মতিউর রহমান
ঢাকার গুলশান, বনানী কিংবা ধানমন্ডির প্রধান সড়কগুলোতে হাঁটলে যে কারোরই মনে হতে পারে, শহরটি বুঝি কোনো জাদুমন্ত্রে লস অ্যাঞ্জেলেস বা দুবাইয়ের ক্ষুদ্র সংস্করণে রূপ নিয়েছে। ঝকঝকে কাঁচের দেয়ালঘেরা শপিং মল, সারিবদ্ধ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের শোরুম, নিওন আলোর আধুনিক ক্যাফে এবং সুসজ্জিত রেস্তোরাঁগুলোর সামনে দামি গাড়ির বহর দেখে এক ধরনের কসমোপলিটন বা বিশ্বজনীন জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। এই দৃশ্যপটে আধুনিকতা মানেই হলো হাতে সর্বাধুনিক স্মার্টফোন, কাঁধে ব্র্যান্ডেরর ব্যাগ আর কন্টিনেন্টাল খাবারের স্বাদ।
ঢাকার প্রেক্ষাপটে আমরা যে আধুনিক ভোগের সংস্কৃতি দেখি, তা আসলে একটি ‘ভোগ-স্কেপ’। এখানে আধুনিকতা কোনো চিন্তা বা দর্শনের নাম নয়, বরং তা পণ্য ক্রয়ের সক্ষমতার নাম। এই ভোগ-স্কেপে প্রবেশ করতে হলে যে প্রবেশমূল্য বা ‘এন্ট্রি ফি’ প্রয়োজন, তা ঢাকার ৯৫ শতাংশ মানুষের সাধ্যের বাইরে। ফলে আধুনিকতা এখানে একটি সর্বজনীন নাগরিক অধিকার না হয়ে বরং একটি বিশেষ সামাজিক সুযোগ বা ‘প্রিভিলেজ’-এ পরিণত হয়েছে
এই চিত্রটি যেন এক নতুন বাংলাদেশের প্রচ্ছদ। কিন্তু এই উজ্জ্বল প্রচ্ছদটি ওল্টালে যে দীর্ঘ অধ্যায়গুলো সামনে আসে, সেখানে অধিকাংশ ঢাকাবাসীর জীবনের কোনো মিল নেই। ঢাকার এই আধুনিকতা আসলে একটি ক্ষুদ্র এবং নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের যাপিত জীবনের প্রদর্শন, যা গুটিকয়েক এলাকার ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ। আধুনিকতার এই ভোগবাদী রূপটি কেন সবার জন্য নয়, তা বুঝতে হলে আমাদের এর গভীরে লুকিয়ে থাকা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
নৃবিজ্ঞানী অরুণ আপ্পাদুরাই তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘মডার্নিটি অ্যাট লার্জ’-এ আধুনিকতাকে কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়কাল হিসেবে দেখেননি, বরং একে দেখেছেন এক ধরনের বৈশ্বিক প্রবাহ বা ‘স্কেপস’ হিসেবে। তার মতে, বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্য, প্রযুক্তি, অর্থ এবং সংস্কৃতি একেকটি প্রবাহের মতো সমাজকে প্রভাবিত করে। ঢাকার প্রেক্ষাপটে আমরা যে আধুনিক ভোগের সংস্কৃতি দেখি, তা আসলে একটি ‘ভোগ-স্কেপ’। এখানে আধুনিকতা কোনো চিন্তা বা দর্শনের নাম নয়, বরং তা পণ্য ক্রয়ের সক্ষমতার নাম। এই ভোগ-স্কেপে প্রবেশ করতে হলে যে প্রবেশমূল্য বা ‘এন্ট্রি ফি’ প্রয়োজন, তা ঢাকার ৯৫ শতাংশ মানুষের সাধ্যের বাইরে। ফলে আধুনিকতা এখানে একটি সর্বজনীন নাগরিক অধিকার না হয়ে বরং একটি বিশেষ সামাজিক সুযোগ বা ‘প্রিভিলেজ’-এ পরিণত হয়েছে। আপ্পাদুরাইয়ের ‘ফাইন্যান্সস্কেপ’ বা বৈশ্বিক পুঁজির প্রবাহ ঢাকায় এমন কিছু দ্বীপ তৈরি করেছে-যেমন গুলশান বা বনানী-যেখানে জীবনযাত্রার মান বিশ্বের যেকোনো ধনী শহরের সমান, কিন্তু সেই দ্বীপের বাইরে বিশাল জনসমুদ্র বাস করে এক আদিম অস্থিরতার মধ্যে।
ঢাকার আধুনিক শপিং মলগুলো এই বৈষম্যের সবচেয়ে বড় স্থাপত্যগত উদাহরণ। বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক কিংবা অতি সম্প্রতি গড়ে ওঠা গুলশানের বিলাসবহুল কমপ্লেক্সগুলো কেবল পণ্য বিক্রির জায়গা নয়, এগুলো হলো আধুনিকতার মন্দির। এখানে শীতল বাতানুকূল পরিবেশ, চলন্ত সিঁড়ি আর কাঁচের দেয়াল এক ধরনের বিজাতীয় আভিজাত্য তৈরি করে। একজন সাধারণ নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য এই মলের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তাকর্মীর চোখ এড়িয়ে ভেতরে ঢোকাটাই এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। মলের ভেতরের পণ্যগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে, যা ক্রেতাকে বলে দেয়-এখানে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির হতে হবে। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের একটি টি-শার্টের দাম যেখানে একজন শ্রমিকের মাসিক আয়ের অর্ধেক, সেখানে আধুনিকতা এক নিষ্ঠুর কৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে এই স্থাপনাগুলো নাগরিক সুযোগের প্রসারের বদলে সামাজিক বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। অধিকাংশ ঢাকাবাসীর কাছে এই মলগুলো কেবল দূর থেকে দেখার বস্তু বা বড়জোর ছুটির দিনে একটু ঘুরে দেখার জায়গা, কিন্তু সেখানকার নিয়মিত ভোক্তা হওয়া তাদের কল্পনার অতীত।
বিশ্বায়ন এবং ডিজিটাল বিপ্লব এই ব্যবধানকে আরও তীব্র ও দৃশ্যমান করে তুলেছে। আপ্পাদুরাই যাকে ‘মিডিয়াস্কেপ’ বলেছেন, তা ঢাকার তরুণ প্রজন্মের মনে আধুনিকতার এক কল্পিত জগৎ তৈরি করেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের পাতায় আমরা প্রতিনিয়ত দেখি অভিজাত শ্রেণির জীবনযাপনের ছবি। তারা কোন ক্যাফেতে কফি খাচ্ছে, কোন ব্র্যান্ডের পোশাক পরছে কিংবা কোন রিসোর্টে ছুটি কাটাচ্ছে-এসব তথ্য সবার চোখের সামনে ভেসে থাকে। এই ‘দৃশ্যমান আধুনিকতা’ সাধারণ মানুষের মনে এক তীব্র আকাক্সক্ষা তৈরি করে। কিন্তু সেই আকাক্সক্ষার বিপরীতে যখন সাধ্যের বাস্তবতাকে দাঁড় করানো হয়, তখন সৃষ্টি হয় দীর্ঘমেয়াদী হতাশা। ডিজিটাল যুগে আধুনিকতা তাই কেবল ভোগের বিষয় নয়, এটি প্রদর্শনেরও বিষয়। যার হাতে দামী আইফোন নেই বা যে নির্দিষ্ট ক্যাফেতে বসে ছবি তুলে চেক-ইন দিতে পারছে না, সে নিজেকে আধুনিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে শুরু করে। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা ‘এলিয়েনেশন’ সমাজের সংহতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ভোগের এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি ভৌগোলিক বা স্থানিকও বটে। ঢাকা শহরটি পরিকল্পিতভাবেই যেন উচ্চবিত্ত এবং অবহেলিত শ্রেণির বাসস্থানে বিভক্ত হয়ে গেছে। আধুনিকতার সব সুযোগ-সুবিধা-যেমন ভালো রাস্তা, নামী রেস্তোরাঁ, বিনোদন কেন্দ্র-সবই উত্তর ঢাকার গুটিকয়েক এলাকায় কেন্দ্রীভূত। অন্যদিকে শহরের বিশাল অংশ- যেমন মিরপুরের ভেতরের অলিগলি, কামরাঙ্গীরচর বা বাড্ডার মতো এলাকাগুলো-এই ভোগ-স্কেপ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন। একজন সাধারণ মানুষের জন্য এই আধুনিক এলাকায় আসা মানেই হলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট আর যাতায়াত খরচের বোঝা। ফলে আধুনিকতা এখানে কেবল একটি শ্রেণির সম্পদ নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট এলাকার সম্পদও বটে। শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোতেও দেখা যায় অভিজাত এলাকার রাস্তা চওড়া করা বা সেখানে নতুন পার্ক ও মল বানানোর তোড়জোড় বেশি, যা সাধারণ নাগরিকদের বসবাসের এলাকাগুলোকে আরও অবহেলিত করে রাখে।
এই আধুনিকতার সংকটের পেছনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো শ্রমবাজারের অসমতা। ঢাকার শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, যেখানে আয়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিপরীতে, একটি কর্পোরেট এলিট শ্রেণি গড়ে উঠেছে যাদের আয় বৈশ্বিক মানের। এই দুই শ্রেণির আয়ের ব্যবধান যখন আকাশচুম্বী হয়, তখন ভোগের ধরণও বদলে যায়। উচ্চবিত্তদের কাছে ভোগ হলো এক ধরনের পরিচয় জানানোর মাধ্যম বা ‘কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন’। তারা পণ্য কেনে কেবল ব্যবহারের জন্য নয়, বরং সমাজের অন্যদের থেকে নিজেদের আলাদা প্রমাণ করার জন্য। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের কাছে ভোগ মানে হলো টিকে থাকার লড়াই। চাল, ডাল, তেল আর বাড়ি ভাড়ার হিসাব মেলাতে গিয়ে তাদের কাছে আধুনিকতা হয়ে দাঁড়ায় এক বিলাসিতা। এই দ্বিমুখী বাস্তবতায় আধুনিকতা কেবল পণ্যমুখী হয়ে পড়েছে, যা মানবিক মূল্যবোধ বা নাগরিক অধিকারের চেয়ে ভোগের মানদ-কে বেশি গুরুত্ব দেয়।
নারীদের ক্ষেত্রে এই ভোগের রাজনীতি আরও জটিল। আধুনিক বিজ্ঞাপনে নারীদের ‘আধুনিক’ হওয়ার যে রূপরেখা দেওয়া হয়, তা মূলত প্রসাধনী, ফ্যাশন এবং নির্দিষ্ট লাইফস্টাইলের ওপর ভিত্তি করে। উচ্চবিত্ত নারীরা এই ভোগ-স্কেপের সক্রিয় অংশীদার হলেও মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত নারীদের জন্য তা এক বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষা এবং আধুনিক সাজার চাপের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়। অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সাররা যে বিলাসী জীবন দেখান, তা সাধারণ তরুণীদের মনে এক ধরনের হীনমন্যতা তৈরি করে। ভোগের এই সংস্কৃতি তাই কেবল পকেট খালি করে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আধুনিক হওয়া মানেই সুন্দর পোশাক পরা বা দামি রেস্তোরাঁয় যাওয়া-এই ধারণাটি যখন শিকড় গেড়ে বসে, তখন শিক্ষার গুণগত মান বা চিন্তার গভীরতার মতো বিষয়গুলো গৌণ হয়ে পড়ে।
শহরের নীতিনির্ধারক এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের কাছে এই ভোগের দৃশ্যপট এক বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। আমরা কি কেবল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর জন্য চকচকে শহর গড়ব, নাকি সব নাগরিকের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করব? আধুনিকতার মাপকাঠি যদি কেবল শপিং মলের সংখ্যা বা ব্র্যান্ডের দোকানের আধিক্য দিয়ে বিচার করা হয়, তবে ঢাকা কখনোই একটি সংহতিপূর্ণ শহর হতে পারবে না। প্রকৃত আধুনিকতা তখনই আসবে যখন একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য ফুটপাতে নির্বিঘ্নে হাঁটার সুযোগ থাকবে, যখন সস্তায় মানসম্মত বিনোদনের জায়গা থাকবে এবং যখন আধুনিক জীবনের ন্যূনতম সুবিধাগুলো সবার নাগালে পৌঁছাবে। আজ ঢাকা আধুনিক দেখাতে পারে, কিন্তু সেই আধুনিকতার পেছনে যে গভীর সামাজিক ক্ষত আর বৈষম্য লুকিয়ে আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
ঢাকার ভোগের সংস্কৃতি আমাদের এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এখানে আধুনিকতা কোনো সর্বজনীন মুক্তির বার্তা নিয়ে আসেনি, বরং তা এক নতুন ধরনের বিভাজন তৈরি করেছে। আপ্পাদুরাইয়ের ভাষায়, বিশ্বায়নের এই স্কেপগুলো স্থানীয় সমাজে এসে এক ‘অসম আধুনিকতা’র জন্ম দিয়েছে। এই ব্যবস্থায় অল্প কিছু মানুষ বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে উঠেছে, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রয়ে গেছে এক ধোঁয়াশাচ্ছন্ন প্রান্তিকে। তারা আধুনিকতার আলো দেখে, কিন্তু সেই আলোয় নিজেদের জীবন সাজানোর সামর্থ্য তাদের নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না আধুনিকতার ধারণাটি পণ্যের মায়া কাটিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদার সমবণ্টনের সঙ্গে যুক্ত হবে, ততক্ষণ ঢাকার এই জৌলুস কেবল গুটিকয়েক মানুষের জন্য এক কৃত্রিম স্বর্গ হয়েই থাকবে। এই বৈষম্যমূলক ভোগের দৃশ্যপট বদলানোই এখন সময়ের দাবি, যেন ঢাকা কেবল আধুনিক দেখায় না, বরং আধুনিকতার সুবিধা প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছায়।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতিউর রহমান
শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
ঢাকার গুলশান, বনানী কিংবা ধানমন্ডির প্রধান সড়কগুলোতে হাঁটলে যে কারোরই মনে হতে পারে, শহরটি বুঝি কোনো জাদুমন্ত্রে লস অ্যাঞ্জেলেস বা দুবাইয়ের ক্ষুদ্র সংস্করণে রূপ নিয়েছে। ঝকঝকে কাঁচের দেয়ালঘেরা শপিং মল, সারিবদ্ধ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের শোরুম, নিওন আলোর আধুনিক ক্যাফে এবং সুসজ্জিত রেস্তোরাঁগুলোর সামনে দামি গাড়ির বহর দেখে এক ধরনের কসমোপলিটন বা বিশ্বজনীন জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। এই দৃশ্যপটে আধুনিকতা মানেই হলো হাতে সর্বাধুনিক স্মার্টফোন, কাঁধে ব্র্যান্ডেরর ব্যাগ আর কন্টিনেন্টাল খাবারের স্বাদ।
ঢাকার প্রেক্ষাপটে আমরা যে আধুনিক ভোগের সংস্কৃতি দেখি, তা আসলে একটি ‘ভোগ-স্কেপ’। এখানে আধুনিকতা কোনো চিন্তা বা দর্শনের নাম নয়, বরং তা পণ্য ক্রয়ের সক্ষমতার নাম। এই ভোগ-স্কেপে প্রবেশ করতে হলে যে প্রবেশমূল্য বা ‘এন্ট্রি ফি’ প্রয়োজন, তা ঢাকার ৯৫ শতাংশ মানুষের সাধ্যের বাইরে। ফলে আধুনিকতা এখানে একটি সর্বজনীন নাগরিক অধিকার না হয়ে বরং একটি বিশেষ সামাজিক সুযোগ বা ‘প্রিভিলেজ’-এ পরিণত হয়েছে
এই চিত্রটি যেন এক নতুন বাংলাদেশের প্রচ্ছদ। কিন্তু এই উজ্জ্বল প্রচ্ছদটি ওল্টালে যে দীর্ঘ অধ্যায়গুলো সামনে আসে, সেখানে অধিকাংশ ঢাকাবাসীর জীবনের কোনো মিল নেই। ঢাকার এই আধুনিকতা আসলে একটি ক্ষুদ্র এবং নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের যাপিত জীবনের প্রদর্শন, যা গুটিকয়েক এলাকার ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ। আধুনিকতার এই ভোগবাদী রূপটি কেন সবার জন্য নয়, তা বুঝতে হলে আমাদের এর গভীরে লুকিয়ে থাকা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
নৃবিজ্ঞানী অরুণ আপ্পাদুরাই তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘মডার্নিটি অ্যাট লার্জ’-এ আধুনিকতাকে কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়কাল হিসেবে দেখেননি, বরং একে দেখেছেন এক ধরনের বৈশ্বিক প্রবাহ বা ‘স্কেপস’ হিসেবে। তার মতে, বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্য, প্রযুক্তি, অর্থ এবং সংস্কৃতি একেকটি প্রবাহের মতো সমাজকে প্রভাবিত করে। ঢাকার প্রেক্ষাপটে আমরা যে আধুনিক ভোগের সংস্কৃতি দেখি, তা আসলে একটি ‘ভোগ-স্কেপ’। এখানে আধুনিকতা কোনো চিন্তা বা দর্শনের নাম নয়, বরং তা পণ্য ক্রয়ের সক্ষমতার নাম। এই ভোগ-স্কেপে প্রবেশ করতে হলে যে প্রবেশমূল্য বা ‘এন্ট্রি ফি’ প্রয়োজন, তা ঢাকার ৯৫ শতাংশ মানুষের সাধ্যের বাইরে। ফলে আধুনিকতা এখানে একটি সর্বজনীন নাগরিক অধিকার না হয়ে বরং একটি বিশেষ সামাজিক সুযোগ বা ‘প্রিভিলেজ’-এ পরিণত হয়েছে। আপ্পাদুরাইয়ের ‘ফাইন্যান্সস্কেপ’ বা বৈশ্বিক পুঁজির প্রবাহ ঢাকায় এমন কিছু দ্বীপ তৈরি করেছে-যেমন গুলশান বা বনানী-যেখানে জীবনযাত্রার মান বিশ্বের যেকোনো ধনী শহরের সমান, কিন্তু সেই দ্বীপের বাইরে বিশাল জনসমুদ্র বাস করে এক আদিম অস্থিরতার মধ্যে।
ঢাকার আধুনিক শপিং মলগুলো এই বৈষম্যের সবচেয়ে বড় স্থাপত্যগত উদাহরণ। বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক কিংবা অতি সম্প্রতি গড়ে ওঠা গুলশানের বিলাসবহুল কমপ্লেক্সগুলো কেবল পণ্য বিক্রির জায়গা নয়, এগুলো হলো আধুনিকতার মন্দির। এখানে শীতল বাতানুকূল পরিবেশ, চলন্ত সিঁড়ি আর কাঁচের দেয়াল এক ধরনের বিজাতীয় আভিজাত্য তৈরি করে। একজন সাধারণ নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য এই মলের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তাকর্মীর চোখ এড়িয়ে ভেতরে ঢোকাটাই এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। মলের ভেতরের পণ্যগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে, যা ক্রেতাকে বলে দেয়-এখানে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির হতে হবে। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের একটি টি-শার্টের দাম যেখানে একজন শ্রমিকের মাসিক আয়ের অর্ধেক, সেখানে আধুনিকতা এক নিষ্ঠুর কৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে এই স্থাপনাগুলো নাগরিক সুযোগের প্রসারের বদলে সামাজিক বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। অধিকাংশ ঢাকাবাসীর কাছে এই মলগুলো কেবল দূর থেকে দেখার বস্তু বা বড়জোর ছুটির দিনে একটু ঘুরে দেখার জায়গা, কিন্তু সেখানকার নিয়মিত ভোক্তা হওয়া তাদের কল্পনার অতীত।
বিশ্বায়ন এবং ডিজিটাল বিপ্লব এই ব্যবধানকে আরও তীব্র ও দৃশ্যমান করে তুলেছে। আপ্পাদুরাই যাকে ‘মিডিয়াস্কেপ’ বলেছেন, তা ঢাকার তরুণ প্রজন্মের মনে আধুনিকতার এক কল্পিত জগৎ তৈরি করেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের পাতায় আমরা প্রতিনিয়ত দেখি অভিজাত শ্রেণির জীবনযাপনের ছবি। তারা কোন ক্যাফেতে কফি খাচ্ছে, কোন ব্র্যান্ডের পোশাক পরছে কিংবা কোন রিসোর্টে ছুটি কাটাচ্ছে-এসব তথ্য সবার চোখের সামনে ভেসে থাকে। এই ‘দৃশ্যমান আধুনিকতা’ সাধারণ মানুষের মনে এক তীব্র আকাক্সক্ষা তৈরি করে। কিন্তু সেই আকাক্সক্ষার বিপরীতে যখন সাধ্যের বাস্তবতাকে দাঁড় করানো হয়, তখন সৃষ্টি হয় দীর্ঘমেয়াদী হতাশা। ডিজিটাল যুগে আধুনিকতা তাই কেবল ভোগের বিষয় নয়, এটি প্রদর্শনেরও বিষয়। যার হাতে দামী আইফোন নেই বা যে নির্দিষ্ট ক্যাফেতে বসে ছবি তুলে চেক-ইন দিতে পারছে না, সে নিজেকে আধুনিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে শুরু করে। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা ‘এলিয়েনেশন’ সমাজের সংহতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ভোগের এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি ভৌগোলিক বা স্থানিকও বটে। ঢাকা শহরটি পরিকল্পিতভাবেই যেন উচ্চবিত্ত এবং অবহেলিত শ্রেণির বাসস্থানে বিভক্ত হয়ে গেছে। আধুনিকতার সব সুযোগ-সুবিধা-যেমন ভালো রাস্তা, নামী রেস্তোরাঁ, বিনোদন কেন্দ্র-সবই উত্তর ঢাকার গুটিকয়েক এলাকায় কেন্দ্রীভূত। অন্যদিকে শহরের বিশাল অংশ- যেমন মিরপুরের ভেতরের অলিগলি, কামরাঙ্গীরচর বা বাড্ডার মতো এলাকাগুলো-এই ভোগ-স্কেপ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন। একজন সাধারণ মানুষের জন্য এই আধুনিক এলাকায় আসা মানেই হলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট আর যাতায়াত খরচের বোঝা। ফলে আধুনিকতা এখানে কেবল একটি শ্রেণির সম্পদ নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট এলাকার সম্পদও বটে। শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোতেও দেখা যায় অভিজাত এলাকার রাস্তা চওড়া করা বা সেখানে নতুন পার্ক ও মল বানানোর তোড়জোড় বেশি, যা সাধারণ নাগরিকদের বসবাসের এলাকাগুলোকে আরও অবহেলিত করে রাখে।
এই আধুনিকতার সংকটের পেছনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো শ্রমবাজারের অসমতা। ঢাকার শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, যেখানে আয়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিপরীতে, একটি কর্পোরেট এলিট শ্রেণি গড়ে উঠেছে যাদের আয় বৈশ্বিক মানের। এই দুই শ্রেণির আয়ের ব্যবধান যখন আকাশচুম্বী হয়, তখন ভোগের ধরণও বদলে যায়। উচ্চবিত্তদের কাছে ভোগ হলো এক ধরনের পরিচয় জানানোর মাধ্যম বা ‘কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন’। তারা পণ্য কেনে কেবল ব্যবহারের জন্য নয়, বরং সমাজের অন্যদের থেকে নিজেদের আলাদা প্রমাণ করার জন্য। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের কাছে ভোগ মানে হলো টিকে থাকার লড়াই। চাল, ডাল, তেল আর বাড়ি ভাড়ার হিসাব মেলাতে গিয়ে তাদের কাছে আধুনিকতা হয়ে দাঁড়ায় এক বিলাসিতা। এই দ্বিমুখী বাস্তবতায় আধুনিকতা কেবল পণ্যমুখী হয়ে পড়েছে, যা মানবিক মূল্যবোধ বা নাগরিক অধিকারের চেয়ে ভোগের মানদ-কে বেশি গুরুত্ব দেয়।
নারীদের ক্ষেত্রে এই ভোগের রাজনীতি আরও জটিল। আধুনিক বিজ্ঞাপনে নারীদের ‘আধুনিক’ হওয়ার যে রূপরেখা দেওয়া হয়, তা মূলত প্রসাধনী, ফ্যাশন এবং নির্দিষ্ট লাইফস্টাইলের ওপর ভিত্তি করে। উচ্চবিত্ত নারীরা এই ভোগ-স্কেপের সক্রিয় অংশীদার হলেও মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত নারীদের জন্য তা এক বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষা এবং আধুনিক সাজার চাপের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়। অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সাররা যে বিলাসী জীবন দেখান, তা সাধারণ তরুণীদের মনে এক ধরনের হীনমন্যতা তৈরি করে। ভোগের এই সংস্কৃতি তাই কেবল পকেট খালি করে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আধুনিক হওয়া মানেই সুন্দর পোশাক পরা বা দামি রেস্তোরাঁয় যাওয়া-এই ধারণাটি যখন শিকড় গেড়ে বসে, তখন শিক্ষার গুণগত মান বা চিন্তার গভীরতার মতো বিষয়গুলো গৌণ হয়ে পড়ে।
শহরের নীতিনির্ধারক এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের কাছে এই ভোগের দৃশ্যপট এক বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। আমরা কি কেবল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর জন্য চকচকে শহর গড়ব, নাকি সব নাগরিকের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করব? আধুনিকতার মাপকাঠি যদি কেবল শপিং মলের সংখ্যা বা ব্র্যান্ডের দোকানের আধিক্য দিয়ে বিচার করা হয়, তবে ঢাকা কখনোই একটি সংহতিপূর্ণ শহর হতে পারবে না। প্রকৃত আধুনিকতা তখনই আসবে যখন একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য ফুটপাতে নির্বিঘ্নে হাঁটার সুযোগ থাকবে, যখন সস্তায় মানসম্মত বিনোদনের জায়গা থাকবে এবং যখন আধুনিক জীবনের ন্যূনতম সুবিধাগুলো সবার নাগালে পৌঁছাবে। আজ ঢাকা আধুনিক দেখাতে পারে, কিন্তু সেই আধুনিকতার পেছনে যে গভীর সামাজিক ক্ষত আর বৈষম্য লুকিয়ে আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
ঢাকার ভোগের সংস্কৃতি আমাদের এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এখানে আধুনিকতা কোনো সর্বজনীন মুক্তির বার্তা নিয়ে আসেনি, বরং তা এক নতুন ধরনের বিভাজন তৈরি করেছে। আপ্পাদুরাইয়ের ভাষায়, বিশ্বায়নের এই স্কেপগুলো স্থানীয় সমাজে এসে এক ‘অসম আধুনিকতা’র জন্ম দিয়েছে। এই ব্যবস্থায় অল্প কিছু মানুষ বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে উঠেছে, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রয়ে গেছে এক ধোঁয়াশাচ্ছন্ন প্রান্তিকে। তারা আধুনিকতার আলো দেখে, কিন্তু সেই আলোয় নিজেদের জীবন সাজানোর সামর্থ্য তাদের নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না আধুনিকতার ধারণাটি পণ্যের মায়া কাটিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদার সমবণ্টনের সঙ্গে যুক্ত হবে, ততক্ষণ ঢাকার এই জৌলুস কেবল গুটিকয়েক মানুষের জন্য এক কৃত্রিম স্বর্গ হয়েই থাকবে। এই বৈষম্যমূলক ভোগের দৃশ্যপট বদলানোই এখন সময়ের দাবি, যেন ঢাকা কেবল আধুনিক দেখায় না, বরং আধুনিকতার সুবিধা প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছায়।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]