alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

বাবুল রবিদাস

: বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫

গত ১০ নভেম্বর বিভিন্ন পত্রপত্রিকার শিরোনাম ছিল- ‘চট্টগ্রামে শতবর্ষী কালীমন্দিরের গহনা ও টাকা চুরি’। জানা যায়, চোরেরা কালীর মাথায় থাকা ৩৯ ভরি ওজনের একটি স্বর্ণের মুকুট, চার ভরি ওজনের একটি রুপার মুকুট, কানের দুল, দুই ভরি ওজনের লকেটসহ চেইন, চার ভরি ওজনের রুপার মুক্তার মালা, চার আনা ওজনের স্বর্ণের লকেট এবং দানবাক্স ভেঙে টাকা চুরি করে নিয়ে যায়। ঘটনাটি সাধারণ মানুষের মনে গভীর কষ্টের পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির অনুভূতিও সৃষ্টি করেছে।

এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে- স্বর্ণের এত মূল্য কেন? মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সোনা ঐশ্বর্য ও ধনীদের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত ব্যক্তির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রবণতা ছিল। সে কারণেই যেখানে মূর্তিপূজা প্রচলিত, সেখানে মূর্তির গায়ে সোনা বা স্বর্ণের গহনার ব্যবহার দেখা যায়। ভক্তি ও ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবেই মানুষ এ ধরনের অলঙ্কার দান করে। এমনকি স্বর্ণের মূর্তি ও স্বর্ণের গাছও বিভিন্ন দর্শনীয় তীর্থস্থানে পরিলক্ষিত হয়।

মানুষ কেন স্বর্ণের প্রতি মাথা নত করে শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশ করে- তার উত্তর লুকিয়ে আছে স্বর্ণের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে।

স্বর্ণের মূল্য নির্ধারিত হয় কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে- এর দুষ্প্রাপ্যতা, উপযোগিতা, সৌন্দর্য, দীর্ঘস্থায়িত্ব, মুদ্রা তৈরিতে ব্যবহার, ওষুধে প্রয়োগ এবং কেউ কেউ খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে।

খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম ও সপ্তম শতাব্দীতে গ্রিসে সোনার মুদ্রার প্রচলন দেখা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে আর্মেনিয়ায় সোনার মোহর ব্যবহৃত হতো। প্রাচীনকালে সোনা, রুপা ও তামার তৈরি ধাতব মুদ্রা ব্যবহৃত হলেও এগুলো ভারী হওয়ায় বড় অঙ্কের লেনদেন বহনযোগ্য ছিল না। এ সমস্যা দূর করতেই ধীরে ধীরে কাগুজে মুদ্রার ধারণা আসে।

ধারণা করা হয়, প্রায় এক হাজার বছর আগে চীনে প্রথম কাগুজে টাকা চালু হয়।

বর্তমানেও ব্যাংকের চেক বা রসিদ পরোক্ষভাবে টাকার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর বহু দেশে স্বর্ণখনির সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ফিলিপাইনে স্বর্ণখনি পরিদর্শনের সময় দেখা গেছে- পাহাড়ের নিচ থেকে পাথর তুলে তা চূর্ণ করে কাদাযুক্ত ম- তৈরি করা হয় এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেখান থেকে স্বর্ণ আলাদা করা হয়। এই প্রক্রিয়া সত্যিই বিস্ময়কর।

সাধারণভাবে ২৪ ক্যারেট সোনা হলো খাঁটি সোনা, যার বিশুদ্ধতা ৯৯.৯ শতাংশ। তবে খাঁটি সোনা নরম হওয়ায় এতে রুপা, তামা বা দস্তা মিশিয়ে সাধারণত ২২ ক্যারেট সোনার অলঙ্কার তৈরি করা হয়। সোনা সমুদ্রের পানিতেও পাওয়া যায়, যদিও তা উত্তোলন ব্যয়বহুল। ওষুধ প্রস্তুত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে স্বর্ণের গুরুত্ব অপরিসীম।

স্বর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত হলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়। তাই যুগের পর যুগ গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখা স্বর্ণালঙ্কার আজও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, যার খবর পত্রপত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে শিরোনাম হয়েছে- ‘১৪৮ কোটি টাকায় বিক্রি হলো স্বর্ণের টয়লেট’। জানা যায়, ১৮ ক্যারেট খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি এই টয়লেটটি শেষ পর্যন্ত ১ কোটি ২১ লাখ ডলারে বিক্রি হয়।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে- একদিকে মানুষ স্বর্ণকে সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য ও ভক্তির প্রতীক হিসেবে মাথায় তোলে, অন্যদিকে সেই স্বর্ণ দিয়েই টয়লেট তৈরি করে মল-মূত্র ত্যাগ করে। এটি কি চরম বৈপরীত্য নয়? দরিদ্র মানুষ স্বর্ণের সামনে মাথা নত করে, আর ধনীরা সেই স্বর্ণের ওপর পায়খানা করে।

স্বর্ণ, লোহা, তামা বা রুপা- সবই ধাতু। কোনো ধাতুরই নিজস্ব কল্যাণ বা অকল্যাণ করার ক্ষমতা নেই। অথচ মানুষ না খেয়ে মরছে, আর কেউ কোটি টাকা ব্যয় করে টয়লেট বানাচ্ছে। একদিকে ভক্তি, অন্যদিকে ভোগ- সব মিলিয়ে যেন মানবিক মূল্যবোধের এক নির্মম প্রহসন।

লোহা মানুষের জীবন রক্ষা করে, নিরাপত্তা দেয়, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় স্থাপনার শক্ত ভিত গড়ে তোলে। অথচ লোহা মূল্যহীন বলে বিবেচিত, আর সোনা- যা জীবন রক্ষা করতে পারে না- তা মাথার মুকুটে স্থান পায়। এই বৈষম্যই আমাদের সমাজের গভীর সংকটকে স্পষ্ট করে তোলে।

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

বিনা-ভাড়ার ট্রেনযাত্রা

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

বাবুল রবিদাস

বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫

গত ১০ নভেম্বর বিভিন্ন পত্রপত্রিকার শিরোনাম ছিল- ‘চট্টগ্রামে শতবর্ষী কালীমন্দিরের গহনা ও টাকা চুরি’। জানা যায়, চোরেরা কালীর মাথায় থাকা ৩৯ ভরি ওজনের একটি স্বর্ণের মুকুট, চার ভরি ওজনের একটি রুপার মুকুট, কানের দুল, দুই ভরি ওজনের লকেটসহ চেইন, চার ভরি ওজনের রুপার মুক্তার মালা, চার আনা ওজনের স্বর্ণের লকেট এবং দানবাক্স ভেঙে টাকা চুরি করে নিয়ে যায়। ঘটনাটি সাধারণ মানুষের মনে গভীর কষ্টের পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির অনুভূতিও সৃষ্টি করেছে।

এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে- স্বর্ণের এত মূল্য কেন? মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সোনা ঐশ্বর্য ও ধনীদের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত ব্যক্তির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রবণতা ছিল। সে কারণেই যেখানে মূর্তিপূজা প্রচলিত, সেখানে মূর্তির গায়ে সোনা বা স্বর্ণের গহনার ব্যবহার দেখা যায়। ভক্তি ও ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবেই মানুষ এ ধরনের অলঙ্কার দান করে। এমনকি স্বর্ণের মূর্তি ও স্বর্ণের গাছও বিভিন্ন দর্শনীয় তীর্থস্থানে পরিলক্ষিত হয়।

মানুষ কেন স্বর্ণের প্রতি মাথা নত করে শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশ করে- তার উত্তর লুকিয়ে আছে স্বর্ণের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে।

স্বর্ণের মূল্য নির্ধারিত হয় কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে- এর দুষ্প্রাপ্যতা, উপযোগিতা, সৌন্দর্য, দীর্ঘস্থায়িত্ব, মুদ্রা তৈরিতে ব্যবহার, ওষুধে প্রয়োগ এবং কেউ কেউ খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে।

খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম ও সপ্তম শতাব্দীতে গ্রিসে সোনার মুদ্রার প্রচলন দেখা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে আর্মেনিয়ায় সোনার মোহর ব্যবহৃত হতো। প্রাচীনকালে সোনা, রুপা ও তামার তৈরি ধাতব মুদ্রা ব্যবহৃত হলেও এগুলো ভারী হওয়ায় বড় অঙ্কের লেনদেন বহনযোগ্য ছিল না। এ সমস্যা দূর করতেই ধীরে ধীরে কাগুজে মুদ্রার ধারণা আসে।

ধারণা করা হয়, প্রায় এক হাজার বছর আগে চীনে প্রথম কাগুজে টাকা চালু হয়।

বর্তমানেও ব্যাংকের চেক বা রসিদ পরোক্ষভাবে টাকার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর বহু দেশে স্বর্ণখনির সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ফিলিপাইনে স্বর্ণখনি পরিদর্শনের সময় দেখা গেছে- পাহাড়ের নিচ থেকে পাথর তুলে তা চূর্ণ করে কাদাযুক্ত ম- তৈরি করা হয় এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেখান থেকে স্বর্ণ আলাদা করা হয়। এই প্রক্রিয়া সত্যিই বিস্ময়কর।

সাধারণভাবে ২৪ ক্যারেট সোনা হলো খাঁটি সোনা, যার বিশুদ্ধতা ৯৯.৯ শতাংশ। তবে খাঁটি সোনা নরম হওয়ায় এতে রুপা, তামা বা দস্তা মিশিয়ে সাধারণত ২২ ক্যারেট সোনার অলঙ্কার তৈরি করা হয়। সোনা সমুদ্রের পানিতেও পাওয়া যায়, যদিও তা উত্তোলন ব্যয়বহুল। ওষুধ প্রস্তুত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে স্বর্ণের গুরুত্ব অপরিসীম।

স্বর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত হলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়। তাই যুগের পর যুগ গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখা স্বর্ণালঙ্কার আজও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, যার খবর পত্রপত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে শিরোনাম হয়েছে- ‘১৪৮ কোটি টাকায় বিক্রি হলো স্বর্ণের টয়লেট’। জানা যায়, ১৮ ক্যারেট খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি এই টয়লেটটি শেষ পর্যন্ত ১ কোটি ২১ লাখ ডলারে বিক্রি হয়।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে- একদিকে মানুষ স্বর্ণকে সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য ও ভক্তির প্রতীক হিসেবে মাথায় তোলে, অন্যদিকে সেই স্বর্ণ দিয়েই টয়লেট তৈরি করে মল-মূত্র ত্যাগ করে। এটি কি চরম বৈপরীত্য নয়? দরিদ্র মানুষ স্বর্ণের সামনে মাথা নত করে, আর ধনীরা সেই স্বর্ণের ওপর পায়খানা করে।

স্বর্ণ, লোহা, তামা বা রুপা- সবই ধাতু। কোনো ধাতুরই নিজস্ব কল্যাণ বা অকল্যাণ করার ক্ষমতা নেই। অথচ মানুষ না খেয়ে মরছে, আর কেউ কোটি টাকা ব্যয় করে টয়লেট বানাচ্ছে। একদিকে ভক্তি, অন্যদিকে ভোগ- সব মিলিয়ে যেন মানবিক মূল্যবোধের এক নির্মম প্রহসন।

লোহা মানুষের জীবন রক্ষা করে, নিরাপত্তা দেয়, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় স্থাপনার শক্ত ভিত গড়ে তোলে। অথচ লোহা মূল্যহীন বলে বিবেচিত, আর সোনা- যা জীবন রক্ষা করতে পারে না- তা মাথার মুকুটে স্থান পায়। এই বৈষম্যই আমাদের সমাজের গভীর সংকটকে স্পষ্ট করে তোলে।

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

back to top