মতিউর রহমান
সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যবৃদ্ধি শব্দবন্ধগুলো যখনই সামনে আসে, তখনই আমাদের চোখে ভাসে অর্থনৈতিক নানা জটিল সমীকরণ, দ্রব্য ও সেবার সামগ্রিক মূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিংবা নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
দীর্ঘস্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের পরিবারগুলোকে এমন সব নতুন নতুন টিকে থাকার কৌশল গ্রহণে বাধ্য করছে, যা কেবল তাদের বর্তমানকে নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনাকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে
কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশের বাস্তবতায় মূল্যবৃদ্ধি কেবল পরিসংখ্যান বা খাতা-কলমের হিসাব নয়; এটি একটি গভীর এবং সুদূরপ্রসারী সামাজিক সংকট। এই সংকট মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আমূল পুনর্গঠন করে, পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধরণ বদলে দেয় এবং অস্তিত্ব রক্ষার বা টিকে থাকার অর্থকেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে। যখন খাদ্য, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবার মূল্য ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে, তখন তার অভিঘাত পরিবার, বৃহত্তর সম্প্রদায় এবং রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ওপর স্তরে স্তরে আছড়ে পড়ে। দীর্ঘস্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের পরিবারগুলোকে এমন সব নতুন নতুন টিকে থাকার কৌশল গ্রহণে বাধ্য করছে, যা কেবল তাদের বর্তমানকে নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনাকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। এই রূপান্তরগুলো লিঙ্গ সম্পর্ক, শিশুকল্যাণ, শ্রমবিন্যাস, অভিবাসন এবং নাগরিকদের রাজনৈতিক মনোভাবকেও স্থায়ীভাবে বদলে দিচ্ছে।
পারিবারিক স্তরে মূল্যবৃদ্ধির সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং দৃশ্যমান প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন বাজেটে। বাংলাদেশের দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মাসিক ব্যয়ের সিংহভাগ জুড়ে থাকে খাদ্য ও জ্বালানি। যখন চাল, ডাল, ভোজ্য তেল কিংবা গ্যাসের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন তাদের প্রকৃত আয় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সংকুচিত হয়। এই পরিস্থিতিতে পরিবারগুলো বাধ্য হয় তাদের ভোগ বা ব্যয়ের ধরনে চরম কাটছাঁট করতে। এই সমন্বয় প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক; তারা প্রথমে শৌখিনতা বিসর্জন দেয়, এরপর জরুরি নয় এমন ব্যয় স্থগিত করে এবং শেষ পর্যন্ত খাবারের মানের সঙ্গে আপস করতে শুরু করে। দামী মাছ, মাংস বা প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বাদ দিয়ে তারা কেবল পেট ভরানোর জন্য শর্করা বা কার্বোহাইড্রেটনির্ভর খাবারে ঝুঁকে পড়ে। এই ‘ক্যালরি-ভিত্তিক টিকে থাকা’ সাময়িকভাবে ক্ষুধার জ্বালা মেটালেও দীর্ঘমেয়াদে তা ভয়াবহ পুষ্টিহীনতা ডেকে আনে। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এই অপুষ্টির ফলাফল অপূরণীয়। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যে ঘাটতি আজ তৈরি হচ্ছে, তা তাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করবে, যা প্রকারান্তরে একটি পুরো প্রজন্মকে দারিদ্র্যের চক্রে আটকে রাখার ঝুঁকি তৈরি করছে।
মূল্যবৃদ্ধির চাপের একটি নীরব কিন্তু গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় পরিবারের অভ্যন্তরীণ লিঙ্গীয় সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশি সমাজব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই গৃহস্থালির ব্যয়ের ব্যবস্থাপনা, রান্না এবং পরিবারের সদস্যদের যত্নের দায়িত্ব পালন করেন। বাজার যখন অগ্নিমূল্য হয়, তখন এই সীমিত সম্পদ দিয়ে পুরো পরিবারের চাহিদা মেটানোর গুরুভার নারীর ওপর এসে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারের সীমিত খাবার যখন সবার মাঝে বণ্টন করা হয়, তখন নারীরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা সামাজিক চাপে নিজের অংশের খাবার কমিয়ে দেন। তারা শিশু বা পুরুষ সদস্যদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে গিয়ে নিজের স্বাস্থ্যের অবহেলা করেন। অন্যদিকে, পারিবারিক আয়ের ঘাটতি মেটাতে অনেক নারী বাধ্য হয়ে প্রথাগত গৃহকর্মের পাশাপাশি শ্রমবাজারে যুক্ত হন। এতে পরিবার আর্থিক কিছুটা স্বস্তি পেলেও নারীর ওপর তৈরি হয় এক ‘দ্বৈত বোঝা’ বা ‘টাইম পোভার্টি’। তাকে একই সঙ্গে ঘরের কাজ এবং বাইরের আয়বর্ধক কাজ সামলাতে হয়, যা তাঁর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করে। যথাযথ সামাজিক সুরক্ষা বা পারিবারিক সহায়তা ছাড়া এই পরিস্থিতি নারীদের শোষণমূলক বা অনিরাপদ কাজে যুক্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে শ্রমের ধরনেও এক ধরনের মরিয়া পরিবর্তন দেখা যায়। পরিবারগুলো তাদের টিকে থাকার কৌশল হিসেবে কাজের সময় বাড়িয়ে দেয় অথবা পরিবারের একাধিক সদস্যকে আয়ের সন্ধানে বাইরে পাঠাতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে করুণ শিকার হয় শিশুরা। যখন প্রাপ্তবয়স্কদের আয় দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে উপার্জনের পথে ঠেলে দেয়। শিশুশ্রমের এই বৃদ্ধি তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারের হাড়ির অন্ন জোগালেও এর বিনিময়ে জাতি তার ভবিষ্যতের দক্ষ মানবসম্পদ চিরতরে হারিয়ে ফেলে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও বাড়তি পরিশ্রম প্রায়ই কাক্সিক্ষত ফল দেয় না, কারণ বাজারে শ্রমের যোগান বাড়লেও মজুরি মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। এর ফলে পরিবারগুলো এক ধরনের চোরাবালিতে পড়ে যায় এবং নিরুপায় হয়ে ক্ষুদ্রঋণ বা উচ্চসুদের অনানুষ্ঠানিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই ঋণনির্ভরতা সাময়িকভাবে বিপদ কাটলেও দীর্ঘমেয়াদে পরিবারটিকে এক অন্তহীন দেনার দায়ে আবদ্ধ করে ফেলে, যা থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
মূল্যবৃদ্ধি যখন স্থানীয় পর্যায়ে জীবনধারণ অসম্ভব করে তোলে, তখন অভিবাসন একটি প্রধান টিকে থাকার কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়। গ্রামাঞ্চলে কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের অসামঞ্জস্যের কারণে মানুষ দ্রুত শহরমুখী হচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে এই অভ্যন্তরীণ অভিবাসন কেবল মানুষের স্থান পরিবর্তন নয়, বরং এটি একটি সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া। শহরে এসে এই মানুষগুলো অধিকাংশ সময় ঘিঞ্জি বস্তি বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয় এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে অত্যন্ত নিম্নমানের মজুরিতে কাজ করে। অন্যদিকে, অনেক পরিবারের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসন বা প্রবাসে শ্রমিক পাঠানো মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে একটি ঢাল হিসেবে কাজ করে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অনেক পরিবারকে চরম দারিদ্র?্য থেকে রক্ষা করলেও, এর পেছনে থাকে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়, জমি বিক্রি বা ঋণের বোঝা এবং প্রিয়জনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস। এই অভিবাসন কৌশলটি একদিকে যেমন সুরক্ষা দিচ্ছে, অন্যদিকে তা গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ও সামাজিক অস্থিরতাকেও উসকে দিচ্ছে।
একসময় বাংলাদেশের গ্রামীণ ও মফস্বল জীবনে প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের একে অপরকে সাহায্য করার একটি জোরালো সংস্কৃতি ছিল। সংকটের সময় চাল ধার দেওয়া কিংবা বিপদে অর্থ সাহায্য করা ছিল সামাজিক নেটওয়ার্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু বর্তমানের দীর্ঘস্থায়ী এবং সর্বগ্রাসী মূল্যবৃদ্ধি এই সামাজিক পুঁজিকে ক্রমশ ক্ষয় করে ফেলছে। যখন প্রায় প্রতিটি পরিবারই একই ধরনের অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যায়, তখন অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। পারস্পরিক সহায়তার এই ভিত্তিটি দুর্বল হয়ে পড়লে পরিবারগুলো তাদের শেষ সম্বল বা উৎপাদনক্ষম সম্পদ যেমন গবাদিপশু, কৃষি যন্ত্রপাতি কিংবা শেষ এক চিলতে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই ‘ডিস-ইনভেস্টিং’ বা সম্পদ বিক্রি স্বল্পমেয়াদে ক্ষুধা মেটালেও দীর্ঘমেয়াদে পরিবারের আয় করার সক্ষমতাকে চিরতরে নষ্ট করে দেয়। এর পাশাপাশি, শিক্ষা ব্যয়ের লাগামহীন বৃদ্ধি তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে তরুণরা যখন কম বয়সেই অনিরাপদ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, তখন তা সমাজে এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী হতাশা ও অদক্ষ শ্রমশক্তির আধিক্য তৈরি করছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুদ্রাস্ফীতি কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও নীতিগত পরীক্ষার ক্ষেত্র। রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো যদি সময়মতো এবং মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমন্বয় করা না হয়, তবে সেগুলো প্রকৃত অর্থে কোনো সুরক্ষা দিতে পারে না। ভাতার পরিমাণ যদি বাজারের দামের চেয়ে অনেক কম হয়, তবে তা কেবল প্রতীকী হিসেবেই থেকে যায়। মূল্যবৃদ্ধি মানুষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। যখন সাধারণ মানুষ দেখে যে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও থালায় ভাতের সংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ছে, তখন তারা রাষ্ট্রের নীতিগত ব্যর্থতা, দুর্নীতি বা বাজারের সিন্ডিকেট নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক চাপ মানুষের মনে ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দেয়, যা সামাজিক অস্থিরতা বা রাজনৈতিক মেরুকরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। সাধারণ নাগরিকের কাছে স্বাধীনতার বা সুশাসনের প্রধান মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায় বাজারের স্থিতিশীলতা এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতার নিরাপত্তা।
বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধি কেবল একটি সংখ্যার খেলা বা মুদ্রাস্ফীতির হার নয়; এটি একটি বহুমাত্রিক সামাজিক জরুরি অবস্থা। এ দেশের সাধারণ পরিবারগুলো কোনো নিষ্ক্রিয় ভুক্তভোগী নয়; তারা তাদের শ্রম, ভোগ, শিক্ষা এবং সামাজিক সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত পুনর্বিন্যাস করে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এই টিকে থাকার লড়াইয়ের একটি চড়া সামাজিক মূল্য রয়েছে। পুষ্টিহীনতা, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, শৈশবের অপমৃত্যু এবং ঋণের বোঝা আমাদের জাতীয় সক্ষমতাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তাই মুদ্রাস্ফীতিকে কেবল অর্থনীতির পরিভাষায় না দেখে একটি ‘সামাজিক সংকট’ হিসেবে বিবেচনা করা আজ সময়ের দাবি। দ্রুত এবং কার্যকর খাদ্য সহায়তা, স্বচ্ছ সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষায় বিনিয়োগ রক্ষা এবং বাজারের অব্যবস্থাপনা রোধে কঠোর ও সংবেদনশীল নীতিগত পদক্ষেপের মাধ্যমেই কেবল বাংলাদেশের সাধারণ পরিবারগুলোর মানবিক সক্ষমতা ও একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতিউর রহমান
রোববার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫
সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যবৃদ্ধি শব্দবন্ধগুলো যখনই সামনে আসে, তখনই আমাদের চোখে ভাসে অর্থনৈতিক নানা জটিল সমীকরণ, দ্রব্য ও সেবার সামগ্রিক মূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিংবা নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
দীর্ঘস্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের পরিবারগুলোকে এমন সব নতুন নতুন টিকে থাকার কৌশল গ্রহণে বাধ্য করছে, যা কেবল তাদের বর্তমানকে নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনাকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে
কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশের বাস্তবতায় মূল্যবৃদ্ধি কেবল পরিসংখ্যান বা খাতা-কলমের হিসাব নয়; এটি একটি গভীর এবং সুদূরপ্রসারী সামাজিক সংকট। এই সংকট মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আমূল পুনর্গঠন করে, পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধরণ বদলে দেয় এবং অস্তিত্ব রক্ষার বা টিকে থাকার অর্থকেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে। যখন খাদ্য, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবার মূল্য ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে, তখন তার অভিঘাত পরিবার, বৃহত্তর সম্প্রদায় এবং রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ওপর স্তরে স্তরে আছড়ে পড়ে। দীর্ঘস্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের পরিবারগুলোকে এমন সব নতুন নতুন টিকে থাকার কৌশল গ্রহণে বাধ্য করছে, যা কেবল তাদের বর্তমানকে নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনাকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। এই রূপান্তরগুলো লিঙ্গ সম্পর্ক, শিশুকল্যাণ, শ্রমবিন্যাস, অভিবাসন এবং নাগরিকদের রাজনৈতিক মনোভাবকেও স্থায়ীভাবে বদলে দিচ্ছে।
পারিবারিক স্তরে মূল্যবৃদ্ধির সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং দৃশ্যমান প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন বাজেটে। বাংলাদেশের দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মাসিক ব্যয়ের সিংহভাগ জুড়ে থাকে খাদ্য ও জ্বালানি। যখন চাল, ডাল, ভোজ্য তেল কিংবা গ্যাসের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন তাদের প্রকৃত আয় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সংকুচিত হয়। এই পরিস্থিতিতে পরিবারগুলো বাধ্য হয় তাদের ভোগ বা ব্যয়ের ধরনে চরম কাটছাঁট করতে। এই সমন্বয় প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক; তারা প্রথমে শৌখিনতা বিসর্জন দেয়, এরপর জরুরি নয় এমন ব্যয় স্থগিত করে এবং শেষ পর্যন্ত খাবারের মানের সঙ্গে আপস করতে শুরু করে। দামী মাছ, মাংস বা প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বাদ দিয়ে তারা কেবল পেট ভরানোর জন্য শর্করা বা কার্বোহাইড্রেটনির্ভর খাবারে ঝুঁকে পড়ে। এই ‘ক্যালরি-ভিত্তিক টিকে থাকা’ সাময়িকভাবে ক্ষুধার জ্বালা মেটালেও দীর্ঘমেয়াদে তা ভয়াবহ পুষ্টিহীনতা ডেকে আনে। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এই অপুষ্টির ফলাফল অপূরণীয়। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যে ঘাটতি আজ তৈরি হচ্ছে, তা তাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করবে, যা প্রকারান্তরে একটি পুরো প্রজন্মকে দারিদ্র্যের চক্রে আটকে রাখার ঝুঁকি তৈরি করছে।
মূল্যবৃদ্ধির চাপের একটি নীরব কিন্তু গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় পরিবারের অভ্যন্তরীণ লিঙ্গীয় সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশি সমাজব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই গৃহস্থালির ব্যয়ের ব্যবস্থাপনা, রান্না এবং পরিবারের সদস্যদের যত্নের দায়িত্ব পালন করেন। বাজার যখন অগ্নিমূল্য হয়, তখন এই সীমিত সম্পদ দিয়ে পুরো পরিবারের চাহিদা মেটানোর গুরুভার নারীর ওপর এসে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারের সীমিত খাবার যখন সবার মাঝে বণ্টন করা হয়, তখন নারীরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা সামাজিক চাপে নিজের অংশের খাবার কমিয়ে দেন। তারা শিশু বা পুরুষ সদস্যদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে গিয়ে নিজের স্বাস্থ্যের অবহেলা করেন। অন্যদিকে, পারিবারিক আয়ের ঘাটতি মেটাতে অনেক নারী বাধ্য হয়ে প্রথাগত গৃহকর্মের পাশাপাশি শ্রমবাজারে যুক্ত হন। এতে পরিবার আর্থিক কিছুটা স্বস্তি পেলেও নারীর ওপর তৈরি হয় এক ‘দ্বৈত বোঝা’ বা ‘টাইম পোভার্টি’। তাকে একই সঙ্গে ঘরের কাজ এবং বাইরের আয়বর্ধক কাজ সামলাতে হয়, যা তাঁর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করে। যথাযথ সামাজিক সুরক্ষা বা পারিবারিক সহায়তা ছাড়া এই পরিস্থিতি নারীদের শোষণমূলক বা অনিরাপদ কাজে যুক্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে শ্রমের ধরনেও এক ধরনের মরিয়া পরিবর্তন দেখা যায়। পরিবারগুলো তাদের টিকে থাকার কৌশল হিসেবে কাজের সময় বাড়িয়ে দেয় অথবা পরিবারের একাধিক সদস্যকে আয়ের সন্ধানে বাইরে পাঠাতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে করুণ শিকার হয় শিশুরা। যখন প্রাপ্তবয়স্কদের আয় দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে উপার্জনের পথে ঠেলে দেয়। শিশুশ্রমের এই বৃদ্ধি তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারের হাড়ির অন্ন জোগালেও এর বিনিময়ে জাতি তার ভবিষ্যতের দক্ষ মানবসম্পদ চিরতরে হারিয়ে ফেলে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও বাড়তি পরিশ্রম প্রায়ই কাক্সিক্ষত ফল দেয় না, কারণ বাজারে শ্রমের যোগান বাড়লেও মজুরি মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। এর ফলে পরিবারগুলো এক ধরনের চোরাবালিতে পড়ে যায় এবং নিরুপায় হয়ে ক্ষুদ্রঋণ বা উচ্চসুদের অনানুষ্ঠানিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই ঋণনির্ভরতা সাময়িকভাবে বিপদ কাটলেও দীর্ঘমেয়াদে পরিবারটিকে এক অন্তহীন দেনার দায়ে আবদ্ধ করে ফেলে, যা থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
মূল্যবৃদ্ধি যখন স্থানীয় পর্যায়ে জীবনধারণ অসম্ভব করে তোলে, তখন অভিবাসন একটি প্রধান টিকে থাকার কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়। গ্রামাঞ্চলে কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের অসামঞ্জস্যের কারণে মানুষ দ্রুত শহরমুখী হচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে এই অভ্যন্তরীণ অভিবাসন কেবল মানুষের স্থান পরিবর্তন নয়, বরং এটি একটি সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া। শহরে এসে এই মানুষগুলো অধিকাংশ সময় ঘিঞ্জি বস্তি বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয় এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে অত্যন্ত নিম্নমানের মজুরিতে কাজ করে। অন্যদিকে, অনেক পরিবারের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসন বা প্রবাসে শ্রমিক পাঠানো মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে একটি ঢাল হিসেবে কাজ করে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অনেক পরিবারকে চরম দারিদ্র?্য থেকে রক্ষা করলেও, এর পেছনে থাকে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়, জমি বিক্রি বা ঋণের বোঝা এবং প্রিয়জনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস। এই অভিবাসন কৌশলটি একদিকে যেমন সুরক্ষা দিচ্ছে, অন্যদিকে তা গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ও সামাজিক অস্থিরতাকেও উসকে দিচ্ছে।
একসময় বাংলাদেশের গ্রামীণ ও মফস্বল জীবনে প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের একে অপরকে সাহায্য করার একটি জোরালো সংস্কৃতি ছিল। সংকটের সময় চাল ধার দেওয়া কিংবা বিপদে অর্থ সাহায্য করা ছিল সামাজিক নেটওয়ার্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু বর্তমানের দীর্ঘস্থায়ী এবং সর্বগ্রাসী মূল্যবৃদ্ধি এই সামাজিক পুঁজিকে ক্রমশ ক্ষয় করে ফেলছে। যখন প্রায় প্রতিটি পরিবারই একই ধরনের অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যায়, তখন অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। পারস্পরিক সহায়তার এই ভিত্তিটি দুর্বল হয়ে পড়লে পরিবারগুলো তাদের শেষ সম্বল বা উৎপাদনক্ষম সম্পদ যেমন গবাদিপশু, কৃষি যন্ত্রপাতি কিংবা শেষ এক চিলতে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই ‘ডিস-ইনভেস্টিং’ বা সম্পদ বিক্রি স্বল্পমেয়াদে ক্ষুধা মেটালেও দীর্ঘমেয়াদে পরিবারের আয় করার সক্ষমতাকে চিরতরে নষ্ট করে দেয়। এর পাশাপাশি, শিক্ষা ব্যয়ের লাগামহীন বৃদ্ধি তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে তরুণরা যখন কম বয়সেই অনিরাপদ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, তখন তা সমাজে এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী হতাশা ও অদক্ষ শ্রমশক্তির আধিক্য তৈরি করছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুদ্রাস্ফীতি কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও নীতিগত পরীক্ষার ক্ষেত্র। রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো যদি সময়মতো এবং মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমন্বয় করা না হয়, তবে সেগুলো প্রকৃত অর্থে কোনো সুরক্ষা দিতে পারে না। ভাতার পরিমাণ যদি বাজারের দামের চেয়ে অনেক কম হয়, তবে তা কেবল প্রতীকী হিসেবেই থেকে যায়। মূল্যবৃদ্ধি মানুষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। যখন সাধারণ মানুষ দেখে যে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও থালায় ভাতের সংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ছে, তখন তারা রাষ্ট্রের নীতিগত ব্যর্থতা, দুর্নীতি বা বাজারের সিন্ডিকেট নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক চাপ মানুষের মনে ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দেয়, যা সামাজিক অস্থিরতা বা রাজনৈতিক মেরুকরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। সাধারণ নাগরিকের কাছে স্বাধীনতার বা সুশাসনের প্রধান মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায় বাজারের স্থিতিশীলতা এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতার নিরাপত্তা।
বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধি কেবল একটি সংখ্যার খেলা বা মুদ্রাস্ফীতির হার নয়; এটি একটি বহুমাত্রিক সামাজিক জরুরি অবস্থা। এ দেশের সাধারণ পরিবারগুলো কোনো নিষ্ক্রিয় ভুক্তভোগী নয়; তারা তাদের শ্রম, ভোগ, শিক্ষা এবং সামাজিক সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত পুনর্বিন্যাস করে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এই টিকে থাকার লড়াইয়ের একটি চড়া সামাজিক মূল্য রয়েছে। পুষ্টিহীনতা, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, শৈশবের অপমৃত্যু এবং ঋণের বোঝা আমাদের জাতীয় সক্ষমতাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তাই মুদ্রাস্ফীতিকে কেবল অর্থনীতির পরিভাষায় না দেখে একটি ‘সামাজিক সংকট’ হিসেবে বিবেচনা করা আজ সময়ের দাবি। দ্রুত এবং কার্যকর খাদ্য সহায়তা, স্বচ্ছ সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষায় বিনিয়োগ রক্ষা এবং বাজারের অব্যবস্থাপনা রোধে কঠোর ও সংবেদনশীল নীতিগত পদক্ষেপের মাধ্যমেই কেবল বাংলাদেশের সাধারণ পরিবারগুলোর মানবিক সক্ষমতা ও একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]