আনোয়ারুল হক

জ্বলছে প্রথম আলো কার্যালয়, লন্ডভন্ড বিধ্বস্ত ছায়ানট ভবন আর বেগম রোকেয়াকে মুরতাদ ঘোষণা
শৈশব, কৈশোরকালে ইসলামের ইতিহাসে আমরা পড়েছি, ইসলামের প্রাথমিক যুগে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রধান বিরোধী ছিলেন মক্কার কুরাইশ গোত্রের নেতা আমর বিন হিশাম। কুরাইশ গোত্রের মানুষ আমর বিন হিশামের মতামতকে বিশ্বাস করতেন। তার বুদ্ধিমত্তার কারণে ঐ সময়ে লোকে তাকে ‘আবুল হাকাম’ (জ্ঞানের পিতা) বললেও পরবর্তীকালে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি চরম শত্রুতার জন্য মুসলিমরা তাকে ‘আবু জাহেল’ (অজ্ঞতার পিতা) উপাধি দেয় এবং ঐ নামেই তিনি পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে তিনি নিহত হন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আবু জাহেলরা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ইতিহাসের নানা পর্বে তারা মুখে ইসলাম আর কাজে আবু জাহেলের ভূমিকা রেখে চলেছেন। আমাদের উপমহাদেশের দিকেই যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই তবে দেখতে পাবো ১৯৭১ সালে মুখে ইসলাম রক্ষার নামে ‘কাজে আবু জাহেলরা’ কি ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে একযোগে ইতিহাসের ভয়াবহতম এক হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। ইসলাম কি এ ধরনের আচরণ বা হত্যাযজ্ঞ অনুমোদন করে? এ প্রশ্নের উত্তরে সকল আলেম ওলেমারা, ইসলাম ধর্মের প-িতগন হয়তোবা একযোগে ‘না’ বলবেন। হয়তো বলবেন ‘সহিংসতা, হত্যাযজ্ঞ, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ঘৃণা কোনোভাবেই ঈমানের প্রকাশ নয়; বরং এগুলো ঈমানী ব্যর্থতার প্রতিফলন’।
কিন্তু ধর্মভীরুতাকে ‘কাজে আবু জাহেলরা’ যখন রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করে, তখনই জন্ম নেয় সহিংসতা। সেই সহিংসতার আগুনে গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশ জ্বলছে। শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর ঐ রাতেই প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটসহ আরও অনেক স্থানে পরিকল্পিত হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দেশের অনেক স্থানেই প্রথম আলোর স্থানীয় কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। পরদিনই আগুন লাগানো হয় ঢাকার তোপখানা সড়কে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। হাদির দুঃখজনক হত্যাকা-ের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে কিছু চিহ্নিত গোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে মব সংগঠিত করে এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। আর শুরু থেকেই মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার যে ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে সর্বশেষ ঘটনা তার আরেকটি ভয়াবহ উদাহরণ।
হাদি হত্যার সাথে এ দুটি পত্রিকা এবং ছায়ানট ও উদিচীর কোনো সংযোগ যে নেই তা এসব স্থাপনায় আক্রমণ পরিকল্পনাকারীরা ভালোভাবেই জানে। ওসমান হাদীর ‘ইনকিলাব মঞ্চের’ রাজনৈতিক বক্তব্যের সাথে প্রগতিবাদীরা তো বটেই উদার গণতন্ত্রীরাও একমত হবেন না। ৫ আগস্টের পরে মব সৃষ্টিতেও তার কিছু বক্তব্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এমনকি ‘নাগরিক কমিটি’তে থাকলেও এনসিপি তার বক্তব্যে একমত না হওয়ায় তিনি এনসিপিতে যুক্ত হননি। সাম্প্রতিককালে তিনি তার মত করে তার বক্তব্য ও নির্বাচনী প্রচারনা শান্তিপূর্ণভাবে করছিলেন। তাইতো দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সকল পত্রিকার সংবাদ ও মতামত বিভাগ এ হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছে। তারপরেও কেন এই হামলা এবং অগ্নিসংযোগ? আর এ ক্ষেত্রে সরকার কী দায়িত্ব পালন করল?
প্রধান উপদেষ্টা বারবার শুধু দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে বললেন। কিন্তু সরকারের নিজস্ব কোনো সতর্কতা থাকলো না। এ ঘটনায় সরকারের দায়িত্বহীনতার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর হামলা গোপনে বা লুকিয়ে হয়নি। ৫ আগস্টের পর থেকে এ সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত হুমকি আসছিলো উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে, দেশে বিদেশে অবস্থানরত কিছু ধান্দাবাজ অনলাইন এক্টিভিস্টদের পক্ষ থেকে। হামলার আগের দিনও শাহবাগ জমায়েত থেকে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে ‘হাদির কিছু হলে’ প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট, উদিচী গুড়িয়ে দেয়া হবে। তা ছাড়া সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির মধ্যেই এসব ঘটনা ঘটেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, ‘গত রাতে, ডেইলি স্টার আর প্রথম আলোর সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে যখন সাহায্যের আকুল আবেদন জানানো ফোন পাচ্ছিলাম, তখন তাদের গলা কান্নায় বুজে আসছিল। বন্ধুরা আমার, আপনাদের কাছে আমি বড় অপরাধী; আমি আপনাদের পাশে দাঁড়াতে পারলাম না।’ কেনো দাঁড়াতে পারলেন না? আপনি তো বলেছিলেন, জনগণ আপনাদের ‘সব কিছু করার ম্যানডেট দিয়েছে’। তাহলে কেন কিছু করতে পারলেন না? পারলেন না এ কারণেই যে এই ঘৃণা ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতি সরকারের কোনো উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির মধ্যে আপনিই প্রথম উষ্কে দিয়েছিলেন ভাষা সংগ্রামের ফেব্রুয়ারি মাসের বই মেলায়। আপনিই মব উল্লম্ফনকেও গণপ্রতিরোধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাই সব কিছু নজরদারিতে থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু টার্গেটে আক্রমণ হলে সরকার সক্রিয়তার সাথেই নিস্ক্রিয় থাকছে। এসব টার্গেটে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ অনেক ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে ঘটছে এবং তারা এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে দেখলে মনে হয় আক্রমণকারীকেই নিরাপত্তা পাহারা দিচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যতগুলো মব ভায়োলেন্স হয়েছে, নিরীহ একটি বিবৃতি দেয়া ছাড়া এই সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। সরকারের উপদেষ্টাদের কি অজানা যে, জুলাই আন্দোলনের পরে ছায়ানট ও উদীচীর বিরুদ্ধে কথিত তৌহিদী জনতা আর ইনসাফ ওয়ালারা ক্রমাগত হুমকি ধামকিসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার আর হিংসা ছড়ানোর উস্কানি দিয়ে যাচ্ছিলো। ষাটের দশকে পাক-সামরিক সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া এবং বেতার বা টেলিভিশনে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে। এ পটভূমিতে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ছায়ানট। কোনো রাজনৈতিক দল ও সরকার সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই বাঙালি সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, উদ্ভাস, প্রকাশ, বিকাশের সাথে জড়িয়ে আছে ছায়ানট। আর উদীচী ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আর ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে বিদ্রোহের গান গাইতে গাইতেই এর বিকাশ ও ব্যাপ্তি লাভ। উদীচীর কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেয়। ছায়ানট বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে দায়বদ্ধ থেকে, জাগরণের গান গেয়ে স্বাধীনতার পটভূমি সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তির গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছে আর উদীচী শিকল ভাঙার গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর ঠিক এ সব কারণেই ছায়ানট ও উদিচীর উপর মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির এ আক্রমণ। যদিও জুলাই আন্দোলনেও উদীচী কারফিউ ভেঙে বিদ্রোহের গান নিয়ে রাজপথে ছিলো।
আক্রমণের শিকার দুটি পত্রিকাই আওয়ামী লীগ আমলে সরকারের বিরাগভাজন ছিলো। ঐ দুই পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যে বিষোদগার করতেন। অনেক দৈনিকের ন্যায় এ দুটি পত্রিকাও জুলাই আন্দোলনের পক্ষেই তাদের ভূমিকা রেখেছে। শেখ হাসিনার কতৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীর তার কলম দিয়ে লড়াই করেছেন, আর ছাত্র জীবনে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গুলির মুখে বুক পেতে লড়াই করেছেন। সংবাদপত্র সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও বরেণ্য এই সাংবাদিককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করা হলো ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে। ‘পাশে আছি’, এ ধরনের মিষ্টি কথা বলা ছাড়া কী ব্যবস্থা নিল সরকার?
এনসিপির আহ্বায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তাই সরকারের ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ে তার কথার গুরুত্ব আছে। নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “সরকারের একটি অংশের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এবং তাদের পরিকল্পনা ছাড়া এ হামলা সম্ভব নয়”। তিনি আরও বলেন, “গতকালের হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা উচিত। তেমনি সরকারের ভেতরে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।” অবশ্য নাহিদ ইসলাম, মাহফুজ আলম এবং আসিফ মাহমুদ যখন একসাথে তিনজনই সরকারের অভ্যন্তরে শক্তিশালী উপদেষ্টা হিসাবে ছিলেন তখনও এই মব সন্ত্রাস বন্ধে তাদের কোনো বিশেষ উদ্যোগ কি দেশবাসী দেখেছে? নাহিদ ইসলামের এটাও অজানা নয় যে, ঐদিন শাহবাগে যে সমাবেশে তারা তিন প্রাক্তন উপদেষ্টাই উপস্থিত হয়েছিলেন Ñ প্রথম আলো, ডেইলি স্টারে হামলা করতে কিন্তু ঐ সমাবেশে থেকেই লোক সাপ্লাই হচ্ছিলো। প্রথম যারা গিয়েছিলেন তারা রাত ১১ টার দিকে উত্তেজনাকর শ্লোগান দিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়ে কিছু সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক দেখে শাহবাগে অবস্থান নেয়াদের ফোন করে আরো লোক ডেকে পাঠান এবং শাহবাগ থেকে আরো বড় জমায়েত প্রথম আলোর সামনে রাত পৌনে বারোটার দিকে আসে। শাহবাগ থেকে মিছিল রওনা হওয়ার আগেই প্রথম আলো কতৃপক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি অবহিত করে এবং সাহায্য চায়। ৪৫ মিনিট পার হয়ে গেলেও অন্য আর কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে দেখা যায়নি। নাহিদ ইসলাম, মাহফুজ আলম এবং আসিফ মাহমুদরা যে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য দিয়েছেন সেই সমাবেশের লোকজনই কিন্তু হামলাটা করে। তাহলে কি জুলাই আন্দোলনের সেই সমন্বয়কদের কথা এখন আর কেউ মান্য করছে না? সব কিছু লন্ডভন্ড ও পুড়ে ছাই হয়ে যাবার পর তিন প্রাক্তন উপদেষ্টা উপস্থিত হন সহমর্মিতা জানাতে!
হাদীর মৃত্যুর পর ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিদ্যালয় শাখার সভাপতি মোস্তাকুর রহমান সমাবেশ করে ঘোষণা করলেন, ‘আমরা আজকের এই প্রোগ্রাম থেকে ঘোষণা দিচ্ছি, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ সব সুশীল সংবাদপত্রকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এই প্রোগ্রামে যদি প্রথম আলো, ডেইলি স্টার পত্রিকার কোনো সাংবাদিক থেকে থাকেন, তাহলে এখনই এখান থেকে চলে যাবেন।’ ঐ রাতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি মোস্তাফিজুর রহমান ঘোষণা দিলেন, ‘বাম, শাহবাগি, ছায়ানট, উদীচীকে তছনছ করে দিতে হবে, তাহলেই বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হবে।’ আমিরে জামায়াত বিবৃতিতে যাই বলুন না কেনো বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার স্বাধীনতাকামী জামায়াত ইসলাম ও তার দোসররা যে এই হামলাও অগ্নিসংযোগের সাথে সংশ্লিষ্ট আছে তা রাবি ও জাবির শিবির নেতৃবৃন্দের ঘোষণার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ বিরোধী উগ্র ধর্মান্ধ এই রাজনৈতিক শক্তিসহ সাম্প্রদায়িক নানা বিভাজনের শক্তিকে কথিত সংস্কার সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনের কেন্দ্রে নিয়ে এসে এখন কি তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়ল? প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর তো আর মিডিয়ায় সেভাবে প্রচারিত হয় না। তারপরেও জানা গেলো রবিদাস সম্প্রদায়ভুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক যার কোনো এনড্রয়েড ফোন ছিলো না, ব্যবহার করতেন বাটন ফোন তার নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ এনে পিটিয়ে ও গাছে ঝুলিয়ে পুডিয়ে হত্যা করেছে তথাকথিত উন্মত্ত তৌহিদী জনতা। দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মবার্ষিকীতে পোস্ট দিচ্ছেন “আজ মুরতাদ কাফির বেগম রোকেয়ার জন্মদিন।” প্রফেসর ইউনূস কি একবারও ভেবে দেখেছেন তিনি দেশে কী ধরনের হুকুমত কায়েম করতে চলেছেন?
এই যে ঘটনাবলী ঘটে চলেছে তার মধ্য দিয়ে শুধু আগামী নির্বাচন - যা নাকি হবে ‘ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’, শুধু তাকেই নস্যাৎ করার চেষ্টা হচ্ছে না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। মাথায় লাল সবুজের পট্টি বেঁধে ছদ্মবেশে যে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা জুলাই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, এমনকি অনেকে নেতৃত্বেও ছিলেন এবং তারও আগে কেউ কেউ ছদ্মবেশে শামিল ছিলেন ছাত্রলীগে ও সরকারী দলে আজ তারা তাদের মুখোশ উন্মোচন করে মুখ দেখাচ্ছে। ঐ পট্টি মাথায় পরে তারা ঘোষণা করছে ‘আওয়ামী লীগ রাজনীতির সমর্থক ছিলেন এমন কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে তবে তাদের কলার ধরে টেনে এনে প্রশাসনিক ভবনের সামনে বেঁধে রাখা হবে’। এদের অনেকের বক্তব্য শুনে মনে হয়, হয় তারা মানসিকভাবে অসুস্থ অথবা নির্ভেজাল ফ্যাসিস্ট। এই সমস্ত তরুণদের পরামর্শ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা জরুরি। অধ্যাপক আলী রীয়াজ জুলাই সনদে ও গণভোটের প্রশ্ন তৈরি করার সময়ে এ বিষয়ে রাষ্ট্রের কর্তব্যের বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন কিভাবে? ধর্মের নামে সহিংসতার যে মগজধোলাই চলছে, তা বন্ধ করা নিদেন পক্ষে কমানোর জন্য এদের মানসিক স্বাস্থ্যের সংস্কার প্রয়োজন।
শরীফ ওসমান হাদী একদিক থেকে রক্ষা পেলেন যে, তাকে আর এ সব জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ ও কবি নজরুলের সমাধির পাশে তার দাফন হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম তিনি নাকি ইচ্ছা প্রকাশ করতেন মৃত্যু হলে যেন পিতার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এবং পরিবারের সম্মতিতে তাকে সমাধিস্থ হতে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে। সৃষ্টিকর্তা কবরে তাকে শান্তিতে রাখুন।
মনে রাখা প্রয়োজন জাতীয় কবি নজরুলের লেখনীতে উচ্চারিত হয়েছে, “মানুষেরে ঘৃণা করি’/ ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’/ ... হায় রে ভজনালয়,/ তোমার মিনারে চড়িয়া ভ- গাহে স্বার্থের জয়!” ভ- তথা ‘কাজে আবু জাহেলদের’ রাজত্ব যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে হাদির কবরের স্থাপনা হয়তো থাকবে, কিন্তু সেই ১৯৪৯ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের এই সূতিকাগারের কলাভবন, অপরাজেয় বাংলা, বটতলা, মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে, গুড়িয়ে, পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তাদের ‘ইনকিলাব’ সমাপ্ত হবে না। এমনকি এমন দাবিও উঠতে পারে যে, ‘মুরতাদ কবির’ কবরটাও পুরুলিয়ায় সরিয়ে নাও!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
আনোয়ারুল হক

জ্বলছে প্রথম আলো কার্যালয়, লন্ডভন্ড বিধ্বস্ত ছায়ানট ভবন আর বেগম রোকেয়াকে মুরতাদ ঘোষণা
মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
শৈশব, কৈশোরকালে ইসলামের ইতিহাসে আমরা পড়েছি, ইসলামের প্রাথমিক যুগে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রধান বিরোধী ছিলেন মক্কার কুরাইশ গোত্রের নেতা আমর বিন হিশাম। কুরাইশ গোত্রের মানুষ আমর বিন হিশামের মতামতকে বিশ্বাস করতেন। তার বুদ্ধিমত্তার কারণে ঐ সময়ে লোকে তাকে ‘আবুল হাকাম’ (জ্ঞানের পিতা) বললেও পরবর্তীকালে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি চরম শত্রুতার জন্য মুসলিমরা তাকে ‘আবু জাহেল’ (অজ্ঞতার পিতা) উপাধি দেয় এবং ঐ নামেই তিনি পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে তিনি নিহত হন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আবু জাহেলরা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ইতিহাসের নানা পর্বে তারা মুখে ইসলাম আর কাজে আবু জাহেলের ভূমিকা রেখে চলেছেন। আমাদের উপমহাদেশের দিকেই যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই তবে দেখতে পাবো ১৯৭১ সালে মুখে ইসলাম রক্ষার নামে ‘কাজে আবু জাহেলরা’ কি ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে একযোগে ইতিহাসের ভয়াবহতম এক হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। ইসলাম কি এ ধরনের আচরণ বা হত্যাযজ্ঞ অনুমোদন করে? এ প্রশ্নের উত্তরে সকল আলেম ওলেমারা, ইসলাম ধর্মের প-িতগন হয়তোবা একযোগে ‘না’ বলবেন। হয়তো বলবেন ‘সহিংসতা, হত্যাযজ্ঞ, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ঘৃণা কোনোভাবেই ঈমানের প্রকাশ নয়; বরং এগুলো ঈমানী ব্যর্থতার প্রতিফলন’।
কিন্তু ধর্মভীরুতাকে ‘কাজে আবু জাহেলরা’ যখন রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করে, তখনই জন্ম নেয় সহিংসতা। সেই সহিংসতার আগুনে গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশ জ্বলছে। শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর ঐ রাতেই প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটসহ আরও অনেক স্থানে পরিকল্পিত হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দেশের অনেক স্থানেই প্রথম আলোর স্থানীয় কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। পরদিনই আগুন লাগানো হয় ঢাকার তোপখানা সড়কে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। হাদির দুঃখজনক হত্যাকা-ের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে কিছু চিহ্নিত গোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে মব সংগঠিত করে এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। আর শুরু থেকেই মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার যে ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে সর্বশেষ ঘটনা তার আরেকটি ভয়াবহ উদাহরণ।
হাদি হত্যার সাথে এ দুটি পত্রিকা এবং ছায়ানট ও উদিচীর কোনো সংযোগ যে নেই তা এসব স্থাপনায় আক্রমণ পরিকল্পনাকারীরা ভালোভাবেই জানে। ওসমান হাদীর ‘ইনকিলাব মঞ্চের’ রাজনৈতিক বক্তব্যের সাথে প্রগতিবাদীরা তো বটেই উদার গণতন্ত্রীরাও একমত হবেন না। ৫ আগস্টের পরে মব সৃষ্টিতেও তার কিছু বক্তব্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এমনকি ‘নাগরিক কমিটি’তে থাকলেও এনসিপি তার বক্তব্যে একমত না হওয়ায় তিনি এনসিপিতে যুক্ত হননি। সাম্প্রতিককালে তিনি তার মত করে তার বক্তব্য ও নির্বাচনী প্রচারনা শান্তিপূর্ণভাবে করছিলেন। তাইতো দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সকল পত্রিকার সংবাদ ও মতামত বিভাগ এ হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছে। তারপরেও কেন এই হামলা এবং অগ্নিসংযোগ? আর এ ক্ষেত্রে সরকার কী দায়িত্ব পালন করল?
প্রধান উপদেষ্টা বারবার শুধু দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে বললেন। কিন্তু সরকারের নিজস্ব কোনো সতর্কতা থাকলো না। এ ঘটনায় সরকারের দায়িত্বহীনতার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর হামলা গোপনে বা লুকিয়ে হয়নি। ৫ আগস্টের পর থেকে এ সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত হুমকি আসছিলো উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে, দেশে বিদেশে অবস্থানরত কিছু ধান্দাবাজ অনলাইন এক্টিভিস্টদের পক্ষ থেকে। হামলার আগের দিনও শাহবাগ জমায়েত থেকে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে ‘হাদির কিছু হলে’ প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট, উদিচী গুড়িয়ে দেয়া হবে। তা ছাড়া সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির মধ্যেই এসব ঘটনা ঘটেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, ‘গত রাতে, ডেইলি স্টার আর প্রথম আলোর সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে যখন সাহায্যের আকুল আবেদন জানানো ফোন পাচ্ছিলাম, তখন তাদের গলা কান্নায় বুজে আসছিল। বন্ধুরা আমার, আপনাদের কাছে আমি বড় অপরাধী; আমি আপনাদের পাশে দাঁড়াতে পারলাম না।’ কেনো দাঁড়াতে পারলেন না? আপনি তো বলেছিলেন, জনগণ আপনাদের ‘সব কিছু করার ম্যানডেট দিয়েছে’। তাহলে কেন কিছু করতে পারলেন না? পারলেন না এ কারণেই যে এই ঘৃণা ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতি সরকারের কোনো উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির মধ্যে আপনিই প্রথম উষ্কে দিয়েছিলেন ভাষা সংগ্রামের ফেব্রুয়ারি মাসের বই মেলায়। আপনিই মব উল্লম্ফনকেও গণপ্রতিরোধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাই সব কিছু নজরদারিতে থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু টার্গেটে আক্রমণ হলে সরকার সক্রিয়তার সাথেই নিস্ক্রিয় থাকছে। এসব টার্গেটে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ অনেক ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে ঘটছে এবং তারা এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে দেখলে মনে হয় আক্রমণকারীকেই নিরাপত্তা পাহারা দিচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যতগুলো মব ভায়োলেন্স হয়েছে, নিরীহ একটি বিবৃতি দেয়া ছাড়া এই সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। সরকারের উপদেষ্টাদের কি অজানা যে, জুলাই আন্দোলনের পরে ছায়ানট ও উদীচীর বিরুদ্ধে কথিত তৌহিদী জনতা আর ইনসাফ ওয়ালারা ক্রমাগত হুমকি ধামকিসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার আর হিংসা ছড়ানোর উস্কানি দিয়ে যাচ্ছিলো। ষাটের দশকে পাক-সামরিক সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া এবং বেতার বা টেলিভিশনে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে। এ পটভূমিতে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ছায়ানট। কোনো রাজনৈতিক দল ও সরকার সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই বাঙালি সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, উদ্ভাস, প্রকাশ, বিকাশের সাথে জড়িয়ে আছে ছায়ানট। আর উদীচী ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আর ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে বিদ্রোহের গান গাইতে গাইতেই এর বিকাশ ও ব্যাপ্তি লাভ। উদীচীর কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেয়। ছায়ানট বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে দায়বদ্ধ থেকে, জাগরণের গান গেয়ে স্বাধীনতার পটভূমি সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তির গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছে আর উদীচী শিকল ভাঙার গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর ঠিক এ সব কারণেই ছায়ানট ও উদিচীর উপর মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির এ আক্রমণ। যদিও জুলাই আন্দোলনেও উদীচী কারফিউ ভেঙে বিদ্রোহের গান নিয়ে রাজপথে ছিলো।
আক্রমণের শিকার দুটি পত্রিকাই আওয়ামী লীগ আমলে সরকারের বিরাগভাজন ছিলো। ঐ দুই পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যে বিষোদগার করতেন। অনেক দৈনিকের ন্যায় এ দুটি পত্রিকাও জুলাই আন্দোলনের পক্ষেই তাদের ভূমিকা রেখেছে। শেখ হাসিনার কতৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীর তার কলম দিয়ে লড়াই করেছেন, আর ছাত্র জীবনে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গুলির মুখে বুক পেতে লড়াই করেছেন। সংবাদপত্র সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও বরেণ্য এই সাংবাদিককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করা হলো ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে। ‘পাশে আছি’, এ ধরনের মিষ্টি কথা বলা ছাড়া কী ব্যবস্থা নিল সরকার?
এনসিপির আহ্বায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তাই সরকারের ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ে তার কথার গুরুত্ব আছে। নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “সরকারের একটি অংশের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এবং তাদের পরিকল্পনা ছাড়া এ হামলা সম্ভব নয়”। তিনি আরও বলেন, “গতকালের হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা উচিত। তেমনি সরকারের ভেতরে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।” অবশ্য নাহিদ ইসলাম, মাহফুজ আলম এবং আসিফ মাহমুদ যখন একসাথে তিনজনই সরকারের অভ্যন্তরে শক্তিশালী উপদেষ্টা হিসাবে ছিলেন তখনও এই মব সন্ত্রাস বন্ধে তাদের কোনো বিশেষ উদ্যোগ কি দেশবাসী দেখেছে? নাহিদ ইসলামের এটাও অজানা নয় যে, ঐদিন শাহবাগে যে সমাবেশে তারা তিন প্রাক্তন উপদেষ্টাই উপস্থিত হয়েছিলেন Ñ প্রথম আলো, ডেইলি স্টারে হামলা করতে কিন্তু ঐ সমাবেশে থেকেই লোক সাপ্লাই হচ্ছিলো। প্রথম যারা গিয়েছিলেন তারা রাত ১১ টার দিকে উত্তেজনাকর শ্লোগান দিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়ে কিছু সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক দেখে শাহবাগে অবস্থান নেয়াদের ফোন করে আরো লোক ডেকে পাঠান এবং শাহবাগ থেকে আরো বড় জমায়েত প্রথম আলোর সামনে রাত পৌনে বারোটার দিকে আসে। শাহবাগ থেকে মিছিল রওনা হওয়ার আগেই প্রথম আলো কতৃপক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি অবহিত করে এবং সাহায্য চায়। ৪৫ মিনিট পার হয়ে গেলেও অন্য আর কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে দেখা যায়নি। নাহিদ ইসলাম, মাহফুজ আলম এবং আসিফ মাহমুদরা যে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য দিয়েছেন সেই সমাবেশের লোকজনই কিন্তু হামলাটা করে। তাহলে কি জুলাই আন্দোলনের সেই সমন্বয়কদের কথা এখন আর কেউ মান্য করছে না? সব কিছু লন্ডভন্ড ও পুড়ে ছাই হয়ে যাবার পর তিন প্রাক্তন উপদেষ্টা উপস্থিত হন সহমর্মিতা জানাতে!
হাদীর মৃত্যুর পর ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিদ্যালয় শাখার সভাপতি মোস্তাকুর রহমান সমাবেশ করে ঘোষণা করলেন, ‘আমরা আজকের এই প্রোগ্রাম থেকে ঘোষণা দিচ্ছি, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ সব সুশীল সংবাদপত্রকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এই প্রোগ্রামে যদি প্রথম আলো, ডেইলি স্টার পত্রিকার কোনো সাংবাদিক থেকে থাকেন, তাহলে এখনই এখান থেকে চলে যাবেন।’ ঐ রাতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি মোস্তাফিজুর রহমান ঘোষণা দিলেন, ‘বাম, শাহবাগি, ছায়ানট, উদীচীকে তছনছ করে দিতে হবে, তাহলেই বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হবে।’ আমিরে জামায়াত বিবৃতিতে যাই বলুন না কেনো বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার স্বাধীনতাকামী জামায়াত ইসলাম ও তার দোসররা যে এই হামলাও অগ্নিসংযোগের সাথে সংশ্লিষ্ট আছে তা রাবি ও জাবির শিবির নেতৃবৃন্দের ঘোষণার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ বিরোধী উগ্র ধর্মান্ধ এই রাজনৈতিক শক্তিসহ সাম্প্রদায়িক নানা বিভাজনের শক্তিকে কথিত সংস্কার সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনের কেন্দ্রে নিয়ে এসে এখন কি তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়ল? প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর তো আর মিডিয়ায় সেভাবে প্রচারিত হয় না। তারপরেও জানা গেলো রবিদাস সম্প্রদায়ভুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক যার কোনো এনড্রয়েড ফোন ছিলো না, ব্যবহার করতেন বাটন ফোন তার নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ এনে পিটিয়ে ও গাছে ঝুলিয়ে পুডিয়ে হত্যা করেছে তথাকথিত উন্মত্ত তৌহিদী জনতা। দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মবার্ষিকীতে পোস্ট দিচ্ছেন “আজ মুরতাদ কাফির বেগম রোকেয়ার জন্মদিন।” প্রফেসর ইউনূস কি একবারও ভেবে দেখেছেন তিনি দেশে কী ধরনের হুকুমত কায়েম করতে চলেছেন?
এই যে ঘটনাবলী ঘটে চলেছে তার মধ্য দিয়ে শুধু আগামী নির্বাচন - যা নাকি হবে ‘ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’, শুধু তাকেই নস্যাৎ করার চেষ্টা হচ্ছে না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। মাথায় লাল সবুজের পট্টি বেঁধে ছদ্মবেশে যে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা জুলাই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, এমনকি অনেকে নেতৃত্বেও ছিলেন এবং তারও আগে কেউ কেউ ছদ্মবেশে শামিল ছিলেন ছাত্রলীগে ও সরকারী দলে আজ তারা তাদের মুখোশ উন্মোচন করে মুখ দেখাচ্ছে। ঐ পট্টি মাথায় পরে তারা ঘোষণা করছে ‘আওয়ামী লীগ রাজনীতির সমর্থক ছিলেন এমন কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে তবে তাদের কলার ধরে টেনে এনে প্রশাসনিক ভবনের সামনে বেঁধে রাখা হবে’। এদের অনেকের বক্তব্য শুনে মনে হয়, হয় তারা মানসিকভাবে অসুস্থ অথবা নির্ভেজাল ফ্যাসিস্ট। এই সমস্ত তরুণদের পরামর্শ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা জরুরি। অধ্যাপক আলী রীয়াজ জুলাই সনদে ও গণভোটের প্রশ্ন তৈরি করার সময়ে এ বিষয়ে রাষ্ট্রের কর্তব্যের বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন কিভাবে? ধর্মের নামে সহিংসতার যে মগজধোলাই চলছে, তা বন্ধ করা নিদেন পক্ষে কমানোর জন্য এদের মানসিক স্বাস্থ্যের সংস্কার প্রয়োজন।
শরীফ ওসমান হাদী একদিক থেকে রক্ষা পেলেন যে, তাকে আর এ সব জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ ও কবি নজরুলের সমাধির পাশে তার দাফন হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম তিনি নাকি ইচ্ছা প্রকাশ করতেন মৃত্যু হলে যেন পিতার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এবং পরিবারের সম্মতিতে তাকে সমাধিস্থ হতে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে। সৃষ্টিকর্তা কবরে তাকে শান্তিতে রাখুন।
মনে রাখা প্রয়োজন জাতীয় কবি নজরুলের লেখনীতে উচ্চারিত হয়েছে, “মানুষেরে ঘৃণা করি’/ ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’/ ... হায় রে ভজনালয়,/ তোমার মিনারে চড়িয়া ভ- গাহে স্বার্থের জয়!” ভ- তথা ‘কাজে আবু জাহেলদের’ রাজত্ব যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে হাদির কবরের স্থাপনা হয়তো থাকবে, কিন্তু সেই ১৯৪৯ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের এই সূতিকাগারের কলাভবন, অপরাজেয় বাংলা, বটতলা, মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে, গুড়িয়ে, পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তাদের ‘ইনকিলাব’ সমাপ্ত হবে না। এমনকি এমন দাবিও উঠতে পারে যে, ‘মুরতাদ কবির’ কবরটাও পুরুলিয়ায় সরিয়ে নাও!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]