সমীর কুমার সাহা
পরিবেশগত অবক্ষয় আজ আর ভবিষ্যতের সমস্যা নয়। এটি বাংলাদেশের জন্য এক চলমান জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা, যা প্রতিদিন অসুস্থতা, অকালমৃত্যু, চিকিৎসা ব্যয় ও স্বাস্থ্য বৈষম্যের পেছনে নীরবে কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, রাসায়নিক উপস্থিতি এবং জীববৈচিত্র?্য হ্রাস এখন শুধু পরিবেশবিদদের উদ্বেগ নয়; এগুলো আমাদের দৈনন্দিন স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবেশগত ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত, যার বড় অংশই প্রতিরোধযোগ্য। এটি আমাদের পুনরায় প্রশ্ন করতে বাধ্য করে, উন্নয়নের নামে কি আমরা এমন এক পথ বেছে নিচ্ছি, যা মানুষের জীবনকেই বিপন্ন করছে?
বায়ু দূষণ: শহুরে বাংলাদেশের নীরব ঘাতক ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে সূক্ষ্ম বস্তুকণা বছরের অধিকাংশ সময় নিরাপদ সীমার বহুগুণ বেশি। এর ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যানসার এবং গর্ভকালীন জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা আরও দেখাচ্ছে, দূষিত বায়ু শুধু শরীরকে নয়, স্নায়ুতন্ত্র ও স্মৃতিশক্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অর্থাৎ আমরা এমন এক পরিবেশে বসবাস করছি, যা আমাদের দৈনন্দিন স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকির বহুগুণ বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, তাপপ্রবাহ ও লবণাক্ততার বিস্তার মানুষের স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে তাপজনিত মৃত্যু বেড়েছে, বিশেষ করে শিশু, প্রবীণ ও খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে।
জলবায়ু পরিবর্তন বাহকবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার বিস্তারকে সহজ করছে। নগরায়ণ ও দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে মিলিত হয়ে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি তৈরি করেছে। পানি ও রাসায়নিক দূষণ: অদৃশ্য কিন্তু মারাত্মক বাংলাদেশে নিরাপদ পানির সংকট ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। আর্সেনিক দূষণের অভিজ্ঞতা আমাদের জানা, কিন্তু শিল্পবর্জ্য, কীটনাশক ও ভারী ধাতুসমৃদ্ধ পানি ও খাদ্যশৃঙ্খল নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। রাসায়নিক দূষণের প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে চোখে পড়ে না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি ক্যানসার, হরমোনজনিত সমস্যা, বন্ধ্যত্ব এবং শিশুদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠী।
পরিবেশগত অবিচার ও স্বাস্থ্য বৈষম্য পরিবেশগত ঝুঁকির বোঝা সমাজে সমানভাবে বণ্টিত নয়। দরিদ্র মানুষ, বস্তিবাসী, নারী, শিশু ও প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। গ্রামাঞ্চলে কঠিন জ্বালানি ব্যবহারজনিত ধোঁয়ায় নারীরা শ্বাসকষ্টে ভোগেন, শহরে বস্তিবাসীরা শিল্প দূষণের শিকার হন। যারা পরিবেশ ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে কম দায়ী, তারাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী-এটি এক ধরনের কাঠামোগত অবিচার। পরিবেশ রক্ষা মানেই স্বাস্থ্য বিনিয়োগ পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে রূপান্তর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে, বায়ু দূষণ কমায় এবং হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্ট হ্রাস করে। হাঁটাচলা ও সাইকেলবান্ধব নগর পরিকল্পনা মানুষের শারীরিক সক্রিয়তা ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে।
টেকসই ও নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা অপুষ্টি ও অসংক্রামক রোগ কমাতে সাহায্য করে। অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ মানেই উন্নয়ন থেমে যাওয়া নয়; বরং এটি সুস্থ, উৎপাদনশীল ও টেকসই সমাজ গঠনের ভিত্তি।
স্বাস্থ্যখাত ও নীতিগত করণীয়: স্বাস্থ্যখাত নিজেও পরিবেশগত অবক্ষয়ের শিকার এবং কিছু ক্ষেত্রে অবদানকারী। জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা, হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা এবং কার্বন নিঃসরণ কমানো জরুরি। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকে আলাদা করে দেখা যাবে না। জ্বালানি, নগর উন্নয়ন, শিল্প ও কৃষিনীতিতে স্বাস্থ্য প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকির পরিবর্তে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, গণপরিবহন ও সবুজ নগরায়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
পরিবেশগত অবক্ষয় একটি নীরব কিন্তু গভীর জনস্বাস্থ্য সংকট। আমরা যদি একে কেবল পরিবেশবিদদের উদ্বেগ হিসেবে দেখি, তাহলে এর মূল্য দিতে হবে মানুষের জীবন ও ভবিষ্যৎ দিয়ে। এখনই সময় পরিবেশ সুরক্ষাকে জনস্বাস্থ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আনার। কারণ সুস্থ পরিবেশ ছাড়া সুস্থ মানুষ সম্ভব নয়, আর সুস্থ মানুষ ছাড়া কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না।
[লেখক: প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ (পিএইচএফবিডি)]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সমীর কুমার সাহা
রোববার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫
পরিবেশগত অবক্ষয় আজ আর ভবিষ্যতের সমস্যা নয়। এটি বাংলাদেশের জন্য এক চলমান জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা, যা প্রতিদিন অসুস্থতা, অকালমৃত্যু, চিকিৎসা ব্যয় ও স্বাস্থ্য বৈষম্যের পেছনে নীরবে কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, রাসায়নিক উপস্থিতি এবং জীববৈচিত্র?্য হ্রাস এখন শুধু পরিবেশবিদদের উদ্বেগ নয়; এগুলো আমাদের দৈনন্দিন স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবেশগত ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত, যার বড় অংশই প্রতিরোধযোগ্য। এটি আমাদের পুনরায় প্রশ্ন করতে বাধ্য করে, উন্নয়নের নামে কি আমরা এমন এক পথ বেছে নিচ্ছি, যা মানুষের জীবনকেই বিপন্ন করছে?
বায়ু দূষণ: শহুরে বাংলাদেশের নীরব ঘাতক ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে সূক্ষ্ম বস্তুকণা বছরের অধিকাংশ সময় নিরাপদ সীমার বহুগুণ বেশি। এর ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যানসার এবং গর্ভকালীন জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা আরও দেখাচ্ছে, দূষিত বায়ু শুধু শরীরকে নয়, স্নায়ুতন্ত্র ও স্মৃতিশক্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অর্থাৎ আমরা এমন এক পরিবেশে বসবাস করছি, যা আমাদের দৈনন্দিন স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকির বহুগুণ বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, তাপপ্রবাহ ও লবণাক্ততার বিস্তার মানুষের স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে তাপজনিত মৃত্যু বেড়েছে, বিশেষ করে শিশু, প্রবীণ ও খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে।
জলবায়ু পরিবর্তন বাহকবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার বিস্তারকে সহজ করছে। নগরায়ণ ও দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে মিলিত হয়ে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি তৈরি করেছে। পানি ও রাসায়নিক দূষণ: অদৃশ্য কিন্তু মারাত্মক বাংলাদেশে নিরাপদ পানির সংকট ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। আর্সেনিক দূষণের অভিজ্ঞতা আমাদের জানা, কিন্তু শিল্পবর্জ্য, কীটনাশক ও ভারী ধাতুসমৃদ্ধ পানি ও খাদ্যশৃঙ্খল নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। রাসায়নিক দূষণের প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে চোখে পড়ে না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি ক্যানসার, হরমোনজনিত সমস্যা, বন্ধ্যত্ব এবং শিশুদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠী।
পরিবেশগত অবিচার ও স্বাস্থ্য বৈষম্য পরিবেশগত ঝুঁকির বোঝা সমাজে সমানভাবে বণ্টিত নয়। দরিদ্র মানুষ, বস্তিবাসী, নারী, শিশু ও প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। গ্রামাঞ্চলে কঠিন জ্বালানি ব্যবহারজনিত ধোঁয়ায় নারীরা শ্বাসকষ্টে ভোগেন, শহরে বস্তিবাসীরা শিল্প দূষণের শিকার হন। যারা পরিবেশ ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে কম দায়ী, তারাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী-এটি এক ধরনের কাঠামোগত অবিচার। পরিবেশ রক্ষা মানেই স্বাস্থ্য বিনিয়োগ পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে রূপান্তর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে, বায়ু দূষণ কমায় এবং হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্ট হ্রাস করে। হাঁটাচলা ও সাইকেলবান্ধব নগর পরিকল্পনা মানুষের শারীরিক সক্রিয়তা ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে।
টেকসই ও নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা অপুষ্টি ও অসংক্রামক রোগ কমাতে সাহায্য করে। অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ মানেই উন্নয়ন থেমে যাওয়া নয়; বরং এটি সুস্থ, উৎপাদনশীল ও টেকসই সমাজ গঠনের ভিত্তি।
স্বাস্থ্যখাত ও নীতিগত করণীয়: স্বাস্থ্যখাত নিজেও পরিবেশগত অবক্ষয়ের শিকার এবং কিছু ক্ষেত্রে অবদানকারী। জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা, হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা এবং কার্বন নিঃসরণ কমানো জরুরি। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকে আলাদা করে দেখা যাবে না। জ্বালানি, নগর উন্নয়ন, শিল্প ও কৃষিনীতিতে স্বাস্থ্য প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকির পরিবর্তে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, গণপরিবহন ও সবুজ নগরায়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
পরিবেশগত অবক্ষয় একটি নীরব কিন্তু গভীর জনস্বাস্থ্য সংকট। আমরা যদি একে কেবল পরিবেশবিদদের উদ্বেগ হিসেবে দেখি, তাহলে এর মূল্য দিতে হবে মানুষের জীবন ও ভবিষ্যৎ দিয়ে। এখনই সময় পরিবেশ সুরক্ষাকে জনস্বাস্থ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আনার। কারণ সুস্থ পরিবেশ ছাড়া সুস্থ মানুষ সম্ভব নয়, আর সুস্থ মানুষ ছাড়া কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না।
[লেখক: প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ (পিএইচএফবিডি)]