alt

opinion » post-editorial

‘সুশীল সমাজ’

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: বুধবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২

সোসাইটি শব্দের অর্থ সমাজ। আর সমাজ বলতে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে “একধিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের মানুষ কিছু নিয়মকানুন বা প্রথা তৈরি করে (এ নিয়মকানুন বা প্রথা লিখিত নাও হতে পারে) একত্রে বসবাস করে।’ সমাজিক নিয়মকানুন মানুষ মানে- এটা সমাজের জন্য সুখকর। তাছাড়া সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করার জন্য অবশ্যই নিয়মের প্রয়োজন রয়েছে। সব সময় সব নিয়ম ভালো তা-ও বলা যায় না। কারণ এই সামাজিক নিয়মের মধ্যেই অন্তর্নিহিত থাকে কুসংস্কারের বিষয়গুলো। শত বছর আগেও বাংলা জনপদের মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করত। সেই সময় সামাজিক প্রথাগুলো মানুষ আজকের দিনের চেয়ে বেশি মান্য করতেন। ওই সময়ের সব নিয়মই যে জনহিতকর ছিল, তা বলা যাবে না। জমিদার বা জোতদারদের পক্ষে কিছু সমাজিক নিয়ম তৈরি করা হতো। এ রকম তৈরি করা নিয়মের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ধনী জোতদাররা শোষণ এবং নিপীড়িন করতে পারত। নারীর প্রতিও তারা কিছু বিধিনিষেধ তৈরি করেছিল, যার প্রেক্ষিতে তখনকার সময়ে নারীরা হয়ে গিয়েছিল এক অর্থে দাসী এবং প্রমোদ উপকরণ। এ সামাজিক নিয়ম বা প্রথাগুলো তৈরি করতেন ওই সময়কার সমাজের কথিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এরাই সেই সময় বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন সমাজে।

সুশীল সমাজটা আসলে কি? এর একটা অর্থটা করা যেতে পারে যে, সমাজের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি জগতের যারা দিকপাল, যারা সমাজ সম্পর্কে সচেতন এবং প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা করেন। তাছাড়া এরা সমাজের মানুষকে সচেতন করতে তাদের চিন্তা-ভাবনাটাও ব্যক্ত করে। তাদের ব্যাক্ত করা চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে বিশেষ জনমত গড়ে উঠে। আর এ জনমতের মাধ্যমে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়। সমাজের ইতিবাচক জনহিতকর পরির্বতনকারীর কারিগর হিসাবে তাদের বলা হয় বুদ্ধিজীবী বা intellectual class।

ফরাসি ‘আঁতেল’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে বুদ্ধিজীবী শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে যাদের এই গোত্রভুক্ত বলে অভিহিত করা হচ্ছে তাদের কর্তৃক আসলে কি সামাজিক কোন ইতিবাচক পরির্বতন সাধিত হয়েছে? বাংলাদেশে তথা বিশ্বের অনেক দেশেই দেখা যায়, কিছু মানুষকে সুশীল ও সিভিল সোসাইটি হিসেবে অভিহিত করা হয়। সুশীল এবং সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বিশেষ প্রিভিলাইজ পেয়ে থাকেন। এই প্রিভিলাইজ পাওয়াটা কতটা সাংবিধানিক মতে যুক্তিযুক্ত।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে দেশের প্রতিটি নাগরিকই সমান। তবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বিশেষ ক্ষমতাধিকারী হন। এই ক্ষমতাটা তাদের জনসাধারণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রদান করে। আইনানুসারে জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্রের বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারেন। তাহলে সুশীল বা সিভিল সোসাইটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কি করে ১৭ কোটি মানুষের পক্ষে নিজের মতামতটির প্রতিফলন ঘটাতে চান? জনগণ কি তাদের এ ম্যান্ডেট দিয়েছে? জনগণ সুশীলদের এই ম্যান্ডেট দেয় নাই।

কিন্তু আমরা প্রায়শই দেখি যে, দেশের বিশিষ্ট ১০১ জন বা এ রকম কতিপয় কথিত বিশিষ্ট ব্যক্তি বিবৃতি দেন রাষ্ট্রের কোন কোন বিষয়ে। সাংবিধানিকভাবে কি রাষ্ট্রের নাগরিকদের এমন কোন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে, যার ফলে দেশের কতিপয় মানুষকে ‘বিশিষ্ট’ বা ‘সুশীল নাগরিক’ বলা যায়? সাংবিধানিকভাবে কি সেই ব্যখ্যা আছে যে, কিছু নাগরিক বিশিষ্ট হবেন আর বাকিরা অশিষ্ট ও সাধারণ নাগরিক। যদি সাংবিধানিকভাবে এ রকম নিয়ম নাই থাকে তাহলে কেন তাদের বিশিষ্ট নাগরিক বলে অভিহিত করা হয়? বিশিষ্ট বলাটা সংবিধান লঙ্ঘন করার শামিল নয় কি? কিন্তু দেখা যায়, বিশিষ্ট বলে আখ্যা দেয়ার পরও কাউকে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় না। অথচ আমরা দেখতে পাই মুক্তভাবে মত প্রকাশের দায়ে অনেক মানুষকে জেল খাটতে হচ্ছে। এই মুক্তমত প্রকাশকারীদের আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করেই জেলা পাঠান আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

সাংবিধানিকভাবে কি রাষ্ট্রের নাগরিকদের এমন কোন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে, যার ফলে দেশের কতিপয় মানুষকে ‘বিশিষ্ট’ বা ‘সুশীল নাগরিক’ বলা যায়?

বর্তমানে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং এই কমিশনের সদস্য নির্বাচনের জন্য গঠিত সার্চ কমিটির স্বচ্ছতার বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। আর এ আলোচনায় রাতের পর রাত টক শোতে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন সুশীল আখ্যা পাওয়া ব্যক্তিরা। কথিত সিভিল সোসাইটির একজনকে দেথা যায়, স্বচ্ছতা নিয়ে তিনি গণমাধ্যমে সরব। তিনি একটি নাগরিক সংগঠনের সম্পাদক (এনজিও বলা যায়)। গত ৩০ বছর ধরে তিনি ওই সংগঠনের এ পদে বহাল আছেন। যদি তার সংস্থায় সুশাসন অনুশীলন হতো, তাহলে সেখানে তার বিকল্প নেতা গড়ে উঠতো নিশ্চয়ই। আর স্বচ্ছভাবে সংস্থাটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি কি এতদিন একই পদে বহাল থাকতেও পারতেন? না। এ রকম মানুষগুলো যখন দেশের গণতন্ত্র চর্চা এবং অনান্য বিষয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে কথা বলেন তা কতটা যৌক্তিক হয়? এই বিষয়টিও তাদের ভাবা উচিত যারা গণমাধ্যমে ওই ব্যক্তিটির মতামাতটা মুখ্য করে প্রচার করেন। যিনি নিজের সংগঠনটির অভ্যান্তরে সুশাসন ও গণতন্ত্র চর্চা করেন না, সেই ব্যক্তিটির কি রাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা বলা মানায়?

টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে টক শোতে অংশ নেয়া, বা বিভিন্ন গণমাধ্যমে নাম প্রকাশিত ব্যক্তিরা কি সিভিল সোসাইটি? এর একটি সঙ্গা থাকা উচিত। কিছুদিন আগে সাহেদ নামে এক ব্যক্তি নানা কুকর্মের জন্য গ্রেপ্তার হন। তিনিও ছিলেন টিভি চ্যানেলের টক শো ব্যক্তিত্ব, তাকেও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হতো এক সময়। যদি তার কুকর্ম ধরা না পড়ত, তাহলে তো সাহেদও আজকের দিনে নির্বাচন কমিশন গঠনের স্বচ্ছতা নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো মাতিয়ে রাখতেন।

সাহেদের মতো অসংখ্য ব্যক্তি আজও সিভিল সোসাইটির ব্যক্তিত্ব হিসাবে সমাজে বিচরন করছেন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেই কি তিনি সুশীল? দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্য বলেছিলেন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চায় না। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে, এই মেয়েরা রাতে বাইরে আড্ডা দেয়। একটি অশ্লীল ইঙ্গিত বহন করেছিল তার বক্তব্যে। তারপর তিনি তার এ ধরনের বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চান। এ ধরনের কান্ডজ্ঞানহীন, নীতিবর্জিত মানুষরাই কি সুশীল? দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ভিসি এমন কিছু কুকর্ম এবং নীতিগর্হিত আর্থিক কেলেংকারি করেছেন যে যা দেশের কুখ্যাত গুন্ডাপান্ডাদের আর্থিক ও অনৈতিক কাজকেও হার মানায়। কান্ডজ্ঞানবর্জিত বক্তব্য দেয়া ও কুকর্মের সঙ্গে জড়িতদের সুশীল বা বুদ্ধিজীবী হিসাবে আখ্যা দেয়াটা কতটা যৌক্তিক হচ্ছে? এ ধরনের সুশীলরা কি সমাজের ইতিবাচক পরির্বতন করতে পারবে বা করেছে?

দেশের গণমাধ্যমগুলোতে বুদ্ধিজীবী হিসেবে যাদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের একটি অনুসন্ধান করা উচিত। গণমাধ্যমে নিজেকে প্রদর্শন করে এরা সমাজে একটি ভিত স্থাপন করে। তারপর আমি অমুক বলে নাম ভাঙিয়ে সরকারি (টেন্ডার, নিয়োগসহ নানা ধরনের) সুবিধা হাতিয়ে নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এদেরই দেখা যায়, রাষ্ট্র তথা সমাজ বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। ফলে সমাজ থেকে দুর্নীতি বা অনিয়ম দূর হয় না।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

পাট চাষের সংকট ও সম্ভাবনা

সামাজিক-প্রযুক্তিগত কল্পনা: বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তার নতুন দিগন্ত

অগ্রক্রয় মোকদ্দমায় উভয় পক্ষের আইনি ডিফেন্স

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

এক সাংবাদিকের খোলা চিঠি

বাংলাদেশের দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

ক্লাউডবার্স্ট: মৃত্যুর বার্তা নিয়ে, আকাশ যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে

রম্যগদ্য:“কবি এখন জেলে...”

কারা কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা ও ‘কারেকশন সার্ভিস’-এর বাস্তবতা

ছবি

বাংলাদেশের শহর পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ছবি

‘আজ ফির তুমপে পেয়ার আয়া হ্যায়’

স্বপ্নের দক্ষিণ কোরিয়া; বাংলাদেশে আন্দোলন, ভিয়েতনামের সাফল্য

ডাকসু নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতি

ঢাকা শহরের উষ্ণতা: সবুজ হারানোর মূল্য

তিন বাহিনী প্রধানদের আশা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা

গনমাধ্যম জগতও নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে!

মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা: জাপান এক অনুসরণীয় আদর্শ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন ট্র্যাজেডি

হোক সবুজ বিপ্লব

tab

opinion » post-editorial

‘সুশীল সমাজ’

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

বুধবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২

সোসাইটি শব্দের অর্থ সমাজ। আর সমাজ বলতে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে “একধিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের মানুষ কিছু নিয়মকানুন বা প্রথা তৈরি করে (এ নিয়মকানুন বা প্রথা লিখিত নাও হতে পারে) একত্রে বসবাস করে।’ সমাজিক নিয়মকানুন মানুষ মানে- এটা সমাজের জন্য সুখকর। তাছাড়া সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করার জন্য অবশ্যই নিয়মের প্রয়োজন রয়েছে। সব সময় সব নিয়ম ভালো তা-ও বলা যায় না। কারণ এই সামাজিক নিয়মের মধ্যেই অন্তর্নিহিত থাকে কুসংস্কারের বিষয়গুলো। শত বছর আগেও বাংলা জনপদের মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করত। সেই সময় সামাজিক প্রথাগুলো মানুষ আজকের দিনের চেয়ে বেশি মান্য করতেন। ওই সময়ের সব নিয়মই যে জনহিতকর ছিল, তা বলা যাবে না। জমিদার বা জোতদারদের পক্ষে কিছু সমাজিক নিয়ম তৈরি করা হতো। এ রকম তৈরি করা নিয়মের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ধনী জোতদাররা শোষণ এবং নিপীড়িন করতে পারত। নারীর প্রতিও তারা কিছু বিধিনিষেধ তৈরি করেছিল, যার প্রেক্ষিতে তখনকার সময়ে নারীরা হয়ে গিয়েছিল এক অর্থে দাসী এবং প্রমোদ উপকরণ। এ সামাজিক নিয়ম বা প্রথাগুলো তৈরি করতেন ওই সময়কার সমাজের কথিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এরাই সেই সময় বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন সমাজে।

সুশীল সমাজটা আসলে কি? এর একটা অর্থটা করা যেতে পারে যে, সমাজের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি জগতের যারা দিকপাল, যারা সমাজ সম্পর্কে সচেতন এবং প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা করেন। তাছাড়া এরা সমাজের মানুষকে সচেতন করতে তাদের চিন্তা-ভাবনাটাও ব্যক্ত করে। তাদের ব্যাক্ত করা চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে বিশেষ জনমত গড়ে উঠে। আর এ জনমতের মাধ্যমে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়। সমাজের ইতিবাচক জনহিতকর পরির্বতনকারীর কারিগর হিসাবে তাদের বলা হয় বুদ্ধিজীবী বা intellectual class।

ফরাসি ‘আঁতেল’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে বুদ্ধিজীবী শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে যাদের এই গোত্রভুক্ত বলে অভিহিত করা হচ্ছে তাদের কর্তৃক আসলে কি সামাজিক কোন ইতিবাচক পরির্বতন সাধিত হয়েছে? বাংলাদেশে তথা বিশ্বের অনেক দেশেই দেখা যায়, কিছু মানুষকে সুশীল ও সিভিল সোসাইটি হিসেবে অভিহিত করা হয়। সুশীল এবং সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বিশেষ প্রিভিলাইজ পেয়ে থাকেন। এই প্রিভিলাইজ পাওয়াটা কতটা সাংবিধানিক মতে যুক্তিযুক্ত।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে দেশের প্রতিটি নাগরিকই সমান। তবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বিশেষ ক্ষমতাধিকারী হন। এই ক্ষমতাটা তাদের জনসাধারণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রদান করে। আইনানুসারে জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্রের বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারেন। তাহলে সুশীল বা সিভিল সোসাইটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কি করে ১৭ কোটি মানুষের পক্ষে নিজের মতামতটির প্রতিফলন ঘটাতে চান? জনগণ কি তাদের এ ম্যান্ডেট দিয়েছে? জনগণ সুশীলদের এই ম্যান্ডেট দেয় নাই।

কিন্তু আমরা প্রায়শই দেখি যে, দেশের বিশিষ্ট ১০১ জন বা এ রকম কতিপয় কথিত বিশিষ্ট ব্যক্তি বিবৃতি দেন রাষ্ট্রের কোন কোন বিষয়ে। সাংবিধানিকভাবে কি রাষ্ট্রের নাগরিকদের এমন কোন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে, যার ফলে দেশের কতিপয় মানুষকে ‘বিশিষ্ট’ বা ‘সুশীল নাগরিক’ বলা যায়? সাংবিধানিকভাবে কি সেই ব্যখ্যা আছে যে, কিছু নাগরিক বিশিষ্ট হবেন আর বাকিরা অশিষ্ট ও সাধারণ নাগরিক। যদি সাংবিধানিকভাবে এ রকম নিয়ম নাই থাকে তাহলে কেন তাদের বিশিষ্ট নাগরিক বলে অভিহিত করা হয়? বিশিষ্ট বলাটা সংবিধান লঙ্ঘন করার শামিল নয় কি? কিন্তু দেখা যায়, বিশিষ্ট বলে আখ্যা দেয়ার পরও কাউকে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় না। অথচ আমরা দেখতে পাই মুক্তভাবে মত প্রকাশের দায়ে অনেক মানুষকে জেল খাটতে হচ্ছে। এই মুক্তমত প্রকাশকারীদের আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করেই জেলা পাঠান আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

সাংবিধানিকভাবে কি রাষ্ট্রের নাগরিকদের এমন কোন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে, যার ফলে দেশের কতিপয় মানুষকে ‘বিশিষ্ট’ বা ‘সুশীল নাগরিক’ বলা যায়?

বর্তমানে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং এই কমিশনের সদস্য নির্বাচনের জন্য গঠিত সার্চ কমিটির স্বচ্ছতার বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। আর এ আলোচনায় রাতের পর রাত টক শোতে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন সুশীল আখ্যা পাওয়া ব্যক্তিরা। কথিত সিভিল সোসাইটির একজনকে দেথা যায়, স্বচ্ছতা নিয়ে তিনি গণমাধ্যমে সরব। তিনি একটি নাগরিক সংগঠনের সম্পাদক (এনজিও বলা যায়)। গত ৩০ বছর ধরে তিনি ওই সংগঠনের এ পদে বহাল আছেন। যদি তার সংস্থায় সুশাসন অনুশীলন হতো, তাহলে সেখানে তার বিকল্প নেতা গড়ে উঠতো নিশ্চয়ই। আর স্বচ্ছভাবে সংস্থাটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি কি এতদিন একই পদে বহাল থাকতেও পারতেন? না। এ রকম মানুষগুলো যখন দেশের গণতন্ত্র চর্চা এবং অনান্য বিষয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে কথা বলেন তা কতটা যৌক্তিক হয়? এই বিষয়টিও তাদের ভাবা উচিত যারা গণমাধ্যমে ওই ব্যক্তিটির মতামাতটা মুখ্য করে প্রচার করেন। যিনি নিজের সংগঠনটির অভ্যান্তরে সুশাসন ও গণতন্ত্র চর্চা করেন না, সেই ব্যক্তিটির কি রাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা বলা মানায়?

টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে টক শোতে অংশ নেয়া, বা বিভিন্ন গণমাধ্যমে নাম প্রকাশিত ব্যক্তিরা কি সিভিল সোসাইটি? এর একটি সঙ্গা থাকা উচিত। কিছুদিন আগে সাহেদ নামে এক ব্যক্তি নানা কুকর্মের জন্য গ্রেপ্তার হন। তিনিও ছিলেন টিভি চ্যানেলের টক শো ব্যক্তিত্ব, তাকেও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হতো এক সময়। যদি তার কুকর্ম ধরা না পড়ত, তাহলে তো সাহেদও আজকের দিনে নির্বাচন কমিশন গঠনের স্বচ্ছতা নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো মাতিয়ে রাখতেন।

সাহেদের মতো অসংখ্য ব্যক্তি আজও সিভিল সোসাইটির ব্যক্তিত্ব হিসাবে সমাজে বিচরন করছেন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেই কি তিনি সুশীল? দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্য বলেছিলেন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চায় না। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে, এই মেয়েরা রাতে বাইরে আড্ডা দেয়। একটি অশ্লীল ইঙ্গিত বহন করেছিল তার বক্তব্যে। তারপর তিনি তার এ ধরনের বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চান। এ ধরনের কান্ডজ্ঞানহীন, নীতিবর্জিত মানুষরাই কি সুশীল? দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ভিসি এমন কিছু কুকর্ম এবং নীতিগর্হিত আর্থিক কেলেংকারি করেছেন যে যা দেশের কুখ্যাত গুন্ডাপান্ডাদের আর্থিক ও অনৈতিক কাজকেও হার মানায়। কান্ডজ্ঞানবর্জিত বক্তব্য দেয়া ও কুকর্মের সঙ্গে জড়িতদের সুশীল বা বুদ্ধিজীবী হিসাবে আখ্যা দেয়াটা কতটা যৌক্তিক হচ্ছে? এ ধরনের সুশীলরা কি সমাজের ইতিবাচক পরির্বতন করতে পারবে বা করেছে?

দেশের গণমাধ্যমগুলোতে বুদ্ধিজীবী হিসেবে যাদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের একটি অনুসন্ধান করা উচিত। গণমাধ্যমে নিজেকে প্রদর্শন করে এরা সমাজে একটি ভিত স্থাপন করে। তারপর আমি অমুক বলে নাম ভাঙিয়ে সরকারি (টেন্ডার, নিয়োগসহ নানা ধরনের) সুবিধা হাতিয়ে নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এদেরই দেখা যায়, রাষ্ট্র তথা সমাজ বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। ফলে সমাজ থেকে দুর্নীতি বা অনিয়ম দূর হয় না।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top