alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫

পাকিস্তানে প্রায় ১৭ শতাংশ লোকের আয়ের অন্যতম প্রধান পেশা হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সর্বত্র ভিক্ষুকদের দাপট।

সউদি আরবের হুমকিতে ভিক্ষুকের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে গেলে এক ভিক্ষুকের মন্তব্য ছিল, ‘পাকিস্তানে ভিক্ষা করা অপরাধ হলো কবে? আমাদের সরকার যেদিন বিদেশিদের কাছে ভিক্ষা চাওয়া বন্ধ করবে, আমিও সেই দিন ভিক্ষা করা বন্ধ করে দেব’

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পরপর বাংলাদেশেও অসংখ্য লোক ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করতো। এই ভিক্ষুকদের অনেকে দূরবর্তী ভিন্ন গ্রাম থেকেও আমাদের গ্রামে আসত এবং প্রতিটি বাড়ির ঘরে ঘরে গিয়ে ভিক্ষার চাল সংগ্রহ করতো। হাঁটতে হাঁটতে পরিশ্রান্ত হয়ে গেলে কোন ঘরে গিয়ে পানি চেয়ে খেয়ে নিতো, পানি চাইলে অনেকে উদ্বৃত্ত বাসি ভাতও খেতে দিত। ভিক্ষুকের লক্ষ্মী হচ্ছে পা, পা সচল থাকলে অধিক সংখ্যক বাড়ি-ঘরে গিয়ে ভিক্ষা সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। পরিচিত ভিক্ষুকদের সঙ্গে মা-চাচীদের অনেক সময় গল্প করতেও দেখা যেত, কারণ ভিক্ষুকদের কাছে সব বাড়ির খবর থাকত। সম্ভাব্য বর-কনেদের খবরও ভিক্ষুকদের কাছে থাকত। শ্বশুর বাড়ি এসে নতুন বউরা মা-বাবার খবর পাওয়ার আশায় নিজ গ্রামের ভিক্ষুকের আগমনের প্রতীক্ষায় থাকত। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হতে থাকে, এবং ব্যাপক উন্নয়নের কারণে দরিদ্র ও অতি দরিদ্রের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, এই কমার কারণে ভিক্ষাবৃত্তিও কমেছে। কিছুদিন আগেও গ্রামে তেমন ভিক্ষুক দেখা যেত না।

প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লোকই ছিল ভিক্ষুক, গ্রামে খুব কম লোকই ছিল সচ্ছল। ’উইটনেস টু সারেণ্ডার’ বইয়ের লেখক ছিলেন মেজর সিদ্দিক সালিক, তিনি ১৯৭০ সনের জানুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানে বদলী হয়ে আসেন এবং একাত্তরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বদলী হয়ে আসার পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, প্রায় ২০০ নারী তার বাড়ির গেইটে ভিড় করে হৈচৈ করছে, ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। সিদ্দিক সালিকের দারোয়ান আগের দিন একজন গৃহকর্মীর আবশ্যকতার কথা আশেপাশের বাড়ির দারোয়ানদের বলে রেখেছিলেন, এই সংবাদ কিভাবে যেন ব্যাপক প্রচার পেয়ে যায়, সেনা কর্মকর্তার গৃহকর্মী হলে বেশি বেতন ও ভালো খাবার পাওয়া যাবে, এই ভরসায় আশেপাশের গরীব মেয়েরা চাকুরি পাওয়ার প্রত্যাশায় ছুটে এসেছে। এই একটি ঘটনা থেকে সিদ্দিক সালেক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের ব্যাপকতা সম্পর্কে প্রথম সম্যক ধারণা পেলেন। এই কথাগুলো তিনি তার ‘উইটনেস টু সারেণ্ডার’ বইতে উল্লেখ করেছেন। ১৯৮৮ সনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকসহ ব্রিগ্রেডিয়ার সিদ্দিক সালিক একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।

তখন অভাবে মানুষ আটার রুটি খেত, চালের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল, প্রতি সের চালের দাম ছিল ছয় আনা বা আট আনা, কিন্তু এই ছয় আনা যোগাড় করার সামর্থ বেশিরভাগ লোকের ছিল না। সকালে পান্তা ভাতের তরকারি ছিল কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ বা একটু পোড়া মরিচের ভর্তা। ভাত রান্না করে মাড় ফেলে দেওয়া হতো না, কারণ মাড় ছিল ডালের মতো তরকারি। সচ্ছল পরিবার ভাতের মাড় খাওয়াত পোষা গরুদের। তবে নতুন চালের মাড় দিয়ে গরম ভাত খাওয়ার রীতি সচ্ছল পরিবারেরও ছিল। ভাতের সঙ্গে অর্ধেক ডিম পেলে শিশুরা খুশিতে লাফাতো। অন্যের পাটক্ষেত থেকে পাটপাতা চুরি করে এনে রান্না করতো বহু পরিবার। লোকজনের পকেটে নগদ টাকা থাকতো না, তাই খাবার থাকলেও তা ক্রয় করে খাওয়ার সক্ষমতা ছিল না। ঈদ বা পুজাপার্বনে একটি নতুন জামা পেলে শিশুদের আনন্দের সীমা থাকত না। শীত নিবারণের একমাত্র অবলম্বন ছিল আগুন, চুলার পাশে বসার জন্য শিশুদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানে পোলাও থাকত, কিন্তু দেওয়া হতো অল্প পরিমাণে, বাকি ক্ষুধা নিবারণ করতে হতো ভাত খেয়ে।

এই অবস্থা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, পশ্চিম পাকিস্তানের নয়। পূর্ব পাকিস্তানের পাট ও চা রপ্তানির টাকার বেশিরভাগ খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। সেই আমলে সারা পৃথিবী পাটের বস্তা ব্যবহার করতো, জাপান প্লাস্টিকের কৃত্রিম তন্তু যেদিন আবিস্কার করল সেদিন থেকে পাটের ব্যবহার কমতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানির আয় দিয়ে পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানে তিন তিনটি রাজধানী শহর গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু ভিক্ষা নয়, ভিক্ষার ঝুলিও ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও পরনির্ভরশীল করে রাখার যে নীতি গ্রহণ করেছিল তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিরোহিত হলেও যুদ্ধে দুর্বল অর্থনৈতিক অবকাঠামোও পাকিস্তানি সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়ে যায়। যুদ্ধের স্বাভাবিক ধ্বংস ছাড়াও পাকিস্তানি সেনারা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, অফিস-আদালত, দোকানপাট, সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেললাইন সব ধ্বংস করে দেয়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বাস্তুহারা এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের আর্থিক সামর্থও সরকারের ছিল না। ঘর নেই, বাড়ি নেই, বস্ত্র নেই, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, খাবার কেনার পয়সা নেই- চারিদিকে ছিল শুধু হাহাকার।

ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ থেকে প্রাপ্ত এক বিলিয়ন ডলার অনুদানই ছিলো বঙ্গবন্ধু সরকারের একমাত্র সম্বল। ভাঙ্গা রাস্তাঘাট এবং পরিবহণের জন্য বাস-ট্রাক না থাকায় বিদেশ থেকে প্রাপ্ত খাবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছানোও সম্ভব হচ্ছিলো না। নদী ও সমুদ্রবন্দর মাইন আর ডুবন্ত জাহাজের ভাগাড়ে পরিণত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানবন্দর মেরামত করা সম্ভব হলেও বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের নিমিত্তে বাংলাদেশের একটি বিমানও ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭৩ সনে হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ব বাজারে সব জিনিসের দাম বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি আমেরিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে না পারলেও একটা দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে পেরেছিল, বাংলাদেশের জন্য প্রেরিত গম সমুদ্রের মাঝখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, অন্য দেশ থেকে দ্রুত চাল-গম সংগ্রহ সম্ভব না হওয়ায় ১৯৭৪ সনের দুর্ভিক্ষে বহু লোক অনাহারে মারা যায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংসলীলায় দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো যেভাবে ধ্বংস হয়েছিল তা ধর্তব্যে নেওয়া হলে ওই দুর্ভিক্ষে দেশের অর্ধেক লোক মারা গেলেও বিস্মিত হওয়ার কথা ছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর জাপান যেভাবে ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে উঠেছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশও সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নের চমক সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট চলতি বছরে দাঁড়িয়েছে ৭ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকায়।বিশ্বের অর্থনীতিতে নানা দুর্যোগ থাকা সত্বেও বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি থেমে যায়নি। দারিদ্রের হার কমেছে, শিশু মৃত্যু হার কমছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে মানুষের আয়ু, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে মিঠে পানির মাছ ও সবজী উৎপাদন। শুধু তাই নয়, মানব উন্নয়ন সূচক, সহজে ব্যবসা করার সূচক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক, গড় আয়ুষ্কাল, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে ছিল। বাংলাদেশে এখন প্রায় সব স্কুল-কলেজ প্রাসাদতুল্য অট্টালিকায় সুশোভিত, কিন্তু পাকিস্তান আমলে অধিকাংশ স্কুল-কলেজ ঘরের ছাদও ছিল না। বাংলাদেশের এই অগ্রগতি কিছুদিন আগেও পাকিস্তানের ঈর্ষার কারণ ছিল। ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েই প্রথম পাঁচ বছরে পাকিস্তানকে সুইডেনের মডেলে উন্নীত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট জাইগাম খান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উক্ত মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন যে, ‘সুইডেন নয়, পাকিস্তানকে ইমরান খান বাংলাদেশের উন্নয়নের স্তরে নিয়ে যেতে পারলেই পাকিস্তানের জনগণ খুশীতে আত্মহারা হবে’।

ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের উন্নয়নে স্থবিরতা নেমে এলেও ঝুড়ির তলা এখনো কিছুটা শক্ত আছে। ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়ে গেলেও তা পাকিস্তানের মতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অর্থনীতিকে যেভাবে সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে তাতে ভিক্ষুকের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। যে সকল রাস্তার ফুটপাতে আগে কখনো ফেরিওয়ালা দেখা যেত না, এখন ঢাকার সব রাস্তায় গিজগিজ করছে। ঢাকা শহরের ফুটপাতে আগেও ব্যবসা ছিল, কিন্তু এখন পা ফেলার জায়গাও নেই। লোকজন কর্মহীন হচ্ছে জ্যামিতিক হারে, সরকারের ঋণনীতি বেকার সৃষ্টি করছে। কিছু ব্যবসায়ীকে ঋণ অস্ত্র দিয়ে অচল করে দেওয়া হচ্ছে, তাদের ব্যবসা ও কলকারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে লোকজন কর্মহীন হচ্ছে। সুদের হার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি কমানোর নীতি খেলাপি ঋণ সৃষ্টির সহায়ক হচ্ছে, বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে, আমদানি কমছে, উৎপাদন কমছে, রাজস্ব আদায় কমছে, দারিদ্রের হার বাড়ছে। ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে উত্তেজনা আবার তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হচ্ছে না, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অর্থনীতি বেসামাল, রাজনীতির ডামাডোলে অর্থ উপদেষ্টা নিরুপায়।

পাকিস্তানের অর্থনীতিকে কিছুটা সবল করছে ভিক্ষাবৃত্তি, যা পাকিস্তানে একটি শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ভিক্ষুক রপ্তানিও হচ্ছে, সরকার দেখেও না দেখার ভান করছে। পাকিস্তানি ভিক্ষুকেরা আগে যেত শুধু সউদি আরবে, এখন পৃথিবীর সব সকল ধনী দেশেই যাচ্ছে। এদের মধ্যে আবার অনেকে পকেটমার। ভিক্ষুকের কারণে সউদি আরব মাঝে মাঝে পাকিস্তানকে সতর্ক করে থাকে, বিগত সাড়ে চার বছরে সউদি আরবসহ কয়েকটি দেশ থেকে ৪৯ হাজার ভিক্ষুককে বিতাড়ন করা হয়েছে। পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৩ কোটি, তারমধ্যে ৪ কোটি লোক ভিক্ষুক। দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে যা আয় হয় তা পাকিস্তানের জিডিপির ১২ শতাংশ, বিরাট অংক।

রাজনীতির মাঠেও ভিক্ষাবৃত্তি আছে, নির্বাচন এলে রাজনৈতিক ভিক্ষুকদের আনাগোনা বেড়ে যায়, এরা ভোট ভিক্ষা করে, বিনিময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা দেদারসে দেয় মসজিদ, মাদ্রাসা ও মন্দিরে। শুধু ব্যক্তি নয়, গরীব দেশগুলোও ভিক্ষা করে, অনুদান-ঋণ নেয়। শুধু পাকিস্তানের ভিক্ষুকদের বিতাড়ন করা হচ্ছে না, আমেরিকা অবৈধ অভিবাসীদের শিকল দিয়ে বেঁধে তাদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে ইসলাম-ভীতি বৃদ্ধি পেতে থাকলে বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিম প্রবাসীদের তাড়ানো শুরু হতে পারে, অধিক সংখ্যায় প্রবাসী ফেরত এলে ভিক্ষা করার উপযোগী স্থানও দেশের ভেতর আর পাওয়া যাবে না। পাকিস্তানে জায়গা দখলের মহড়ায় এক ভিক্ষুক আরেক ভিক্ষুককে পিস্তল ধরে বিতাড়িত করলে বিতাড়িত ভিক্ষুক কোর্টে মামলা করেছে। ভিক্ষা করার জন্য বাংলাদেশে ফুটপাতে জায়গা নেই, ভিক্ষার উপযোগী স্থান মাজারও উচ্ছেদ হচ্ছে, তাই রাজনৈতিক অভিসন্ধির অনুকূল অর্থনীতির প্রবর্তন হতে থাকলে দেশে ভিক্ষুক বাড়তেই থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও সহজ হবে না। সউদি আরবের হুমকিতে ভিক্ষুকের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে গেলে এক ভিক্ষুকের মন্তব্য ছিল, ‘পাকিস্তানে ভিক্ষা করা অপরাধ হলো কবে? আমাদের সরকার যেদিন বিদেশিদের কাছে ভিক্ষা চাওয়া বন্ধ করবে, আমিও সেই দিন ভিক্ষা করা বন্ধ করে দেব’। তাই বাংলাদেশ যেন পাকিস্তান হওয়ার স্বপ্ন না দেখে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫

পাকিস্তানে প্রায় ১৭ শতাংশ লোকের আয়ের অন্যতম প্রধান পেশা হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সর্বত্র ভিক্ষুকদের দাপট।

সউদি আরবের হুমকিতে ভিক্ষুকের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে গেলে এক ভিক্ষুকের মন্তব্য ছিল, ‘পাকিস্তানে ভিক্ষা করা অপরাধ হলো কবে? আমাদের সরকার যেদিন বিদেশিদের কাছে ভিক্ষা চাওয়া বন্ধ করবে, আমিও সেই দিন ভিক্ষা করা বন্ধ করে দেব’

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পরপর বাংলাদেশেও অসংখ্য লোক ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করতো। এই ভিক্ষুকদের অনেকে দূরবর্তী ভিন্ন গ্রাম থেকেও আমাদের গ্রামে আসত এবং প্রতিটি বাড়ির ঘরে ঘরে গিয়ে ভিক্ষার চাল সংগ্রহ করতো। হাঁটতে হাঁটতে পরিশ্রান্ত হয়ে গেলে কোন ঘরে গিয়ে পানি চেয়ে খেয়ে নিতো, পানি চাইলে অনেকে উদ্বৃত্ত বাসি ভাতও খেতে দিত। ভিক্ষুকের লক্ষ্মী হচ্ছে পা, পা সচল থাকলে অধিক সংখ্যক বাড়ি-ঘরে গিয়ে ভিক্ষা সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। পরিচিত ভিক্ষুকদের সঙ্গে মা-চাচীদের অনেক সময় গল্প করতেও দেখা যেত, কারণ ভিক্ষুকদের কাছে সব বাড়ির খবর থাকত। সম্ভাব্য বর-কনেদের খবরও ভিক্ষুকদের কাছে থাকত। শ্বশুর বাড়ি এসে নতুন বউরা মা-বাবার খবর পাওয়ার আশায় নিজ গ্রামের ভিক্ষুকের আগমনের প্রতীক্ষায় থাকত। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হতে থাকে, এবং ব্যাপক উন্নয়নের কারণে দরিদ্র ও অতি দরিদ্রের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, এই কমার কারণে ভিক্ষাবৃত্তিও কমেছে। কিছুদিন আগেও গ্রামে তেমন ভিক্ষুক দেখা যেত না।

প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লোকই ছিল ভিক্ষুক, গ্রামে খুব কম লোকই ছিল সচ্ছল। ’উইটনেস টু সারেণ্ডার’ বইয়ের লেখক ছিলেন মেজর সিদ্দিক সালিক, তিনি ১৯৭০ সনের জানুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানে বদলী হয়ে আসেন এবং একাত্তরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বদলী হয়ে আসার পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, প্রায় ২০০ নারী তার বাড়ির গেইটে ভিড় করে হৈচৈ করছে, ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। সিদ্দিক সালিকের দারোয়ান আগের দিন একজন গৃহকর্মীর আবশ্যকতার কথা আশেপাশের বাড়ির দারোয়ানদের বলে রেখেছিলেন, এই সংবাদ কিভাবে যেন ব্যাপক প্রচার পেয়ে যায়, সেনা কর্মকর্তার গৃহকর্মী হলে বেশি বেতন ও ভালো খাবার পাওয়া যাবে, এই ভরসায় আশেপাশের গরীব মেয়েরা চাকুরি পাওয়ার প্রত্যাশায় ছুটে এসেছে। এই একটি ঘটনা থেকে সিদ্দিক সালেক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের ব্যাপকতা সম্পর্কে প্রথম সম্যক ধারণা পেলেন। এই কথাগুলো তিনি তার ‘উইটনেস টু সারেণ্ডার’ বইতে উল্লেখ করেছেন। ১৯৮৮ সনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকসহ ব্রিগ্রেডিয়ার সিদ্দিক সালিক একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।

তখন অভাবে মানুষ আটার রুটি খেত, চালের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল, প্রতি সের চালের দাম ছিল ছয় আনা বা আট আনা, কিন্তু এই ছয় আনা যোগাড় করার সামর্থ বেশিরভাগ লোকের ছিল না। সকালে পান্তা ভাতের তরকারি ছিল কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ বা একটু পোড়া মরিচের ভর্তা। ভাত রান্না করে মাড় ফেলে দেওয়া হতো না, কারণ মাড় ছিল ডালের মতো তরকারি। সচ্ছল পরিবার ভাতের মাড় খাওয়াত পোষা গরুদের। তবে নতুন চালের মাড় দিয়ে গরম ভাত খাওয়ার রীতি সচ্ছল পরিবারেরও ছিল। ভাতের সঙ্গে অর্ধেক ডিম পেলে শিশুরা খুশিতে লাফাতো। অন্যের পাটক্ষেত থেকে পাটপাতা চুরি করে এনে রান্না করতো বহু পরিবার। লোকজনের পকেটে নগদ টাকা থাকতো না, তাই খাবার থাকলেও তা ক্রয় করে খাওয়ার সক্ষমতা ছিল না। ঈদ বা পুজাপার্বনে একটি নতুন জামা পেলে শিশুদের আনন্দের সীমা থাকত না। শীত নিবারণের একমাত্র অবলম্বন ছিল আগুন, চুলার পাশে বসার জন্য শিশুদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানে পোলাও থাকত, কিন্তু দেওয়া হতো অল্প পরিমাণে, বাকি ক্ষুধা নিবারণ করতে হতো ভাত খেয়ে।

এই অবস্থা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, পশ্চিম পাকিস্তানের নয়। পূর্ব পাকিস্তানের পাট ও চা রপ্তানির টাকার বেশিরভাগ খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। সেই আমলে সারা পৃথিবী পাটের বস্তা ব্যবহার করতো, জাপান প্লাস্টিকের কৃত্রিম তন্তু যেদিন আবিস্কার করল সেদিন থেকে পাটের ব্যবহার কমতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানির আয় দিয়ে পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানে তিন তিনটি রাজধানী শহর গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু ভিক্ষা নয়, ভিক্ষার ঝুলিও ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও পরনির্ভরশীল করে রাখার যে নীতি গ্রহণ করেছিল তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিরোহিত হলেও যুদ্ধে দুর্বল অর্থনৈতিক অবকাঠামোও পাকিস্তানি সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়ে যায়। যুদ্ধের স্বাভাবিক ধ্বংস ছাড়াও পাকিস্তানি সেনারা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, অফিস-আদালত, দোকানপাট, সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেললাইন সব ধ্বংস করে দেয়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বাস্তুহারা এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের আর্থিক সামর্থও সরকারের ছিল না। ঘর নেই, বাড়ি নেই, বস্ত্র নেই, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, খাবার কেনার পয়সা নেই- চারিদিকে ছিল শুধু হাহাকার।

ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ থেকে প্রাপ্ত এক বিলিয়ন ডলার অনুদানই ছিলো বঙ্গবন্ধু সরকারের একমাত্র সম্বল। ভাঙ্গা রাস্তাঘাট এবং পরিবহণের জন্য বাস-ট্রাক না থাকায় বিদেশ থেকে প্রাপ্ত খাবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছানোও সম্ভব হচ্ছিলো না। নদী ও সমুদ্রবন্দর মাইন আর ডুবন্ত জাহাজের ভাগাড়ে পরিণত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানবন্দর মেরামত করা সম্ভব হলেও বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের নিমিত্তে বাংলাদেশের একটি বিমানও ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭৩ সনে হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ব বাজারে সব জিনিসের দাম বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি আমেরিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে না পারলেও একটা দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে পেরেছিল, বাংলাদেশের জন্য প্রেরিত গম সমুদ্রের মাঝখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, অন্য দেশ থেকে দ্রুত চাল-গম সংগ্রহ সম্ভব না হওয়ায় ১৯৭৪ সনের দুর্ভিক্ষে বহু লোক অনাহারে মারা যায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংসলীলায় দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো যেভাবে ধ্বংস হয়েছিল তা ধর্তব্যে নেওয়া হলে ওই দুর্ভিক্ষে দেশের অর্ধেক লোক মারা গেলেও বিস্মিত হওয়ার কথা ছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর জাপান যেভাবে ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে উঠেছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশও সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নের চমক সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট চলতি বছরে দাঁড়িয়েছে ৭ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকায়।বিশ্বের অর্থনীতিতে নানা দুর্যোগ থাকা সত্বেও বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি থেমে যায়নি। দারিদ্রের হার কমেছে, শিশু মৃত্যু হার কমছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে মানুষের আয়ু, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে মিঠে পানির মাছ ও সবজী উৎপাদন। শুধু তাই নয়, মানব উন্নয়ন সূচক, সহজে ব্যবসা করার সূচক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক, গড় আয়ুষ্কাল, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে ছিল। বাংলাদেশে এখন প্রায় সব স্কুল-কলেজ প্রাসাদতুল্য অট্টালিকায় সুশোভিত, কিন্তু পাকিস্তান আমলে অধিকাংশ স্কুল-কলেজ ঘরের ছাদও ছিল না। বাংলাদেশের এই অগ্রগতি কিছুদিন আগেও পাকিস্তানের ঈর্ষার কারণ ছিল। ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েই প্রথম পাঁচ বছরে পাকিস্তানকে সুইডেনের মডেলে উন্নীত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট জাইগাম খান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উক্ত মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন যে, ‘সুইডেন নয়, পাকিস্তানকে ইমরান খান বাংলাদেশের উন্নয়নের স্তরে নিয়ে যেতে পারলেই পাকিস্তানের জনগণ খুশীতে আত্মহারা হবে’।

ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের উন্নয়নে স্থবিরতা নেমে এলেও ঝুড়ির তলা এখনো কিছুটা শক্ত আছে। ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়ে গেলেও তা পাকিস্তানের মতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অর্থনীতিকে যেভাবে সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে তাতে ভিক্ষুকের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। যে সকল রাস্তার ফুটপাতে আগে কখনো ফেরিওয়ালা দেখা যেত না, এখন ঢাকার সব রাস্তায় গিজগিজ করছে। ঢাকা শহরের ফুটপাতে আগেও ব্যবসা ছিল, কিন্তু এখন পা ফেলার জায়গাও নেই। লোকজন কর্মহীন হচ্ছে জ্যামিতিক হারে, সরকারের ঋণনীতি বেকার সৃষ্টি করছে। কিছু ব্যবসায়ীকে ঋণ অস্ত্র দিয়ে অচল করে দেওয়া হচ্ছে, তাদের ব্যবসা ও কলকারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে লোকজন কর্মহীন হচ্ছে। সুদের হার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি কমানোর নীতি খেলাপি ঋণ সৃষ্টির সহায়ক হচ্ছে, বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে, আমদানি কমছে, উৎপাদন কমছে, রাজস্ব আদায় কমছে, দারিদ্রের হার বাড়ছে। ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে উত্তেজনা আবার তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হচ্ছে না, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অর্থনীতি বেসামাল, রাজনীতির ডামাডোলে অর্থ উপদেষ্টা নিরুপায়।

পাকিস্তানের অর্থনীতিকে কিছুটা সবল করছে ভিক্ষাবৃত্তি, যা পাকিস্তানে একটি শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ভিক্ষুক রপ্তানিও হচ্ছে, সরকার দেখেও না দেখার ভান করছে। পাকিস্তানি ভিক্ষুকেরা আগে যেত শুধু সউদি আরবে, এখন পৃথিবীর সব সকল ধনী দেশেই যাচ্ছে। এদের মধ্যে আবার অনেকে পকেটমার। ভিক্ষুকের কারণে সউদি আরব মাঝে মাঝে পাকিস্তানকে সতর্ক করে থাকে, বিগত সাড়ে চার বছরে সউদি আরবসহ কয়েকটি দেশ থেকে ৪৯ হাজার ভিক্ষুককে বিতাড়ন করা হয়েছে। পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৩ কোটি, তারমধ্যে ৪ কোটি লোক ভিক্ষুক। দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে যা আয় হয় তা পাকিস্তানের জিডিপির ১২ শতাংশ, বিরাট অংক।

রাজনীতির মাঠেও ভিক্ষাবৃত্তি আছে, নির্বাচন এলে রাজনৈতিক ভিক্ষুকদের আনাগোনা বেড়ে যায়, এরা ভোট ভিক্ষা করে, বিনিময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা দেদারসে দেয় মসজিদ, মাদ্রাসা ও মন্দিরে। শুধু ব্যক্তি নয়, গরীব দেশগুলোও ভিক্ষা করে, অনুদান-ঋণ নেয়। শুধু পাকিস্তানের ভিক্ষুকদের বিতাড়ন করা হচ্ছে না, আমেরিকা অবৈধ অভিবাসীদের শিকল দিয়ে বেঁধে তাদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে ইসলাম-ভীতি বৃদ্ধি পেতে থাকলে বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিম প্রবাসীদের তাড়ানো শুরু হতে পারে, অধিক সংখ্যায় প্রবাসী ফেরত এলে ভিক্ষা করার উপযোগী স্থানও দেশের ভেতর আর পাওয়া যাবে না। পাকিস্তানে জায়গা দখলের মহড়ায় এক ভিক্ষুক আরেক ভিক্ষুককে পিস্তল ধরে বিতাড়িত করলে বিতাড়িত ভিক্ষুক কোর্টে মামলা করেছে। ভিক্ষা করার জন্য বাংলাদেশে ফুটপাতে জায়গা নেই, ভিক্ষার উপযোগী স্থান মাজারও উচ্ছেদ হচ্ছে, তাই রাজনৈতিক অভিসন্ধির অনুকূল অর্থনীতির প্রবর্তন হতে থাকলে দেশে ভিক্ষুক বাড়তেই থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও সহজ হবে না। সউদি আরবের হুমকিতে ভিক্ষুকের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে গেলে এক ভিক্ষুকের মন্তব্য ছিল, ‘পাকিস্তানে ভিক্ষা করা অপরাধ হলো কবে? আমাদের সরকার যেদিন বিদেশিদের কাছে ভিক্ষা চাওয়া বন্ধ করবে, আমিও সেই দিন ভিক্ষা করা বন্ধ করে দেব’। তাই বাংলাদেশ যেন পাকিস্তান হওয়ার স্বপ্ন না দেখে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

back to top