alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

অ্যালগরিদমের রাজনীতি

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

: শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

কেউ কি কল্পনা করতে পারত—একটি রাষ্ট্র, যাকে একসময় ‘অস্তিত্বের সংগ্রামে টিকে থাকা জাতি’ বলা হতো, সেই রাষ্ট্রই একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ঘৃণিত প্রতীকে পরিণত হবে? যে নামটি একসময় বুদ্ধিবৃত্তি, উদ্ভাবন ও প্রতিরক্ষার প্রতীক ছিল, আজ সেটিই মানবতার চোখে এক নৃশংসতার অভিধান হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালের ৬ অক্টোবরের আগে কেউ ভাবেনি, পৃথিবীর বিবেক একদিন ‘ইসরায়েল’ নাম উচ্চারণে থমকে যাবে—যেন এই উচ্চারণেই শিশুহত্যার ধ্বনি, নারীর আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া শহরের গন্ধ মিশে আছে। ইতিহাসে এমন রাত আমরা বহু দেখেছি, যেখানে ক্ষমতা ন্যায়কে গ্রাস করেছে; কিন্তু এত দ্রুত কোনো জাতির চেহারা বদলে যেতে দেখিনি। কয়েক মাসেই ‘ইসরায়েল’ শব্দটি হয়ে উঠেছে গণহত্যার প্রতিশব্দ, পরিকল্পিত ধর্ষণের উপাখ্যান, আর সভ্যতার মুখোশধারী বর্বরতার এক চলমান চলচ্চিত্র। এই রাষ্ট্র যেন এখন শুধু ভূরাজনীতির মানচিত্রে নয়—মানবতার আত্মায়ও এক কালো দাগ হয়ে গেছে।

অ্যালগরিদমের ভিতরে নতুন যুদ্ধ

কিন্তু এই দাগ তারা নিজের চোখে দেখতে চায় না। তাদের বিশ্বাস—মানুষের ঘৃণা বাস্তব নয়, বরং সেটি এক ‘অ্যালগরিদমিক বিভ্রম।’ তাদের ধারণা, ঘৃণার কারণ তাদের কর্ম নয়, বরং ডিজিটাল অ্যালগরিদমের কৌশল। সুতরাং তাদের যুদ্ধ এখন বাস্তবের মাটিতে নয়, বরং পর্দার ভেতর—তথ্যের কোডে, মেটাডেটার স্তরে, সাইবার জগতে। যেভাবে তারা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের বয়ান দখলে নিয়েছিল, এখন তারা চায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ন্যারেটিভও নিজেদের হাতে তুলতে—যেন প্রযুক্তির মঞ্চে সত্যকে থামিয়ে দিয়ে, মিথ্যার জন্য নতুন অ্যালগরিদম বানানো যায়। এই কারণেই টিকটক হয়ে উঠেছে তাদের প্রথম লক্ষ্য—একটি অদ্ভুত যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে অস্ত্র নয়, আছে অ্যালগরিদম; সৈনিক নয়, আছে হ্যাশট্যাগ ও ভিডিওর শব্দ; রক্ত নয়, প্রবাহিত হয় তথ্য ও বিভ্রম। তাদের বিশ্বাস—যদি এই প্ল্যাটফর্ম দখল করা যায়, তাহলে মানুষের বিবেককেও অ্যালগরিদমিকভাবে পুনর্লিখন করা সম্ভব হবে। ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধ তাই এখন গাজায় নয়, চলছে গুগল সার্ভারে; বোমার নিচে নয়, ডেটা সেন্টারের ভেতরে। এই যুদ্ধের লক্ষ্য একটাই—ঘৃণার উৎস মুছে দেওয়া নয়, বরং ঘৃণার গল্পটিকেই অদৃশ্য করে ফেলা।

গবেষণার অ্যালগরিদমে প্রতিফলিত বিবেক

নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ফুটে উঠেছে এই নীরব যুদ্ধের পরিসংখ্যানিক কাব্য। দেখা গেছে—২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর টিকটকে ফিলিস্তিনপন্থী পোস্ট ছিল প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজারেরও বেশি, আর ইসরায়েলপন্থী পোস্ট মাত্র আট হাজারের কিছু বেশি। এই বৈষম্য শুধু সংখ্যা নয়—এ এক প্রজন্মের বিবেকের প্রতিফলন। যেন তরুণ পৃথিবী একসাথে ঘোষণা দিচ্ছে, ‘আমরা দেখছি, আমরা শুনছি, আর আমরা চুপ থাকব না।’ এনগেজমেন্টের দিক থেকেও ব্যবধান অভাবনীয়—ফিলিস্তিনপন্থী পোস্ট দেখা হয়েছে প্রায় দুইশ ছত্রিশ মিলিয়ন বার, আর ইসরায়েলপন্থী পোস্ট পেয়েছে মাত্র চৌদ্দ মিলিয়ন ভিউ। এই পার্থক্য শুধু অ্যালগরিদমিক প্রতিক্রিয়া নয়, এটি ইতিহাসের শিকার এক জাতির পক্ষে জনমতের নীরব উচ্চারণ।

প্রথমদিকে হয়তো আবেগের ঢেউ ছিল প্রবল—সংবাদচিত্রের ঝলক, যুদ্ধের উত্তাপ, মানবিক প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, যখন সেই তাপ স্তিমিত হওয়ার কথা, তখনও ফিলিস্তিনের পক্ষে আওয়াজ থামেনি; বরং তা পরিণত হয়েছে ধারাবাহিক, সংগঠিত ও স্থায়ী আন্দোলনে। এ যেন এক অবিরাম জোয়ার—বালুচরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, আবারও ছুটে যায় তীরের দিকে। প্রতিটি ভিডিও, প্রতিটি মন্তব্য, প্রতিটি শেয়ার যেন একেকটি ঢেউ; একত্রে তারা গড়ে তুলছে এক ডিজিটাল সাগর, যার তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডার দেয়ালে। এই তরঙ্গের রূপ শুধু ভার্চুয়াল নয়—এটি এক প্রজন্মের নৈতিক প্রতিরোধ। যারা যুদ্ধ দেখেছে পর্দায়, কিন্তু সত্য খুঁজেছে হৃদয়ে। যারা জানে—প্রযুক্তি কখনও বিবেকের বিকল্প হতে পারে না। এভাবেই টিকটকের স্ক্রিনে, এক মিনিটের ছোট্ট ভিডিওর ভেতর দিয়ে, পৃথিবীর বিবেক নিজের নতুন ভাষা খুঁজে নিয়েছে—যেখানে অ্যালগরিদম ব্যর্থ, কিন্তু মানুষ জেগে আছে।

নীরব যুদ্ধের নেপথ্যে

জায়নবাদীরা বিষয়টির গভীরতা প্রথমেই অনুধাবন করেছিল। তারা বুঝে যায়—এ যুদ্ধ আর গাজা উপত্যকার নয়; এটি টিকটকের পর্দায়, এটি মিসাইলের নয়, মনোভাবের। যেখানেই তাদের নৃশংসতার ছবি ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানেই জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রজন্মের প্রশ্ন—‘মানবতা কার পক্ষে?’ এই প্রশ্নই হয়ে ওঠে তাদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ। এই প্রজন্ম—যাদের আমরা বলি জেনারেশন জেড—ধর্ম, রাজনীতি বা রাষ্ট্রের প্রাচীর দিয়ে বিচার করে না; তারা দেখে কে নিপীড়িত আর কে নিপীড়ক। এই বাস্তবতাই জায়নবাদী প্রচারণার দেয়ালে বড় ফাটল ধরায়।

অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগের প্রধান জনাথন গ্রিনব্যাটের এক ফাঁস হওয়া অডিওতে ধরা পড়ে আতঙ্কের সুর—“আমাদের টিকটক সমস্যা আছে, আমাদের জেনারেশন-জেড সমস্যা আছে।’ এই একটি বাক্যই তাদের সমগ্র ভয়কে নগ্ন করে দেয়। তারপর শুরু হয় রাজনীতি ও অর্থের জোটবদ্ধ অভিযান। শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে ছড়ানো হলো ভয়—চীন নাকি টিকটকের অ্যালগরিদমের মালিক, তারা মার্কিন নাগরিকদের ডেটা চুরি করছে, জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে! এভাবে এক অদৃশ্য আতঙ্ক সৃষ্টি করা হলো, যেন টিকটক এক গুপ্তচর প্যাটফর্ম। কিন্তু প্রকৃত কারণ ছিল অন্য—ফিলিস্তিনের পক্ষে মানুষের সহমর্মিতা থেকে জন্ম নেওয়া সত্যকে ঢেকে দেওয়ার প্রচেষ্টা। চীন শুধু অজুহাত; মূল যুদ্ধ ইসরায়েলের ভাবমূর্তি রক্ষার। অবশেষে দেখা গেল—রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, যারা সাধারণত একমত হয় না, তারা এবার একসুরে কথা বলছে টিকটকবিরোধিতায়। ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ ও ‘ডেটা সুরক্ষা’র মুখোশে শুরু হলো এক নীরব যুদ্ধ—একটি অ্যাপের বিরুদ্ধে নয়, বরং এক প্রজন্মের বিবেকের বিরুদ্ধে।

অদৃশ্য সাম্রাজ্য ও অ্যালগরিদমিক নিয়ন্ত্রণ

বিক্রেতারা এল—ওরাকলসহ কিছু প্রযুক্তি জায়ান্টের কনসোর্টিয়াম। কিন্তু এই বিক্রয়ের আড়ালে ছিল ভিন্ন এক কাহিনি। ওরাকলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসন—বিশ্বের অন্যতম ধনী, সামরিক অনুদানকারী ও কট্টর জায়নবাদী—এখন এই ডিজিটাল যুদ্ধের অর্থনৈতিক সেনাপতি। নেতানিয়াহু তখন প্রফুল্ল। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র, আর টিকটকের মালিকানা পরিবর্তন সেই যুদ্ধেরই এক অধ্যায়।’ কিন্তু এখানেই কাহিনি শেষ নয়। এবার তাদের চোখ পড়েছে ‘এক্স’-এ, সাবেক টুইটারে। সংবাদমাধ্যমে তখন শিরোনাম—‘এক্স হচ্ছে নতুন অ্যান্টিসেমিটিজমের আশ্রয়।’ নেতানিয়াহু শান্তভাবে বললেন, ‘ইলন আমাদের বন্ধু।’ আর বন্ধু ইলন মাস্ক—ক্ষমতার অ্যালগরিদম যিনি বোঝেন—অবশ্যই ‘শোনেন।’ তাদের লক্ষ্য এখন আরও গভীরে—চেতনা নিয়ন্ত্রণ। তারা চায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিজেদের কণ্ঠে রূপান্তরিত করতে। ট্রাম্প সরকারের প্রাক্তন এক প্রচারপ্রধানের সঙ্গে কোটি ডলারের চুক্তিতে তৈরি হচ্ছে নতুন ইসরায়েলপন্থী ওয়েবসাইট, ভিডিও ও কনটেন্ট—যা দিয়ে প্রশিক্ষিত হবে বৃহৎ ভাষা-মডেলগুলো। উদ্দেশ্য স্পষ্ট— এআই যেন বারবার প্রচার করে তাদের বয়ান, তাদের ইতিহাস, তাদের ‘সত্য’। আর এই প্রক্রিয়ায় গাজায় শিশুহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসস্তূপের স্মৃতি হারিয়ে যাবে কোডের অন্ধকারে। যেন এক অদৃশ্য হাতে মুছে ফেলা যায় স্মৃতি—যেভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে ভৌগোলিক রেখা, জীবনের চিহ্ন, আর এক জাতির অস্তিত্ব।

ইতিহাস ও অ্যালগরিদমের মুছনযজ্ঞ

এখন চলছে এক অনন্য যুদ্ধ—যেখানে একদিকে লেখা হচ্ছে ইতিহাস, আর অন্যদিকে চলছে সেই ইতিহাসেরই সুচারু মুছনযজ্ঞ। কলমের কালি নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদমই এখন সেই ক্যানভাস—যেখানে সত্য ও মিথ্যা, স্মৃতি ও প্রচারণা, ন্যায় ও স্বার্থ একাকার হয়ে মিশে যাচ্ছে। এ ক্যানভাসে আঁকা ছবি শুধুই সংবাদ নয়; এটি এক চিন্তার দখলযুদ্ধ। মানুষের আবেগ, ক্রোধ, সহমর্মিতা—সবকিছুই এখন মাপা যায় লাইক, ভিউ বা ট্রেন্ডের ভাষায়। এখানে ভাবনার স্বাধীনতা নেই—আছে অর্থ, ক্ষমতা ও প্রযুক্তির মিশ্রণে তৈরি এক রাজনৈতিক রঙপ্যালেট, যা নির্ধারণ করে কাকে মানবিক বলা হবে, আর কাকে ‘সন্ত্রাসী’ বানানো হবে।

আমরা যদি এই যুদ্ধ বুঝতে চাই, তবে এটিকে শুধু মতাদর্শের সংঘাত বলা যাবে না। এটি জনমতের লড়াই, যেখানে মঞ্চ হলো স্মৃতি, আর অস্ত্র হলো অ্যালগরিদম। সত্য ও মিথ্যা একই ডেটাসেটে বসবাস করছে—তবু জয় পায় সেই পক্ষ, যার হাতে গল্প বলার নিয়ন্ত্রণ; যার অ্যালগরিদম শেখায় কাকে মানুষ হিসেবে স্মরণ রাখতে হবে, আর কাকে ভুলে যেতে হবে। আজ তাই এই যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে শুধু বুলেট নয়, বর্ণনাও—যে বর্ণনা আমাদের চোখে দেখায় ‘ঘৃণা’, অথচ মুছে দেয় ‘সহানুভূতি’। এই হল অ্যালগরিদমের যুদ্ধ—যেখানে তথ্য নয়, মানবতার দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হচ্ছে কোডের ভাষায়।

[লেখক: আইনজীবী]

শীতকালীন জীবন: সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও সহমর্মিতা

চারদিকে আতঙ্ক আর শঙ্কা

অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই

দিপু দাস হত্যাকাণ্ড ও মব সন্ত্রাস

ভোগের দৃশ্যপট: ঢাকায় আধুনিকতা কেন কেবল অল্প কিছু মানুষের জন্য?

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

বিনা-ভাড়ার ট্রেনযাত্রা

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

অ্যালগরিদমের রাজনীতি

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

কেউ কি কল্পনা করতে পারত—একটি রাষ্ট্র, যাকে একসময় ‘অস্তিত্বের সংগ্রামে টিকে থাকা জাতি’ বলা হতো, সেই রাষ্ট্রই একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ঘৃণিত প্রতীকে পরিণত হবে? যে নামটি একসময় বুদ্ধিবৃত্তি, উদ্ভাবন ও প্রতিরক্ষার প্রতীক ছিল, আজ সেটিই মানবতার চোখে এক নৃশংসতার অভিধান হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালের ৬ অক্টোবরের আগে কেউ ভাবেনি, পৃথিবীর বিবেক একদিন ‘ইসরায়েল’ নাম উচ্চারণে থমকে যাবে—যেন এই উচ্চারণেই শিশুহত্যার ধ্বনি, নারীর আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া শহরের গন্ধ মিশে আছে। ইতিহাসে এমন রাত আমরা বহু দেখেছি, যেখানে ক্ষমতা ন্যায়কে গ্রাস করেছে; কিন্তু এত দ্রুত কোনো জাতির চেহারা বদলে যেতে দেখিনি। কয়েক মাসেই ‘ইসরায়েল’ শব্দটি হয়ে উঠেছে গণহত্যার প্রতিশব্দ, পরিকল্পিত ধর্ষণের উপাখ্যান, আর সভ্যতার মুখোশধারী বর্বরতার এক চলমান চলচ্চিত্র। এই রাষ্ট্র যেন এখন শুধু ভূরাজনীতির মানচিত্রে নয়—মানবতার আত্মায়ও এক কালো দাগ হয়ে গেছে।

অ্যালগরিদমের ভিতরে নতুন যুদ্ধ

কিন্তু এই দাগ তারা নিজের চোখে দেখতে চায় না। তাদের বিশ্বাস—মানুষের ঘৃণা বাস্তব নয়, বরং সেটি এক ‘অ্যালগরিদমিক বিভ্রম।’ তাদের ধারণা, ঘৃণার কারণ তাদের কর্ম নয়, বরং ডিজিটাল অ্যালগরিদমের কৌশল। সুতরাং তাদের যুদ্ধ এখন বাস্তবের মাটিতে নয়, বরং পর্দার ভেতর—তথ্যের কোডে, মেটাডেটার স্তরে, সাইবার জগতে। যেভাবে তারা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের বয়ান দখলে নিয়েছিল, এখন তারা চায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ন্যারেটিভও নিজেদের হাতে তুলতে—যেন প্রযুক্তির মঞ্চে সত্যকে থামিয়ে দিয়ে, মিথ্যার জন্য নতুন অ্যালগরিদম বানানো যায়। এই কারণেই টিকটক হয়ে উঠেছে তাদের প্রথম লক্ষ্য—একটি অদ্ভুত যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে অস্ত্র নয়, আছে অ্যালগরিদম; সৈনিক নয়, আছে হ্যাশট্যাগ ও ভিডিওর শব্দ; রক্ত নয়, প্রবাহিত হয় তথ্য ও বিভ্রম। তাদের বিশ্বাস—যদি এই প্ল্যাটফর্ম দখল করা যায়, তাহলে মানুষের বিবেককেও অ্যালগরিদমিকভাবে পুনর্লিখন করা সম্ভব হবে। ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধ তাই এখন গাজায় নয়, চলছে গুগল সার্ভারে; বোমার নিচে নয়, ডেটা সেন্টারের ভেতরে। এই যুদ্ধের লক্ষ্য একটাই—ঘৃণার উৎস মুছে দেওয়া নয়, বরং ঘৃণার গল্পটিকেই অদৃশ্য করে ফেলা।

গবেষণার অ্যালগরিদমে প্রতিফলিত বিবেক

নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ফুটে উঠেছে এই নীরব যুদ্ধের পরিসংখ্যানিক কাব্য। দেখা গেছে—২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর টিকটকে ফিলিস্তিনপন্থী পোস্ট ছিল প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজারেরও বেশি, আর ইসরায়েলপন্থী পোস্ট মাত্র আট হাজারের কিছু বেশি। এই বৈষম্য শুধু সংখ্যা নয়—এ এক প্রজন্মের বিবেকের প্রতিফলন। যেন তরুণ পৃথিবী একসাথে ঘোষণা দিচ্ছে, ‘আমরা দেখছি, আমরা শুনছি, আর আমরা চুপ থাকব না।’ এনগেজমেন্টের দিক থেকেও ব্যবধান অভাবনীয়—ফিলিস্তিনপন্থী পোস্ট দেখা হয়েছে প্রায় দুইশ ছত্রিশ মিলিয়ন বার, আর ইসরায়েলপন্থী পোস্ট পেয়েছে মাত্র চৌদ্দ মিলিয়ন ভিউ। এই পার্থক্য শুধু অ্যালগরিদমিক প্রতিক্রিয়া নয়, এটি ইতিহাসের শিকার এক জাতির পক্ষে জনমতের নীরব উচ্চারণ।

প্রথমদিকে হয়তো আবেগের ঢেউ ছিল প্রবল—সংবাদচিত্রের ঝলক, যুদ্ধের উত্তাপ, মানবিক প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, যখন সেই তাপ স্তিমিত হওয়ার কথা, তখনও ফিলিস্তিনের পক্ষে আওয়াজ থামেনি; বরং তা পরিণত হয়েছে ধারাবাহিক, সংগঠিত ও স্থায়ী আন্দোলনে। এ যেন এক অবিরাম জোয়ার—বালুচরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, আবারও ছুটে যায় তীরের দিকে। প্রতিটি ভিডিও, প্রতিটি মন্তব্য, প্রতিটি শেয়ার যেন একেকটি ঢেউ; একত্রে তারা গড়ে তুলছে এক ডিজিটাল সাগর, যার তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডার দেয়ালে। এই তরঙ্গের রূপ শুধু ভার্চুয়াল নয়—এটি এক প্রজন্মের নৈতিক প্রতিরোধ। যারা যুদ্ধ দেখেছে পর্দায়, কিন্তু সত্য খুঁজেছে হৃদয়ে। যারা জানে—প্রযুক্তি কখনও বিবেকের বিকল্প হতে পারে না। এভাবেই টিকটকের স্ক্রিনে, এক মিনিটের ছোট্ট ভিডিওর ভেতর দিয়ে, পৃথিবীর বিবেক নিজের নতুন ভাষা খুঁজে নিয়েছে—যেখানে অ্যালগরিদম ব্যর্থ, কিন্তু মানুষ জেগে আছে।

নীরব যুদ্ধের নেপথ্যে

জায়নবাদীরা বিষয়টির গভীরতা প্রথমেই অনুধাবন করেছিল। তারা বুঝে যায়—এ যুদ্ধ আর গাজা উপত্যকার নয়; এটি টিকটকের পর্দায়, এটি মিসাইলের নয়, মনোভাবের। যেখানেই তাদের নৃশংসতার ছবি ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানেই জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রজন্মের প্রশ্ন—‘মানবতা কার পক্ষে?’ এই প্রশ্নই হয়ে ওঠে তাদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ। এই প্রজন্ম—যাদের আমরা বলি জেনারেশন জেড—ধর্ম, রাজনীতি বা রাষ্ট্রের প্রাচীর দিয়ে বিচার করে না; তারা দেখে কে নিপীড়িত আর কে নিপীড়ক। এই বাস্তবতাই জায়নবাদী প্রচারণার দেয়ালে বড় ফাটল ধরায়।

অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগের প্রধান জনাথন গ্রিনব্যাটের এক ফাঁস হওয়া অডিওতে ধরা পড়ে আতঙ্কের সুর—“আমাদের টিকটক সমস্যা আছে, আমাদের জেনারেশন-জেড সমস্যা আছে।’ এই একটি বাক্যই তাদের সমগ্র ভয়কে নগ্ন করে দেয়। তারপর শুরু হয় রাজনীতি ও অর্থের জোটবদ্ধ অভিযান। শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে ছড়ানো হলো ভয়—চীন নাকি টিকটকের অ্যালগরিদমের মালিক, তারা মার্কিন নাগরিকদের ডেটা চুরি করছে, জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে! এভাবে এক অদৃশ্য আতঙ্ক সৃষ্টি করা হলো, যেন টিকটক এক গুপ্তচর প্যাটফর্ম। কিন্তু প্রকৃত কারণ ছিল অন্য—ফিলিস্তিনের পক্ষে মানুষের সহমর্মিতা থেকে জন্ম নেওয়া সত্যকে ঢেকে দেওয়ার প্রচেষ্টা। চীন শুধু অজুহাত; মূল যুদ্ধ ইসরায়েলের ভাবমূর্তি রক্ষার। অবশেষে দেখা গেল—রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, যারা সাধারণত একমত হয় না, তারা এবার একসুরে কথা বলছে টিকটকবিরোধিতায়। ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ ও ‘ডেটা সুরক্ষা’র মুখোশে শুরু হলো এক নীরব যুদ্ধ—একটি অ্যাপের বিরুদ্ধে নয়, বরং এক প্রজন্মের বিবেকের বিরুদ্ধে।

অদৃশ্য সাম্রাজ্য ও অ্যালগরিদমিক নিয়ন্ত্রণ

বিক্রেতারা এল—ওরাকলসহ কিছু প্রযুক্তি জায়ান্টের কনসোর্টিয়াম। কিন্তু এই বিক্রয়ের আড়ালে ছিল ভিন্ন এক কাহিনি। ওরাকলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসন—বিশ্বের অন্যতম ধনী, সামরিক অনুদানকারী ও কট্টর জায়নবাদী—এখন এই ডিজিটাল যুদ্ধের অর্থনৈতিক সেনাপতি। নেতানিয়াহু তখন প্রফুল্ল। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র, আর টিকটকের মালিকানা পরিবর্তন সেই যুদ্ধেরই এক অধ্যায়।’ কিন্তু এখানেই কাহিনি শেষ নয়। এবার তাদের চোখ পড়েছে ‘এক্স’-এ, সাবেক টুইটারে। সংবাদমাধ্যমে তখন শিরোনাম—‘এক্স হচ্ছে নতুন অ্যান্টিসেমিটিজমের আশ্রয়।’ নেতানিয়াহু শান্তভাবে বললেন, ‘ইলন আমাদের বন্ধু।’ আর বন্ধু ইলন মাস্ক—ক্ষমতার অ্যালগরিদম যিনি বোঝেন—অবশ্যই ‘শোনেন।’ তাদের লক্ষ্য এখন আরও গভীরে—চেতনা নিয়ন্ত্রণ। তারা চায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিজেদের কণ্ঠে রূপান্তরিত করতে। ট্রাম্প সরকারের প্রাক্তন এক প্রচারপ্রধানের সঙ্গে কোটি ডলারের চুক্তিতে তৈরি হচ্ছে নতুন ইসরায়েলপন্থী ওয়েবসাইট, ভিডিও ও কনটেন্ট—যা দিয়ে প্রশিক্ষিত হবে বৃহৎ ভাষা-মডেলগুলো। উদ্দেশ্য স্পষ্ট— এআই যেন বারবার প্রচার করে তাদের বয়ান, তাদের ইতিহাস, তাদের ‘সত্য’। আর এই প্রক্রিয়ায় গাজায় শিশুহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসস্তূপের স্মৃতি হারিয়ে যাবে কোডের অন্ধকারে। যেন এক অদৃশ্য হাতে মুছে ফেলা যায় স্মৃতি—যেভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে ভৌগোলিক রেখা, জীবনের চিহ্ন, আর এক জাতির অস্তিত্ব।

ইতিহাস ও অ্যালগরিদমের মুছনযজ্ঞ

এখন চলছে এক অনন্য যুদ্ধ—যেখানে একদিকে লেখা হচ্ছে ইতিহাস, আর অন্যদিকে চলছে সেই ইতিহাসেরই সুচারু মুছনযজ্ঞ। কলমের কালি নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদমই এখন সেই ক্যানভাস—যেখানে সত্য ও মিথ্যা, স্মৃতি ও প্রচারণা, ন্যায় ও স্বার্থ একাকার হয়ে মিশে যাচ্ছে। এ ক্যানভাসে আঁকা ছবি শুধুই সংবাদ নয়; এটি এক চিন্তার দখলযুদ্ধ। মানুষের আবেগ, ক্রোধ, সহমর্মিতা—সবকিছুই এখন মাপা যায় লাইক, ভিউ বা ট্রেন্ডের ভাষায়। এখানে ভাবনার স্বাধীনতা নেই—আছে অর্থ, ক্ষমতা ও প্রযুক্তির মিশ্রণে তৈরি এক রাজনৈতিক রঙপ্যালেট, যা নির্ধারণ করে কাকে মানবিক বলা হবে, আর কাকে ‘সন্ত্রাসী’ বানানো হবে।

আমরা যদি এই যুদ্ধ বুঝতে চাই, তবে এটিকে শুধু মতাদর্শের সংঘাত বলা যাবে না। এটি জনমতের লড়াই, যেখানে মঞ্চ হলো স্মৃতি, আর অস্ত্র হলো অ্যালগরিদম। সত্য ও মিথ্যা একই ডেটাসেটে বসবাস করছে—তবু জয় পায় সেই পক্ষ, যার হাতে গল্প বলার নিয়ন্ত্রণ; যার অ্যালগরিদম শেখায় কাকে মানুষ হিসেবে স্মরণ রাখতে হবে, আর কাকে ভুলে যেতে হবে। আজ তাই এই যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে শুধু বুলেট নয়, বর্ণনাও—যে বর্ণনা আমাদের চোখে দেখায় ‘ঘৃণা’, অথচ মুছে দেয় ‘সহানুভূতি’। এই হল অ্যালগরিদমের যুদ্ধ—যেখানে তথ্য নয়, মানবতার দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হচ্ছে কোডের ভাষায়।

[লেখক: আইনজীবী]

back to top