alt

opinion » post-editorial

পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলের রাজনীতি

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ০৬ মে ২০২২

পশ্চিমবঙ্গের ঝিমিয়ে পড়া বিরোধী রাজনীতি বিগত দুই মাসে নতুনভাবে প্রাণের সাড়া পেয়েছে। গত ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর থেকে এখানকার সংবাদমাধ্যম বিরোধী রাজনীতির ব্যাটটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির হাতে দিয়ে দিয়েছিল। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক দশক ধরে শাসন করা তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভটা যাতে কোন অবস্থাতেই বামপন্থিদের দিকে গিয়ে জমা হতে না পারে, সেই জন্যে আরএসএস নিয়ন্ত্রিত গদি মিডিয়া তৃণমূলের সফল বিকল্প হিসেবে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে দেখাতেই সব থেকে বেশি তৎপর ছিল।

এই অবস্থায় ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে আরএসএস তাদের অন্যতম বিশ্বস্ত গোপন বন্ধু তৃণমূলের সঙ্গে যে বোঝাপড়া করেছিল, তার ভিত্তিতে বামশূন্য বিধানসভায় বিজেপির সাফল্য কে তুলে ধরে বামেরা নিঃশেষিত-এই তত্ত্বটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংবাদ মাধ্যমের তৎপরতাও ছিল তুঙ্গে। আর সেই সময়ের বাম নেতৃত্বের একটা অংশ কোভিড পরিস্থিতি উত্তর পথে নেমে আন্দোলনের প্রশ্নে খুব একটা তৎপর ছিলেন না। ফলে বিরোধী রাজনীতির পরিসরে বামেদের ভূমিকাকে সঠিক ভাবে দেখাবার প্রশ্নেও সংবাদমাধ্যম ছিল একটু বেশি রকমেরই কৃপণ।

এই রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পোড়খাওয়া বামপন্থি ব্যক্তিত্ব, সিপিআই (এম)-এর পলিটব্যুলোর সদস্য মহ. সেলিম তাদের দলের প্রাদেশিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য উত্তর প্রজন্মের বামপন্থি নেতা হিসেবে শুধু দলীয় পরিমন্ডলের ভেতরেই নয়, পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার মানুষদের কাছে প্রথম এবং প্রধান পছন্দের মানুষ হলেন সেলিম। প্রখর মেধা সম্পন্ন, আত্মনিবেদিত ধর্মনিরপেক্ষ এবং দলীয় স্তরের রাজনীতিতে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে জেরবার বাম পরিমন্ডলে সমস্ত রকমের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে আন্তরিকতার সঙ্গে রাজনীতিটাকেই জীবনের ধ্যানজ্ঞান করে নেয়া মানুষ সেলিম বামপন্থি রাজনীতির প্রধান মুখ হয়ে উঠে আসার পর, যে গদি মিডিয়া রাজনীতি থেকে বামপন্থিদের একেবারে প্রায় বাণপ্রস্থে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তারাই এখন, মাত্র একমাস দলীয় সম্পাদক হিসেবে সর্বস্তরে সেলিমের ভূমিকা দেখবার পর ক্রমবর্ধমান বাম আন্দোলনগুলোকে সংবাদ শিরোনামে রাখতে বাধ্য হচ্ছে।

বিরোধী রাজনীতি কে যেভাবে একটা প্রাণবন্ত ধারায় মানুষ দেখতে চায়, সেলিম দলের প্রাদেশিক শাখার দায়িত্বভার গ্রহণের মাত্র ১০ দিনের ভেতরেই সেই জায়গায় পশ্চিমবঙ্গে বাম আন্দোলনের গ্রোতের ধারাকে প্রবাহিত করবার প্রাথমিক কাজটা শুরু করে দিতে পেরেছেন। দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সেলিম তার কাজের ভেতর দিয়ে যেটা প্রথমেই বুঝিয়েছেন, দলের প্রাদেশিক সদর দপ্তর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে থেকে তিনি দল বা আন্দোলনকে পরিচালিত করবেন না। আমলাতান্ত্রিকতার পথে যে তিনি কখনোই দল কে পরিচালিত করবেন না, তা তার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক দিনের ভেতরেই বীরভূম জেলার রামপুরহাট গণহত্যার খবর পাওয়ামাত্র ই কর্মকান্ডের ভেতর দিয়ে বুঝতে পারা গিয়েছিল।

রামপুরহাটের কাছে, বাগটুই গণহত্যার খবর জানার অল্প সময়ের ভেতরেই দলের রাজ্য দপ্তরে সাংবাদিক সম্মেলন করে যে দ্রুততার সঙ্গে বর্বরতার নিন্দা তিনি করেছিলেন, তার ফলশ্রুতিই ফল, বাগটুই গণহত্যার মিডিয়া কভারেজ। সেলিম যদি ওই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গণহত্যার নিন্দা করে সাংবাদিক সম্মেলন টা না করতেন, তাহলে গদি মিডিয়া খুব সহজেই বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডলের ‘টি ভি বাস্টে’ র তত্ত্বকেই শিরোপা দিতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ত। অঘোষিত জরুরি অবস্থার জেরে সংবাদমাধ্যম, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম যতটা সম্ভব সেন্সর করত ওই গণহত্যাকে।

পুলিশের দ্বারা সংগঠিত হত্যা আনিস খানের বিষয়টি। বাগটুইয়ের ঘটনা জেনে, সাংবাদিক বৈঠক করে বাড়ি ফিরে আনিসের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতির ভেতরেই সেলিম সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বাগটুই যাবেন। একান্ত কাছের মানুষদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিলেন রণকৌশল। কারণ, তিনি জানেন, সংগঠিতভাবে, রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করে, তারপর বাগটুই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, কোনো অবস্থাতেই মমতা প্রশাসন তাকে অকুস্থলে পৌঁছতে দেবে না। আর রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিকতাকে মান্যতা দিয়ে, ধীরে সুস্থে, রয়েসয়ে যদি তিনি বাগটুই যান, ততক্ষণে প্রশাসন সব প্রমাণ লোপাট করে দিয়ে গণহত্যাকে, সাধারণ দুর্ঘটনা বলে সরকারি শীলমোহর দিয়ে দেবে। কারণ, তারই ভেতরে গণহত্যায় নিহত গরিব সহনাগরিক, যারা জন্মসূত্রে মুসলমান এবং শাসক তৃণমূলেরই সমর্থক, কর্মী, তাদের লাশ জ্বালিয়ে দেয়ার খবর আসতে শুরু করেছিল।

যে গেরিলা কায়দার মেজাজ মানুষ বিরোধীদের কাছ থেকে দেখতে চান, সেই পথেই প্রথম থেকে হাঁটতে শুরু করলেন সেলিম। তিনি জানতেন, বেশি ঢাকঢোল পিটিয়ে তিনি যদি গণহত্যার অকুস্থলের দিকে রওনা হন, প্রশাসন কিছুতেই তাকে গন্তব্যে পৌঁছতে দেবে না। সেই কারণে, একদম গেরিলা কায়দায়, কার্যত পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দলীয় সতীর্থদের মোটরসাইকেলের সাওয়ারী হয়ে সেলিম পৌঁছে গেলেন গণহত্যার সেই বিভৎসতার সামনে। গত প্রায় ১১ বছরে পশ্চিমবঙ্গে বহু নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। সরকার সেসব ঘটনাবলিকেই প্রায় নিজেদের বশংবদ মিডিয়াগুলোকে কাজে লাগিয়ে চেপে দিয়েছে। একজন অপরাধীও শাস্তি পায়নি। আর্থিক দুর্নীতি থেকে সামাজিক, আইনশৃঙ্খলাজনিত এমন নারকীয়তার ভুরি ভুরি উদাহরণ গত ১১ বছরে পশ্চিমবঙ্গে আছে। রয়েছে কেন্দ্রের শাসক বিজেপি আর রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের প্রায় একযোগে সংগঠিত হাজিনগর, তেলিনীপাড়া, বসিরহাট, ধুলিয়ান, বসিরহাট ইত্যাদি এলাকায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা। বিজেপি আর তৃণমূলের ভেতরে সমন্বয়কারী মুকুল রায় এবং তার পুত্রের দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল নৈহাটির পাশে হাজিনগরে পবিত্র মুহররমের অল্প কিছু আগে ভয়াবহ দাঙ্গা।

সংসদীয় রাজনীতির দীর্ঘ ইনিংসে, সরকার পক্ষ বা বিরোধী পক্ষ, যেদিকে থাকুন না কেন, মানুষের দাবি দাওয়ার প্রশ্নে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ছিল সেলিমের সব থেকে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী হিসেবে খুব স্বল্পকালীন সময়ে সেলিম যে বৈশিষ্ট্যের ছাপ ফেলেছিলেন, সেগুলিকে এখন নিজেদের সাফল্য বলে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকেরা প্রচার করে চলেছে। সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের পাশাপাশি যুবকল্যাণ এবং কারিগরি শিক্ষার ও মন্ত্রী ছিলেন তিনি। সেই সময়কালে শুধু সংখ্যালঘুদের বিষয়ই নয়, সামগ্রিকভাবে যুব সম্প্রদায় যাতে প্রযুক্তিগত শিক্ষার নিত্যনতুন ধারাপ্রবাহের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে কর্মসংস্থানের দিকে সাফল্য পায়, সেদিকে যেভাবে তীক্ষ্ম নজর সেলিম রেখেছিলেন, তার ধারাবাহিকতা যদি তার উত্তরসূরিরা বজায় রাখতেন, সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের প্রযুক্তিবিদ্যাকুশলীদের স্রোত আজকের মতো দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, বাঙ্গারোরমুখী হতো না। বিশেষ করে সংখ্যালঘুসহ আদিবাসী, তফসিলি জাতি-উপজাতিসহ সব স্তরের মেয়েরা প্রযুক্তি বিদ্যায় নিজেদের মেধা অনুযায়ী পারদর্শী হয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক- এই স্বপ্নের বাস্তবায়নে সরকারের মন্ত্রী বা শাসক শিবিরের সাংসদ, পরে বিরোধী শিবিরের সাংসদ আর আজ প্রধান বামপন্থি দল সিপিআইয়ের (এম) রাজ্য সম্পাদক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমান সক্রিয় সেলিম।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

পাট চাষের সংকট ও সম্ভাবনা

সামাজিক-প্রযুক্তিগত কল্পনা: বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তার নতুন দিগন্ত

অগ্রক্রয় মোকদ্দমায় উভয় পক্ষের আইনি ডিফেন্স

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

এক সাংবাদিকের খোলা চিঠি

tab

opinion » post-editorial

পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলের রাজনীতি

গৌতম রায়

শুক্রবার, ০৬ মে ২০২২

পশ্চিমবঙ্গের ঝিমিয়ে পড়া বিরোধী রাজনীতি বিগত দুই মাসে নতুনভাবে প্রাণের সাড়া পেয়েছে। গত ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর থেকে এখানকার সংবাদমাধ্যম বিরোধী রাজনীতির ব্যাটটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির হাতে দিয়ে দিয়েছিল। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক দশক ধরে শাসন করা তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভটা যাতে কোন অবস্থাতেই বামপন্থিদের দিকে গিয়ে জমা হতে না পারে, সেই জন্যে আরএসএস নিয়ন্ত্রিত গদি মিডিয়া তৃণমূলের সফল বিকল্প হিসেবে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে দেখাতেই সব থেকে বেশি তৎপর ছিল।

এই অবস্থায় ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে আরএসএস তাদের অন্যতম বিশ্বস্ত গোপন বন্ধু তৃণমূলের সঙ্গে যে বোঝাপড়া করেছিল, তার ভিত্তিতে বামশূন্য বিধানসভায় বিজেপির সাফল্য কে তুলে ধরে বামেরা নিঃশেষিত-এই তত্ত্বটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংবাদ মাধ্যমের তৎপরতাও ছিল তুঙ্গে। আর সেই সময়ের বাম নেতৃত্বের একটা অংশ কোভিড পরিস্থিতি উত্তর পথে নেমে আন্দোলনের প্রশ্নে খুব একটা তৎপর ছিলেন না। ফলে বিরোধী রাজনীতির পরিসরে বামেদের ভূমিকাকে সঠিক ভাবে দেখাবার প্রশ্নেও সংবাদমাধ্যম ছিল একটু বেশি রকমেরই কৃপণ।

এই রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পোড়খাওয়া বামপন্থি ব্যক্তিত্ব, সিপিআই (এম)-এর পলিটব্যুলোর সদস্য মহ. সেলিম তাদের দলের প্রাদেশিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য উত্তর প্রজন্মের বামপন্থি নেতা হিসেবে শুধু দলীয় পরিমন্ডলের ভেতরেই নয়, পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার মানুষদের কাছে প্রথম এবং প্রধান পছন্দের মানুষ হলেন সেলিম। প্রখর মেধা সম্পন্ন, আত্মনিবেদিত ধর্মনিরপেক্ষ এবং দলীয় স্তরের রাজনীতিতে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে জেরবার বাম পরিমন্ডলে সমস্ত রকমের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে আন্তরিকতার সঙ্গে রাজনীতিটাকেই জীবনের ধ্যানজ্ঞান করে নেয়া মানুষ সেলিম বামপন্থি রাজনীতির প্রধান মুখ হয়ে উঠে আসার পর, যে গদি মিডিয়া রাজনীতি থেকে বামপন্থিদের একেবারে প্রায় বাণপ্রস্থে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তারাই এখন, মাত্র একমাস দলীয় সম্পাদক হিসেবে সর্বস্তরে সেলিমের ভূমিকা দেখবার পর ক্রমবর্ধমান বাম আন্দোলনগুলোকে সংবাদ শিরোনামে রাখতে বাধ্য হচ্ছে।

বিরোধী রাজনীতি কে যেভাবে একটা প্রাণবন্ত ধারায় মানুষ দেখতে চায়, সেলিম দলের প্রাদেশিক শাখার দায়িত্বভার গ্রহণের মাত্র ১০ দিনের ভেতরেই সেই জায়গায় পশ্চিমবঙ্গে বাম আন্দোলনের গ্রোতের ধারাকে প্রবাহিত করবার প্রাথমিক কাজটা শুরু করে দিতে পেরেছেন। দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সেলিম তার কাজের ভেতর দিয়ে যেটা প্রথমেই বুঝিয়েছেন, দলের প্রাদেশিক সদর দপ্তর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে থেকে তিনি দল বা আন্দোলনকে পরিচালিত করবেন না। আমলাতান্ত্রিকতার পথে যে তিনি কখনোই দল কে পরিচালিত করবেন না, তা তার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক দিনের ভেতরেই বীরভূম জেলার রামপুরহাট গণহত্যার খবর পাওয়ামাত্র ই কর্মকান্ডের ভেতর দিয়ে বুঝতে পারা গিয়েছিল।

রামপুরহাটের কাছে, বাগটুই গণহত্যার খবর জানার অল্প সময়ের ভেতরেই দলের রাজ্য দপ্তরে সাংবাদিক সম্মেলন করে যে দ্রুততার সঙ্গে বর্বরতার নিন্দা তিনি করেছিলেন, তার ফলশ্রুতিই ফল, বাগটুই গণহত্যার মিডিয়া কভারেজ। সেলিম যদি ওই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গণহত্যার নিন্দা করে সাংবাদিক সম্মেলন টা না করতেন, তাহলে গদি মিডিয়া খুব সহজেই বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডলের ‘টি ভি বাস্টে’ র তত্ত্বকেই শিরোপা দিতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ত। অঘোষিত জরুরি অবস্থার জেরে সংবাদমাধ্যম, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম যতটা সম্ভব সেন্সর করত ওই গণহত্যাকে।

পুলিশের দ্বারা সংগঠিত হত্যা আনিস খানের বিষয়টি। বাগটুইয়ের ঘটনা জেনে, সাংবাদিক বৈঠক করে বাড়ি ফিরে আনিসের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতির ভেতরেই সেলিম সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বাগটুই যাবেন। একান্ত কাছের মানুষদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিলেন রণকৌশল। কারণ, তিনি জানেন, সংগঠিতভাবে, রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করে, তারপর বাগটুই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, কোনো অবস্থাতেই মমতা প্রশাসন তাকে অকুস্থলে পৌঁছতে দেবে না। আর রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিকতাকে মান্যতা দিয়ে, ধীরে সুস্থে, রয়েসয়ে যদি তিনি বাগটুই যান, ততক্ষণে প্রশাসন সব প্রমাণ লোপাট করে দিয়ে গণহত্যাকে, সাধারণ দুর্ঘটনা বলে সরকারি শীলমোহর দিয়ে দেবে। কারণ, তারই ভেতরে গণহত্যায় নিহত গরিব সহনাগরিক, যারা জন্মসূত্রে মুসলমান এবং শাসক তৃণমূলেরই সমর্থক, কর্মী, তাদের লাশ জ্বালিয়ে দেয়ার খবর আসতে শুরু করেছিল।

যে গেরিলা কায়দার মেজাজ মানুষ বিরোধীদের কাছ থেকে দেখতে চান, সেই পথেই প্রথম থেকে হাঁটতে শুরু করলেন সেলিম। তিনি জানতেন, বেশি ঢাকঢোল পিটিয়ে তিনি যদি গণহত্যার অকুস্থলের দিকে রওনা হন, প্রশাসন কিছুতেই তাকে গন্তব্যে পৌঁছতে দেবে না। সেই কারণে, একদম গেরিলা কায়দায়, কার্যত পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দলীয় সতীর্থদের মোটরসাইকেলের সাওয়ারী হয়ে সেলিম পৌঁছে গেলেন গণহত্যার সেই বিভৎসতার সামনে। গত প্রায় ১১ বছরে পশ্চিমবঙ্গে বহু নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। সরকার সেসব ঘটনাবলিকেই প্রায় নিজেদের বশংবদ মিডিয়াগুলোকে কাজে লাগিয়ে চেপে দিয়েছে। একজন অপরাধীও শাস্তি পায়নি। আর্থিক দুর্নীতি থেকে সামাজিক, আইনশৃঙ্খলাজনিত এমন নারকীয়তার ভুরি ভুরি উদাহরণ গত ১১ বছরে পশ্চিমবঙ্গে আছে। রয়েছে কেন্দ্রের শাসক বিজেপি আর রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের প্রায় একযোগে সংগঠিত হাজিনগর, তেলিনীপাড়া, বসিরহাট, ধুলিয়ান, বসিরহাট ইত্যাদি এলাকায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা। বিজেপি আর তৃণমূলের ভেতরে সমন্বয়কারী মুকুল রায় এবং তার পুত্রের দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল নৈহাটির পাশে হাজিনগরে পবিত্র মুহররমের অল্প কিছু আগে ভয়াবহ দাঙ্গা।

সংসদীয় রাজনীতির দীর্ঘ ইনিংসে, সরকার পক্ষ বা বিরোধী পক্ষ, যেদিকে থাকুন না কেন, মানুষের দাবি দাওয়ার প্রশ্নে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ছিল সেলিমের সব থেকে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী হিসেবে খুব স্বল্পকালীন সময়ে সেলিম যে বৈশিষ্ট্যের ছাপ ফেলেছিলেন, সেগুলিকে এখন নিজেদের সাফল্য বলে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকেরা প্রচার করে চলেছে। সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের পাশাপাশি যুবকল্যাণ এবং কারিগরি শিক্ষার ও মন্ত্রী ছিলেন তিনি। সেই সময়কালে শুধু সংখ্যালঘুদের বিষয়ই নয়, সামগ্রিকভাবে যুব সম্প্রদায় যাতে প্রযুক্তিগত শিক্ষার নিত্যনতুন ধারাপ্রবাহের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে কর্মসংস্থানের দিকে সাফল্য পায়, সেদিকে যেভাবে তীক্ষ্ম নজর সেলিম রেখেছিলেন, তার ধারাবাহিকতা যদি তার উত্তরসূরিরা বজায় রাখতেন, সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের প্রযুক্তিবিদ্যাকুশলীদের স্রোত আজকের মতো দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, বাঙ্গারোরমুখী হতো না। বিশেষ করে সংখ্যালঘুসহ আদিবাসী, তফসিলি জাতি-উপজাতিসহ সব স্তরের মেয়েরা প্রযুক্তি বিদ্যায় নিজেদের মেধা অনুযায়ী পারদর্শী হয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক- এই স্বপ্নের বাস্তবায়নে সরকারের মন্ত্রী বা শাসক শিবিরের সাংসদ, পরে বিরোধী শিবিরের সাংসদ আর আজ প্রধান বামপন্থি দল সিপিআইয়ের (এম) রাজ্য সম্পাদক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমান সক্রিয় সেলিম।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top