alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তনে গ্লোবাল সাউথের সর্বনাশ

সালিমুল হক ও মোহাম্মদ আদো

: রোববার, ১৫ মে ২০২২

এই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানে রেকর্ড পরিমাণ তাপপ্রবাহে লক্ষাধিক মানুষের জীবন পুরোপুরি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মাথাফাটা গরমে গমসহ বিভিন্ন শস্যের ফলন ব্যাহত হচ্ছে, অসংখ্য শ্রমিক বাইরে কাজ করতে যেতে পারছে না, সাধারণ মানুষ ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে গরমের কারণে, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে।

কেনিয়া ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এ সমস্যার ভুক্তভোগী। গত বছর কেনিয়ার উত্তরাংশকে দীর্ঘস্থায়ী খরার মুখোমুখি করেছে, যা সেখানকার জনগোষ্ঠীকে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ফেলেছে। গত বছরই বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ মুষলধারে বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছে এবং লক্ষাধিক মানুষকে গৃহহীন করেছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন মানুষ কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার ভুক্তভোগী হচ্ছে, এ দুটো তার সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র। পাশাপাশি, উন্নত বিশ্ব যদি তড়িৎ পদক্ষেপ না নেয়, তবে অদূর ভবিষ্যতের নতুন বাস্তবতা কী হবে পারে, তাওও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় উদাহরণ দুটো।

জলবায়ু সংকটের জন্য তাদের ক্ষমতা, সম্পদ এবং দায়িত্বেবোধের প্রেক্ষিতে, দুর্বল দেশগুলোকে আবহাওয়ার জলবায়ুর প্রভাবে সাহায্য করার জন্য উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের ধনী দেশগুলোর ওপর বিশেষ দায়বদ্ধতা রয়েছে, এবং এটি কখনই আজকের মতো এতো বেশি জরুরি ছিল না। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এ দুর্বল দেশগুলো সবচেয়ে কম দায়ী, কিন্তু তারাই এর মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। কিন্তু তারা নিজেরা কখনই এ লড়াইয়ে একাকী জয়ী হতে পারবে না।

এটা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, বরং এটি সাহায্য করবে বৈশ্বিক সংকটের ঝুঁকি কমাতে। আবার এ সাহায্য পরবর্তী সময়ে দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমান্বয়ে বাড়িঘর হারিয়ে ফেলা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের মতো খরচ কমাতেও সাহায্য করবে।

গত বছর জাতিসংঘ কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে নেয়া সিদ্ধান্তসমূহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এ নাটক মঞ্চায়ন দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে পারি না।

এই বছর নভেম্বরে মিসরে অনুষ্ঠিতব্য কপ-২৭ সম্মেলনকে সামনে রেখে এ সপ্তাহেই অ্যাক্ট-২০২৫ (২০২৫ সালের মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গঠিত জোট, যা জলবায়ুকেন্দ্রিক আলোচনায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে) একটি কর্মপরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে।

প্রথমত, সব দেশকে, বিশেষত জি-৭ এবং জি-২০ ভুক্ত দেশসমূহকে অবশ্যই নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে, যেন বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৩৪.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট) সীমাবদ্ধ থাকে। বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা, তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা এ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খারাপ ঝুঁকিগুলো অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব। এ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা প্রস্তাবিত ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩৯.২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ব্যবধানকে ইতিমধ্যেই কমিয়ে ২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৩৫.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) নিয়ে এসেছে।

যাইহোক, যেহেতু প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রার ব্যবধানই পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, এবং মানুষসহ সব প্রাণীর জীবনযাত্রাকে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখোমুখি করতে পারে, তাই শুধু এ পদক্ষেপই জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়।

দ্বিতীয়ত, উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর এ জলবায়ুযুদ্ধের অর্থায়নে এগিয়ে আসতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, এ অর্থায়ন দ্বারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীগুলো তাদের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ সমাধান খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে। এটা ২০২৫ সালের ভেতর ৬০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করে, যা এমন একটি পরিকল্পনা, উন্নত দেশগুলো এখনও যা অর্জনের পথে যথাযথভাবে হাঁটতে পারেনি।

তৃতীয়ত, সব দেশকে অবশ্যই শক্তিশালী অভিযোজন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে; যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অভিযোজন সংক্রান্ত একটি সমন্বিত বৈশ্বিক চুক্তিতে আসা। এ অভিযোজন প্রক্রিয়া মনিটরিং এবং মাঠপর্যায়ে যথাযথ ও মানসম্মত অর্থায়ন কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, এ ব্যাপারেও এ চুক্তিতে আলোচনা থাকতে হবে। এ অভিযোজন প্রক্রিয়ায় সামুদ্রিক ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার লক্ষ্যে উপকূলীয় বাস্তুসংস্থানের পুনরুদ্ধার থেকে শুরু করে খরায় মানিয়ে নিতে পারে এমন শস্যাদির উৎপাদনকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় সফল হবার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

চতুর্থত, উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই সে সব দেশসমূহকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে, যেসব দেশ এবং জনপদ ইতোমধ্যেই এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে, যে তারা নিজেরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব সারাবিশ্বেই পড়বে, তাই কাজ শুরু করতে হবে সেসব অঞ্চল থেকে, যেগুলো ভয়াবহরকম ঝুঁকিপূর্ণ। এ কাজ শুরু হতে পারে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতায় অবস্থিত দেশসমূহ থেকে, যেগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের সামান্য উচ্চতা বৃদ্ধিতেই তলিয়ে যেতে পারে, কিংবা যে অঞ্চলে কৃষকেরা ভয়াবহ খরার কারণে ঠিকমতো শস্য ফলাতে পারছে না, কিংবা পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে যেসব অঞ্চলের আদিবাসীরা অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। এসব অঞ্চলের সমস্যাগুলো অবশ্যই সমাধান করতে হবে, কিন্তু তাদের সাহায্য করার জন্য এখন পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে শুধু স্কটল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের ওয়ালেনিয়া প্রদেশের সরকার। তাদের অবশ্যই উষ্ণ অভ্যর্থনা, কিন্তু তাদের এ সাহায্য পর্যাপ্ত নয়। বরং উন্নত দেশগুলোকে খুব দ্রুতই এগিয়ে এসে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে।

পরিশেষে, যে দেশগুলো প্যারিস চুক্তি অনুমোদন করেছে, তাদের অবশ্যই আইন প্রয়োহ করতে হবে, যেন স্টেট এক্টর, এবং নন স্টেট এক্টরগুলো তাদের প্রতিশ্রুতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকে। এটা রাষ্ট্রসমূহের কাছে যে লক্ষ্য অর্জনের উপায়সমূহ আছে, তার সঠিক ও যথাযথ পরিমাপ হওয়া নিশ্চিত করাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে, আমরা এমন এক দশকের এক-চতুর্থাংশ পথ এগিয়ে যাবো, যে দশকের ভেতরেই বিজ্ঞানীরা এ গ্রহের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে ফেলতে চান। কিন্তু পৃথিবীর সামনে কভ অপেক্ষা করছে? আমরা এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন একেবারে আমাদের দোরগোড়ায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর হাতে নষ্ট করার মতো এক মুহূর্ত সময়ও নেই।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবাইকে এক হতে হবে, একই কাতারে শামিল হতে হবে, যদি সত্যিই আমরা এ বৈশ্বিক দুর্যোগ থেকে দ্রুততম সময়ে মুক্তি পেতে চাই।

আল-জাজিরা থেকে অনূদিত।

(অনুবাদ : আরিব মাহমুদ, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

[লেখক : সালিমুল হক, পরিচালক, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। মোহাম্মদ আদো, প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, পাওয়ার শিফট আফ্রিকা]

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তনে গ্লোবাল সাউথের সর্বনাশ

সালিমুল হক ও মোহাম্মদ আদো

রোববার, ১৫ মে ২০২২

এই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানে রেকর্ড পরিমাণ তাপপ্রবাহে লক্ষাধিক মানুষের জীবন পুরোপুরি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মাথাফাটা গরমে গমসহ বিভিন্ন শস্যের ফলন ব্যাহত হচ্ছে, অসংখ্য শ্রমিক বাইরে কাজ করতে যেতে পারছে না, সাধারণ মানুষ ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে গরমের কারণে, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে।

কেনিয়া ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এ সমস্যার ভুক্তভোগী। গত বছর কেনিয়ার উত্তরাংশকে দীর্ঘস্থায়ী খরার মুখোমুখি করেছে, যা সেখানকার জনগোষ্ঠীকে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ফেলেছে। গত বছরই বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ মুষলধারে বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছে এবং লক্ষাধিক মানুষকে গৃহহীন করেছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন মানুষ কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার ভুক্তভোগী হচ্ছে, এ দুটো তার সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র। পাশাপাশি, উন্নত বিশ্ব যদি তড়িৎ পদক্ষেপ না নেয়, তবে অদূর ভবিষ্যতের নতুন বাস্তবতা কী হবে পারে, তাওও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় উদাহরণ দুটো।

জলবায়ু সংকটের জন্য তাদের ক্ষমতা, সম্পদ এবং দায়িত্বেবোধের প্রেক্ষিতে, দুর্বল দেশগুলোকে আবহাওয়ার জলবায়ুর প্রভাবে সাহায্য করার জন্য উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের ধনী দেশগুলোর ওপর বিশেষ দায়বদ্ধতা রয়েছে, এবং এটি কখনই আজকের মতো এতো বেশি জরুরি ছিল না। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এ দুর্বল দেশগুলো সবচেয়ে কম দায়ী, কিন্তু তারাই এর মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। কিন্তু তারা নিজেরা কখনই এ লড়াইয়ে একাকী জয়ী হতে পারবে না।

এটা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, বরং এটি সাহায্য করবে বৈশ্বিক সংকটের ঝুঁকি কমাতে। আবার এ সাহায্য পরবর্তী সময়ে দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমান্বয়ে বাড়িঘর হারিয়ে ফেলা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের মতো খরচ কমাতেও সাহায্য করবে।

গত বছর জাতিসংঘ কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে নেয়া সিদ্ধান্তসমূহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এ নাটক মঞ্চায়ন দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে পারি না।

এই বছর নভেম্বরে মিসরে অনুষ্ঠিতব্য কপ-২৭ সম্মেলনকে সামনে রেখে এ সপ্তাহেই অ্যাক্ট-২০২৫ (২০২৫ সালের মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গঠিত জোট, যা জলবায়ুকেন্দ্রিক আলোচনায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে) একটি কর্মপরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে।

প্রথমত, সব দেশকে, বিশেষত জি-৭ এবং জি-২০ ভুক্ত দেশসমূহকে অবশ্যই নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে, যেন বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৩৪.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট) সীমাবদ্ধ থাকে। বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা, তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা এ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খারাপ ঝুঁকিগুলো অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব। এ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা প্রস্তাবিত ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩৯.২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ব্যবধানকে ইতিমধ্যেই কমিয়ে ২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৩৫.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) নিয়ে এসেছে।

যাইহোক, যেহেতু প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রার ব্যবধানই পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, এবং মানুষসহ সব প্রাণীর জীবনযাত্রাকে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখোমুখি করতে পারে, তাই শুধু এ পদক্ষেপই জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়।

দ্বিতীয়ত, উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর এ জলবায়ুযুদ্ধের অর্থায়নে এগিয়ে আসতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, এ অর্থায়ন দ্বারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীগুলো তাদের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ সমাধান খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে। এটা ২০২৫ সালের ভেতর ৬০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করে, যা এমন একটি পরিকল্পনা, উন্নত দেশগুলো এখনও যা অর্জনের পথে যথাযথভাবে হাঁটতে পারেনি।

তৃতীয়ত, সব দেশকে অবশ্যই শক্তিশালী অভিযোজন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে; যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অভিযোজন সংক্রান্ত একটি সমন্বিত বৈশ্বিক চুক্তিতে আসা। এ অভিযোজন প্রক্রিয়া মনিটরিং এবং মাঠপর্যায়ে যথাযথ ও মানসম্মত অর্থায়ন কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, এ ব্যাপারেও এ চুক্তিতে আলোচনা থাকতে হবে। এ অভিযোজন প্রক্রিয়ায় সামুদ্রিক ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার লক্ষ্যে উপকূলীয় বাস্তুসংস্থানের পুনরুদ্ধার থেকে শুরু করে খরায় মানিয়ে নিতে পারে এমন শস্যাদির উৎপাদনকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় সফল হবার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

চতুর্থত, উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই সে সব দেশসমূহকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে, যেসব দেশ এবং জনপদ ইতোমধ্যেই এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে, যে তারা নিজেরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব সারাবিশ্বেই পড়বে, তাই কাজ শুরু করতে হবে সেসব অঞ্চল থেকে, যেগুলো ভয়াবহরকম ঝুঁকিপূর্ণ। এ কাজ শুরু হতে পারে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতায় অবস্থিত দেশসমূহ থেকে, যেগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের সামান্য উচ্চতা বৃদ্ধিতেই তলিয়ে যেতে পারে, কিংবা যে অঞ্চলে কৃষকেরা ভয়াবহ খরার কারণে ঠিকমতো শস্য ফলাতে পারছে না, কিংবা পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে যেসব অঞ্চলের আদিবাসীরা অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। এসব অঞ্চলের সমস্যাগুলো অবশ্যই সমাধান করতে হবে, কিন্তু তাদের সাহায্য করার জন্য এখন পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে শুধু স্কটল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের ওয়ালেনিয়া প্রদেশের সরকার। তাদের অবশ্যই উষ্ণ অভ্যর্থনা, কিন্তু তাদের এ সাহায্য পর্যাপ্ত নয়। বরং উন্নত দেশগুলোকে খুব দ্রুতই এগিয়ে এসে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে।

পরিশেষে, যে দেশগুলো প্যারিস চুক্তি অনুমোদন করেছে, তাদের অবশ্যই আইন প্রয়োহ করতে হবে, যেন স্টেট এক্টর, এবং নন স্টেট এক্টরগুলো তাদের প্রতিশ্রুতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকে। এটা রাষ্ট্রসমূহের কাছে যে লক্ষ্য অর্জনের উপায়সমূহ আছে, তার সঠিক ও যথাযথ পরিমাপ হওয়া নিশ্চিত করাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে, আমরা এমন এক দশকের এক-চতুর্থাংশ পথ এগিয়ে যাবো, যে দশকের ভেতরেই বিজ্ঞানীরা এ গ্রহের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে ফেলতে চান। কিন্তু পৃথিবীর সামনে কভ অপেক্ষা করছে? আমরা এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন একেবারে আমাদের দোরগোড়ায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর হাতে নষ্ট করার মতো এক মুহূর্ত সময়ও নেই।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবাইকে এক হতে হবে, একই কাতারে শামিল হতে হবে, যদি সত্যিই আমরা এ বৈশ্বিক দুর্যোগ থেকে দ্রুততম সময়ে মুক্তি পেতে চাই।

আল-জাজিরা থেকে অনূদিত।

(অনুবাদ : আরিব মাহমুদ, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

[লেখক : সালিমুল হক, পরিচালক, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। মোহাম্মদ আদো, প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, পাওয়ার শিফট আফ্রিকা]

back to top