মিহির কুমার রায়

অস্থির পেঁয়াজের বাজার আবারও ভোক্তাদের জন্য বড় দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন সত্ত্বেও হঠাৎ করেই পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। মাঠ থেকে বাজারে আসতে শুরু করেছে নতুন পেঁয়াজ, কিছুদিন পরই বাজার ভরে যাওয়ার কথা। পাশাপাশি দেশে এখনো এক লাখ টনের বেশি পুরোনো পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। এরপরও বাজারে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সংকট।
মাঠ থেকে বাজারে আসতে শুরু করেছে নতুন পেঁয়াজ, কিছুদিন পরই বাজার ভরে যাওয়ার কথা। পাশাপাশি দেশে এখনো এক লাখ টনের বেশি পুরোনো পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। এরপরও বাজারে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সংকট
সিন্ডিকেটের পুরোনো ছকে পড়ে ভোক্তাসাধারণ আবারও বিপাকে। সরবরাহ কমে যাওয়ার অজুহাতে এক দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। বিক্রেতারা বলছেন, দেশি পেঁয়াজের মৌসুম শেষের দিকে থাকায় সরবরাহ কমেছে, তাই দাম বাড়ছে। একদিন আগেও মোকামে প্রতি মণ পেঁয়াজ ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকা ছিল, যা এখন বেড়ে ৪ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার ৩০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ মণপ্রতি প্রায় এক হাজার টাকা বেড়েছে দাম।
বিক্রেতাদের দাবি, নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করলেও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে দাম কমবে-এমন আশ্বাসও দিচ্ছেন তারা। তবে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যেই স্পষ্ট, সরবরাহ কম দেখিয়ে সরকারকে আমদানির অনুমতি দিতে চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছেন অসাধু একটি চক্র। প্রতি বছর অক্টোবর এলেই এই ছক বাস্তবায়ন হয় এবং প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকে।
এর প্রভাব পড়েছে রাজধানী ঢাকাতেও। শুক্রবার ঢাকার বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকায়, যেখানে দুই দিন আগেই সর্বোচ্চ দাম ছিল ১১০ টাকা। অক্টোবরের শেষদিকে কেজিপ্রতি দাম ছিল ৭০ টাকা এবং সেপ্টেম্বরে ৬০-৬৫ টাকা। বাস্তবে বাজারে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। আমদানির অনুমতি আদায়ের জন্যই সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।
পেঁয়াজের বাজার সহনীয় রাখতে সরকার প্রতিদিন ২০০টি করে আমদানির অনুমতি (আইপি) দেওয়া শুরু করেছে। প্রতিটি আইপিতে সর্বোচ্চ ৩০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন থাকবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৭ ডিসেম্বর থেকে এই অনুমতি দেওয়া শুরু হয়েছে। ১ আগস্ট থেকে যেসব ব্যবসায়ী আবেদন করেছিলেন, কেবল তারাই পুনরায় আবেদন করতে পারবেন। একজন আমদানিকারক একবারই আবেদন করতে পারবেন। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলবে।
তবে আমদানির পরও বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। ঢাকার খুচরা বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে দেশি পেঁয়াজের দামও কমেনি। পুরোনো দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়, আর নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকায়।
কয়েক বছর আগেও চাহিদা মেটাতে নিয়মিত পেঁয়াজ আমদানি করা হতো, যার পরিমাণ ছিল বছরে ৫-৬ লাখ টন। তবে গত এক দশকে উৎপাদন ও সংরক্ষণ সক্ষমতা বাড়ায় আমদানি নির্ভরতা কমছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে যেখানে ৪ লাখ ৮১ হাজার ৯৬৮ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, সেখানে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এক লাখ টনও আমদানি করতে হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মৌসুমের উৎপাদিত সাড়ে ৩ লাখ টন পেঁয়াজ এখনো মজুত রয়েছে। এ ছাড়া ৮৭ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যায়ে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে আরও প্রায় ২ লাখ ৩৭ হাজার টন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসবে। সব মিলিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ বাজারে সরবরাহ সম্ভব, যা মাসিক ২ লাখ ২০-৩০ হাজার টনের চাহিদার তুলনায় বেশি।
উৎপাদনের ধারাবাহিক বৃদ্ধিও স্পষ্ট। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন ছিল ৩৩ দশমিক ৬২১ লাখ টন, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ টনে। বিপরীতে আমদানি ক্রমান্বয়ে কমছে। এই স্বনির্ভরতার পেছনে সরকারের আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত এবং ‘এয়ার ফ্লো’ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ সুবিধা সম্প্রসারণ বড় ভূমিকা রেখেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের ভাষায়, কৃষক যেন ন্যায্যমূল্য পান এবং ভোক্তাও যেন অতিরিক্ত দামের বোঝা না বইতে হয়-এই ভারসাম্য রক্ষাই সরকারের লক্ষ্য। তাই এখন আমদানি স্থগিত রাখাই যুক্তিযুক্ত। অন্যদিকে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতির অভিযোগ, আড়তদার ও দাদন ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে। নজরদারি না বাড়ালে এই সিন্ডিকেট আবারও সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলবে।
সবশেষে বলা যায়, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যে পরনির্ভরতা কমানো জরুরি। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ সম্প্রসারণ, মৌসুমে আমদানি বন্ধ রাখা, পর্যাপ্ত ওয়্যারহাউস নির্মাণ এবং বাজার মনিটরিং জোরদার করাই পারে এই সংকটের টেকসই সমাধান দিতে। সর্বোপরি, পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনই কৃষক, ভোক্তা ও সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তির পথ।
[লেখক: সাবেক ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মিহির কুমার রায়

রোববার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫
অস্থির পেঁয়াজের বাজার আবারও ভোক্তাদের জন্য বড় দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন সত্ত্বেও হঠাৎ করেই পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। মাঠ থেকে বাজারে আসতে শুরু করেছে নতুন পেঁয়াজ, কিছুদিন পরই বাজার ভরে যাওয়ার কথা। পাশাপাশি দেশে এখনো এক লাখ টনের বেশি পুরোনো পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। এরপরও বাজারে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সংকট।
মাঠ থেকে বাজারে আসতে শুরু করেছে নতুন পেঁয়াজ, কিছুদিন পরই বাজার ভরে যাওয়ার কথা। পাশাপাশি দেশে এখনো এক লাখ টনের বেশি পুরোনো পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। এরপরও বাজারে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সংকট
সিন্ডিকেটের পুরোনো ছকে পড়ে ভোক্তাসাধারণ আবারও বিপাকে। সরবরাহ কমে যাওয়ার অজুহাতে এক দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। বিক্রেতারা বলছেন, দেশি পেঁয়াজের মৌসুম শেষের দিকে থাকায় সরবরাহ কমেছে, তাই দাম বাড়ছে। একদিন আগেও মোকামে প্রতি মণ পেঁয়াজ ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকা ছিল, যা এখন বেড়ে ৪ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার ৩০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ মণপ্রতি প্রায় এক হাজার টাকা বেড়েছে দাম।
বিক্রেতাদের দাবি, নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করলেও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে দাম কমবে-এমন আশ্বাসও দিচ্ছেন তারা। তবে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যেই স্পষ্ট, সরবরাহ কম দেখিয়ে সরকারকে আমদানির অনুমতি দিতে চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছেন অসাধু একটি চক্র। প্রতি বছর অক্টোবর এলেই এই ছক বাস্তবায়ন হয় এবং প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকে।
এর প্রভাব পড়েছে রাজধানী ঢাকাতেও। শুক্রবার ঢাকার বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকায়, যেখানে দুই দিন আগেই সর্বোচ্চ দাম ছিল ১১০ টাকা। অক্টোবরের শেষদিকে কেজিপ্রতি দাম ছিল ৭০ টাকা এবং সেপ্টেম্বরে ৬০-৬৫ টাকা। বাস্তবে বাজারে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। আমদানির অনুমতি আদায়ের জন্যই সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।
পেঁয়াজের বাজার সহনীয় রাখতে সরকার প্রতিদিন ২০০টি করে আমদানির অনুমতি (আইপি) দেওয়া শুরু করেছে। প্রতিটি আইপিতে সর্বোচ্চ ৩০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন থাকবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৭ ডিসেম্বর থেকে এই অনুমতি দেওয়া শুরু হয়েছে। ১ আগস্ট থেকে যেসব ব্যবসায়ী আবেদন করেছিলেন, কেবল তারাই পুনরায় আবেদন করতে পারবেন। একজন আমদানিকারক একবারই আবেদন করতে পারবেন। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলবে।
তবে আমদানির পরও বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। ঢাকার খুচরা বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে দেশি পেঁয়াজের দামও কমেনি। পুরোনো দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়, আর নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকায়।
কয়েক বছর আগেও চাহিদা মেটাতে নিয়মিত পেঁয়াজ আমদানি করা হতো, যার পরিমাণ ছিল বছরে ৫-৬ লাখ টন। তবে গত এক দশকে উৎপাদন ও সংরক্ষণ সক্ষমতা বাড়ায় আমদানি নির্ভরতা কমছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে যেখানে ৪ লাখ ৮১ হাজার ৯৬৮ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, সেখানে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এক লাখ টনও আমদানি করতে হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মৌসুমের উৎপাদিত সাড়ে ৩ লাখ টন পেঁয়াজ এখনো মজুত রয়েছে। এ ছাড়া ৮৭ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যায়ে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে আরও প্রায় ২ লাখ ৩৭ হাজার টন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসবে। সব মিলিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ বাজারে সরবরাহ সম্ভব, যা মাসিক ২ লাখ ২০-৩০ হাজার টনের চাহিদার তুলনায় বেশি।
উৎপাদনের ধারাবাহিক বৃদ্ধিও স্পষ্ট। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন ছিল ৩৩ দশমিক ৬২১ লাখ টন, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ টনে। বিপরীতে আমদানি ক্রমান্বয়ে কমছে। এই স্বনির্ভরতার পেছনে সরকারের আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত এবং ‘এয়ার ফ্লো’ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ সুবিধা সম্প্রসারণ বড় ভূমিকা রেখেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের ভাষায়, কৃষক যেন ন্যায্যমূল্য পান এবং ভোক্তাও যেন অতিরিক্ত দামের বোঝা না বইতে হয়-এই ভারসাম্য রক্ষাই সরকারের লক্ষ্য। তাই এখন আমদানি স্থগিত রাখাই যুক্তিযুক্ত। অন্যদিকে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতির অভিযোগ, আড়তদার ও দাদন ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে। নজরদারি না বাড়ালে এই সিন্ডিকেট আবারও সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলবে।
সবশেষে বলা যায়, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যে পরনির্ভরতা কমানো জরুরি। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ সম্প্রসারণ, মৌসুমে আমদানি বন্ধ রাখা, পর্যাপ্ত ওয়্যারহাউস নির্মাণ এবং বাজার মনিটরিং জোরদার করাই পারে এই সংকটের টেকসই সমাধান দিতে। সর্বোপরি, পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনই কৃষক, ভোক্তা ও সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তির পথ।
[লেখক: সাবেক ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]