alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

চারদিকে আতঙ্ক আর শঙ্কা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরিফ ওসমান হাদি ঢাকার একটি আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। তাকে গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পল্টনের কালভার্ট রোডে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে যাওয়ার সময় একটি মোটরসাইকেল থেকে গুলি করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবর হচ্ছে ঘাতক ভারতে পালিয়ে গেছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার, এত দীর্ঘ সীমান্ত মানুষের পাহারায় নিশ্চিদ্র করা কঠিন। দুয়েকজন অনুপ্রবেশকারীকে গুলি করে হত্যা করা হলেও দুই দেশের চোরাচালান ঠেকানো যায়নি এবং কখনো সম্ভবও হবে না, কারণ এখন পর্যন্ত মাত্র ৭৯ শতাংশ কাটাতারের বেড়া দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তাই ঘাতকের ভারতে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতেই পারে, ইতঃপূর্বেও অনেক সন্ত্রাসী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। ওসমান হাদির ঘাতক ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কথা প্রচার করে ঘাতককে দেশের ভিতর লুকিয়ে রাখার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশের অভ্যন্তরে গ্রেফতার হলে এখন অনেকে বলবেন, ‘ভারত পুশ করেছে’। ওসমান হাদি হত্যার ঘটনায় ভারতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে নয়াদিল্লি।

কোনো মৃত্যুই প্রত্যাশিত নয়, বিশেষ করে হত্যা আর খুন। ৩২ বছরের শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন চব্বিশের অভ্যুত্থানের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও ভারতের তীব্র সমালোচক ছিলেন। ঝালকাঠির একটি মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। হাদি ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স নামক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, জুলাই আন্দোলনে তিনি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। জোরে এবং স্পষ্ট করে কথা বলার কারণে ভোটপ্রার্থী হাদির প্রচার-প্রচারণা তুঙ্গে ওঠেছিল, তিনি তার নির্বাচনী আসনের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঢু মেরেছিলেন। হয়তো জিততে পারতেন না, কিন্তু ভোটারদের মধ্যে একটি আলোড়ন তুলতে পেরেছিলেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তার হত্যার ঘটনাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই, সরকার অবশ্য খুনের রহস্য উদঘাটন ও খুনিদের ধরার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ওসমান হাদি স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল তাকে কেউ গুলি করে মেরে ফেললেও যেন বিচারটা নিশ্চিত করা হয়। খেয়াল রাখতে হবে, বিচার নিশ্চিত করার জন্য যেন আরেকজন ‘জজমিয়া’র সৃষ্টি না হয়।

ওসমান হাদির করুণ মৃত্যুর ভাবগম্ভীর আবহ নষ্ট হলো মবের উন্মত্ত আচরণে। হাদীর মৃত্যুর পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ভারতীয় হাইকমিশন, ছায়ানট, উদীচি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘরবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে জনগণের মনোযোগে পরিবর্তন ঘটে, মানুষ ওসমান হাদির কথা ভুলে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে থাকে, দেখতে থাকে দিপু চন্দ্র দাসের ঝুলন্ত মরদেহের আগুন। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের বিপক্ষে ছিল শেখ হাসিনা, এখন দেখি শেখ হাসিনার বিরোধীরাও এই দুটি পত্রিকার বিরোধী। শুধু এই একটি ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট আর ফ্যাসিস্ট বিরোধীদের মধ্যে মিল ও ঐক্য আছে। অভ্যুত্থানের পরপরই এই দুটি পত্রিকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে, পত্রিকা অফিসের সম্মুখে গরু জবাই করে উৎসব করেছে, উৎসর্গকৃত সেই গরুর উপর নাম লেখা হয়েছিল পত্রিকার সম্পাদকের। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে এই দুটি পত্রিকা অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোর সমর্থক। এখন বোধ হয় তাদের আনুগত্য সম্ভাব্য বিজয়ের কাছে শিফট করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গত দেড় বছরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এই স্থবিরতার মধ্যে আবার কয়েকদিন আগে ‘উদীচী’ শিল্পীগোষ্ঠীর ৫৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী আর্কাইভ ও কয়েক হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর ‘ছায়ানট’। ছায়ানটের একটি হারমোনিয়ামকে এক ব্যক্তি আছাড় দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে গান-বাজনা আর চলবে না। শুধু নাচ-গানের ঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ক্ষান্ত হচ্ছে না, আক্রমণ করছে বাউলদের ওপর, বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে লালন উৎসব, ভাঙ্গা হচ্ছে সুফি-সাধকদের মাজার, বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে একুশে বইমেলা, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে উল্লাস করা হচ্ছে কবর থেকে লাশ তুলে। তৌহিদী জনতার নামে চলমান এই সকল কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। সংস্কৃতি আর বুদ্ধিবৃত্তিক পঙ্গুত্ব যতবেশি নেমে আসবে মানুষের মনোবৈকল্য তত বাড়তে থাকবে, এক সময় শুধু পাবনায় নয়, দেশের প্রতিটি জেলায় মানসিক হাসপাতাল ও পাগলা গারদ তৈরি করতে হবে।

দীপু চন্দ্র দাস নামের একজন নিরীহ গরীব পোষাক শ্রমিককে পিটিয়ে আধমরা অবস্থায় পায়ে দড়ি বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে আগুন জ্বালিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হলো প্রকাশ্যে দিনের আলোয়।ধর্মীয় অবমাননার কথা বলে সৃষ্টির সেরা একজন মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করার মধ্যে আরেকজন মানুষ যখন উল্লাস খুঁজে পায় তখন বলতেই হবে আমরা আবার আদিম অন্ধকার যুগে ফেরত যাচ্ছি।আদিম বর্বর যুগে ফেরত এসেছি বলেই কেউ নির্যাতন করার সময় ধর্মীয় কটুক্তিটা কী তা জানার প্রয়োজন বোধও করে না। উলঙ্গ দীপুর জলন্ত দেহ দেখে আতঙ্ক আর শঙ্কায় পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোন পথিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও প্রকাশ করতে সাহস করেনি।যারা পোড়ানোর জন্য আধমরা দীপুকে রশি দিয়ে বেঁধে গাছে টাঙিয়েছে তাদের অনেকে হয়তো নিয়মিত নামাজও পড়ে না, ওয়াজ শুনে শুনে তারা হয়ে গেছে মুসলিম জাতীয়তাবাদের জেহাদী। এমন উগ্রপন্থার কারণেই সারা বিশ্বে ‘ইসলাম ফোবিয়া’ বা ইসলাম-ভীতি তৈরি হয়েছে, ইসলাম সম্পর্কে ভালো ধারণা তিরোহিত হচ্ছে। ইসলাম মতে ‘আগুনের রব ছাড়া আগুন দিয়ে কিছুকে শাস্তি দেওয়ার কারো অধিকার নেই’। কিন্তু দীপুর ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশ তারা মানেনি। ওয়াজি আলেমদের অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে অনেক রূঢ় কথা বলেন, কিন্তু তখন এই সকল জেহাদীদের অনুভূতিতে আঘাত করে না। প্রকাশ্যে মানুষ পিটিয়ে আগুন দিয়ে পোড়ানোর এই রাজনীতিই কী সংস্কার! দুঃখজনক হচ্ছে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার এমন পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড কোন ফ্যাসিস্ট করেনি, করেছে ফ্যাসিস্ট বিরোধীরাই।

মব সংস্কৃতি থামছে না, মব করার দুটি হাতিয়ার- এক, ধর্মের দোহাই; দুই, স্বৈরাচারের দোসর।প্রেস সচিব বলেছেন, এরা মব গ্রুপ নয়, এরা প্রেসার গ্রুপ। বিরোধী মতের মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠানকে ভেঙ্গে তছনছ করা হচ্ছে, প্রকাশ্য দিবালোকে বা গভীর অন্ধকারে খুন হচ্ছে, খুনি মুখ ঢাকার গরজও বোধ করছে না।খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, রক্ত নেওয়ার অঙ্গীকার করা হচ্ছে, দেশ রসাতলে যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার চেয়ে চেয়ে দেখছে, হুঁশ ফিরছে না।অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংঘটিত ঘটনার নিন্দা জানানো আর বিবৃতির মধ্যেই সরকার সীমাবদ্ধ।আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে পারেনি, অবশ্য থামাতে পারেনি কথাটি সত্য নয়, তারা থামানোর চেষ্টাও করেনি, প্রতিটি মবের সম্মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিষ্কৃয় মনে হয়েছে।আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী মতকে দমন করতে গুম সংস্কৃতি চালু করেছিল, এখন আর গুমের প্রয়োজন নেই, প্রকাশ্যেই বিরোধী মতকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, এখন আর আয়নাঘরে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভিকটিমকে লালন-পালন করার দরকার হচ্ছে না।আওয়ামী লীগের আমলে ‘রাজাকার’ ট্যাগ লাগিয়ে যত্রতত্র বিরোধী মতকে থামিয়ে দেওয়া হতো; আর এখন ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বা ‘ভারতের দালাল’ ট্যাগ লাগিয়ে পিটিয়ে থানায় সোপর্দ করা হচ্ছে। ওসমান হাদি জীবিত থাকতে সরকারের কাছে নিরাপত্তা চায়নি, চেয়েছিল অপরাধীর বিচার। কিন্তু আজ তার শ্যুটারদের কোন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না, খুনি অবাধে সীমান্ত পাড়ি দিতে পারছে।শুধু ওসমান হাদি নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আরো অসংখ্য খুন হয়েছে, কিন্তু কোন খুনির বিচার হওয়ার কথা শোনা যায়নি।

রাজনীতির বলী শিশু ও নিরপরাধী ব্যক্তিরা। ওসমান হাদির স্ত্রী আছে, একজন শিশু সন্তান আছে।নষ্ট রাজনীতির নির্মমতার শিকার ওসমান হাদির এই দুধের শিশুটি। ইসরায়েল গাজায় হাজার হাজার শিশুকে হত্যা করেছে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর অভিপ্রায়ে নিজের শিশু সন্তানকে নিজ হাতে মেরে প্রতিপক্ষকে দায়ী করে মামলা করার ঘটনা বাংলাদেশে বহুবার ঘটেছে। এক ধর্মান্ধ পিতা গরু-ছাগলের পরিবর্তে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে কোরবানি দিয়েছিল। নবজাতক সন্তানের জন্য ওষুধ কিনতে গেলে পঙ্গু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জের চরমনসা এলাকায় বিএনপি নেতার ঘরে তালা লাগিয়ে অগ্নিসংযোগ করার কারণে সাত বছর বয়সী আয়েশা আক্তার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। চট্টগ্রামের রাউজানে মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে চারটি সংখ্যালঘু পরিবারের ঘরে দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। এক প্লেট ভাতের লোভ দেখিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন করা হয়েছিল মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মবের বলী দিপুর বউ এবং তার শিশু সন্তানও রয়েছে।

অন্তবর্তী সরকারের আমলে শুধু শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়নি, ধ্বংস হয়েছে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও, শিল্প ও সাহিত্যের চর্চায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। কোথাও আগের মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না। আওয়ামী শিল্পীদের অনুপস্থিতিতে একটা অলিখিত শূন্যতা বিরাজ করছে, দেশের নামকরা শিল্পীদের গায়ে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’-এর তকমা লেগে গেছে, তাই তারা সাংস্কৃতিক জগত থেকে দূরে অবস্থান করছেন। দেশটা বহু আগে থেকেই ঘুনেধরা, সর্বত্র বিভাজন, সব পেশায় বিভক্তি, সাংস্কৃতিক জগতে এই বিভাজন প্রকট।সাংস্কৃতিক জগতের দলীয় কর্মীরা ভিন্নমতের কোন শিল্পীকে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি ইত্যাদি করার সুযোগ দেয় না, রেডিও-টিভির তালিকাভুক্ত ভিন্নমতের শিল্পীরা হয়ে যান অপাঙ্ক্তেয়। ইউনূস সরকারের আমলে শুরু হয়েছে নতুন নতুন বিপত্তি, শুরু হয়েছে বাউলদের ওপর আক্রমণ, বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে লালন উৎসব, ভাংচুর করা হচ্ছে সুফি-সাধকদের মাজার, গুরুত্বহীন করে তোলা হচ্ছে একুশে বইমেলা, কবর থেকে তুলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষের লাশ। তৌহিদী জনতার নামে মব সৃষ্টি করে রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অচল করে দেওয়া হচ্ছে- সরকার নির্বিকার, উদাসীন। মাত্র দেড় বছরে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নেমে গেছে। অথচ প্রথম প্রথম ইউনূসের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল আকাশচুম্বী, সবার ধারণা ছিল, ‘এবার কিছু একটা ভালো হবে’। একজন সাবেক সচিব টকশোতে এসে এক সময় ইউনূসের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার অপরিহার্যতা ব্যাখ্যা করেছিলেন, সম্প্রতি আবার টকশোতে এসে বলছেন, ‘ভিক্ষার দরকার নেই, কুত্তা সামলাও’।

নির্বাচন যতই সন্নিকটে আসছে দেশ ততই ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে পড়ছে। সঙ্কট বহুমুখী- রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক সঙ্কট, সাংস্কৃতিক সঙ্কট, ধর্মীয় সঙ্কট ও বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্কট।সরকার পরিবর্তনে জনগণের মধ্যে যে আশা-আকাক্সক্ষার জন্ম হয়েছিল তার ছিটেফোঁটারও বাস্তবায়ন হয়নি, কোন ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি; বরং দুর্নীতি বেড়েছে, ঘুষ বেড়েছে, লুটপাট বেড়েছে, সন্ত্রাস বেড়েছে, চাঁদাবাজি বেড়েছে, খুনাখুনি বেড়েছে, গ্রেফতার বেড়েছে, হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, ভয় ও শঙ্কা বেড়েছে, ধর্মীয় অনুভূতি বেড়েছে, উগ্রপন্থীদের দৌরাত্ব বেড়েছে, শিক্ষকদের হেনস্তা বেড়েছে, নারীদের ওপর মোরাল পুলিশিং বেড়েছে। অপরদিকে কমেছে জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা, আরও কমেছে বেঁচে থাকার আগ্রহ, দেশপ্রেম এবং ইউনূসের জনপ্রিয়তা।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

শীতকালীন জীবন: সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও সহমর্মিতা

অ্যালগরিদমের রাজনীতি

অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই

দিপু দাস হত্যাকাণ্ড ও মব সন্ত্রাস

ভোগের দৃশ্যপট: ঢাকায় আধুনিকতা কেন কেবল অল্প কিছু মানুষের জন্য?

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

বিনা-ভাড়ার ট্রেনযাত্রা

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

চারদিকে আতঙ্ক আর শঙ্কা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরিফ ওসমান হাদি ঢাকার একটি আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। তাকে গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পল্টনের কালভার্ট রোডে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে যাওয়ার সময় একটি মোটরসাইকেল থেকে গুলি করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবর হচ্ছে ঘাতক ভারতে পালিয়ে গেছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার, এত দীর্ঘ সীমান্ত মানুষের পাহারায় নিশ্চিদ্র করা কঠিন। দুয়েকজন অনুপ্রবেশকারীকে গুলি করে হত্যা করা হলেও দুই দেশের চোরাচালান ঠেকানো যায়নি এবং কখনো সম্ভবও হবে না, কারণ এখন পর্যন্ত মাত্র ৭৯ শতাংশ কাটাতারের বেড়া দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তাই ঘাতকের ভারতে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতেই পারে, ইতঃপূর্বেও অনেক সন্ত্রাসী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। ওসমান হাদির ঘাতক ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কথা প্রচার করে ঘাতককে দেশের ভিতর লুকিয়ে রাখার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশের অভ্যন্তরে গ্রেফতার হলে এখন অনেকে বলবেন, ‘ভারত পুশ করেছে’। ওসমান হাদি হত্যার ঘটনায় ভারতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে নয়াদিল্লি।

কোনো মৃত্যুই প্রত্যাশিত নয়, বিশেষ করে হত্যা আর খুন। ৩২ বছরের শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন চব্বিশের অভ্যুত্থানের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও ভারতের তীব্র সমালোচক ছিলেন। ঝালকাঠির একটি মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। হাদি ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স নামক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, জুলাই আন্দোলনে তিনি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। জোরে এবং স্পষ্ট করে কথা বলার কারণে ভোটপ্রার্থী হাদির প্রচার-প্রচারণা তুঙ্গে ওঠেছিল, তিনি তার নির্বাচনী আসনের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঢু মেরেছিলেন। হয়তো জিততে পারতেন না, কিন্তু ভোটারদের মধ্যে একটি আলোড়ন তুলতে পেরেছিলেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তার হত্যার ঘটনাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই, সরকার অবশ্য খুনের রহস্য উদঘাটন ও খুনিদের ধরার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ওসমান হাদি স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল তাকে কেউ গুলি করে মেরে ফেললেও যেন বিচারটা নিশ্চিত করা হয়। খেয়াল রাখতে হবে, বিচার নিশ্চিত করার জন্য যেন আরেকজন ‘জজমিয়া’র সৃষ্টি না হয়।

ওসমান হাদির করুণ মৃত্যুর ভাবগম্ভীর আবহ নষ্ট হলো মবের উন্মত্ত আচরণে। হাদীর মৃত্যুর পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ভারতীয় হাইকমিশন, ছায়ানট, উদীচি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘরবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে জনগণের মনোযোগে পরিবর্তন ঘটে, মানুষ ওসমান হাদির কথা ভুলে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে থাকে, দেখতে থাকে দিপু চন্দ্র দাসের ঝুলন্ত মরদেহের আগুন। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের বিপক্ষে ছিল শেখ হাসিনা, এখন দেখি শেখ হাসিনার বিরোধীরাও এই দুটি পত্রিকার বিরোধী। শুধু এই একটি ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট আর ফ্যাসিস্ট বিরোধীদের মধ্যে মিল ও ঐক্য আছে। অভ্যুত্থানের পরপরই এই দুটি পত্রিকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে, পত্রিকা অফিসের সম্মুখে গরু জবাই করে উৎসব করেছে, উৎসর্গকৃত সেই গরুর উপর নাম লেখা হয়েছিল পত্রিকার সম্পাদকের। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে এই দুটি পত্রিকা অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোর সমর্থক। এখন বোধ হয় তাদের আনুগত্য সম্ভাব্য বিজয়ের কাছে শিফট করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গত দেড় বছরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এই স্থবিরতার মধ্যে আবার কয়েকদিন আগে ‘উদীচী’ শিল্পীগোষ্ঠীর ৫৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী আর্কাইভ ও কয়েক হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর ‘ছায়ানট’। ছায়ানটের একটি হারমোনিয়ামকে এক ব্যক্তি আছাড় দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে গান-বাজনা আর চলবে না। শুধু নাচ-গানের ঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ক্ষান্ত হচ্ছে না, আক্রমণ করছে বাউলদের ওপর, বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে লালন উৎসব, ভাঙ্গা হচ্ছে সুফি-সাধকদের মাজার, বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে একুশে বইমেলা, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে উল্লাস করা হচ্ছে কবর থেকে লাশ তুলে। তৌহিদী জনতার নামে চলমান এই সকল কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। সংস্কৃতি আর বুদ্ধিবৃত্তিক পঙ্গুত্ব যতবেশি নেমে আসবে মানুষের মনোবৈকল্য তত বাড়তে থাকবে, এক সময় শুধু পাবনায় নয়, দেশের প্রতিটি জেলায় মানসিক হাসপাতাল ও পাগলা গারদ তৈরি করতে হবে।

দীপু চন্দ্র দাস নামের একজন নিরীহ গরীব পোষাক শ্রমিককে পিটিয়ে আধমরা অবস্থায় পায়ে দড়ি বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে আগুন জ্বালিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হলো প্রকাশ্যে দিনের আলোয়।ধর্মীয় অবমাননার কথা বলে সৃষ্টির সেরা একজন মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করার মধ্যে আরেকজন মানুষ যখন উল্লাস খুঁজে পায় তখন বলতেই হবে আমরা আবার আদিম অন্ধকার যুগে ফেরত যাচ্ছি।আদিম বর্বর যুগে ফেরত এসেছি বলেই কেউ নির্যাতন করার সময় ধর্মীয় কটুক্তিটা কী তা জানার প্রয়োজন বোধও করে না। উলঙ্গ দীপুর জলন্ত দেহ দেখে আতঙ্ক আর শঙ্কায় পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোন পথিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও প্রকাশ করতে সাহস করেনি।যারা পোড়ানোর জন্য আধমরা দীপুকে রশি দিয়ে বেঁধে গাছে টাঙিয়েছে তাদের অনেকে হয়তো নিয়মিত নামাজও পড়ে না, ওয়াজ শুনে শুনে তারা হয়ে গেছে মুসলিম জাতীয়তাবাদের জেহাদী। এমন উগ্রপন্থার কারণেই সারা বিশ্বে ‘ইসলাম ফোবিয়া’ বা ইসলাম-ভীতি তৈরি হয়েছে, ইসলাম সম্পর্কে ভালো ধারণা তিরোহিত হচ্ছে। ইসলাম মতে ‘আগুনের রব ছাড়া আগুন দিয়ে কিছুকে শাস্তি দেওয়ার কারো অধিকার নেই’। কিন্তু দীপুর ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশ তারা মানেনি। ওয়াজি আলেমদের অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে অনেক রূঢ় কথা বলেন, কিন্তু তখন এই সকল জেহাদীদের অনুভূতিতে আঘাত করে না। প্রকাশ্যে মানুষ পিটিয়ে আগুন দিয়ে পোড়ানোর এই রাজনীতিই কী সংস্কার! দুঃখজনক হচ্ছে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার এমন পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড কোন ফ্যাসিস্ট করেনি, করেছে ফ্যাসিস্ট বিরোধীরাই।

মব সংস্কৃতি থামছে না, মব করার দুটি হাতিয়ার- এক, ধর্মের দোহাই; দুই, স্বৈরাচারের দোসর।প্রেস সচিব বলেছেন, এরা মব গ্রুপ নয়, এরা প্রেসার গ্রুপ। বিরোধী মতের মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠানকে ভেঙ্গে তছনছ করা হচ্ছে, প্রকাশ্য দিবালোকে বা গভীর অন্ধকারে খুন হচ্ছে, খুনি মুখ ঢাকার গরজও বোধ করছে না।খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, রক্ত নেওয়ার অঙ্গীকার করা হচ্ছে, দেশ রসাতলে যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার চেয়ে চেয়ে দেখছে, হুঁশ ফিরছে না।অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংঘটিত ঘটনার নিন্দা জানানো আর বিবৃতির মধ্যেই সরকার সীমাবদ্ধ।আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে পারেনি, অবশ্য থামাতে পারেনি কথাটি সত্য নয়, তারা থামানোর চেষ্টাও করেনি, প্রতিটি মবের সম্মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিষ্কৃয় মনে হয়েছে।আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী মতকে দমন করতে গুম সংস্কৃতি চালু করেছিল, এখন আর গুমের প্রয়োজন নেই, প্রকাশ্যেই বিরোধী মতকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, এখন আর আয়নাঘরে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভিকটিমকে লালন-পালন করার দরকার হচ্ছে না।আওয়ামী লীগের আমলে ‘রাজাকার’ ট্যাগ লাগিয়ে যত্রতত্র বিরোধী মতকে থামিয়ে দেওয়া হতো; আর এখন ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বা ‘ভারতের দালাল’ ট্যাগ লাগিয়ে পিটিয়ে থানায় সোপর্দ করা হচ্ছে। ওসমান হাদি জীবিত থাকতে সরকারের কাছে নিরাপত্তা চায়নি, চেয়েছিল অপরাধীর বিচার। কিন্তু আজ তার শ্যুটারদের কোন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না, খুনি অবাধে সীমান্ত পাড়ি দিতে পারছে।শুধু ওসমান হাদি নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আরো অসংখ্য খুন হয়েছে, কিন্তু কোন খুনির বিচার হওয়ার কথা শোনা যায়নি।

রাজনীতির বলী শিশু ও নিরপরাধী ব্যক্তিরা। ওসমান হাদির স্ত্রী আছে, একজন শিশু সন্তান আছে।নষ্ট রাজনীতির নির্মমতার শিকার ওসমান হাদির এই দুধের শিশুটি। ইসরায়েল গাজায় হাজার হাজার শিশুকে হত্যা করেছে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর অভিপ্রায়ে নিজের শিশু সন্তানকে নিজ হাতে মেরে প্রতিপক্ষকে দায়ী করে মামলা করার ঘটনা বাংলাদেশে বহুবার ঘটেছে। এক ধর্মান্ধ পিতা গরু-ছাগলের পরিবর্তে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে কোরবানি দিয়েছিল। নবজাতক সন্তানের জন্য ওষুধ কিনতে গেলে পঙ্গু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জের চরমনসা এলাকায় বিএনপি নেতার ঘরে তালা লাগিয়ে অগ্নিসংযোগ করার কারণে সাত বছর বয়সী আয়েশা আক্তার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। চট্টগ্রামের রাউজানে মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে চারটি সংখ্যালঘু পরিবারের ঘরে দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। এক প্লেট ভাতের লোভ দেখিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন করা হয়েছিল মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মবের বলী দিপুর বউ এবং তার শিশু সন্তানও রয়েছে।

অন্তবর্তী সরকারের আমলে শুধু শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়নি, ধ্বংস হয়েছে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও, শিল্প ও সাহিত্যের চর্চায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। কোথাও আগের মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না। আওয়ামী শিল্পীদের অনুপস্থিতিতে একটা অলিখিত শূন্যতা বিরাজ করছে, দেশের নামকরা শিল্পীদের গায়ে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’-এর তকমা লেগে গেছে, তাই তারা সাংস্কৃতিক জগত থেকে দূরে অবস্থান করছেন। দেশটা বহু আগে থেকেই ঘুনেধরা, সর্বত্র বিভাজন, সব পেশায় বিভক্তি, সাংস্কৃতিক জগতে এই বিভাজন প্রকট।সাংস্কৃতিক জগতের দলীয় কর্মীরা ভিন্নমতের কোন শিল্পীকে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি ইত্যাদি করার সুযোগ দেয় না, রেডিও-টিভির তালিকাভুক্ত ভিন্নমতের শিল্পীরা হয়ে যান অপাঙ্ক্তেয়। ইউনূস সরকারের আমলে শুরু হয়েছে নতুন নতুন বিপত্তি, শুরু হয়েছে বাউলদের ওপর আক্রমণ, বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে লালন উৎসব, ভাংচুর করা হচ্ছে সুফি-সাধকদের মাজার, গুরুত্বহীন করে তোলা হচ্ছে একুশে বইমেলা, কবর থেকে তুলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষের লাশ। তৌহিদী জনতার নামে মব সৃষ্টি করে রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অচল করে দেওয়া হচ্ছে- সরকার নির্বিকার, উদাসীন। মাত্র দেড় বছরে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নেমে গেছে। অথচ প্রথম প্রথম ইউনূসের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল আকাশচুম্বী, সবার ধারণা ছিল, ‘এবার কিছু একটা ভালো হবে’। একজন সাবেক সচিব টকশোতে এসে এক সময় ইউনূসের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার অপরিহার্যতা ব্যাখ্যা করেছিলেন, সম্প্রতি আবার টকশোতে এসে বলছেন, ‘ভিক্ষার দরকার নেই, কুত্তা সামলাও’।

নির্বাচন যতই সন্নিকটে আসছে দেশ ততই ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে পড়ছে। সঙ্কট বহুমুখী- রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক সঙ্কট, সাংস্কৃতিক সঙ্কট, ধর্মীয় সঙ্কট ও বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্কট।সরকার পরিবর্তনে জনগণের মধ্যে যে আশা-আকাক্সক্ষার জন্ম হয়েছিল তার ছিটেফোঁটারও বাস্তবায়ন হয়নি, কোন ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি; বরং দুর্নীতি বেড়েছে, ঘুষ বেড়েছে, লুটপাট বেড়েছে, সন্ত্রাস বেড়েছে, চাঁদাবাজি বেড়েছে, খুনাখুনি বেড়েছে, গ্রেফতার বেড়েছে, হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, ভয় ও শঙ্কা বেড়েছে, ধর্মীয় অনুভূতি বেড়েছে, উগ্রপন্থীদের দৌরাত্ব বেড়েছে, শিক্ষকদের হেনস্তা বেড়েছে, নারীদের ওপর মোরাল পুলিশিং বেড়েছে। অপরদিকে কমেছে জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা, আরও কমেছে বেঁচে থাকার আগ্রহ, দেশপ্রেম এবং ইউনূসের জনপ্রিয়তা।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

back to top