রাজিব শর্মা
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভান্ডারি পীরের আধ্যাত্মিকার ধারার অনুসারীদের গাওয়া মরমি গানগুলো চট্টগ্রামের প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো। এ ধারার প্রবর্তক সৈয়দ আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী। আজ পর্যন্ত শতাধিক ভক্ত কবি হাজারের ও বেশি গান রচনা করেছেন। আর এই মাইজভান্ডারি গানের এক অন্যরকম মাত্রা যোগ করে এখনও জনপ্রিয় রমেশ শীলের মরমি দরদি গানগুলো। এবং এর চেয়ে বড় কথা এই কবি রমেশ শীল একজন প্রতিবাদী স্বাধীনচেতা কবি ও বটে।
কবিগানের অন্যতম রূপকার। কবিগানের লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক সমাজ সচেতনতার সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন মাইজভান্ডারী গানের কিংবদন্তি সাধক। জনপ্রিয় এই শিল্পী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে এবং সেই সঙ্গে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন পরবর্তী নুরুল আমিন বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন।
জন্ম ও শৈশব : কবিয়াল রমেশ শীল ১৮৭৭ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের বোয়ালখালী থানার অন্তর্গত গোমদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম চন্ডীচরণ শীল। চন্ডীচরণ শীল ছিলেন পেশাতে শীল সম্প্রদায়ের জাতীয় পেশা ও কবিরাজ। কবিয়াল রমেশ শীলের স্কুলজীবন ৪র্থ শ্রেণীতে অধ্যায়নকালে পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ও পরিবারের সকল দায়িত্ব এসে পড়ে কবির কাঁধে। তার নিজের লেখনীতে রয়েছে,
“আমিই বালক, চালক, পালক, আমার আর কেহ/নাই। মায়ের অলংকার সম্বল আমারা বিক্রি/ করে খাই”।
কবির দেশাত্মবোধ ছিল সুগভীর-‘বাংলার জন্য জীবন গেলে হব স্বর্গবাসি/ আমার বাংলার দাবি ঠিক থাকিবে যদিও হয় ফাঁসি’। সংগ্রামী জীবন ও কারাভোগ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত কবিয়াল রমেশ শীল সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তার গণসংগীত দেশের মানুষদের এই সব সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯৫৪ সালে জণগণের ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং নুরুল আমিনকে পূর্ববাংলার গভর্নর বানানো হয়। এই নুরুল আমীন চট্টগ্রামে এলে জনগণের কাছে লাঞ্ছিত হন। এই নিয়ে তিনি বিখ্যাত একটি ব্যাঙ্গাত্মক গান রচনা করেন। গানটি হচ্ছে,
“শোন ভাই আজগুবি খবর/মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন করে চট্টগ্রাম সফর/দিনের তিনটা বেজে গেল পল্টনে/সভা বসিল/ হায় কি দেখিলাম কি ঘটিল/মানুষ ভয়ে জড়সড়/হঠাৎ দেখি পচা আন্ডা/মন্ত্রীকে করিতেছে ঠান্ডা/উড়তে লাগলো কাল ঝান্ডা/ মন্ত্রীর চোখের উপর/বিপ্লবী চট্টগ্রাম গেলা সূর্যসেনের/প্রধান কেল্লা/মন্ত্রী করে তৌব্বা তিল্লা/করবো না জনমভরে চট্টগ্রাম শহর।”
এই গানটি এত জনপ্রিয় পেয়েছিল যে তা সাড়াদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই জন্য তাকে কারাগারে নেয়া হয়। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন। এই সময় তার বয়স হয়েছিল সত্তর বছর এবং তাকে প্রচুর মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। সেই সময় তাকে অঢেল বিত্তবৈভবের লোভ দেখিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত লেখার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই পাকিস্তানিদের প্রলোভনের জবাব দিয়েছিলেন তিনি নিচের কবিতা দিয়ে, “আমার খুনে যারা করেছে মিনার/রক্তমাংস খেয়ে করেছে কঙ্কালসার/আজ সেই সময় নাই ত্বরা ছুটে আসো ভাই/বেদনা প্রতিকারের সময় এসেছে।”
জীবদ্দশায় অর্জন করেন কিংবদন্তির খ্যাতি। এই জীবন দুঃখী কবি ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন অনেক দেরিতে ২০০২ সালে তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন এবং কষ্টের ব্যাপার হলো এই প্রতিবাদী, মরমি গানের স্রষ্টাকে নিয়ে আমাদের মতো নতুন প্রজন্মদের ভাবার সময় নেই।
[লেখক : সংবাদকর্মী]
রাজিব শর্মা
শনিবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২২
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভান্ডারি পীরের আধ্যাত্মিকার ধারার অনুসারীদের গাওয়া মরমি গানগুলো চট্টগ্রামের প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো। এ ধারার প্রবর্তক সৈয়দ আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী। আজ পর্যন্ত শতাধিক ভক্ত কবি হাজারের ও বেশি গান রচনা করেছেন। আর এই মাইজভান্ডারি গানের এক অন্যরকম মাত্রা যোগ করে এখনও জনপ্রিয় রমেশ শীলের মরমি দরদি গানগুলো। এবং এর চেয়ে বড় কথা এই কবি রমেশ শীল একজন প্রতিবাদী স্বাধীনচেতা কবি ও বটে।
কবিগানের অন্যতম রূপকার। কবিগানের লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক সমাজ সচেতনতার সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন মাইজভান্ডারী গানের কিংবদন্তি সাধক। জনপ্রিয় এই শিল্পী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে এবং সেই সঙ্গে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন পরবর্তী নুরুল আমিন বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন।
জন্ম ও শৈশব : কবিয়াল রমেশ শীল ১৮৭৭ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের বোয়ালখালী থানার অন্তর্গত গোমদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম চন্ডীচরণ শীল। চন্ডীচরণ শীল ছিলেন পেশাতে শীল সম্প্রদায়ের জাতীয় পেশা ও কবিরাজ। কবিয়াল রমেশ শীলের স্কুলজীবন ৪র্থ শ্রেণীতে অধ্যায়নকালে পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ও পরিবারের সকল দায়িত্ব এসে পড়ে কবির কাঁধে। তার নিজের লেখনীতে রয়েছে,
“আমিই বালক, চালক, পালক, আমার আর কেহ/নাই। মায়ের অলংকার সম্বল আমারা বিক্রি/ করে খাই”।
কবির দেশাত্মবোধ ছিল সুগভীর-‘বাংলার জন্য জীবন গেলে হব স্বর্গবাসি/ আমার বাংলার দাবি ঠিক থাকিবে যদিও হয় ফাঁসি’। সংগ্রামী জীবন ও কারাভোগ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত কবিয়াল রমেশ শীল সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তার গণসংগীত দেশের মানুষদের এই সব সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯৫৪ সালে জণগণের ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং নুরুল আমিনকে পূর্ববাংলার গভর্নর বানানো হয়। এই নুরুল আমীন চট্টগ্রামে এলে জনগণের কাছে লাঞ্ছিত হন। এই নিয়ে তিনি বিখ্যাত একটি ব্যাঙ্গাত্মক গান রচনা করেন। গানটি হচ্ছে,
“শোন ভাই আজগুবি খবর/মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন করে চট্টগ্রাম সফর/দিনের তিনটা বেজে গেল পল্টনে/সভা বসিল/ হায় কি দেখিলাম কি ঘটিল/মানুষ ভয়ে জড়সড়/হঠাৎ দেখি পচা আন্ডা/মন্ত্রীকে করিতেছে ঠান্ডা/উড়তে লাগলো কাল ঝান্ডা/ মন্ত্রীর চোখের উপর/বিপ্লবী চট্টগ্রাম গেলা সূর্যসেনের/প্রধান কেল্লা/মন্ত্রী করে তৌব্বা তিল্লা/করবো না জনমভরে চট্টগ্রাম শহর।”
এই গানটি এত জনপ্রিয় পেয়েছিল যে তা সাড়াদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই জন্য তাকে কারাগারে নেয়া হয়। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন। এই সময় তার বয়স হয়েছিল সত্তর বছর এবং তাকে প্রচুর মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। সেই সময় তাকে অঢেল বিত্তবৈভবের লোভ দেখিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত লেখার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই পাকিস্তানিদের প্রলোভনের জবাব দিয়েছিলেন তিনি নিচের কবিতা দিয়ে, “আমার খুনে যারা করেছে মিনার/রক্তমাংস খেয়ে করেছে কঙ্কালসার/আজ সেই সময় নাই ত্বরা ছুটে আসো ভাই/বেদনা প্রতিকারের সময় এসেছে।”
জীবদ্দশায় অর্জন করেন কিংবদন্তির খ্যাতি। এই জীবন দুঃখী কবি ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন অনেক দেরিতে ২০০২ সালে তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন এবং কষ্টের ব্যাপার হলো এই প্রতিবাদী, মরমি গানের স্রষ্টাকে নিয়ে আমাদের মতো নতুন প্রজন্মদের ভাবার সময় নেই।
[লেখক : সংবাদকর্মী]