alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

সৈয়দ আমিরুজ্জামান

: বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫

(পূর্বপ্রকাশের পর)

পাকিস্তানি দালাল গোষ্ঠী, মানে রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর, আল শামস সকলের মন মানসিকতার সাথে আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তানি শাসকচক্রের চরম মিল বিদ্যমান। তারাও সর্বত্র ভারতীয় হিন্দু এবং দেশীয় হিন্দুদের ষড়যন্ত্র খুঁজে পেত। মনে রাখা প্রয়োজন, পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলমান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল; কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানের জন্যে আন্দোলন করেছিল তার সাথে বাস্তবতার বিরাট ফারাক দেখে এই বাঙালি মুসলমানের অধিকাংশই পাকিস্তান তত্ত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়।

অপরদিকে পাকিস্তান কায়েমের ফলে যারা ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন তারা নিজেদের স্বার্থেই ‘পাকিস্তান তত্ত্ব’কে আঁকড়ে ধরে রইলেন। ক্ষমতার স্বার্থের কারণেই জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মীয় দলগুলো পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে গণহত্যায় সাহায্য করে যেতে থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালের আমেরিকার গোপন নথি অনুযায়ী এই ইসলামী দলগুলো ছিল আমেরিকান মদদপুষ্ট। একাত্তরের শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীদের প্রতি এই দালাল-গোষ্ঠীর আক্রোশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মোহাম্মদপুরে শান্তি কমিটির এক সংশ্লিষ্ট কমিটি আগস্টের ৯ তারিখ যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করে তার মধ্যে একটা ছিল, ‘বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির কারণে বাঙালি সরকারি কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের ওপর ২৪ ঘণ্টা নজর রাখতে হবে (পরে তাদের সামরিক বিচার করে হত্যা করতে হবে)’।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব বাংলায় বাম রাজনীতির তৎপরতা ছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার জন্যে খুব বড় মাথাব্যথার কারণ। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘পেটে খাবার ও ইসলাম এই দুই জিনিস তাদের কমিউনিজম থেকে দূরে রাখবে’।

কমিউনিস্টদের তৎপরতা ঠেকাতে ১৯৫০ সালে আমেরিকা ‘পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট রুখতে একটি সমন্বিত কর্মসূচি’ নামে এক গোপন কর্মপন্থা হাতে নেয় যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল ‘কমিউনিস্ট প্রভাব দূরীভূত করা এবং পাকিস্তানের নতুন ভাবাদর্শের প্রতি সমর্থনসূচক একটি কর্মসূচি তৈরি করা’। গোপন সেই দলিলে বিভিন্ন রকমের টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ এবং তাদের কাজের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা আছে। সে টার্গেট-গ্রুপ থেকে শিক্ষাক্ষেত্র, শ্রমিক শ্রেণী, সেনাবাহিনী কিছুই বাদ ছিল না। নথিতে ‘বিশেষ প্রকল্প’ এর মধ্যে ছিল রেডিও, সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র এবং ধর্মীয় নেতা ও গ্রুপগুলো। ‘ধর্মীয় নেতা ও গ্রুপগুলো’ প্রকল্পে বলা আছে, ধর্মীয় মঞ্চ থেকে যাতে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণা চালানো যায় সে উদ্দেশ্যে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌছাতে হবে। এ ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য হবে এই কথা বোঝান, যেহেতু কমিউনিজম ধর্মবিরোধী, ফলে সে ইসলামবিরোধী।

উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনকেও আমেরিকা কমিউনিস্ট প্রভাবিত আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে।

কমিউনিস্টদেরকে শুরু থেকেই ইসলামের শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত করা হত। সেই সাথে পাকিস্তানি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের শিকল থেকে বের হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী উত্থানটাকে পাকিস্তানি শাসকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। যেমন ভারতের হিন্দু তেমনি স্থানীয় হিন্দুদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তোলা হয়। দাবি করা হয় যে, দেশভাগের সময় অনেক হিন্দু শিক্ষক দেশ ত্যাগ না করে থেকে যায় এবং এই শিক্ষকরাই পূর্ববাংলার মুসলমানকে প্রভাবিত করেন ও ছেলেমেয়েদের মনে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপণ করেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের প্রতি ছিল তাদের প্রবল আক্রোশ। রাও ফরমান আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি স্বাধীন দ্বীপের সাথে তুলনা করেছিলেন।

পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, যখনই কেউ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, তাকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে গালি দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তান আমলে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মূলত তিনটা ধারার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এক, পাকিস্তানবাদী ধারা, দুই, জাতীয়তাবাদী ধারা, এবং তিন, বামপন্থী ধারা। উল্লেখ্য, জাতীয়াতাবাদী ধারাকে ড রেজোয়ান সিদ্দিকী বলছেন ‘পূর্ব বাংলার স্বাতন্ত্র্য চেতনা ভিত্তিক মধ্যপন্থী ধারা’।

পাকিস্তানকালের সূচনাতে পাকিস্তানবাদী ধারাটা প্রবল ছিল, কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে এই ধারাটা জনগণ থেকে ততা বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এই ধারার বুদ্ধিজীবীরা আসলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পতাকাই বহন করে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ধারার আন্দোলন এবং বামপন্থী আন্দোলন – দুটোই মূলত পাকিস্তানি শাসক চক্রের বিরুদ্ধেই যাচ্ছিল। তাই এর সাথে সক্রিয় সদস্যদের প্রতি শাসকদের তীব্র ক্ষোভ জমা হওয়াটাও ছিল স্বাভাবিক। ১৯৭১-এর নয় মাস পাকিস্তান শাসক কর্তৃক বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পনামাফিক হত্যাকাণ্ডের এটাই ছিল মূল কারণ।

উল্লেখ্য, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থানও এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে লুকিয়ে থাকা আরেকটি কারণ।

পাকিস্তানিদের এই ক্রোধের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের পিছনে লুকিয়ে ছিল আরও একটা কারণ। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, যে কোন জাতির বিবেক জাগ্রত করার জন্যে যেমন প্রয়োজন বুদ্ধিজীবীর, তেমনি জাতিকে নির্জীব করার জন্যে প্রয়োজন বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দেয়া। যদি বাঙালিরা যুদ্ধে জিতেও যায় তবে যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেটাও ছিল তাদের বুদ্ধিজীবী নিধনের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাই পরাজয় যখন নিশ্চিত তখন শাসকচক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠে যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনায়। গ্রেফতারকৃত এক আলবদর দাবি করেছিল আরও কিছুদিন সময় পেলে সকল বুদ্ধিজীবীদেরকেই হত্যা করে ফেলা হত।

তবে, যুদ্ধের মাত্র ৫ বছরের মাথায় পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী এবং গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা লোকজনের রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠা প্রমাণ করে যে, জাতিকে মেধাশূন্য করার মাধ্যমে যে পরিকল্পনা তারা নিয়েছিল তা অনেকাংশে সফল হয়েছিল।

দায়ী কারা?

বলেছি যে, ২৫ শে মার্চ রাত থেকেই বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে অনেকেই দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন, আবার অনেকেই বিভিন্ন কারণেই থেকে যান আক্রান্ত ভূখণ্ডের মাঝেই। যেমন, জহির রায়হান যখন চলে যান দেশ ছেড়ে তখন শহীদুল্লাহ কায়সার বলেছিলেন, ‘ও সীমান্তে থাকবে। সেখানে ওর প্রকৃত কাজ আছে। আমার কাজ এখানে।’

তার কাজ কী ছিল এখানে?

‘বাংলাদেশের সব মানুষ কি ওপারে যেতে পারবে? পারবে না। যারা যেতে পারবে না, তারা প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকবে। আতঙ্কে রাত কাটাবে, বিনিদ্র রাত যাপন করবে। তাদের সে- যন্ত্রণার কথা লিখব আমি’।

আবার সিলেট মেডিকেল কলেজের প্রধান শল্যচিকিৎসক অধ্যাপক ডা: শামসুদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমরা ডাক্তার। রোগী ফেলে আহত মানুষ ফেলে আমরা তো কোথাও যেতে পারি না’।

তাকেও হত্যা করা হয়েছিল এপ্রিল মাসেই।

১৪ ডিসেম্বরের আগেও দেশে অবস্থানরত বুদ্ধিজীবী, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দমন নিপীড়ন করেছে। একাত্তরের জুন মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘আর্মির নির্দিষ্ট টার্গেট হল বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের জনমত গঠনকারী অংশ-চিকিৎসক, অধ্যাপক, ছাত্র ও লেখক’। এন্থনী মাসকারেনহাসও তার বিখ্যাত ‘রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে পাকিস্তানিদের ‘পরিকল্পিত গণহত্যা’র অংশ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বরে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তার মূল পরিকল্পনায় কারা ছিল? পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী একাত্তরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দফতরের পরিচালক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা রাও ফরমান আলীই সেই ব্যক্তি। কেননা ফরমান সেই ব্যক্তি যার উপর কর্তৃপক্ষের আস্থা ছিল সবচেয়ে বেশী। ফরমানই পারত নিঝুম নীরবতাকে প্রচণ্ড শক্তিশালী, সরব করে তুলতে। ফরমান হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আপনার বক্তব্য শুনবেন, যার চেহারায় ধরে রাখা আছে একটা বৈদগ্ধ্যের ছাপ’।

জেনারেল নিয়াজী বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা আমার কাছে কোন তাৎপর্যের অধিকারী ছিলেন না। আমার ছিল অস্ত্রধারী দুশমনদের নিয়েই মাথাব্যথা। তবে আলতাফ গওহর এ কথা উল্লেখ করেছেন যে, কেউ একজন আমাকে জানায় যে, ফরমানের কাছে বুদ্ধিজীবীর একটা তালিকা রয়েছে। আমি সেটার সত্যতা যাচাইয়ের করার জন্য কোন একজনকে পাঠাই আর তার অনুরোধে রাও ফরমান ঐ তালিকা থেকে দুটি নাম কেটে বাদ দেন। আমি বিষয়টা জানতাম না। আমি এটি আলতাফ গওহরের কাছ থেকে জেনেছি।’

পরাজয় যখন নিশ্চিত তখন শাসকচক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনায়।

এই দুই পাকিস্তানির অভিযোগই ফরমান আলীর দিকে যাচ্ছে; এবার তাই শোনা উচিৎ এই রাও ফরমান আলী এ বিষয়ে কি বলেন! ঢাকা পতনের পর গভর্নমেন্ট হাউসে যেসকল লিখিত দলিল পাওয়া যায় তন্মধ্যে ফরমান আলীর লেখা বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকাও ছিল। তালিকায় যাদের নাম ছিল অধিকাংশকেই ১৪ ডিসেম্বরের পর আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। আবার তাদের কাছে সঠিক ঠিকানা ছিলনা বলে অনেক শিক্ষক বেঁচেও গিয়েছিলেন। এই তালিকা সম্পর্কে ফরমান আলীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; জবাবে রাও উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ঐ সময় অনেকে আমার কাছে এসে নানা জনের কথা বলত। যাদের বিরুদ্ধে বলত তাদের নাম আমি শুধু টুকে রেখেছিলাম।’ কেন বলত? এই প্রশ্নের উত্তরে রাও জানাচ্ছেন, ‘কারণ, তারা ছিল পাকিস্তান বিরোধী। তাই ওদের ওসব আমি রেখে দিতাম বটে তবে সেগুলির ওপর একশন নিতাম না’।

তিনি নিজেই এই তালিকার কথা স্বীকার করে এটাও জানাচ্ছেন যে তালিকাভুক্তরা ছিল পাকিস্তান বিরোধী। যদিও তিনি হত্যাকাণ্ডের কথা কৌশলে অস্বীকার করছেন, তবে এটার সাথে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটা নিশ্চিন্তে বলা যায়। বাংলাপিডিয়াতে বলা আছে, পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর সার্বিক নির্দেশনায় নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার বশির, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হেজাজী, মেজর জহুর, মেজর আসলাম, ক্যাপ্টেন নাসির ও ক্যাপ্টেন কাইউম।

ফরমানের এই ছোট কথোপকথনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দালালদের কথা, যারা তার কাছে এসে অভিযোগ জানাত। দালাল বলতে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসকে বুঝানো হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আলবদর ছিল আক্ষরিক অর্থেই ডেথ স্কোয়াড। তারা সরাসরি মাঠে ময়দানে গিয়ে লড়েনি, বরং পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্গেট কিলিংই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তারাই ছিল সবচেয়ে বেশী তৎপর এবং এদের সাহায্যেই পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করেছে, তারাই এসে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং পরিশেষে হত্যা করেছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছে নিজামী মুজাহিদরা।

(চলবে)

[লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি; সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন]

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

সৈয়দ আমিরুজ্জামান

বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫

(পূর্বপ্রকাশের পর)

পাকিস্তানি দালাল গোষ্ঠী, মানে রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর, আল শামস সকলের মন মানসিকতার সাথে আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তানি শাসকচক্রের চরম মিল বিদ্যমান। তারাও সর্বত্র ভারতীয় হিন্দু এবং দেশীয় হিন্দুদের ষড়যন্ত্র খুঁজে পেত। মনে রাখা প্রয়োজন, পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলমান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল; কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানের জন্যে আন্দোলন করেছিল তার সাথে বাস্তবতার বিরাট ফারাক দেখে এই বাঙালি মুসলমানের অধিকাংশই পাকিস্তান তত্ত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়।

অপরদিকে পাকিস্তান কায়েমের ফলে যারা ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন তারা নিজেদের স্বার্থেই ‘পাকিস্তান তত্ত্ব’কে আঁকড়ে ধরে রইলেন। ক্ষমতার স্বার্থের কারণেই জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মীয় দলগুলো পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে গণহত্যায় সাহায্য করে যেতে থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালের আমেরিকার গোপন নথি অনুযায়ী এই ইসলামী দলগুলো ছিল আমেরিকান মদদপুষ্ট। একাত্তরের শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীদের প্রতি এই দালাল-গোষ্ঠীর আক্রোশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মোহাম্মদপুরে শান্তি কমিটির এক সংশ্লিষ্ট কমিটি আগস্টের ৯ তারিখ যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করে তার মধ্যে একটা ছিল, ‘বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির কারণে বাঙালি সরকারি কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের ওপর ২৪ ঘণ্টা নজর রাখতে হবে (পরে তাদের সামরিক বিচার করে হত্যা করতে হবে)’।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব বাংলায় বাম রাজনীতির তৎপরতা ছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার জন্যে খুব বড় মাথাব্যথার কারণ। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘পেটে খাবার ও ইসলাম এই দুই জিনিস তাদের কমিউনিজম থেকে দূরে রাখবে’।

কমিউনিস্টদের তৎপরতা ঠেকাতে ১৯৫০ সালে আমেরিকা ‘পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট রুখতে একটি সমন্বিত কর্মসূচি’ নামে এক গোপন কর্মপন্থা হাতে নেয় যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল ‘কমিউনিস্ট প্রভাব দূরীভূত করা এবং পাকিস্তানের নতুন ভাবাদর্শের প্রতি সমর্থনসূচক একটি কর্মসূচি তৈরি করা’। গোপন সেই দলিলে বিভিন্ন রকমের টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ এবং তাদের কাজের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা আছে। সে টার্গেট-গ্রুপ থেকে শিক্ষাক্ষেত্র, শ্রমিক শ্রেণী, সেনাবাহিনী কিছুই বাদ ছিল না। নথিতে ‘বিশেষ প্রকল্প’ এর মধ্যে ছিল রেডিও, সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র এবং ধর্মীয় নেতা ও গ্রুপগুলো। ‘ধর্মীয় নেতা ও গ্রুপগুলো’ প্রকল্পে বলা আছে, ধর্মীয় মঞ্চ থেকে যাতে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণা চালানো যায় সে উদ্দেশ্যে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌছাতে হবে। এ ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য হবে এই কথা বোঝান, যেহেতু কমিউনিজম ধর্মবিরোধী, ফলে সে ইসলামবিরোধী।

উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনকেও আমেরিকা কমিউনিস্ট প্রভাবিত আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে।

কমিউনিস্টদেরকে শুরু থেকেই ইসলামের শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত করা হত। সেই সাথে পাকিস্তানি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের শিকল থেকে বের হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী উত্থানটাকে পাকিস্তানি শাসকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। যেমন ভারতের হিন্দু তেমনি স্থানীয় হিন্দুদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তোলা হয়। দাবি করা হয় যে, দেশভাগের সময় অনেক হিন্দু শিক্ষক দেশ ত্যাগ না করে থেকে যায় এবং এই শিক্ষকরাই পূর্ববাংলার মুসলমানকে প্রভাবিত করেন ও ছেলেমেয়েদের মনে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপণ করেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের প্রতি ছিল তাদের প্রবল আক্রোশ। রাও ফরমান আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি স্বাধীন দ্বীপের সাথে তুলনা করেছিলেন।

পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, যখনই কেউ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, তাকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে গালি দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তান আমলে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মূলত তিনটা ধারার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এক, পাকিস্তানবাদী ধারা, দুই, জাতীয়তাবাদী ধারা, এবং তিন, বামপন্থী ধারা। উল্লেখ্য, জাতীয়াতাবাদী ধারাকে ড রেজোয়ান সিদ্দিকী বলছেন ‘পূর্ব বাংলার স্বাতন্ত্র্য চেতনা ভিত্তিক মধ্যপন্থী ধারা’।

পাকিস্তানকালের সূচনাতে পাকিস্তানবাদী ধারাটা প্রবল ছিল, কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে এই ধারাটা জনগণ থেকে ততা বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এই ধারার বুদ্ধিজীবীরা আসলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পতাকাই বহন করে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ধারার আন্দোলন এবং বামপন্থী আন্দোলন – দুটোই মূলত পাকিস্তানি শাসক চক্রের বিরুদ্ধেই যাচ্ছিল। তাই এর সাথে সক্রিয় সদস্যদের প্রতি শাসকদের তীব্র ক্ষোভ জমা হওয়াটাও ছিল স্বাভাবিক। ১৯৭১-এর নয় মাস পাকিস্তান শাসক কর্তৃক বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পনামাফিক হত্যাকাণ্ডের এটাই ছিল মূল কারণ।

উল্লেখ্য, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থানও এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে লুকিয়ে থাকা আরেকটি কারণ।

পাকিস্তানিদের এই ক্রোধের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের পিছনে লুকিয়ে ছিল আরও একটা কারণ। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, যে কোন জাতির বিবেক জাগ্রত করার জন্যে যেমন প্রয়োজন বুদ্ধিজীবীর, তেমনি জাতিকে নির্জীব করার জন্যে প্রয়োজন বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দেয়া। যদি বাঙালিরা যুদ্ধে জিতেও যায় তবে যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেটাও ছিল তাদের বুদ্ধিজীবী নিধনের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাই পরাজয় যখন নিশ্চিত তখন শাসকচক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠে যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনায়। গ্রেফতারকৃত এক আলবদর দাবি করেছিল আরও কিছুদিন সময় পেলে সকল বুদ্ধিজীবীদেরকেই হত্যা করে ফেলা হত।

তবে, যুদ্ধের মাত্র ৫ বছরের মাথায় পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী এবং গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা লোকজনের রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠা প্রমাণ করে যে, জাতিকে মেধাশূন্য করার মাধ্যমে যে পরিকল্পনা তারা নিয়েছিল তা অনেকাংশে সফল হয়েছিল।

দায়ী কারা?

বলেছি যে, ২৫ শে মার্চ রাত থেকেই বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে অনেকেই দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন, আবার অনেকেই বিভিন্ন কারণেই থেকে যান আক্রান্ত ভূখণ্ডের মাঝেই। যেমন, জহির রায়হান যখন চলে যান দেশ ছেড়ে তখন শহীদুল্লাহ কায়সার বলেছিলেন, ‘ও সীমান্তে থাকবে। সেখানে ওর প্রকৃত কাজ আছে। আমার কাজ এখানে।’

তার কাজ কী ছিল এখানে?

‘বাংলাদেশের সব মানুষ কি ওপারে যেতে পারবে? পারবে না। যারা যেতে পারবে না, তারা প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকবে। আতঙ্কে রাত কাটাবে, বিনিদ্র রাত যাপন করবে। তাদের সে- যন্ত্রণার কথা লিখব আমি’।

আবার সিলেট মেডিকেল কলেজের প্রধান শল্যচিকিৎসক অধ্যাপক ডা: শামসুদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমরা ডাক্তার। রোগী ফেলে আহত মানুষ ফেলে আমরা তো কোথাও যেতে পারি না’।

তাকেও হত্যা করা হয়েছিল এপ্রিল মাসেই।

১৪ ডিসেম্বরের আগেও দেশে অবস্থানরত বুদ্ধিজীবী, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দমন নিপীড়ন করেছে। একাত্তরের জুন মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘আর্মির নির্দিষ্ট টার্গেট হল বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের জনমত গঠনকারী অংশ-চিকিৎসক, অধ্যাপক, ছাত্র ও লেখক’। এন্থনী মাসকারেনহাসও তার বিখ্যাত ‘রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে পাকিস্তানিদের ‘পরিকল্পিত গণহত্যা’র অংশ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বরে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তার মূল পরিকল্পনায় কারা ছিল? পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী একাত্তরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দফতরের পরিচালক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা রাও ফরমান আলীই সেই ব্যক্তি। কেননা ফরমান সেই ব্যক্তি যার উপর কর্তৃপক্ষের আস্থা ছিল সবচেয়ে বেশী। ফরমানই পারত নিঝুম নীরবতাকে প্রচণ্ড শক্তিশালী, সরব করে তুলতে। ফরমান হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আপনার বক্তব্য শুনবেন, যার চেহারায় ধরে রাখা আছে একটা বৈদগ্ধ্যের ছাপ’।

জেনারেল নিয়াজী বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা আমার কাছে কোন তাৎপর্যের অধিকারী ছিলেন না। আমার ছিল অস্ত্রধারী দুশমনদের নিয়েই মাথাব্যথা। তবে আলতাফ গওহর এ কথা উল্লেখ করেছেন যে, কেউ একজন আমাকে জানায় যে, ফরমানের কাছে বুদ্ধিজীবীর একটা তালিকা রয়েছে। আমি সেটার সত্যতা যাচাইয়ের করার জন্য কোন একজনকে পাঠাই আর তার অনুরোধে রাও ফরমান ঐ তালিকা থেকে দুটি নাম কেটে বাদ দেন। আমি বিষয়টা জানতাম না। আমি এটি আলতাফ গওহরের কাছ থেকে জেনেছি।’

পরাজয় যখন নিশ্চিত তখন শাসকচক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনায়।

এই দুই পাকিস্তানির অভিযোগই ফরমান আলীর দিকে যাচ্ছে; এবার তাই শোনা উচিৎ এই রাও ফরমান আলী এ বিষয়ে কি বলেন! ঢাকা পতনের পর গভর্নমেন্ট হাউসে যেসকল লিখিত দলিল পাওয়া যায় তন্মধ্যে ফরমান আলীর লেখা বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকাও ছিল। তালিকায় যাদের নাম ছিল অধিকাংশকেই ১৪ ডিসেম্বরের পর আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। আবার তাদের কাছে সঠিক ঠিকানা ছিলনা বলে অনেক শিক্ষক বেঁচেও গিয়েছিলেন। এই তালিকা সম্পর্কে ফরমান আলীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; জবাবে রাও উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ঐ সময় অনেকে আমার কাছে এসে নানা জনের কথা বলত। যাদের বিরুদ্ধে বলত তাদের নাম আমি শুধু টুকে রেখেছিলাম।’ কেন বলত? এই প্রশ্নের উত্তরে রাও জানাচ্ছেন, ‘কারণ, তারা ছিল পাকিস্তান বিরোধী। তাই ওদের ওসব আমি রেখে দিতাম বটে তবে সেগুলির ওপর একশন নিতাম না’।

তিনি নিজেই এই তালিকার কথা স্বীকার করে এটাও জানাচ্ছেন যে তালিকাভুক্তরা ছিল পাকিস্তান বিরোধী। যদিও তিনি হত্যাকাণ্ডের কথা কৌশলে অস্বীকার করছেন, তবে এটার সাথে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটা নিশ্চিন্তে বলা যায়। বাংলাপিডিয়াতে বলা আছে, পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর সার্বিক নির্দেশনায় নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার বশির, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হেজাজী, মেজর জহুর, মেজর আসলাম, ক্যাপ্টেন নাসির ও ক্যাপ্টেন কাইউম।

ফরমানের এই ছোট কথোপকথনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দালালদের কথা, যারা তার কাছে এসে অভিযোগ জানাত। দালাল বলতে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসকে বুঝানো হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আলবদর ছিল আক্ষরিক অর্থেই ডেথ স্কোয়াড। তারা সরাসরি মাঠে ময়দানে গিয়ে লড়েনি, বরং পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্গেট কিলিংই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তারাই ছিল সবচেয়ে বেশী তৎপর এবং এদের সাহায্যেই পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করেছে, তারাই এসে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং পরিশেষে হত্যা করেছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছে নিজামী মুজাহিদরা।

(চলবে)

[লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি; সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন]

back to top