আনোয়ারুল হক
অবশেষে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। সে অনুযায়ী ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ ঘোষণা নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে কিছুটা আশ্বস্ত করলেও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ কাটছে না। একটি জাতীয় দৈনিকের জরিপ অনুযায়ী দেশের ৫০ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে বলে আশাবাদী।
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জুলাই সনদ’, সংস্কার আর বিচারের বাগাড়ম্বরের মধ্যে এই গত নভেম্বর মাসেই দেশে ৭২টি রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন নয়জন এবং আহত হয়েছেন ৭২৪ জন। অক্টোবর মাসেও ৪৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৫৪৭ জন আহত ও দুজন নিহত হয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশে মব সহিংসতাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ২৫৬টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ধরনের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে এবং নির্বাচনের আগেই নির্বাচনী প্রার্থীর ওপর যদি এমন ভয়াবহ হামলা হয় তবে নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কি হতে পারে ভেবে মানুষ রীতিমতো আতঙ্কিত। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনটা কোন দিক দিয়ে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হবে?
আর বাকি প্রায় ৫০ শতাংশ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে কিনা এ বিষয়ে সন্দিহান। আওয়ামী লীগ দলটির মধ্যে কোনো অনুশোচনা না থাকলেও ঐ জরিপেরই ফলাফলে জানা যায় দেশের প্রায় ৭০% শতাংশ মানুষ চায় শর্তহীন ও শর্তযুক্তভাবে হলেও আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকা উচিত। ৭০ শতাংশ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে, প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের মনে এখনি নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ জাগ্রত করে মুহাম্মদ ইউনূস কীভাবে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন করবেন?
তবে আমার মনে জাগছে অন্য প্রশ্ন? এই নির্বাচনটা এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৪ সনের ১২ ফেব্রুয়ারি হলে সমস্যা কী ছিলো? অন্তর্বর্তী সরকার অতিরিক্ত এক বছর সময় লেফট-রাইট করে চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিনী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিদেশী কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার কাজে অগ্রগতি সাধন ছাড়া আর কী এমন অর্জন করলেন? ঐকমত্য কমিশনের নামে ‘সংস্কার সংস্কার’ জপ করেও রাজনৈতিক দলসমূহকে ঐকমত্যে আনতে পারেননি। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। সারাদেশে খুন, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, দখলদারি বেড়েই চলেছে। খোদ রাজধানী শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রকাশ্য দিবালোকে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চ নামক একটি সংগঠনের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জুলাই সনদ’, সংস্কার আর বিচারের বাগাড়ম্বরের মধ্যে এই গত নভেম্বর মাসেই দেশে ৭২টি রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন নয়জন এবং আহত হয়েছেন ৭২৪ জন। অক্টোবর মাসেও ৪৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৫৪৭ জন আহত ও দুজন নিহত হয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশে মব সহিংসতাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ২৫৬টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ধরনের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে এবং নির্বাচনের আগেই নির্বাচনী প্রার্থীর ওপর যদি এমন ভয়াবহ হামলা হয় তবে নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কি হতে পারে ভেবে মানুষ রীতিমতো আতঙ্কিত। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনটা কোন দিক দিয়ে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হবে?
সবচেয়ে আফসোসের বিষয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি, যেটা ছিলো সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন এবং সবচেয়ে কাক্সিক্ষত। মানুষের মাঝে যে সংস্কারের আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়েছিলো তা মোটা দাগে এমনটাই যে, দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, মানুষ স্বাধীনভাবে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে,ব্যালটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে কারা সরকার পরিচালনা করবে, বিরোধী দলের কন্ঠস্বরকে দমন করা হবে না, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে, প্রশাসন, পুলিশ দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকবে, রাজনৈতিক দলগুলো পরিবারতন্ত্র মুক্ত হবে, অর্থনীতিতে অবাধ লুন্ঠন ও শোষণ- বৈষম্যের অবসান হবে। এ ধরনের সংস্কার কার্যকর করার জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ভাড়া করার এবং সংবিধানের মূলনীতি সমূহ পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার উল্লেখিত মোটা দাগের সংস্কারে অগ্রসর না হয়ে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ বিরোধী উগ্র ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি এবং সাম্প্রদায়িক নানা বিভাজনের শক্তিকে ‘সংস্কার সংলাপের’ মাধ্যমে রাজনৈতিক অংগনের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। ফলে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে যা অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতিতে কিভাবে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হবে?
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আগের দিন টেলিভিশন ও পত্রিকার অনলাইন সংবাদে দেশের নির্বাহী প্রধানের একেবারে পাশের চেয়ারে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মূল দোসর জামায়াত ইসলাম দলের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ারকে দেখা গেলো। আর পরদিনই আলোচনা সভায় সেক্রেটারি জেনারেল বললেন ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয়রা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। নিজ দলের কৃতকর্ম এবং অপরাধকে আড়াল করে জামাত ও তার অনুসারীরা বিভিন্ন স্থানে এমন সব বক্তব্য দিচ্ছেন যা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাকে বিকৃত করছে এবং সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। হত্যাকারীদের উত্তরসূরিরা নতুন জমানায় উদোরপিন্ডি বুধোর ওপর চাপানোর সুযোগ পাচ্ছে। আবার জামায়াত ইসলাম দলে স্বাগত জানালো হলো অতি বিতর্কিত এবং একটি দল থেকে পাঁচবার বহিষ্কৃত, ভারসাম্যহীন এক অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে। অন্যদিকে নব্য জামায়াত নেতা কৃষ্ণ নন্দী বক্তৃতা দিয়ে মাঠ গরম করছেন এই বলে যে, জামায়াতে ইসলাম একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল। হরেকৃষ্ণ হরিবল, দাড়ি পাল্লা টেনে তোল! কী রাজনীতি শুরু হলো দেশে?
ক’দিন আগে জামায়াতের শুরা সদস্য চট্টগ্রামের শাহজাহান চৌধুরী ‘নবুয়ত লাভ’ করে পুলিশ প্রশাসনকে তার কথামত উঠতে বসতে হবে বলায় দলীয় নোটিশ পাওয়ার পরও বলেছেন, ‘খবরদার, খবরদার; আমি শাহজাহান চৌধুরী। আমাকে যারা চিনে না, তারা এখনো মাটির নিচে বসবাস করে...। সূর্য আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে’। আবার জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ার বলছেন, যারা জামায়াত করেন না, তাদেরকে দাঁড়ি পাল্লা প্রতীক বানানোর টাকা দিতে হবে। সাতক্ষীরায় জামায়াতে ইসলামীর এক প্রার্থীর নির্বাচনি পথসভায় পুলিশের পোশাক পরে এএসআই (সশস্ত্র) মহিবুল্লাহ কারী নামক একজন পুলিশ কর্মকর্তার ভাষণ দেয়ার ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউনূস সরকারের আমলে এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই দেশবাসী দেখছে!
এদিকে বিএনপিও কম কিসে? চৌদ্দগ্রামে স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. ওয়াহিদুর রহমান বক্তৃতা দিয়ে বলছেন, আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব - এই শ্লোগান চৌদ্দগ্রামে বাস্তবায়ন হতে দেবো না’। গাজীপুরের শ্রীপুরে রাস্তা নির্মাণের অনিয়মের অভিযোগের তথ্য জানতে ঘটনাস্থলে যাওয়ায় এক সাংবাদিককে স্থানীয় বিএনপি নেতা নুরে আলম হুমকি দিলেন, ‘এলাকায় ঢুকলে ঠেঙের নালা ভাইঙ্গালাম’। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শাখার সভাপতি কামরুল হুদা বলেছেন ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নাম প্রতিদিন নিলে বেহেশত নিশ্চিত’। অন্যদিকে কুমিল্লা মহানগর বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, হজরত উমর (রা.) এর পর সৎ-দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। জিয়া পুত্র তারেক রহমানের নাম উচ্চারণ করতে হলে ওজু করবেন। বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় প্রবীণ রাজনীতিক মীর্জা আব্বাসইবা পিছিয়ে থাকবেন কেনো? ক’দিন আগে তিনি বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে ইসরায়েল গাজা আক্রমণের সাহসই পেত না। ইউনূস আমলে রাজনীতিকরা কী ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন!
আশাজাগানিয়া তরুণদের দল সবচেয়ে বেশী হতাশ করেছে মানুষকে। এই দলের নেতৃত্বের একটা অংশ মুখে ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আওয়াজ আর অন্তরে ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী প্রবণতার ধারক হওয়ায় এবং তাদের কারণে দেশজুড়ে ‘মব জাস্টিস’ আর ‘মবোল্লাসের সংস্কৃতি’ আধিপত্য বিস্তার করায় জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরের মধ্যেই তাদের পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। ইউনূস যে ছাত্রনেতৃত্ব নিয়ে দুনিয়া জুড়ে এত মাতামাতি করলেন, সেই নেতৃত্ব যে রাজনৈতিক দল গড়ে তুললেন তা জনগণের আস্থা অর্জনের বদলে দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হলো। কিছুদিন আগেও নানা জরিপে বলা হচ্ছিল এনসিপির প্রতি ৫% মানুষের সমর্থন আছে, বর্তমান জরিপে তা ১%-এর নীচে নেমে গেছে। ভোট যতো এগিয়ে আসবে তা কমবে বই বাড়বে বলে মনে হয় না। চব্বিশের জুলাই এর পরে মনে হয়েছিল এই তরুণ নেতৃত্ব হয়তো সুবিধাবাদের শৃঙ্খল এবং পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে বের হবেন। কিন্তু দিনশেষে তারাও সুবিধালাভের রাজনীতিই করছেন। ক্ষমতার অংশীদারিত্বের জন্য কখনো জামাত, কখনো বিএনপি, কখনো উভয় দলেরই একত্রে সমর্থন এবং অতি অবশ্যই স্টাবলিশমেন্টের সমর্থনের জন্য তারা মরিয়া। নীতি, আদর্শ, রাজনীতি সবই তুচ্ছ। তরুণ নেতৃত্ব কি কখনো ভেবে দেখেছেন কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আস্থা তারা হারালেন এবং কীভাবে তারা সারা দেশের ছাত্র সমাজ ও জনগণ থেকে এতটা দূরে সরে গেলেন? লাশের বদলা লাশ, চোখের বদলে চোখ - এ ভাবে নিজ হাতে আইন তুলে নেয়ার যে সব হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে তা কি বিপ্লবী হতাশার ভিন্ন রূপ?
উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে বা গণভোট করে সংস্কার হয় না, হবেও না। ইউনূস সরকার গত দেড় বছরে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ছাড়া দেশের বুকে এমন কোনো আবহ সৃষ্টি করতে পারেননি যাতে করে রাজনীতিতে নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়। ‘নতুন বন্দোবস্ত’ কথার কথা হিসেবেই থেকে গেছে। আর এখন চারিদিকে শুধু নমিনেশনের জন্য হাহাকার। যেন নির্বাচনে না দাঁড়াতে পারলে বা সংসদ সদস্য হতে না পারলে জীবনটা বৃথা! এমনকি বিএনপির নতুন জোটসংগী বামপন্থী ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দাবীদার কয়েকটি দলের জোট নেতৃবৃন্দের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হওয়ার অসম্মানজনক আকুতি দেখে প্রবীণ রাজনীতিক রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুর আওয়ামী নমিনেশনের জন্য হাহাকার পরিস্থিতির কথা মনে পড়ছে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে একটি নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু নতুন বন্দোবস্ত তো দূরের কথা, নির্বাচনী গণতন্ত্র কতটা ফিরবে, কতটা থিতু হবে বলা মুশকিল। নির্বাচনকে ঘিরে, ভবিষ্যৎ ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে পর্দার অন্তরালে দেশী বিদেশী নানা মহলের কূটকৌশল থাকাও অস্বাভাবিক নয়। নির্বাচনের পরেও যদি মানুষের মাঝে পূর্বের ন্যায় ধারণা হয় যে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি, তা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে থাকবে।
এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে জাতি স্বাধীনতার বিজয়ের ৫৪ বছর পূর্তির বিজয় দিবস উদযাপন করছে। বিজয়টা কার বিরুদ্ধে ছিল? বিজয় হয়েছিলো হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর জামায়াত ইসলাম, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। বিজয় এসেছিল দেশের অগণিত সেরা বুদ্ধিজীবীসহ লাখো লাখো শহীদের রক্ত আর লাখো মা বোনের ত্যাগের বিনিময়ে। জাতির সেই বিজয় পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পরাজিত শক্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের সকল গৌরবগাথাকে দলীয় ও পারিবারিক অর্জন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের নামে দেশে স্বৈরশাসন ও অবাধ লুটপাটের অর্থনীতি কায়েম করে মুক্তিযুদ্ধকে পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তো শুধু নয় মাসের যুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধ গড়ে উঠেছে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, ভাষা সংগ্রাম, ছয় দফার সংগ্রাম, ঐতিহাসিক ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। আর সেসব সংগ্রামের নায়ক বাংলাদেশের জনগণ। নেতৃত্ব দিয়েছেন শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মনি সিং, মোজাফ্ফর সহ দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দ। ১৯৭০ এর নির্বাচনে জনতার অবিস্মরণীয় রায় নিয়ে আর ৭ই মার্চের অংগুলি হেলনে, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার নেতা। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে মেজর জিয়া দেশবাসীকে আশ্বস্ত করলেন, ভরসা যোগালেন যে বাঙালি সেনাবাহিনী, রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনীও রয়েছে সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রামে। মুজিব নগরে গঠিত হলো সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার। গঠিত হলো ভাসানী, মোজাফ্ফর, মনি সিংহ সহ বিপ্লবী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। অতঃপর নয় মাসের জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আর বামপন্থী আন্দোলনের সমন্বয়ে দীর্ঘ ২৫ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান আর তারুণ্যের জুলাই জাগরণের বাংলাদেশের সমাজে এক অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে। জুলাই সাফল্য ভুল হাতে পড়লেও সমাজে বিরাজমান সেই অন্তর্নিহিত শক্তি অন্ধকারকে পরাভূত করে দেশবাসীকে এক মুক্ত মানবিক সাম্েযর সমাজ গড়ার পথ দেখাবে। প্রহর গুনি সে আশাতেই!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
আনোয়ারুল হক
বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
অবশেষে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। সে অনুযায়ী ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ ঘোষণা নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে কিছুটা আশ্বস্ত করলেও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ কাটছে না। একটি জাতীয় দৈনিকের জরিপ অনুযায়ী দেশের ৫০ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে বলে আশাবাদী।
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জুলাই সনদ’, সংস্কার আর বিচারের বাগাড়ম্বরের মধ্যে এই গত নভেম্বর মাসেই দেশে ৭২টি রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন নয়জন এবং আহত হয়েছেন ৭২৪ জন। অক্টোবর মাসেও ৪৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৫৪৭ জন আহত ও দুজন নিহত হয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশে মব সহিংসতাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ২৫৬টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ধরনের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে এবং নির্বাচনের আগেই নির্বাচনী প্রার্থীর ওপর যদি এমন ভয়াবহ হামলা হয় তবে নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কি হতে পারে ভেবে মানুষ রীতিমতো আতঙ্কিত। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনটা কোন দিক দিয়ে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হবে?
আর বাকি প্রায় ৫০ শতাংশ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে কিনা এ বিষয়ে সন্দিহান। আওয়ামী লীগ দলটির মধ্যে কোনো অনুশোচনা না থাকলেও ঐ জরিপেরই ফলাফলে জানা যায় দেশের প্রায় ৭০% শতাংশ মানুষ চায় শর্তহীন ও শর্তযুক্তভাবে হলেও আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকা উচিত। ৭০ শতাংশ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে, প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের মনে এখনি নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ জাগ্রত করে মুহাম্মদ ইউনূস কীভাবে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন করবেন?
তবে আমার মনে জাগছে অন্য প্রশ্ন? এই নির্বাচনটা এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৪ সনের ১২ ফেব্রুয়ারি হলে সমস্যা কী ছিলো? অন্তর্বর্তী সরকার অতিরিক্ত এক বছর সময় লেফট-রাইট করে চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিনী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিদেশী কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার কাজে অগ্রগতি সাধন ছাড়া আর কী এমন অর্জন করলেন? ঐকমত্য কমিশনের নামে ‘সংস্কার সংস্কার’ জপ করেও রাজনৈতিক দলসমূহকে ঐকমত্যে আনতে পারেননি। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। সারাদেশে খুন, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, দখলদারি বেড়েই চলেছে। খোদ রাজধানী শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রকাশ্য দিবালোকে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চ নামক একটি সংগঠনের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জুলাই সনদ’, সংস্কার আর বিচারের বাগাড়ম্বরের মধ্যে এই গত নভেম্বর মাসেই দেশে ৭২টি রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন নয়জন এবং আহত হয়েছেন ৭২৪ জন। অক্টোবর মাসেও ৪৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৫৪৭ জন আহত ও দুজন নিহত হয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশে মব সহিংসতাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ২৫৬টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ধরনের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে এবং নির্বাচনের আগেই নির্বাচনী প্রার্থীর ওপর যদি এমন ভয়াবহ হামলা হয় তবে নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কি হতে পারে ভেবে মানুষ রীতিমতো আতঙ্কিত। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনটা কোন দিক দিয়ে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হবে?
সবচেয়ে আফসোসের বিষয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি, যেটা ছিলো সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন এবং সবচেয়ে কাক্সিক্ষত। মানুষের মাঝে যে সংস্কারের আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়েছিলো তা মোটা দাগে এমনটাই যে, দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, মানুষ স্বাধীনভাবে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে,ব্যালটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে কারা সরকার পরিচালনা করবে, বিরোধী দলের কন্ঠস্বরকে দমন করা হবে না, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে, প্রশাসন, পুলিশ দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকবে, রাজনৈতিক দলগুলো পরিবারতন্ত্র মুক্ত হবে, অর্থনীতিতে অবাধ লুন্ঠন ও শোষণ- বৈষম্যের অবসান হবে। এ ধরনের সংস্কার কার্যকর করার জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ভাড়া করার এবং সংবিধানের মূলনীতি সমূহ পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার উল্লেখিত মোটা দাগের সংস্কারে অগ্রসর না হয়ে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ বিরোধী উগ্র ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি এবং সাম্প্রদায়িক নানা বিভাজনের শক্তিকে ‘সংস্কার সংলাপের’ মাধ্যমে রাজনৈতিক অংগনের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। ফলে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে যা অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতিতে কিভাবে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হবে?
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আগের দিন টেলিভিশন ও পত্রিকার অনলাইন সংবাদে দেশের নির্বাহী প্রধানের একেবারে পাশের চেয়ারে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মূল দোসর জামায়াত ইসলাম দলের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ারকে দেখা গেলো। আর পরদিনই আলোচনা সভায় সেক্রেটারি জেনারেল বললেন ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয়রা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। নিজ দলের কৃতকর্ম এবং অপরাধকে আড়াল করে জামাত ও তার অনুসারীরা বিভিন্ন স্থানে এমন সব বক্তব্য দিচ্ছেন যা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাকে বিকৃত করছে এবং সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। হত্যাকারীদের উত্তরসূরিরা নতুন জমানায় উদোরপিন্ডি বুধোর ওপর চাপানোর সুযোগ পাচ্ছে। আবার জামায়াত ইসলাম দলে স্বাগত জানালো হলো অতি বিতর্কিত এবং একটি দল থেকে পাঁচবার বহিষ্কৃত, ভারসাম্যহীন এক অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে। অন্যদিকে নব্য জামায়াত নেতা কৃষ্ণ নন্দী বক্তৃতা দিয়ে মাঠ গরম করছেন এই বলে যে, জামায়াতে ইসলাম একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল। হরেকৃষ্ণ হরিবল, দাড়ি পাল্লা টেনে তোল! কী রাজনীতি শুরু হলো দেশে?
ক’দিন আগে জামায়াতের শুরা সদস্য চট্টগ্রামের শাহজাহান চৌধুরী ‘নবুয়ত লাভ’ করে পুলিশ প্রশাসনকে তার কথামত উঠতে বসতে হবে বলায় দলীয় নোটিশ পাওয়ার পরও বলেছেন, ‘খবরদার, খবরদার; আমি শাহজাহান চৌধুরী। আমাকে যারা চিনে না, তারা এখনো মাটির নিচে বসবাস করে...। সূর্য আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে’। আবার জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ার বলছেন, যারা জামায়াত করেন না, তাদেরকে দাঁড়ি পাল্লা প্রতীক বানানোর টাকা দিতে হবে। সাতক্ষীরায় জামায়াতে ইসলামীর এক প্রার্থীর নির্বাচনি পথসভায় পুলিশের পোশাক পরে এএসআই (সশস্ত্র) মহিবুল্লাহ কারী নামক একজন পুলিশ কর্মকর্তার ভাষণ দেয়ার ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউনূস সরকারের আমলে এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই দেশবাসী দেখছে!
এদিকে বিএনপিও কম কিসে? চৌদ্দগ্রামে স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. ওয়াহিদুর রহমান বক্তৃতা দিয়ে বলছেন, আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব - এই শ্লোগান চৌদ্দগ্রামে বাস্তবায়ন হতে দেবো না’। গাজীপুরের শ্রীপুরে রাস্তা নির্মাণের অনিয়মের অভিযোগের তথ্য জানতে ঘটনাস্থলে যাওয়ায় এক সাংবাদিককে স্থানীয় বিএনপি নেতা নুরে আলম হুমকি দিলেন, ‘এলাকায় ঢুকলে ঠেঙের নালা ভাইঙ্গালাম’। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শাখার সভাপতি কামরুল হুদা বলেছেন ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নাম প্রতিদিন নিলে বেহেশত নিশ্চিত’। অন্যদিকে কুমিল্লা মহানগর বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, হজরত উমর (রা.) এর পর সৎ-দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। জিয়া পুত্র তারেক রহমানের নাম উচ্চারণ করতে হলে ওজু করবেন। বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় প্রবীণ রাজনীতিক মীর্জা আব্বাসইবা পিছিয়ে থাকবেন কেনো? ক’দিন আগে তিনি বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে ইসরায়েল গাজা আক্রমণের সাহসই পেত না। ইউনূস আমলে রাজনীতিকরা কী ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন!
আশাজাগানিয়া তরুণদের দল সবচেয়ে বেশী হতাশ করেছে মানুষকে। এই দলের নেতৃত্বের একটা অংশ মুখে ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আওয়াজ আর অন্তরে ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী প্রবণতার ধারক হওয়ায় এবং তাদের কারণে দেশজুড়ে ‘মব জাস্টিস’ আর ‘মবোল্লাসের সংস্কৃতি’ আধিপত্য বিস্তার করায় জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরের মধ্যেই তাদের পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। ইউনূস যে ছাত্রনেতৃত্ব নিয়ে দুনিয়া জুড়ে এত মাতামাতি করলেন, সেই নেতৃত্ব যে রাজনৈতিক দল গড়ে তুললেন তা জনগণের আস্থা অর্জনের বদলে দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হলো। কিছুদিন আগেও নানা জরিপে বলা হচ্ছিল এনসিপির প্রতি ৫% মানুষের সমর্থন আছে, বর্তমান জরিপে তা ১%-এর নীচে নেমে গেছে। ভোট যতো এগিয়ে আসবে তা কমবে বই বাড়বে বলে মনে হয় না। চব্বিশের জুলাই এর পরে মনে হয়েছিল এই তরুণ নেতৃত্ব হয়তো সুবিধাবাদের শৃঙ্খল এবং পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে বের হবেন। কিন্তু দিনশেষে তারাও সুবিধালাভের রাজনীতিই করছেন। ক্ষমতার অংশীদারিত্বের জন্য কখনো জামাত, কখনো বিএনপি, কখনো উভয় দলেরই একত্রে সমর্থন এবং অতি অবশ্যই স্টাবলিশমেন্টের সমর্থনের জন্য তারা মরিয়া। নীতি, আদর্শ, রাজনীতি সবই তুচ্ছ। তরুণ নেতৃত্ব কি কখনো ভেবে দেখেছেন কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আস্থা তারা হারালেন এবং কীভাবে তারা সারা দেশের ছাত্র সমাজ ও জনগণ থেকে এতটা দূরে সরে গেলেন? লাশের বদলা লাশ, চোখের বদলে চোখ - এ ভাবে নিজ হাতে আইন তুলে নেয়ার যে সব হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে তা কি বিপ্লবী হতাশার ভিন্ন রূপ?
উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে বা গণভোট করে সংস্কার হয় না, হবেও না। ইউনূস সরকার গত দেড় বছরে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ছাড়া দেশের বুকে এমন কোনো আবহ সৃষ্টি করতে পারেননি যাতে করে রাজনীতিতে নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়। ‘নতুন বন্দোবস্ত’ কথার কথা হিসেবেই থেকে গেছে। আর এখন চারিদিকে শুধু নমিনেশনের জন্য হাহাকার। যেন নির্বাচনে না দাঁড়াতে পারলে বা সংসদ সদস্য হতে না পারলে জীবনটা বৃথা! এমনকি বিএনপির নতুন জোটসংগী বামপন্থী ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দাবীদার কয়েকটি দলের জোট নেতৃবৃন্দের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হওয়ার অসম্মানজনক আকুতি দেখে প্রবীণ রাজনীতিক রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুর আওয়ামী নমিনেশনের জন্য হাহাকার পরিস্থিতির কথা মনে পড়ছে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে একটি নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু নতুন বন্দোবস্ত তো দূরের কথা, নির্বাচনী গণতন্ত্র কতটা ফিরবে, কতটা থিতু হবে বলা মুশকিল। নির্বাচনকে ঘিরে, ভবিষ্যৎ ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে পর্দার অন্তরালে দেশী বিদেশী নানা মহলের কূটকৌশল থাকাও অস্বাভাবিক নয়। নির্বাচনের পরেও যদি মানুষের মাঝে পূর্বের ন্যায় ধারণা হয় যে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি, তা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে থাকবে।
এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে জাতি স্বাধীনতার বিজয়ের ৫৪ বছর পূর্তির বিজয় দিবস উদযাপন করছে। বিজয়টা কার বিরুদ্ধে ছিল? বিজয় হয়েছিলো হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর জামায়াত ইসলাম, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। বিজয় এসেছিল দেশের অগণিত সেরা বুদ্ধিজীবীসহ লাখো লাখো শহীদের রক্ত আর লাখো মা বোনের ত্যাগের বিনিময়ে। জাতির সেই বিজয় পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পরাজিত শক্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের সকল গৌরবগাথাকে দলীয় ও পারিবারিক অর্জন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের নামে দেশে স্বৈরশাসন ও অবাধ লুটপাটের অর্থনীতি কায়েম করে মুক্তিযুদ্ধকে পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তো শুধু নয় মাসের যুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধ গড়ে উঠেছে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, ভাষা সংগ্রাম, ছয় দফার সংগ্রাম, ঐতিহাসিক ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। আর সেসব সংগ্রামের নায়ক বাংলাদেশের জনগণ। নেতৃত্ব দিয়েছেন শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মনি সিং, মোজাফ্ফর সহ দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দ। ১৯৭০ এর নির্বাচনে জনতার অবিস্মরণীয় রায় নিয়ে আর ৭ই মার্চের অংগুলি হেলনে, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার নেতা। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে মেজর জিয়া দেশবাসীকে আশ্বস্ত করলেন, ভরসা যোগালেন যে বাঙালি সেনাবাহিনী, রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনীও রয়েছে সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রামে। মুজিব নগরে গঠিত হলো সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার। গঠিত হলো ভাসানী, মোজাফ্ফর, মনি সিংহ সহ বিপ্লবী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। অতঃপর নয় মাসের জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আর বামপন্থী আন্দোলনের সমন্বয়ে দীর্ঘ ২৫ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান আর তারুণ্যের জুলাই জাগরণের বাংলাদেশের সমাজে এক অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে। জুলাই সাফল্য ভুল হাতে পড়লেও সমাজে বিরাজমান সেই অন্তর্নিহিত শক্তি অন্ধকারকে পরাভূত করে দেশবাসীকে এক মুক্ত মানবিক সাম্েযর সমাজ গড়ার পথ দেখাবে। প্রহর গুনি সে আশাতেই!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]