alt

opinion » post-editorial

তোমার কথাই ঠিক

এম এ কবীর

: বুধবার, ১৫ জুন ২০২২

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা এক দিন কাজীর আসনে বসে বিচার করছিলেন। প্রথমে ফরিয়াদি তার বক্তব্য দিতে শুরু করেন। আসামি সম্পর্কে তার অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছেন। হোজ্জা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছেন। বলা শেষ হলে হোজ্জা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘তোমার কথাই ঠিক।’

এবার আসামি বলে উঠল, ‘হুজুর, আমার দুটি কথা ছিল।’ হোজ্জা বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি তোমার বক্তব্য বলো।’ আসামির বক্তব্যও মনোযোগ দিয়ে শোনার পর হোজ্জা বললেন, ‘তোমার কথাই ঠিক।’

হোজ্জার স্ত্রী পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে তিনি বললেন, ‘দুজনই ঠিক হয় কীভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক অথবা ফরিয়াদির কথা ঠিক।’ হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে সমর্থনসূচক হাসি দিয়ে বললেন, ‘বিবি, তোমার কথাই ঠিক।’

উদীয়মান বাংলাদেশের জন্য সামনে কিছু ভালো, কিছু খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ভালো ও মন্দ খবরের একটা সম্মিলিত পরিব্যাপ্তি দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সেগুলোর প্রলম্বিত অর্থনৈতিক প্রভাবের কথাও বারবার উঠে আসছে। বিবর্তনশীল এ বৈশ্বিক দৃশ্যপট থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কি মুক্ত থাকতে পারবে? চলছে বাজেট মৌসুম। স্বাভাবিকভাবে আসন্ন বাজেট বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি এড়াতে পারবে না। সুতরাং জাতীয় পর্যায়ে বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহগুলো ব্যাপক আলোচনা ও নীতি পদক্ষেপ দাবি রাখে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ৭ কোটি মানুষ আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। ফরিদপুর এবং মাদারীপুর প্রধানত কৃষিপ্রধান অঞ্চল হলেও পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ জোরেশোরে শুরু হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের চেহারা যেন পাল্টে গেছে। অনেক মানুষ কৃষিকাজে তেমন মন না দিয়ে বরং পেশা বদলে নানা ধরনের দোকানপাট আর ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দিচ্ছে। সড়ক বা সাধারণ রাস্তার পাশে কাঠ, বাঁশ আর টিন ইত্যাদি দিয়ে পূর্বে নির্মিত ঘরবাড়ি ও দোকানপাটের বেশির ভাগই এখন ইটের পাকা ঘরবাড়িতে পরিণত হয়েছে। এসব মিলিয়ে বিশাল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বত্র এখন চলছে আনন্দ-উচ্ছ্বাস।

পদ্মা সেতু এ দেশের জনগণের অর্থে নির্মিত জাতির গর্বের ধন। ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে বিবৃতি দিয়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন, সেদিন তিনি বলেছিলেন, তিন বছরের মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করা হবে। তবে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। আর সড়কপথ চালুর পর্বটি শুরু করতেই আরও সাড়ে সাত বছর লেগে যায়। জাপানের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা মোতাবেক পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অরিজিনালি ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প।

কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চাপাচাপিতে কয়েকবার ডিজাইন পরিবর্তনের মাধ্যমে সেতু প্রকল্পকে ২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের ‘গ্র্যান্ড ব্রিজ প্রজেক্টে’ রূপান্তরিত করে ফেলা হয়। সেতুটিকে দোতলা করে নিচের তলায় রেলপথ সংযুক্ত করা হয়েছিল বিশ্বব্যাংকেরই চাপাচাপিতে, যদিও ওই অঞ্চলে তখন কোন রেলপথ ছিল না। এখন রিভার ট্রেনিংসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে গৃহীত প্রকল্প অনুসারে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে সেতুর নিচতলা দিয়ে এই রেলপথ ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে পায়রা বন্দর ও যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হচ্ছে, যার প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়াচ্ছে আরও ৩৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। ওই রেলপথ প্রকল্পে চীনের ঋণ নেয়া হচ্ছে ২১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে রেলপথ প্রকল্পটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। অতএব, পদ্মা সেতুর জন্য গত সাড়ে সাত বা আট বছরে দেশের জনগণ ৬৯ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ জোগান দিয়েছে কিংবা চীনের ঋণের দায়ে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে, যা সুদ-আসলে বহু বছর ধরে জাতিকে কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক তার মেয়াদ ফুরানোর আগের দিন ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশকে প্রদেয় বিশ্বব্যাংকের ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করে দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত জানানোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের এই চরম অপমানকর ঋণপর্বের যবনিকাপাত ঘটে। প্রাথমিকভাবে সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন চাওয়া হয়েছিল ৬০ কোটি ডলার, কিন্তু বিশ্বব্যাংকই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের ঋণকে ১২০ কোটি ডলারে সম্প্রসারিত করেছিল প্রকল্পে নিজেদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে।

প্রথমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকই ছিল প্রকল্পের প্রধান ঋণদাতা। কিন্তু ওই ভূমিকা বিশ্বব্যাংক কেড়ে নিয়েছিল। এডিবি ওই সময় বেশ খানিকটা উষ্মা প্রকাশও করেছিল। এভাবে একটি সহযোগী সংস্থা থেকে প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়াটা রহস্যজনক। সব সেতু স্বপ্নের নয়, কল্পনারও নয়। কিন্তু পদ্মা সত্যিই স্বপ্নের সেতু। স্বাধীনতা কোনো হেলাফেলার জিনিস নয়। স্বাধীনতা একটা জাতির মুক্তির দুয়ার। ছোট্ট ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে যেমন বিশ্ব দেখা যায়, ঠিক কোনো ভূখন্ডের স্বাধীনতাও এক জীর্ণ কুটিরের দুয়ার খোলার মতো।

পদ্মা সেতু নিয়ে নানান উথাল-পাথাল হয়েছে। পদ্মা সেতু কোনো ব্যক্তির নয়, পদ্মা সেতু সমগ্র জাতির, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের, বাংলাদেশের মানুষের রক্ত-ঘামের বাস্তবায়ন। পুরুষের পেটে বাচ্চা জন্মানোর মতো অকল্পনীয় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর এই বাস্তবায়ন। ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে ... তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ নতুন আসবে, নতুন পুরান হবে, আবার দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে নতুনের আবির্ভাব হবে। এ দুনিয়ায় কালপরিক্রমায় কোনো কিছুই যেমন নতুন নয়, কোনো কিছুই তেমন পুরানও নয়। যখন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি চলবে, কাউকে এপার-ওপার হতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হবে না, কষ্ট করতে হবে না। সে সময়টা কতইনা আনন্দের। জাতীয় আয়ে পদ্মা সেতু যে অবদান রাখবে তাই আমাদের মাথা সমান। সেজন্য সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোকজন থাকবে, গাড়িঘোড়া এপাশ-ওপাশ করবে তাদের হিসাব রাখার জন্য অবশ্যই টোল আদায় হতে হবে। কিন্তু তা ফেরি পারাপারের মাশুলের অর্ধেকের বেশি হওয়া কাম্য নয়।

এখন কারও টাকা-পয়সা হলেই তারা সরকারের লোক হয়ে যায়। পোশাকে-আশাকে, চালচলনে রাজা-বাদশাহকেও হার মানায়

অনেক বছর আগে মোগল সম্রাট হুমায়ুন পাঠান বীর শেরশাহর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে যমুনা নদীতে ডুবে যাচ্ছিলেন। এক ভিস্তিওয়ালা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। পরাজিত সম্রাট হুমায়ুন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নিয়ে রাজস্থানের অমরকোটে আশ্রয় নেন। যে অমরকোটে শ্রেষ্ঠ মোগল সম্রাট আকবরের জন্ম। হুমায়ুন ইরান-তুরান নানা জায়গায় ঘোরাফেরা করে শক্তি সংগ্রহ করে আবার দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। দিল্লি পুনর্দখলের পর সম্রাটের সেই ভিস্তিওয়ালার কথা মনে হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সেই ভিস্তিওয়ালাকে এনে এক দিনের জন্য তাকে বাদশাহ বানিয়েছিলেন।

সীতাকুন্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোয় ভয়াবহ অগ্নিকান্ড দেশের জন্য অশনিসংকেত। এমন ভয়াবহ ধ্বংস আমরা কল্পনাও করতে পারি না। যেখানে আগুন নেভাতে গিয়ে দমকল কর্মীদের নয়জনকে জীবন দিতে হয়েছে। হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে। সম্পদের চেয়ে মূল্যবান কতগুলো জীবন এ পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। অনেকে হয়েছেন আহত। তাদের কতজন যে প্রাণ হারাবে কারও জানা নেই। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়বে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। এখন কারও টাকা-পয়সা হলেই তারা সরকারের লোক হয়ে যায়। পোশাকে-আশাকে, চালচলনে রাজা-বাদশাকেও হার মানায়। এ ঘটনার যথাযথ প্রতিকার না হলে আমাদের অর্থনীতিতে ধস নামবে। তাই কারও ওপর অযথা দোষ না চাপিয়ে সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটন করা উচিত।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি,

ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

তোমার কথাই ঠিক

এম এ কবীর

বুধবার, ১৫ জুন ২০২২

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা এক দিন কাজীর আসনে বসে বিচার করছিলেন। প্রথমে ফরিয়াদি তার বক্তব্য দিতে শুরু করেন। আসামি সম্পর্কে তার অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছেন। হোজ্জা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছেন। বলা শেষ হলে হোজ্জা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘তোমার কথাই ঠিক।’

এবার আসামি বলে উঠল, ‘হুজুর, আমার দুটি কথা ছিল।’ হোজ্জা বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি তোমার বক্তব্য বলো।’ আসামির বক্তব্যও মনোযোগ দিয়ে শোনার পর হোজ্জা বললেন, ‘তোমার কথাই ঠিক।’

হোজ্জার স্ত্রী পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে তিনি বললেন, ‘দুজনই ঠিক হয় কীভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক অথবা ফরিয়াদির কথা ঠিক।’ হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে সমর্থনসূচক হাসি দিয়ে বললেন, ‘বিবি, তোমার কথাই ঠিক।’

উদীয়মান বাংলাদেশের জন্য সামনে কিছু ভালো, কিছু খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ভালো ও মন্দ খবরের একটা সম্মিলিত পরিব্যাপ্তি দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সেগুলোর প্রলম্বিত অর্থনৈতিক প্রভাবের কথাও বারবার উঠে আসছে। বিবর্তনশীল এ বৈশ্বিক দৃশ্যপট থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কি মুক্ত থাকতে পারবে? চলছে বাজেট মৌসুম। স্বাভাবিকভাবে আসন্ন বাজেট বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি এড়াতে পারবে না। সুতরাং জাতীয় পর্যায়ে বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহগুলো ব্যাপক আলোচনা ও নীতি পদক্ষেপ দাবি রাখে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ৭ কোটি মানুষ আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। ফরিদপুর এবং মাদারীপুর প্রধানত কৃষিপ্রধান অঞ্চল হলেও পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ জোরেশোরে শুরু হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের চেহারা যেন পাল্টে গেছে। অনেক মানুষ কৃষিকাজে তেমন মন না দিয়ে বরং পেশা বদলে নানা ধরনের দোকানপাট আর ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দিচ্ছে। সড়ক বা সাধারণ রাস্তার পাশে কাঠ, বাঁশ আর টিন ইত্যাদি দিয়ে পূর্বে নির্মিত ঘরবাড়ি ও দোকানপাটের বেশির ভাগই এখন ইটের পাকা ঘরবাড়িতে পরিণত হয়েছে। এসব মিলিয়ে বিশাল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বত্র এখন চলছে আনন্দ-উচ্ছ্বাস।

পদ্মা সেতু এ দেশের জনগণের অর্থে নির্মিত জাতির গর্বের ধন। ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে বিবৃতি দিয়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন, সেদিন তিনি বলেছিলেন, তিন বছরের মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করা হবে। তবে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। আর সড়কপথ চালুর পর্বটি শুরু করতেই আরও সাড়ে সাত বছর লেগে যায়। জাপানের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা মোতাবেক পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অরিজিনালি ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প।

কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চাপাচাপিতে কয়েকবার ডিজাইন পরিবর্তনের মাধ্যমে সেতু প্রকল্পকে ২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের ‘গ্র্যান্ড ব্রিজ প্রজেক্টে’ রূপান্তরিত করে ফেলা হয়। সেতুটিকে দোতলা করে নিচের তলায় রেলপথ সংযুক্ত করা হয়েছিল বিশ্বব্যাংকেরই চাপাচাপিতে, যদিও ওই অঞ্চলে তখন কোন রেলপথ ছিল না। এখন রিভার ট্রেনিংসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে গৃহীত প্রকল্প অনুসারে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে সেতুর নিচতলা দিয়ে এই রেলপথ ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে পায়রা বন্দর ও যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হচ্ছে, যার প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়াচ্ছে আরও ৩৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। ওই রেলপথ প্রকল্পে চীনের ঋণ নেয়া হচ্ছে ২১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে রেলপথ প্রকল্পটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। অতএব, পদ্মা সেতুর জন্য গত সাড়ে সাত বা আট বছরে দেশের জনগণ ৬৯ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ জোগান দিয়েছে কিংবা চীনের ঋণের দায়ে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে, যা সুদ-আসলে বহু বছর ধরে জাতিকে কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক তার মেয়াদ ফুরানোর আগের দিন ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশকে প্রদেয় বিশ্বব্যাংকের ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করে দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত জানানোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের এই চরম অপমানকর ঋণপর্বের যবনিকাপাত ঘটে। প্রাথমিকভাবে সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন চাওয়া হয়েছিল ৬০ কোটি ডলার, কিন্তু বিশ্বব্যাংকই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের ঋণকে ১২০ কোটি ডলারে সম্প্রসারিত করেছিল প্রকল্পে নিজেদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে।

প্রথমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকই ছিল প্রকল্পের প্রধান ঋণদাতা। কিন্তু ওই ভূমিকা বিশ্বব্যাংক কেড়ে নিয়েছিল। এডিবি ওই সময় বেশ খানিকটা উষ্মা প্রকাশও করেছিল। এভাবে একটি সহযোগী সংস্থা থেকে প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়াটা রহস্যজনক। সব সেতু স্বপ্নের নয়, কল্পনারও নয়। কিন্তু পদ্মা সত্যিই স্বপ্নের সেতু। স্বাধীনতা কোনো হেলাফেলার জিনিস নয়। স্বাধীনতা একটা জাতির মুক্তির দুয়ার। ছোট্ট ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে যেমন বিশ্ব দেখা যায়, ঠিক কোনো ভূখন্ডের স্বাধীনতাও এক জীর্ণ কুটিরের দুয়ার খোলার মতো।

পদ্মা সেতু নিয়ে নানান উথাল-পাথাল হয়েছে। পদ্মা সেতু কোনো ব্যক্তির নয়, পদ্মা সেতু সমগ্র জাতির, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের, বাংলাদেশের মানুষের রক্ত-ঘামের বাস্তবায়ন। পুরুষের পেটে বাচ্চা জন্মানোর মতো অকল্পনীয় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর এই বাস্তবায়ন। ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে ... তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ নতুন আসবে, নতুন পুরান হবে, আবার দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে নতুনের আবির্ভাব হবে। এ দুনিয়ায় কালপরিক্রমায় কোনো কিছুই যেমন নতুন নয়, কোনো কিছুই তেমন পুরানও নয়। যখন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি চলবে, কাউকে এপার-ওপার হতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হবে না, কষ্ট করতে হবে না। সে সময়টা কতইনা আনন্দের। জাতীয় আয়ে পদ্মা সেতু যে অবদান রাখবে তাই আমাদের মাথা সমান। সেজন্য সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোকজন থাকবে, গাড়িঘোড়া এপাশ-ওপাশ করবে তাদের হিসাব রাখার জন্য অবশ্যই টোল আদায় হতে হবে। কিন্তু তা ফেরি পারাপারের মাশুলের অর্ধেকের বেশি হওয়া কাম্য নয়।

এখন কারও টাকা-পয়সা হলেই তারা সরকারের লোক হয়ে যায়। পোশাকে-আশাকে, চালচলনে রাজা-বাদশাহকেও হার মানায়

অনেক বছর আগে মোগল সম্রাট হুমায়ুন পাঠান বীর শেরশাহর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে যমুনা নদীতে ডুবে যাচ্ছিলেন। এক ভিস্তিওয়ালা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। পরাজিত সম্রাট হুমায়ুন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নিয়ে রাজস্থানের অমরকোটে আশ্রয় নেন। যে অমরকোটে শ্রেষ্ঠ মোগল সম্রাট আকবরের জন্ম। হুমায়ুন ইরান-তুরান নানা জায়গায় ঘোরাফেরা করে শক্তি সংগ্রহ করে আবার দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। দিল্লি পুনর্দখলের পর সম্রাটের সেই ভিস্তিওয়ালার কথা মনে হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সেই ভিস্তিওয়ালাকে এনে এক দিনের জন্য তাকে বাদশাহ বানিয়েছিলেন।

সীতাকুন্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোয় ভয়াবহ অগ্নিকান্ড দেশের জন্য অশনিসংকেত। এমন ভয়াবহ ধ্বংস আমরা কল্পনাও করতে পারি না। যেখানে আগুন নেভাতে গিয়ে দমকল কর্মীদের নয়জনকে জীবন দিতে হয়েছে। হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে। সম্পদের চেয়ে মূল্যবান কতগুলো জীবন এ পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। অনেকে হয়েছেন আহত। তাদের কতজন যে প্রাণ হারাবে কারও জানা নেই। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়বে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। এখন কারও টাকা-পয়সা হলেই তারা সরকারের লোক হয়ে যায়। পোশাকে-আশাকে, চালচলনে রাজা-বাদশাকেও হার মানায়। এ ঘটনার যথাযথ প্রতিকার না হলে আমাদের অর্থনীতিতে ধস নামবে। তাই কারও ওপর অযথা দোষ না চাপিয়ে সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটন করা উচিত।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি,

ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

back to top