alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

মিথুশিলাক মুরমু

: বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫

মানুষের প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হলো- প্রিয় পুত্র প্রভু যীশু খ্রিষ্টকে দান করা। বিশ্বব্রহ্মা-ের স্রষ্টা ঈশ্বর মানুষকে ভালোবেসে তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে স্থায়ী করতে প্রিয় পুত্রের মাধ্যমে এক সেতুবন্ধন রচনা করেছেন। একে ধর্মতত্ত্বের ভাষায় ‘ইনকারনেশন’ বা দেহধারণ বলা হয়। শাস্ত্রে অতীতের পৃথিবীতে মানুষের প্রতি স্রষ্টার ক্ষুব্ধতা, প্রতিশোধ ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ পাওয়া যায়; তবুও সৃষ্ট মানুষ বারবার ঈশ্বরকে উপেক্ষা করেছে। এবার ঈশ্বর ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে পৌঁছেছেন।

প্রভু যীশু খ্রিষ্টের প্রচারিত বাণীর মূলমন্ত্র ছিল- ভালোবাসা। তৎকালীন শাস্ত্রবিদেরা প্রশ্ন করলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন- ‘তোমার সমস্ত অন্তঃকরণ, তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত মন দিয়ে তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করিবে’ এবং দ্বিতীয়টি- ‘তোমার প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করিবে।’ প্রথম আজ্ঞাটি সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের পূর্ণাঙ্গ সমর্পণ ও ভালোবাসার নির্দেশ দেয়, আর দ্বিতীয়টি মানুষকে নিজের মতো করে অন্যকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। প্রকৃত ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে ত্যাগ, ক্ষমা ও অনুতাপ; এটি কখনো সীমানাবদ্ধ নয়। এতে প্রাপ্তির চেয়ে অন্যকে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে নির্মল আনন্দ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘তাই তোমার আনন্দ আমার, পর, তুমি তাই এসেছ নীচে- আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে।’

প্রভু যীশু খ্রিষ্টের জন্মের রাতে আকাশে উজ্জ্বল তারার ঝলকানি প্রত্যক্ষ করেছিলেন পূর্বদেশীয় প-িতেরা। মাঠের রাখালেরা স্বর্গদূতদের মাধ্যমে জন্মসংবাদ পেয়ে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেছিলেন। অন্ধকার জগতকে আলোকিত করা এবং সত্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রভু যীশু খ্রিষ্ট অন্ধকার রাতকে বেছে নেন। তিনি জন্ম নেন সবচেয়ে অবহেলিত, অবাঞ্ছিত ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে। স্রষ্টার আকাক্সক্ষা ছিল- প্রভু যীশুর আলোয় যেন কেউ অন্ধকারের রাজত্বে বাস না করে। মানুষের জীবন থেকে শুরু করে প্রাণিজগৎ ও সমগ্র বিশ্বব্রহ্মা-- সর্বত্রই ভালোবাসার স্পর্শ অপরিহার্য। ভালোবাসাহীন পৃথিবী মানবসভ্যতাকে আজ হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বড়দিন সেই মহাক্ষণ, যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক আলোর আগমন ঘটেছিল। ঈশ্বরের আকাক্সক্ষা, যা ভাববাণীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, তার পূর্ণতা এসেছে। তার জন্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি, প্রেম, ক্ষমা ও ভালোবাসার বার্তা প্রচারিত হয়েছে। তাই বড়দিন মানে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ এবং দরিদ্র ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা।

সদাপ্রভু ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করাই হলো পাপ। পাপ মানুষের বিবেক ও চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। স্রষ্টার বিরুদ্ধে অপরাধবোধ মানুষের অন্তরে অস্থিরতা ও ভয় সৃষ্টি করে। মানবদেহেও পাপের প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়- রোগ, জরা ও বার্ধক্য আমাদের মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। পাপ মানুষের মনে ভয় ও দুশ্চিন্তা জন্ম দেয়, যা আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্রোগের কারণ হতে পারে। তিনি ভগ্নহৃদয় সুস্থ করেন। গীতসংহিতায় বলা হয়েছে- ‘তোমার কোপহেতু আমার মাংসে কিছু স্বাস্থ্য নাই, আমার পাপের কারণে আমার অস্থির মধ্যে শান্তি নাই’ (গীত ৩৮:৩)। দুশ্চিন্তা ও অনুশোচনার অভাব শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই প্রভু যীশু খ্রিষ্ট একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করার সময় জনসমক্ষে বলেছিলেন- ‘তোমার পাপ সকল ক্ষমা হইল।’ এতে বোঝা যায়, পাপ ও শারীরিক অবস্থার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

সদাপ্রভু বলেন- ‘আমিই সদাপ্রভু, তোমার আরোগ্যকারী।’ পবিত্র বাইবেল জানায়- ‘তোমরা ঈশ্বরের মন্দির, এবং ঈশ্বরের আত্মা তোমাদের মধ্যে বাস করেন।’ ঈশ্বরের উপস্থিতিতে আমাদের চিন্তা, কথা ও কাজ কল্যাণমুখী হতে বাধ্য। নীতি-নৈতিকতাই তখন জীবনের মানদ- হয়ে ওঠে। ভালোবাসার শক্তিতেই মন্দকে জয় করা সম্ভব এবং মানুষের জীবন বদলে দেওয়া যায়। প্রভু যীশু খ্রিষ্টের জন্ম সম্পর্কে প্রায় সাড়ে সাতশ বছর আগেই ভাববাণী করা হয়েছিল। যীশুর আরেক নাম ইম্মানুয়েল- যার অর্থ ‘ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন’। বড়দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ঈশ্বর মানুষকে একা ছেড়ে দেননি; বরং মানুষের সুখ-দুঃখে অংশ নিতে তিনি পৃথিবীতে এসেছেন।

ঈশ্বর মানুষকে ভালোবেসেছেন বলেই মানুষকেও নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটি ধর্মীয় নির্দেশনা এবং অবশ্যই পালনীয়। তিনি যুগান্তকারী শিক্ষা দিয়েছেন- ‘তোমরা আপন আপন শত্রুদের প্রেম করো এবং যারা তোমাদের তাড়না করে, তাদের জন্য প্রার্থনা করো।’ তিনি কেবল শিক্ষা দেননি, নিজের জীবন দিয়ে তার প্রমাণ দিয়েছেন। ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবেও তিনি যুক্ত করেছেন- ‘যেমন আমরাও আপন আপন অপরাধীদের ক্ষমা করেছি।’ শত্রুকে ক্ষমা করা মানে মন্দের কাছে পরাজিত হওয়া নয়; বরং উত্তমের দ্বারা মন্দকে জয় করা। ক্ষমা মানুষের তিক্ততা দূর করে এবং আধ্যাত্মিক শান্তি এনে দেয়। হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা রাগ ও ঘৃণা ভারী বোঝার মতো- যা সৃজনশীলতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। অন্যকে ক্ষমা করার মাধ্যমে মানুষ মানসিক বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়।

একমাত্র প্রভু যীশু খ্রিষ্টের জন্ম নিয়েই অজস্র ভাববাণী করা হয়েছিল। তাকে দেওয়া হয়েছে নানা উপাধি- আশ্চর্য মন্ত্রী, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা ও শান্তিরাজ। তার প্রদর্শিত পথেই অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি, অন্যায়তার স্থানে ন্যায্যতা এবং ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। পতিত মানবজাতিকে মুক্তির সঠিক পথ দেখিয়েছেন যীশু খ্রিষ্ট।

যীশু নামটি স্বয়ং স্রষ্টার প্রদত্ত। এই নামের মাহাত্ম্য অপরিসীম- ‘যেন যীশু নাম শুনিলে স্বর্গীয়, মর্ত্য ও পাতালস্থ সকলের জানু পতিত হয়’ (ফিলিপীয় ২:১০)। যীশু নামের হিব্রু অর্থ- ত্রাণকর্তা, অর্থাৎ প্রভু উদ্ধার করেন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে- তিনি তার প্রজাদের পাপ থেকে পরিত্রাণ করবেন। পরিত্রাণ ঈশ্বরের অনুগ্রহ, যা মানুষের বিশ্বাসের মাধ্যমে কার্যকর হয়। এটি কোনো নিয়ম পালনের বিষয় নয়; বরং ঈশ্বরের সঙ্গে একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের নাম। সেই সম্পর্কের স্থায়িত্বই হলো বড়দিন। হৃদয়ে বড়দিনের বাণী গেঁথে নিলে আমাদের জীবনে নেমে আসবে শান্তি, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, ক্ষমা ও ভালোবাসা।

প্রত্যেককে জানাই বড়দিনের শুভেচ্ছা। শুভ বড়দিন।

[লেখক: কলামিস্ট]

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

বিনা-ভাড়ার ট্রেনযাত্রা

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

মিথুশিলাক মুরমু

বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫

মানুষের প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হলো- প্রিয় পুত্র প্রভু যীশু খ্রিষ্টকে দান করা। বিশ্বব্রহ্মা-ের স্রষ্টা ঈশ্বর মানুষকে ভালোবেসে তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে স্থায়ী করতে প্রিয় পুত্রের মাধ্যমে এক সেতুবন্ধন রচনা করেছেন। একে ধর্মতত্ত্বের ভাষায় ‘ইনকারনেশন’ বা দেহধারণ বলা হয়। শাস্ত্রে অতীতের পৃথিবীতে মানুষের প্রতি স্রষ্টার ক্ষুব্ধতা, প্রতিশোধ ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ পাওয়া যায়; তবুও সৃষ্ট মানুষ বারবার ঈশ্বরকে উপেক্ষা করেছে। এবার ঈশ্বর ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে পৌঁছেছেন।

প্রভু যীশু খ্রিষ্টের প্রচারিত বাণীর মূলমন্ত্র ছিল- ভালোবাসা। তৎকালীন শাস্ত্রবিদেরা প্রশ্ন করলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন- ‘তোমার সমস্ত অন্তঃকরণ, তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত মন দিয়ে তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করিবে’ এবং দ্বিতীয়টি- ‘তোমার প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করিবে।’ প্রথম আজ্ঞাটি সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের পূর্ণাঙ্গ সমর্পণ ও ভালোবাসার নির্দেশ দেয়, আর দ্বিতীয়টি মানুষকে নিজের মতো করে অন্যকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। প্রকৃত ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে ত্যাগ, ক্ষমা ও অনুতাপ; এটি কখনো সীমানাবদ্ধ নয়। এতে প্রাপ্তির চেয়ে অন্যকে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে নির্মল আনন্দ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘তাই তোমার আনন্দ আমার, পর, তুমি তাই এসেছ নীচে- আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে।’

প্রভু যীশু খ্রিষ্টের জন্মের রাতে আকাশে উজ্জ্বল তারার ঝলকানি প্রত্যক্ষ করেছিলেন পূর্বদেশীয় প-িতেরা। মাঠের রাখালেরা স্বর্গদূতদের মাধ্যমে জন্মসংবাদ পেয়ে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেছিলেন। অন্ধকার জগতকে আলোকিত করা এবং সত্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রভু যীশু খ্রিষ্ট অন্ধকার রাতকে বেছে নেন। তিনি জন্ম নেন সবচেয়ে অবহেলিত, অবাঞ্ছিত ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে। স্রষ্টার আকাক্সক্ষা ছিল- প্রভু যীশুর আলোয় যেন কেউ অন্ধকারের রাজত্বে বাস না করে। মানুষের জীবন থেকে শুরু করে প্রাণিজগৎ ও সমগ্র বিশ্বব্রহ্মা-- সর্বত্রই ভালোবাসার স্পর্শ অপরিহার্য। ভালোবাসাহীন পৃথিবী মানবসভ্যতাকে আজ হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বড়দিন সেই মহাক্ষণ, যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক আলোর আগমন ঘটেছিল। ঈশ্বরের আকাক্সক্ষা, যা ভাববাণীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, তার পূর্ণতা এসেছে। তার জন্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি, প্রেম, ক্ষমা ও ভালোবাসার বার্তা প্রচারিত হয়েছে। তাই বড়দিন মানে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ এবং দরিদ্র ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা।

সদাপ্রভু ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করাই হলো পাপ। পাপ মানুষের বিবেক ও চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। স্রষ্টার বিরুদ্ধে অপরাধবোধ মানুষের অন্তরে অস্থিরতা ও ভয় সৃষ্টি করে। মানবদেহেও পাপের প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়- রোগ, জরা ও বার্ধক্য আমাদের মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। পাপ মানুষের মনে ভয় ও দুশ্চিন্তা জন্ম দেয়, যা আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্রোগের কারণ হতে পারে। তিনি ভগ্নহৃদয় সুস্থ করেন। গীতসংহিতায় বলা হয়েছে- ‘তোমার কোপহেতু আমার মাংসে কিছু স্বাস্থ্য নাই, আমার পাপের কারণে আমার অস্থির মধ্যে শান্তি নাই’ (গীত ৩৮:৩)। দুশ্চিন্তা ও অনুশোচনার অভাব শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই প্রভু যীশু খ্রিষ্ট একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করার সময় জনসমক্ষে বলেছিলেন- ‘তোমার পাপ সকল ক্ষমা হইল।’ এতে বোঝা যায়, পাপ ও শারীরিক অবস্থার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

সদাপ্রভু বলেন- ‘আমিই সদাপ্রভু, তোমার আরোগ্যকারী।’ পবিত্র বাইবেল জানায়- ‘তোমরা ঈশ্বরের মন্দির, এবং ঈশ্বরের আত্মা তোমাদের মধ্যে বাস করেন।’ ঈশ্বরের উপস্থিতিতে আমাদের চিন্তা, কথা ও কাজ কল্যাণমুখী হতে বাধ্য। নীতি-নৈতিকতাই তখন জীবনের মানদ- হয়ে ওঠে। ভালোবাসার শক্তিতেই মন্দকে জয় করা সম্ভব এবং মানুষের জীবন বদলে দেওয়া যায়। প্রভু যীশু খ্রিষ্টের জন্ম সম্পর্কে প্রায় সাড়ে সাতশ বছর আগেই ভাববাণী করা হয়েছিল। যীশুর আরেক নাম ইম্মানুয়েল- যার অর্থ ‘ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন’। বড়দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ঈশ্বর মানুষকে একা ছেড়ে দেননি; বরং মানুষের সুখ-দুঃখে অংশ নিতে তিনি পৃথিবীতে এসেছেন।

ঈশ্বর মানুষকে ভালোবেসেছেন বলেই মানুষকেও নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটি ধর্মীয় নির্দেশনা এবং অবশ্যই পালনীয়। তিনি যুগান্তকারী শিক্ষা দিয়েছেন- ‘তোমরা আপন আপন শত্রুদের প্রেম করো এবং যারা তোমাদের তাড়না করে, তাদের জন্য প্রার্থনা করো।’ তিনি কেবল শিক্ষা দেননি, নিজের জীবন দিয়ে তার প্রমাণ দিয়েছেন। ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবেও তিনি যুক্ত করেছেন- ‘যেমন আমরাও আপন আপন অপরাধীদের ক্ষমা করেছি।’ শত্রুকে ক্ষমা করা মানে মন্দের কাছে পরাজিত হওয়া নয়; বরং উত্তমের দ্বারা মন্দকে জয় করা। ক্ষমা মানুষের তিক্ততা দূর করে এবং আধ্যাত্মিক শান্তি এনে দেয়। হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা রাগ ও ঘৃণা ভারী বোঝার মতো- যা সৃজনশীলতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। অন্যকে ক্ষমা করার মাধ্যমে মানুষ মানসিক বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়।

একমাত্র প্রভু যীশু খ্রিষ্টের জন্ম নিয়েই অজস্র ভাববাণী করা হয়েছিল। তাকে দেওয়া হয়েছে নানা উপাধি- আশ্চর্য মন্ত্রী, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা ও শান্তিরাজ। তার প্রদর্শিত পথেই অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি, অন্যায়তার স্থানে ন্যায্যতা এবং ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। পতিত মানবজাতিকে মুক্তির সঠিক পথ দেখিয়েছেন যীশু খ্রিষ্ট।

যীশু নামটি স্বয়ং স্রষ্টার প্রদত্ত। এই নামের মাহাত্ম্য অপরিসীম- ‘যেন যীশু নাম শুনিলে স্বর্গীয়, মর্ত্য ও পাতালস্থ সকলের জানু পতিত হয়’ (ফিলিপীয় ২:১০)। যীশু নামের হিব্রু অর্থ- ত্রাণকর্তা, অর্থাৎ প্রভু উদ্ধার করেন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে- তিনি তার প্রজাদের পাপ থেকে পরিত্রাণ করবেন। পরিত্রাণ ঈশ্বরের অনুগ্রহ, যা মানুষের বিশ্বাসের মাধ্যমে কার্যকর হয়। এটি কোনো নিয়ম পালনের বিষয় নয়; বরং ঈশ্বরের সঙ্গে একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের নাম। সেই সম্পর্কের স্থায়িত্বই হলো বড়দিন। হৃদয়ে বড়দিনের বাণী গেঁথে নিলে আমাদের জীবনে নেমে আসবে শান্তি, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, ক্ষমা ও ভালোবাসা।

প্রত্যেককে জানাই বড়দিনের শুভেচ্ছা। শুভ বড়দিন।

[লেখক: কলামিস্ট]

back to top