alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসীদের প্রতি সুনজর দিন

মিথুশিলাক মুরমু

: শুক্রবার, ০৬ মে ২০২২

পাহাড় থেকে সমতল কিংবা চা-বাগান থেকে দক্ষিণের সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত কোথাও কোনো জায়গার আদিবাসীরা শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ও ক্ষমতাবানরা আদিবাসীদের জায়গা-জমি, শশ্মান-কবরস্থান, বসতভিটা দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। আদিবাসীদের ভূমিহীনে পরিণত করার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে একসময় নিজ থেকেই তারা নিরাপদ স্থানের খোঁজে স্থানান্তর হতে বাধ্য হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নীতি-নৈতিকতা রয়েছে এবং সেটির ব্যতয় ঘটলে অবশ্যই দলীয়ভাবে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দোষে দুষ্ট হবেন। আদিবাসীদের কখনো ডানপন্থি, বামপন্থি, গণতন্ত্রপন্থি হিসেবে আখ্যা দিয়ে সর্বশ্রেণীর রাজনীতিবিদদের দ্বারা আক্রান্তের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কালেভাদ্রে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে তড়িত গতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দলের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল রাখার দৃষ্টান্ত আমাদের একটু হলেও স্বস্তি দিয়ে থাকে। পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর আদিবাসীদের জন্মভূমিতে সুরক্ষা ও অধিকার নিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি প্রয়োজন।

বান্দরবান লামার আদিবাসী এক বাসিন্দা হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, আদিবাসীদের জুমের ফসল চিহ্নিত লোকজন পুড়িয়ে দিয়েছে। তার কণ্ঠে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, হরিণের ডেরায় বাঘ হাজির হয়েছে। এতদিন শান্তিপূর্ণভাবে যে জীবনাচরণে তারা অভ্যস্ত ও যুগের পর যুগের যে রেওয়াজ ও রীতিনীতি তারা মানছে, সেখানে হঠাৎ করেই কোম্পানির উপস্থিতিতে তা বিঘ্নিত হচ্ছে। লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় ৩৯টি ম্রো ও ত্রিপুরা পরিবার প্রায় ৪০০ একর বনাঞ্চলে বংশ পরম্পরায় জুমচাষ করে আসছে। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানি রাবার চাষের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তত করতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কেটে উজাড় করে ও আগুনে জালিয়ে দেয়। ম্রো ও ত্রিপুরাদের বসতবাড়ি ও জুমের ফসল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিলুপ্ত প্রায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী ম্রো’রা গহীন বনাঞ্চলেই নিজেদের মানিয়ে নিয়ে থাকে, সেখানেও শহরের কথিত সভ্য নাগরিকদের হস্তক্ষেপ। আমাদের বিবেক যেন অসাড় হয়ে গেছে। পার্বত্য এলাকায় একের পর এক জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নানা ধরনের সহিংস তৎপরতা এবং ভূমি দখলের ঘটনা ঘটে চলেছে। পাহাড়ি আদিবাসীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার।

সম্প্রতিকালে সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী সময়ে বসবাসকারী উরাঁও আদিবাসীদের বসত জায়গা থেকে ভূমিদস্যুরা মাটি সরিয়ে তাদের জীবনযাত্রাকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে। তারা কয়েক দফা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বাঁচার আকুতি জানিয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের সুদৃষ্টি ক্ষমতাবানদের দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে। ঠাকুরগাঁও-এ ২৩ এপ্রিল পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মো. বাবুলের বিরুদ্ধে আদিবাসী সাঁওতাল ও উরাঁও’রা মিছিল ও মানববন্ধন করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নানা ধরনের কলাকৌশল, কারসাজি করে জমি জবরদখলের হীনচেষ্টা করেন। মানববন্ধনের দিনেও সাবেক কাউন্সিলর মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে উদ্যত হয়েছিলেন। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির লক্ষ্যে গুজব ছড়ান- আদিবাসীরা মসজিদে মুসল্লিদের ওপর হামলা করেছে! এ নিয়ে শহরের মন্দিরপাড়ার আদিবাসী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মারমুখি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সচেতন ব্যক্তিদের প্রচেষ্টা ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে কাউন্সিলর মো. বাবুলকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়। ১৭ এপ্রিল নওগাঁর পোরশার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের মুরলিয়া পাহাড়িয়া আদিবাসী গ্রামকে চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা রাতের আধারে আগুনে জ¦ালিয়ে দেয়। মুরলিয়া গ্রামে অন্যতম জাতিগত সংখ্যালঘু পাহাড়িয়ার প্রায় ৬০/৬২ পরিবার স্মরণাতীতকাল থেকেই বসবাস করে আসছে। গ্রাম ও পুকুরসহ আদিবাসীদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ মোট ৩৯ বিঘা, এটির মধ্যে ১৮ বিঘা বসতভিটা, পুকুর ও শশ্মান রয়েছে। বিগত বছরও এই সম্পত্তিকে নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় শশ্মান ও পুকুরসংলগ্ন জমি দখলের প্রচেষ্টা চালালে সংঘর্ষ হয় এবং মিনু পাহাড়িয়া নামে এক আদিবাসী নিহত হন। মনিল পাহাড়িয়া ছেলে মদন পাহাড়িয়ার বাড়িটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে, অন্যদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কিছুটা রক্ষা পেয়েছে।

রাজশাহী গোদাগাড়ীর বসন্তপুরে আদিবাসীদের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। ২৬ বছর ধরে ২৪ কাঠা জমি দখল করে আসছিল স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা জালাল উদ্দিন ও তার তিন ছেলে শহিদুল, মাহাবুবুর রহমান, তাহাবুর রহমান। জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউপির ৩নং ওয়ার্ডে বসন্তপুর গ্রামে বাঁশঝাড় ও ভিটা মিলে ২৪ কাঠা জমি ওয়ারিস সূত্রে দুই ভাই জোহরলাল পান্না ও মোহরলাল পান্না মালিক হয়েছেন। দুই সহদরের বাবা গোহানু সরদার নাকি জালাল উদ্দিনের কাছে জমিটি হস্তান্তর করেছিলেন। দুই সহদর জমির ফেরত পেতে চাইলে নানাভাবে তাদের হুমকি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করেছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন দুই পক্ষকে জমির কাগজপত্র সমেত থানায় হাজির হতে বললে, জালাল উদ্দিন কোন কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। গোদাগাড়ী থানার ওসি কামরুল ইসলাম জানান, ‘জমিটির প্রকৃত মালিক গাহানু সরকারের ছেলে জোহরলাল পান্ন এবং মোহরলাল পান্না।

আরেকটি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী তানোর থানার মালশিরা গ্রামে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নাগরিক দেবেন মুরমু’র পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিটি রাজনৈতিক পেশীশক্তির প্রতীক ভূমিদস্যু হামিদুর রহমান দাবি করে আসছে নিজের সম্পত্তি বলে। অখ্যাত অঞ্চল ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর দেবেন মুরমুকে উচ্ছেদ করণার্থে ৩০/৪০ জনের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সাড়াশি আক্রমণ চালায়। ২৩ অক্টোবর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সন্ত্রাসী হামিদুর রাতের অন্ধকারে দেবেন মুরমুর ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও হত্যার চেষ্টাও করে। ইতিপূর্বে অন্যান্য আদিবাসীর ঘরবাড়ি বাইরে থেকে তালা মেরে আটকে রাখা হয়েছিল। জানা মতে, আজ পর্যন্ত চিহ্নিত হামিদুর বীরদর্পে খোলা আকাশের নিচে বিচরণ করে চলেছে।

প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই আদিবাসীদের জায়গা-জমি সম্পৃক্ত। আদিবাসীদের অজ্ঞানতা, সরলতা, পিছিয়ে পড়ার কারণে সম্পত্তি রক্ষার আইনকানুন সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নন। অন্যদিকে শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র এবং শহুরে বাবুদের লোলুপ দৃষ্টি ওই দুর্বলদের সহায় সম্পত্তিতেই। স্রষ্টা আমাদের দিয়েছেন বিবেক, আর বিবেকই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আদালত। দুর্বলদের বিপদে সহযোগিতা না করা, পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের ভূমিহীন করা, উচ্ছেদ বা দেশত্যাগে বাধ্য করার প্রচেষ্টা একধরনের নৈতিক অবক্ষয়। মানুষের, সমাজের, দেশের নৈতিক অবক্ষয় বিশৃঙ্খলা ও ঈশ্বরীয় অভিশাপ নেমে আসে।

সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আদিবাসীদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হোন। অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করুন, অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত গাছ, ডাল-পালাকে ছেঁটে ফেলুন। ঈশ্বর ন্যায়বানদের সঙ্গেই অবস্থিতি করেন।

[লেখক : কলামিস্ট]

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

রম্যগদ্য: শিক্ষা সহজ, বিদ্যা কঠিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসীদের প্রতি সুনজর দিন

মিথুশিলাক মুরমু

শুক্রবার, ০৬ মে ২০২২

পাহাড় থেকে সমতল কিংবা চা-বাগান থেকে দক্ষিণের সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত কোথাও কোনো জায়গার আদিবাসীরা শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ও ক্ষমতাবানরা আদিবাসীদের জায়গা-জমি, শশ্মান-কবরস্থান, বসতভিটা দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। আদিবাসীদের ভূমিহীনে পরিণত করার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে একসময় নিজ থেকেই তারা নিরাপদ স্থানের খোঁজে স্থানান্তর হতে বাধ্য হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নীতি-নৈতিকতা রয়েছে এবং সেটির ব্যতয় ঘটলে অবশ্যই দলীয়ভাবে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দোষে দুষ্ট হবেন। আদিবাসীদের কখনো ডানপন্থি, বামপন্থি, গণতন্ত্রপন্থি হিসেবে আখ্যা দিয়ে সর্বশ্রেণীর রাজনীতিবিদদের দ্বারা আক্রান্তের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কালেভাদ্রে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে তড়িত গতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দলের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল রাখার দৃষ্টান্ত আমাদের একটু হলেও স্বস্তি দিয়ে থাকে। পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর আদিবাসীদের জন্মভূমিতে সুরক্ষা ও অধিকার নিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি প্রয়োজন।

বান্দরবান লামার আদিবাসী এক বাসিন্দা হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, আদিবাসীদের জুমের ফসল চিহ্নিত লোকজন পুড়িয়ে দিয়েছে। তার কণ্ঠে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, হরিণের ডেরায় বাঘ হাজির হয়েছে। এতদিন শান্তিপূর্ণভাবে যে জীবনাচরণে তারা অভ্যস্ত ও যুগের পর যুগের যে রেওয়াজ ও রীতিনীতি তারা মানছে, সেখানে হঠাৎ করেই কোম্পানির উপস্থিতিতে তা বিঘ্নিত হচ্ছে। লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় ৩৯টি ম্রো ও ত্রিপুরা পরিবার প্রায় ৪০০ একর বনাঞ্চলে বংশ পরম্পরায় জুমচাষ করে আসছে। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানি রাবার চাষের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তত করতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কেটে উজাড় করে ও আগুনে জালিয়ে দেয়। ম্রো ও ত্রিপুরাদের বসতবাড়ি ও জুমের ফসল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিলুপ্ত প্রায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী ম্রো’রা গহীন বনাঞ্চলেই নিজেদের মানিয়ে নিয়ে থাকে, সেখানেও শহরের কথিত সভ্য নাগরিকদের হস্তক্ষেপ। আমাদের বিবেক যেন অসাড় হয়ে গেছে। পার্বত্য এলাকায় একের পর এক জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নানা ধরনের সহিংস তৎপরতা এবং ভূমি দখলের ঘটনা ঘটে চলেছে। পাহাড়ি আদিবাসীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার।

সম্প্রতিকালে সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী সময়ে বসবাসকারী উরাঁও আদিবাসীদের বসত জায়গা থেকে ভূমিদস্যুরা মাটি সরিয়ে তাদের জীবনযাত্রাকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে। তারা কয়েক দফা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বাঁচার আকুতি জানিয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের সুদৃষ্টি ক্ষমতাবানদের দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে। ঠাকুরগাঁও-এ ২৩ এপ্রিল পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মো. বাবুলের বিরুদ্ধে আদিবাসী সাঁওতাল ও উরাঁও’রা মিছিল ও মানববন্ধন করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নানা ধরনের কলাকৌশল, কারসাজি করে জমি জবরদখলের হীনচেষ্টা করেন। মানববন্ধনের দিনেও সাবেক কাউন্সিলর মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে উদ্যত হয়েছিলেন। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির লক্ষ্যে গুজব ছড়ান- আদিবাসীরা মসজিদে মুসল্লিদের ওপর হামলা করেছে! এ নিয়ে শহরের মন্দিরপাড়ার আদিবাসী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মারমুখি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সচেতন ব্যক্তিদের প্রচেষ্টা ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে কাউন্সিলর মো. বাবুলকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়। ১৭ এপ্রিল নওগাঁর পোরশার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের মুরলিয়া পাহাড়িয়া আদিবাসী গ্রামকে চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা রাতের আধারে আগুনে জ¦ালিয়ে দেয়। মুরলিয়া গ্রামে অন্যতম জাতিগত সংখ্যালঘু পাহাড়িয়ার প্রায় ৬০/৬২ পরিবার স্মরণাতীতকাল থেকেই বসবাস করে আসছে। গ্রাম ও পুকুরসহ আদিবাসীদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ মোট ৩৯ বিঘা, এটির মধ্যে ১৮ বিঘা বসতভিটা, পুকুর ও শশ্মান রয়েছে। বিগত বছরও এই সম্পত্তিকে নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় শশ্মান ও পুকুরসংলগ্ন জমি দখলের প্রচেষ্টা চালালে সংঘর্ষ হয় এবং মিনু পাহাড়িয়া নামে এক আদিবাসী নিহত হন। মনিল পাহাড়িয়া ছেলে মদন পাহাড়িয়ার বাড়িটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে, অন্যদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কিছুটা রক্ষা পেয়েছে।

রাজশাহী গোদাগাড়ীর বসন্তপুরে আদিবাসীদের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। ২৬ বছর ধরে ২৪ কাঠা জমি দখল করে আসছিল স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা জালাল উদ্দিন ও তার তিন ছেলে শহিদুল, মাহাবুবুর রহমান, তাহাবুর রহমান। জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউপির ৩নং ওয়ার্ডে বসন্তপুর গ্রামে বাঁশঝাড় ও ভিটা মিলে ২৪ কাঠা জমি ওয়ারিস সূত্রে দুই ভাই জোহরলাল পান্না ও মোহরলাল পান্না মালিক হয়েছেন। দুই সহদরের বাবা গোহানু সরদার নাকি জালাল উদ্দিনের কাছে জমিটি হস্তান্তর করেছিলেন। দুই সহদর জমির ফেরত পেতে চাইলে নানাভাবে তাদের হুমকি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করেছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন দুই পক্ষকে জমির কাগজপত্র সমেত থানায় হাজির হতে বললে, জালাল উদ্দিন কোন কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। গোদাগাড়ী থানার ওসি কামরুল ইসলাম জানান, ‘জমিটির প্রকৃত মালিক গাহানু সরকারের ছেলে জোহরলাল পান্ন এবং মোহরলাল পান্না।

আরেকটি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী তানোর থানার মালশিরা গ্রামে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নাগরিক দেবেন মুরমু’র পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিটি রাজনৈতিক পেশীশক্তির প্রতীক ভূমিদস্যু হামিদুর রহমান দাবি করে আসছে নিজের সম্পত্তি বলে। অখ্যাত অঞ্চল ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর দেবেন মুরমুকে উচ্ছেদ করণার্থে ৩০/৪০ জনের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সাড়াশি আক্রমণ চালায়। ২৩ অক্টোবর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সন্ত্রাসী হামিদুর রাতের অন্ধকারে দেবেন মুরমুর ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও হত্যার চেষ্টাও করে। ইতিপূর্বে অন্যান্য আদিবাসীর ঘরবাড়ি বাইরে থেকে তালা মেরে আটকে রাখা হয়েছিল। জানা মতে, আজ পর্যন্ত চিহ্নিত হামিদুর বীরদর্পে খোলা আকাশের নিচে বিচরণ করে চলেছে।

প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই আদিবাসীদের জায়গা-জমি সম্পৃক্ত। আদিবাসীদের অজ্ঞানতা, সরলতা, পিছিয়ে পড়ার কারণে সম্পত্তি রক্ষার আইনকানুন সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নন। অন্যদিকে শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র এবং শহুরে বাবুদের লোলুপ দৃষ্টি ওই দুর্বলদের সহায় সম্পত্তিতেই। স্রষ্টা আমাদের দিয়েছেন বিবেক, আর বিবেকই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আদালত। দুর্বলদের বিপদে সহযোগিতা না করা, পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের ভূমিহীন করা, উচ্ছেদ বা দেশত্যাগে বাধ্য করার প্রচেষ্টা একধরনের নৈতিক অবক্ষয়। মানুষের, সমাজের, দেশের নৈতিক অবক্ষয় বিশৃঙ্খলা ও ঈশ্বরীয় অভিশাপ নেমে আসে।

সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আদিবাসীদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হোন। অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করুন, অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত গাছ, ডাল-পালাকে ছেঁটে ফেলুন। ঈশ্বর ন্যায়বানদের সঙ্গেই অবস্থিতি করেন।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top