হোসেন আবদুল মান্নান
বাংলাদেশে ট্রেনের ভ্রমণ সবচেয়ে সহজ, নিরাপদ এবং স্বল্পব্যয়বহুল। ট্রেনে চেপে এতা নির্বিঘ্নে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের সুবিধা বোধহয় পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। স্বাধীন সার্বভৌম ও দায়হীন হয়ে এখানকার মানুষই ট্রেনকে ব্যবহার করে থাকে। যার জন্যে তাদের খুব আর্থিক ব্যয় করতে হয়না। বিশেষ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকাল ট্রেনের যাত্রীরা যারা রেলস্টেশনের ২/৩ কি. মি. এলাকায় বসবাস করেন, তাদের অন্তত ৯৫% যাত্রী টিকিটবিহীন যাতায়াত করে। এবং এই ভ্রমণ যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ধরে চলে এসেছে। এটা চলেছে সময়ের পরম্পরায় শতাব্দীকাল ব্যাপী।
২.
বৃটিশ ভারতের এই অঞ্চলে অর্থাৎ আমাদের পূর্ব বাংলায় ট্রেন চালু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। সেদিন রেল শুরু হয়েছিল কুষ্টিয়া জেলার জগতি স্টেশন থেকে দর্শনা স্টেশন পর্যন্ত ৫৩.১১ কি.মি. ব্রডগেজ রেললাইনে। বলাবাহুল্য, ভারতে বৃটিশরাজের দুঃশাসনকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং বিস্ময়কর অবদান হলো রেলপথ চালু করা। যা তাদের স্বার্থেই চালু করা হয়েছিল। আর এই কর্মের জন্যে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ক্ষণজন্মা শাসক লর্ড ডালহৌসীকে (১৮১২-১৮৬০) ভারতবর্ষের মানুষ কখনো ভুলে যাবে না। তার প্রচেষ্টাই এদেশে রেলপথের গোড়াপত্তন হয়েছিল। এ কথাও সত্য যে, গণপরিবহন মাধ্যম হিসেবে রেলপথ আজোবধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। বাংলাদেশেও সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় পরিবহন খাত হলো রেলওয়ে। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করেই বাংলাদেশ সরকার বিগত ১৯৯০ সালে রেলওয়েকে বিভাগ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রনালয়ের স্বীকৃতি দেয়। বাৎসরিক বাজেট বহুগুণ বৃদ্ধি করে।
বর্তমানে এ বি সি ক্যাটাগরিতে এ দেশে রেলস্টেশনের সংখ্যা ৪৫৫টি। দেশে রেললাইনের আয়তন পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে ২,৭০০ কি.মি. কাছাকাছি। রেলের জমি ক্রমেই বেহাত হতে হতে মার্জিনে পৌঁছে যাচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও এর পরিমাণ ছিল ৬০,৬৩৩ একর। সুশাসনের অভাবে রেলপথ আশানুরূপ সম্প্রসারিত না হয়ে সংকুচিত পথে হেঁটেছে।
৩.
রেল বাঙালিদের কাছে বরাবরই ভীষণ এক কৌতুহলের নাম। এর যাত্রালগ্ন থেকে অধ্যাবধি- সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে অন্যান্য দেশের মতন বাংলাদেশ রেলওয়েতেও এসেছে নানাবিধ বৈচিত্র?্য। রেলপথে পৃথিবীব্যাপী যাত্রী পরিবহনে এসেছে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। মেইল ট্রেন, কমিউটার ট্রেন, এক্সপ্রেস ট্রেন, বুলেট ট্রেন কতকিছু এসেছে। বাংলাদেশেও বুলেট ট্রেন চালু নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা চলেছিল। টিকিট প্রদান ও সংগ্রহে চলেছে অনলাইন ব্যবস্থা। কম্পিউটারাইজ পদ্ধতিতে কামরা এবং সীট বরাদ্দ হচ্ছে। তথাপি কোনো ট্রেনে তিলধারণের ঠাঁই নেই। জনসংখ্যা তথা যাত্রীর আধিক্যের কারণে নিজের আসনে নিরাপদে আয়েশে চলাচল করতে পারছে না শান্তিপ্রিয় টিকিটধারী সুশীল যাত্রীগণ।
একটা কথা সবসময়ই শোনা যায়, এত যাত্রী, স্টেশন ভর্তি অসংখ্য প্যাসেঞ্জারের সমাগম। এমনকি স্থান সংকুলান না হওয়ায় স্ট্যান্ডিং টিকিট দেওয়া হচ্ছে শত-শত করে। তারপরও বাংলাদেশ রেলওয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত না হয়ে অলাভজনক ভর্তুকি-নির্ভর সংগঠন কেন? এর পেছনের আসল রহস্য কী? রেল কখনো কি লাভবান প্রতিষ্টানে উঠে দাঁড়াবে? অবস্থাদৃষ্ঠে প্রতীয়মান হয়, মূল কারণ হলো, দেশের সর্বত্র বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহন করা। রেলওয়ের এবং ট্রেনের অভ্যন্তরীন আইন ও কর্ম-শৃঙ্খলা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীগণ দুর্নীতিতে আকন্ঠ- নিমজ্জিত এবং প্রতিবাদহীন এক পুতুলে পরিণত হয়েছে। তারা একজন সাধারণ যাত্রীকেও জিজ্ঞেস করতে প্রায় ভুলেই গেছেন, ‘টিকিট ছাড়া ট্রেনে উঠলেন কেন ? আপনাকে জরিমানা দিতে হবে’। এমন একটা নৈতিক এবং সৎ প্রশ্ন করতেও তারা দ্বিধান্বিত, শঙ্কিত। শোনা যায়, টিকিট করার বিষয়ে তারা নিজেরাই নিরুৎসাহিত করে থাকেন। বরং তাদের হাতে নগদ দশ টাকা তুলে দিলেই তারা অধিকতর খুশি।
আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত স্বচক্ষে দেখেছি, দেশের ছোট ছোট স্টেশনগুলোতে লোকাল ট্রেনেও আকস্মিক ভ্রাম্যমান আদালত বসেছে। টিকিটবিহীন যাত্রীদের দিবালোকে, জনসমক্ষে জরিমানা করা হয়েছে। দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে অন্যরা শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হয়েছে। দেশ থেকে এসব প্রায় উঠেই গেছে, কোথাও চিহ্নটুকু নেই। ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ কয়েক কি.মি. দূর থেকে সিএনজি, অটোরিকশার ভাড়া পরিশোধ করে ট্রেনে চলেছে বিনা ভাড়ায়। এভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেশের প্রত্যন্ত এলাকার ট্রেনগুলো ব্যবহার করে চলেছে বিনা বাধায়, বিনা প্রশ্নে এবং বিনা খরচে। কোথাও কেউ নেই জিজ্ঞেস করার। আরও একটা শ্রেণি যারা চাকরিজীবী বা পেশাজীবী। উপজেলা, জেলা পর্যায়ে কর্মরত আছেন, নিত্যদিন দু’বার ট্রেনের সার্ভিস নিচ্ছেন কিন্তু কখনো টিকিটের কথা মাথায় আনেন না। অথচ অন্য সকল বাহনের জন্যই তাকে যথাযথ ভাড়া শোধ করতে হচ্ছে শুধু মাত্র ট্রেনটা সরকারের অধীনে সরকারের মাল বলে কারও দায়িত্ব নেই।
৪.
তবে ইদানীং সারা দেশে রেলস্টেশনের পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষেরা ট্রেনের টিকিট না করার আরেকটা কারণ অনলাইন পদ্ধতি। এক স্টেশন থেকে পরবর্তী আরেক স্টেশনে যেতে একজন যাত্রীকে পেছনের আরও অন্তত ৫/৬ টা স্টেশনের সমান মূল্যের টিকিট ক্রয় করতে হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতি স্টেশনের জন্য পৃথকভাবে টিকিট নেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যা পূর্বে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে ছিল। তখন মোটা কাগজের ছোট ছোট স্পাঞ্জ করা হলদে বর্ণের টিকিট ছিল। এভাবে ৫ বা ১০ টাকার টিকিট করা হলে টিকিট ক্রয় বিষয়ে হয়তোবা এদের মানসিক ও নৈতিক মননে স্পর্শ করা যেত। দায় চাপানো সহজতর হতো। তারা ৬০ টাকার টিকিট করে এক বা দুই স্টেশন দূরবর্তী আনুমানিক ৬/৭ মাইল রাস্তা যাবে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে এবিষয়ে পরীক্ষা করতে হবে, ভাবতে হবে। টিকিটের মূল্য তালিকায় পরিবর্তন এনে মানুষকে বাস সার্ভিসের মত সেবার বিনিময়ে অর্থ প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। রেডিও, টিভিতে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় এমন আইন অমান্যকারী, নির্বোধ, স্বেচ্ছাচারী ও নৈরাজ্যবাদী মানসিকতা থেকে মানুষকে বের করে আনা সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, দেশের কোনো কোনো রুটে তিতাস, বলাকা এসব নামে কমিউটার ট্রেন চালু আছে। তারা তাৎক্ষণিকভাবে টিকিট প্রদান করে যাত্রীদের জন্য সার্ভিস দিয়ে চলেছে। সেখানে মানুষ টিকিট করছে ট্রেনে চড়ছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে শোনা যায় না। তারা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় তা পরিচালনা করছে বিধায় সম্ভব হচ্ছে। এ-ও জানা যায়, যাত্রীরা টিকিট না করে বলপ্রয়োগ করে বা জোরজবরদস্তি পূর্বক ট্রেনে চড়ছে না। বরং শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু সকল দুরাচার ও দুরাবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। এখানে সর্ষের ভেতর অগণিত ভূত বাস করে। অপরদিকে, বাংলাদেশ রেলওয়েকে সড়ক পথ বা বাস মালিকদের সমিতি যেভাবে জিম্মি করে রেখেছে দুনিয়ার আর কোথাও এমন অসহায়ত্ব আছে বলে মনে হয় না। এখানে নাকি বাস সমিতির সঙ্গে আলোচনা করেই ট্রেন তার সিডিউল/ সময়সূচি নির্ধারণ করে থাকে। মূল টার্গেট হলো সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা, বিপদগ্রস্ত করে অধিক মুনাফা করা। দেশের প্রান্ত থেকে রাজধানীর সাথে যোগাযোগকারী ট্রেনগুলোর আগমন এবং প্রস্থানে স্বাধীন কোনো সিদ্ধান্ত নেই বললেই চলে।
৫.
পৃথিবীর দেশে-দেশে রেল এক নিরাপদ, সহজলভ্য ও কম ব্যয়বহুল গণপরিবহনের নাম। সাধারণ মানুষের কাছেও সবচেয়ে বড় আশ্রয় স্থল। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিলাসিতাও ট্রেনের ভ্রমণকেন্দ্রিক। বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা উন্নত দেশ থেকে শুরু করে এশিয়া, আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশেও রেলপথ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম। পার্শ্ববর্তী ভারতের মত জনবহুল ও বিশাল আয়তনের রাষ্ট্রের লাইফ লাইন হলো রেলপথ। সেখানে মালামাল পরিবহন লাভজনক হওয়া সত্বেও গণপরিবহনে তারা অধিকতর বৈচিত্র?্য এনেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কেবল ২০১৮ সালে ভারতের রেলপথে যাত্রী চলাচল করেছে ৯.১১৬ বিলিয়ন।
সারা দুনিয়ায় দীর্ঘ ভ্রমণের পথে মানুষ ট্রেনকেই প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। ইউরোপের দেশগুলোতে রেলওয়ে আকাশ পথের গৌরবকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। যদিও এদিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এখানকার ট্রেনে আধুনিকতার ছাপ ও সেবা সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আর এর প্রধান কারণ সরকারি খাত বা পাবলিক সেক্টর হিসেবে রেল কাংখিত মানে উপনীত হতে পারে নি। আমাদের ট্রেন সার্ভিসকে বিশেষ কোনো কোনো রুটে পরীক্ষামূলক ভাবে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে গণযোগাযোগে আমূল পরিবর্তন আনা এবং গণপ্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব কিনা তা অবশ্যই ভাবতে হবে। দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকেই এমনটা মনে করেন।
[লেখক: গল্পকার]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
হোসেন আবদুল মান্নান
বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশে ট্রেনের ভ্রমণ সবচেয়ে সহজ, নিরাপদ এবং স্বল্পব্যয়বহুল। ট্রেনে চেপে এতা নির্বিঘ্নে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের সুবিধা বোধহয় পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। স্বাধীন সার্বভৌম ও দায়হীন হয়ে এখানকার মানুষই ট্রেনকে ব্যবহার করে থাকে। যার জন্যে তাদের খুব আর্থিক ব্যয় করতে হয়না। বিশেষ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকাল ট্রেনের যাত্রীরা যারা রেলস্টেশনের ২/৩ কি. মি. এলাকায় বসবাস করেন, তাদের অন্তত ৯৫% যাত্রী টিকিটবিহীন যাতায়াত করে। এবং এই ভ্রমণ যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ধরে চলে এসেছে। এটা চলেছে সময়ের পরম্পরায় শতাব্দীকাল ব্যাপী।
২.
বৃটিশ ভারতের এই অঞ্চলে অর্থাৎ আমাদের পূর্ব বাংলায় ট্রেন চালু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। সেদিন রেল শুরু হয়েছিল কুষ্টিয়া জেলার জগতি স্টেশন থেকে দর্শনা স্টেশন পর্যন্ত ৫৩.১১ কি.মি. ব্রডগেজ রেললাইনে। বলাবাহুল্য, ভারতে বৃটিশরাজের দুঃশাসনকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং বিস্ময়কর অবদান হলো রেলপথ চালু করা। যা তাদের স্বার্থেই চালু করা হয়েছিল। আর এই কর্মের জন্যে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ক্ষণজন্মা শাসক লর্ড ডালহৌসীকে (১৮১২-১৮৬০) ভারতবর্ষের মানুষ কখনো ভুলে যাবে না। তার প্রচেষ্টাই এদেশে রেলপথের গোড়াপত্তন হয়েছিল। এ কথাও সত্য যে, গণপরিবহন মাধ্যম হিসেবে রেলপথ আজোবধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। বাংলাদেশেও সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় পরিবহন খাত হলো রেলওয়ে। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করেই বাংলাদেশ সরকার বিগত ১৯৯০ সালে রেলওয়েকে বিভাগ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রনালয়ের স্বীকৃতি দেয়। বাৎসরিক বাজেট বহুগুণ বৃদ্ধি করে।
বর্তমানে এ বি সি ক্যাটাগরিতে এ দেশে রেলস্টেশনের সংখ্যা ৪৫৫টি। দেশে রেললাইনের আয়তন পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে ২,৭০০ কি.মি. কাছাকাছি। রেলের জমি ক্রমেই বেহাত হতে হতে মার্জিনে পৌঁছে যাচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও এর পরিমাণ ছিল ৬০,৬৩৩ একর। সুশাসনের অভাবে রেলপথ আশানুরূপ সম্প্রসারিত না হয়ে সংকুচিত পথে হেঁটেছে।
৩.
রেল বাঙালিদের কাছে বরাবরই ভীষণ এক কৌতুহলের নাম। এর যাত্রালগ্ন থেকে অধ্যাবধি- সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে অন্যান্য দেশের মতন বাংলাদেশ রেলওয়েতেও এসেছে নানাবিধ বৈচিত্র?্য। রেলপথে পৃথিবীব্যাপী যাত্রী পরিবহনে এসেছে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। মেইল ট্রেন, কমিউটার ট্রেন, এক্সপ্রেস ট্রেন, বুলেট ট্রেন কতকিছু এসেছে। বাংলাদেশেও বুলেট ট্রেন চালু নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা চলেছিল। টিকিট প্রদান ও সংগ্রহে চলেছে অনলাইন ব্যবস্থা। কম্পিউটারাইজ পদ্ধতিতে কামরা এবং সীট বরাদ্দ হচ্ছে। তথাপি কোনো ট্রেনে তিলধারণের ঠাঁই নেই। জনসংখ্যা তথা যাত্রীর আধিক্যের কারণে নিজের আসনে নিরাপদে আয়েশে চলাচল করতে পারছে না শান্তিপ্রিয় টিকিটধারী সুশীল যাত্রীগণ।
একটা কথা সবসময়ই শোনা যায়, এত যাত্রী, স্টেশন ভর্তি অসংখ্য প্যাসেঞ্জারের সমাগম। এমনকি স্থান সংকুলান না হওয়ায় স্ট্যান্ডিং টিকিট দেওয়া হচ্ছে শত-শত করে। তারপরও বাংলাদেশ রেলওয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত না হয়ে অলাভজনক ভর্তুকি-নির্ভর সংগঠন কেন? এর পেছনের আসল রহস্য কী? রেল কখনো কি লাভবান প্রতিষ্টানে উঠে দাঁড়াবে? অবস্থাদৃষ্ঠে প্রতীয়মান হয়, মূল কারণ হলো, দেশের সর্বত্র বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহন করা। রেলওয়ের এবং ট্রেনের অভ্যন্তরীন আইন ও কর্ম-শৃঙ্খলা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীগণ দুর্নীতিতে আকন্ঠ- নিমজ্জিত এবং প্রতিবাদহীন এক পুতুলে পরিণত হয়েছে। তারা একজন সাধারণ যাত্রীকেও জিজ্ঞেস করতে প্রায় ভুলেই গেছেন, ‘টিকিট ছাড়া ট্রেনে উঠলেন কেন ? আপনাকে জরিমানা দিতে হবে’। এমন একটা নৈতিক এবং সৎ প্রশ্ন করতেও তারা দ্বিধান্বিত, শঙ্কিত। শোনা যায়, টিকিট করার বিষয়ে তারা নিজেরাই নিরুৎসাহিত করে থাকেন। বরং তাদের হাতে নগদ দশ টাকা তুলে দিলেই তারা অধিকতর খুশি।
আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত স্বচক্ষে দেখেছি, দেশের ছোট ছোট স্টেশনগুলোতে লোকাল ট্রেনেও আকস্মিক ভ্রাম্যমান আদালত বসেছে। টিকিটবিহীন যাত্রীদের দিবালোকে, জনসমক্ষে জরিমানা করা হয়েছে। দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে অন্যরা শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হয়েছে। দেশ থেকে এসব প্রায় উঠেই গেছে, কোথাও চিহ্নটুকু নেই। ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ কয়েক কি.মি. দূর থেকে সিএনজি, অটোরিকশার ভাড়া পরিশোধ করে ট্রেনে চলেছে বিনা ভাড়ায়। এভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেশের প্রত্যন্ত এলাকার ট্রেনগুলো ব্যবহার করে চলেছে বিনা বাধায়, বিনা প্রশ্নে এবং বিনা খরচে। কোথাও কেউ নেই জিজ্ঞেস করার। আরও একটা শ্রেণি যারা চাকরিজীবী বা পেশাজীবী। উপজেলা, জেলা পর্যায়ে কর্মরত আছেন, নিত্যদিন দু’বার ট্রেনের সার্ভিস নিচ্ছেন কিন্তু কখনো টিকিটের কথা মাথায় আনেন না। অথচ অন্য সকল বাহনের জন্যই তাকে যথাযথ ভাড়া শোধ করতে হচ্ছে শুধু মাত্র ট্রেনটা সরকারের অধীনে সরকারের মাল বলে কারও দায়িত্ব নেই।
৪.
তবে ইদানীং সারা দেশে রেলস্টেশনের পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষেরা ট্রেনের টিকিট না করার আরেকটা কারণ অনলাইন পদ্ধতি। এক স্টেশন থেকে পরবর্তী আরেক স্টেশনে যেতে একজন যাত্রীকে পেছনের আরও অন্তত ৫/৬ টা স্টেশনের সমান মূল্যের টিকিট ক্রয় করতে হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতি স্টেশনের জন্য পৃথকভাবে টিকিট নেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যা পূর্বে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে ছিল। তখন মোটা কাগজের ছোট ছোট স্পাঞ্জ করা হলদে বর্ণের টিকিট ছিল। এভাবে ৫ বা ১০ টাকার টিকিট করা হলে টিকিট ক্রয় বিষয়ে হয়তোবা এদের মানসিক ও নৈতিক মননে স্পর্শ করা যেত। দায় চাপানো সহজতর হতো। তারা ৬০ টাকার টিকিট করে এক বা দুই স্টেশন দূরবর্তী আনুমানিক ৬/৭ মাইল রাস্তা যাবে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে এবিষয়ে পরীক্ষা করতে হবে, ভাবতে হবে। টিকিটের মূল্য তালিকায় পরিবর্তন এনে মানুষকে বাস সার্ভিসের মত সেবার বিনিময়ে অর্থ প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। রেডিও, টিভিতে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় এমন আইন অমান্যকারী, নির্বোধ, স্বেচ্ছাচারী ও নৈরাজ্যবাদী মানসিকতা থেকে মানুষকে বের করে আনা সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, দেশের কোনো কোনো রুটে তিতাস, বলাকা এসব নামে কমিউটার ট্রেন চালু আছে। তারা তাৎক্ষণিকভাবে টিকিট প্রদান করে যাত্রীদের জন্য সার্ভিস দিয়ে চলেছে। সেখানে মানুষ টিকিট করছে ট্রেনে চড়ছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে শোনা যায় না। তারা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় তা পরিচালনা করছে বিধায় সম্ভব হচ্ছে। এ-ও জানা যায়, যাত্রীরা টিকিট না করে বলপ্রয়োগ করে বা জোরজবরদস্তি পূর্বক ট্রেনে চড়ছে না। বরং শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু সকল দুরাচার ও দুরাবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। এখানে সর্ষের ভেতর অগণিত ভূত বাস করে। অপরদিকে, বাংলাদেশ রেলওয়েকে সড়ক পথ বা বাস মালিকদের সমিতি যেভাবে জিম্মি করে রেখেছে দুনিয়ার আর কোথাও এমন অসহায়ত্ব আছে বলে মনে হয় না। এখানে নাকি বাস সমিতির সঙ্গে আলোচনা করেই ট্রেন তার সিডিউল/ সময়সূচি নির্ধারণ করে থাকে। মূল টার্গেট হলো সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা, বিপদগ্রস্ত করে অধিক মুনাফা করা। দেশের প্রান্ত থেকে রাজধানীর সাথে যোগাযোগকারী ট্রেনগুলোর আগমন এবং প্রস্থানে স্বাধীন কোনো সিদ্ধান্ত নেই বললেই চলে।
৫.
পৃথিবীর দেশে-দেশে রেল এক নিরাপদ, সহজলভ্য ও কম ব্যয়বহুল গণপরিবহনের নাম। সাধারণ মানুষের কাছেও সবচেয়ে বড় আশ্রয় স্থল। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিলাসিতাও ট্রেনের ভ্রমণকেন্দ্রিক। বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা উন্নত দেশ থেকে শুরু করে এশিয়া, আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশেও রেলপথ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম। পার্শ্ববর্তী ভারতের মত জনবহুল ও বিশাল আয়তনের রাষ্ট্রের লাইফ লাইন হলো রেলপথ। সেখানে মালামাল পরিবহন লাভজনক হওয়া সত্বেও গণপরিবহনে তারা অধিকতর বৈচিত্র?্য এনেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কেবল ২০১৮ সালে ভারতের রেলপথে যাত্রী চলাচল করেছে ৯.১১৬ বিলিয়ন।
সারা দুনিয়ায় দীর্ঘ ভ্রমণের পথে মানুষ ট্রেনকেই প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। ইউরোপের দেশগুলোতে রেলওয়ে আকাশ পথের গৌরবকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। যদিও এদিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এখানকার ট্রেনে আধুনিকতার ছাপ ও সেবা সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আর এর প্রধান কারণ সরকারি খাত বা পাবলিক সেক্টর হিসেবে রেল কাংখিত মানে উপনীত হতে পারে নি। আমাদের ট্রেন সার্ভিসকে বিশেষ কোনো কোনো রুটে পরীক্ষামূলক ভাবে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে গণযোগাযোগে আমূল পরিবর্তন আনা এবং গণপ্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব কিনা তা অবশ্যই ভাবতে হবে। দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকেই এমনটা মনে করেন।
[লেখক: গল্পকার]