মানুষের শূন্য হাতে। এই ঋণ শোধ করার একমাত্র উপায় ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণ।
পাঁচ দশকের বেশি সময় পেরিয়ে আজও সেই ঋণের হিসাব আমাদের পিছু ছাড়ে না। বিজয় দিবস এলেই প্রশ্ন ফিরে আসে-আমরা কি সেই দায় ঠিকভাবে পালন করেছি? স্বাধীনতা কি কেবল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, নাকি মানুষের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটেছে?
বিজয় মানে শুধু জাতীয় সংগীত গাওয়া বা পতাকা ওড়ানো নয়। বিজয় মানে এমন একটি সমাজ, যেখানে মানুষ ভিন্নমত প্রকাশ করতে ভয় পায় না; যেখানে দুর্বল মানুষ রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুরক্ষা পায়; যেখানে ক্ষমতা মানুষের জন্য, মানুষ ক্ষমতার জন্য নয়। এই মানদণ্ডে দাঁড়িয়ে আমাদের আত্মসমালোচনা জরুরি।
বিজয়কে যদি আমরা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দি করি, তবে তা ধীরে ধীরে অর্থহীন হয়ে পড়ে। ইতিহাস তখন জীবন্ত শিক্ষা না হয়ে স্মৃতিস্তম্ভে রূপ নেয়। আর স্মৃতিস্তম্ভ কথা বলে না, প্রশ্ন তোলে না। অথচ মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল-অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, নীরবতার বিরুদ্ধে।
আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে বিজয়ের অর্থ নতুন করে ভাবতে হয়। উন্নয়ন, অবকাঠামো, প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ কতা জায়গা পাচ্ছে-এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যে রাষ্ট্র মানুষকে বাদ দিয়ে এগোয়, তার বিজয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
বিজয় দিবস তাই শুধু গর্বের দিন নয়, দায়ের দিন। এই দিন আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করে-আমরা কি ইতিহাসের সঙ্গে সৎ? আমরা কি আমাদের নতুন প্রজন্মকে কেবল গল্প শোনাচ্ছি, নাকি দায়িত্ববোধ শেখাচ্ছি?
লাল-সবুজ পতাকা তাই কেবল উৎসবের প্রতীক নয়। এটি একটি নীরব অঙ্গীকার। অঙ্গীকার-ইতিহাস বিকৃত করব না, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না। পথ কঠিন হলেও মানবিকতার দিকেই হাঁটব।
বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য আজও আকাশে ওঠে। তার আলো আমাদের উষ্ণ করে, আবার বিব্রতও করে। কারণ সেই আলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়-এই স্বাধীনতা চিরস্থায়ী নয়, যদি আমরা তার দায় বহন না করি।
১৬ ডিসেম্বর শেষ পর্যন্ত একটি দিনের নাম নয়। এটি একটি চলমান দায়িত্ব। প্রতিদিনের সিদ্ধান্তে, আচরণে, ন্যায়বোধে সেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। শহীদের প্রতি সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধা কোনো ফুল নয়-বরং একটি ন্যায্য, মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার অবিরাম চেষ্টা।
[লেখক: সভাপতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ফকর উদ্দিন মানিক
মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের বিজয় কোনো হঠাৎ পাওয়া সুখবর ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘ সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি। ১৯৭১ সালের আগে বাঙালির জীবন ছিল পরিসংখ্যানের বাইরে-অবমূল্যায়িত, অবহেলিত, শোষিত। ভাষা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা দিয়ে যে অন্যায় শুরু হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে রূপ নেয় রাজনৈতিক বঞ্চনায়, অর্থনৈতিক বৈষম্যে এবং সাংস্কৃতিক দমনে। একসময় স্পষ্ট হয়ে যায়-এই অবস্থা মেনে নেওয়া মানে অস্তিত্ব হারানো।
১৯৭১ সাল তাই কেবল একটি বছর নয়, এটি ছিল একটি জাতির আত্মপ্রকাশের মুহূর্ত। সেই নয় মাসে বাংলাদেশ রূপ নেয় এক বিশাল মানবযুদ্ধে। অস্ত্র হাতে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন যারা অস্ত্র ধরেননি। কেউ আশ্রয় দিয়েছেন, কেউ খাবার জুগিয়েছেন, কেউ আহতদের সেবা করেছেন, কেউ নির্যাতনের মধ্যেও মাথা নত করেননি। এই সম্মিলিত প্রতিরোধই জন্ম দিয়েছিল বিজয়ের।
বিজয় এসেছিল। পরাজিত হয়েছিল একটি সামরিক শক্তি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা-পরাজিত হয়েছিল ভয়। আকাশে উড়েছিল লাল-সবুজ পতাকা, কিন্তু সেই পতাকা উঠেছিল অসংখ্য অদেখা কবরের ওপর দাঁড়িয়ে। তাই বিজয়ের মুহূর্তে উল্লাসের পাশাপাশি ছিল কান্না। আনন্দের সঙ্গে মিশে ছিল শূন্যতার দীর্ঘশ্বাস। অনেকেই জানতেন-এই বিজয়ের দাম তারা আজীবন শোধ করতে পারবেন না।
এই বিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-এটি ছিল মানুষের মর্যাদার বিজয়। স্বাধীনতা মানে কেবল ভৌগোলিক সীমানা নয়, এটি মানুষের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। নিজের ভাষায় কথা বলা, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করা, নিজের ভবিষ্যৎ নিজে নির্ধারণ করার সাহস-এসবই ছিল স্বাধীনতার মূল সুর।
কিন্তু বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় আরেকটি অধ্যায়-ঋণের অধ্যায়। এই ঋণ কোনো আর্থিক হিসাবের খাতায় লেখা থাকে না। এই ঋণ লেখা থাকে শহীদের রক্তে, নির্যাতিত মায়ের চোখের জলে, উদ্বাস্তু মানুষের শূন্য হাতে। এই ঋণ শোধ করার একমাত্র উপায় ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণ।
পাঁচ দশকের বেশি সময় পেরিয়ে আজও সেই ঋণের হিসাব আমাদের পিছু ছাড়ে না। বিজয় দিবস এলেই প্রশ্ন ফিরে আসে-আমরা কি সেই দায় ঠিকভাবে পালন করেছি? স্বাধীনতা কি কেবল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, নাকি মানুষের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটেছে?
বিজয় মানে শুধু জাতীয় সংগীত গাওয়া বা পতাকা ওড়ানো নয়। বিজয় মানে এমন একটি সমাজ, যেখানে মানুষ ভিন্নমত প্রকাশ করতে ভয় পায় না; যেখানে দুর্বল মানুষ রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুরক্ষা পায়; যেখানে ক্ষমতা মানুষের জন্য, মানুষ ক্ষমতার জন্য নয়। এই মানদণ্ডে দাঁড়িয়ে আমাদের আত্মসমালোচনা জরুরি।
বিজয়কে যদি আমরা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দি করি, তবে তা ধীরে ধীরে অর্থহীন হয়ে পড়ে। ইতিহাস তখন জীবন্ত শিক্ষা না হয়ে স্মৃতিস্তম্ভে রূপ নেয়। আর স্মৃতিস্তম্ভ কথা বলে না, প্রশ্ন তোলে না। অথচ মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল-অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, নীরবতার বিরুদ্ধে।
আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে বিজয়ের অর্থ নতুন করে ভাবতে হয়। উন্নয়ন, অবকাঠামো, প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ কতা জায়গা পাচ্ছে-এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যে রাষ্ট্র মানুষকে বাদ দিয়ে এগোয়, তার বিজয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
বিজয় দিবস তাই শুধু গর্বের দিন নয়, দায়ের দিন। এই দিন আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করে-আমরা কি ইতিহাসের সঙ্গে সৎ? আমরা কি আমাদের নতুন প্রজন্মকে কেবল গল্প শোনাচ্ছি, নাকি দায়িত্ববোধ শেখাচ্ছি?
লাল-সবুজ পতাকা তাই কেবল উৎসবের প্রতীক নয়। এটি একটি নীরব অঙ্গীকার। অঙ্গীকার-ইতিহাস বিকৃত করব না, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না। পথ কঠিন হলেও মানবিকতার দিকেই হাঁটব।
বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য আজও আকাশে ওঠে। তার আলো আমাদের উষ্ণ করে, আবার বিব্রতও করে। কারণ সেই আলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়-এই স্বাধীনতা চিরস্থায়ী নয়, যদি আমরা তার দায় বহন না করি।
১৬ ডিসেম্বর শেষ পর্যন্ত একটি দিনের নাম নয়। এটি একটি চলমান দায়িত্ব। প্রতিদিনের সিদ্ধান্তে, আচরণে, ন্যায়বোধে সেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। শহীদের প্রতি সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধা কোনো ফুল নয়-বরং একটি ন্যায্য, মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার অবিরাম চেষ্টা।
[লেখক: সভাপতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]