alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সৌর বিদ্যুতের সম্ভাবনা

এস ডি সুব্রত

: সোমবার, ২৫ জুলাই ২০২২

মহামারী সংকট আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধাবস্থার কারণে বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিশেষ করে জ্বলানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও। যার ফলশ্রুতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেখা দিয়েছে ঘাটতি। এর প্রভাবে লোডশেডিং অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে।

সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লোডশেডিং। রাত ৮টার পর শপিং মল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি অফিস আদালতে ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। সরকারি অফিসের সময়সূচি কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা চলছে। এ সংকট শুধু বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই তা বিরাজমান। সরকারের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। সরকারের এ পদক্ষেপ সময়োপযোগী। কারন এখন থেকে সচেতন এবং সাশ্রয়ী না হলে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ অবস্থা মোকাবেলা করতে হতে পারে।

নানমুখী পদক্ষেপের সঙ্গে সৌর বিদ্যুতের কথা এখন গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। শুধু জ্বালানির ওপর নির্ভর না করে প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতি অর্থাৎ সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিতে হবে এবং এর ব্যবহার বাঙানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যুৎ সংকটের এই ভয়াবহ অবস্থা কমাতে সৌর বিদ্যুৎ বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বাঙাতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। চর অঞ্চলে এবং হাওর অঞ্চলে এর ব্যবহারে সাফল্য পাওয়া গেছে। শহরাঞ্চলেও এর সুফল পাওয়া যাবে একথা নিশ্চিত বলা যায়।

সৌর বিদ্যুতের ভাবনাটা শুরু হয়েছিল ১৮৬০ এর দশকে। সৌর প্রযুক্তি নিয়ে তখনই নানামুখী ভাবনা শুরু হয়েছিল। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের একটি বাড়ির ছাদে ১৮৮৪ সালে সর্বপ্রথম সৌর বিদ্যুৎ তৈরি করা হলেও এর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং প্রসারণ আর তেমনভাবে ঘটেনি। সৌর বিদ্যুৎ নিয়ে তখন খুব বেশি গবেষণাও হয়নি। তবে বিংশ শতাব্দিতে এসে আবার সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টিকে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালে উত্তর আমেরিকার ৬টি বাড়িতে সৌর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। ১৯৭৯ সালে সারা বিশ্বে জ্বালানি সংকট শুরু হলে জ্বালানি নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলে উন্নত বিশ্ব সৌর প্রযুক্তির উন্নয়নে গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু ১৯৮০এর দশকে জ্বালানি তেলের দাম আবার হ্রাস পেতে শুরু করলে ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল অবধি সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের গতি কমে যায়। আবার ২০১৬ সাল নাগাদ বিশ্বে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। সেসময় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় চীনে।

বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। ঢাকা শহরের অনেক বাড়ির ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্যানেল দেখতে পাওয়া যায়। এক সময় এই ঢাকায় নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সৌর প্যানেল স্থাপনের বাধ্যবাধকতাও করা হয়েছিল। তবে নানা টালবাহানায় সেই উদ্যোগটি অনেকটাই ভেস্তে যায়। অনেকের মতে সৌর বিদ্যুতের জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ বেশি হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে এই বিদ্যুতের ব্যবহার আশানুরূপ আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। কারো অভিমত উদ্যোগটি প্রশংসনীয় হওয়া সত্ত্বেও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এগোতে পারেনি। ঘরবাড়িতে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের চিন্তা করা যেতে পারে। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি সম্পর্কে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সুবিধা বঞ্চিত এলাকায়, বিশেষ করে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছোটবড় চরাঞ্চলে, হাওর অঞ্চলে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন। তাই ওই সব এলাকায় সৌর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়ার জন্য সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়। সেখানে বেশ সফলতাও পাওয়া যায়। করোনা মহামারী, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক। আমাদের দেশে অসংখ্য ইঞ্জিনচালিত লঞ্চ ও স্টিমারসহ নানা ধরনের নৌযান রয়েছে। কোনোটিতে যাত্রী বহন করে, আবার কোনোটিতে বিভিন্ন মালামাল। ওই যানগুলোতে জ্বালানি হিসেবে সাধারণত ডিজেল বা কেরোসিন ব্যবহার করা হয়। আমদানি করা ওই জালানির পরিবর্তে যদি প্রতিটি নৌযানের ওপরের ছাদে সৌর প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায় তাহলে অন্তত কিছুটা বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় সম্ভব। বিদ্যুতের সাশ্রয়ও হবে।

বাংলাদেশে রয়েছে অগণিত নদ-নদী, খাল-বিল আর হাওড়। এছাড়া দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। সতেরো কোটি মানুষের এই ছোট্ট আয়তনের দেশটির ভূমিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো শত শত একর এলাকা জুড়ে সৌর প্যানেল স্থাপন করার জমি নেই। তাই আমাদের যেসব নদ-নদী, খাল-বিল, সাগর রয়েছে সেখানে ভাসমান সৌর প্যানেল স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায় তাহলে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর একটা নতুন পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। আমাদের প্রযুক্তিবিদরা এ বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে পারেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই সমুদ্রের লবণাক্ত পানিকে বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই প্রক্রিয়ায় সৌর বিদ্যুত প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের ঢাকাসহ অনেক স্থানেরই নদীর পানি বর্তমানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাকে আর পানি বলা যায় না। ঐসব নদী বা জলাশয়ের পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। ফলে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের মাধ্যমে লোডশেডিং কমবে। আমাদের গ্রাম-গঞ্জে আগের দিনের মতো এখন আর তেমন বনজঙ্গল নেই। সব কেটেকুটে ফেলায় সেসব বনবাদাড় এখন উজাড় প্রায়। আর ওই সব গাছের বেশির ভাগ কাঠই ব্যবহৃত হয় রান্নার কাজে।

তাই গ্রামাঞ্চলে রান্নার কাজে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা গেলে অনেক গাছপালাই আমাদের হাত থেকে বেঁচে যাবে। পরিবেশ ও প্রকৃতি তার নিজের অবস্থান ফিরে পাবে। অন্যদিকে আমাদের জ্বলানি তথা বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। বড় এবং মাঝারি আকারের সেতুর। দু’পাশে বা দুই লেনের মাঝে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এসব সেতুতে স্থাপিত সৌর প্যানেল থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। আর ওই বিদ্যুৎ শুধু সেতুতে যানবাহন চলাচল পথকেই আলোকিত করবে না, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডেও নেয়া যাবে। রেলপথের দু’ধারে স্থাপিত সৌর প্যানেল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতে ট্রেন চলাচল করা ছাড়াও অন্যত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এর জন্য গবেষণা করতে হবে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে পরিবেশবান্ধব। এ প্রক্রিয়াটি পরিবেশকে দূষিত করে না, পরিবেশকে জীবজগতের জন্য গ্রহণীয় করে রাখে। বলতে গেলে এই বিদ্যুৎ উৎপন্ন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।

স্বল্প খরচে গ্রামের সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্যরে মধ্যে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহার ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিরাট পরিবর্তন আবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন এবং ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে কিছুটা হলেও বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের গতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জন্য অবশ্যই শতভাগ প্রিপেইড মিটার ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক সাশ্রয় হবে। গ্যাসের লাইনগুলো প্রিপেইড মিটার ব্যবহার এমনকি সম্ভব হলে সিলিন্ডার সিস্টেমে নিয়ে আসতে পারলে গ্যাস সাশ্রয় হবে নিঃসন্দেহে এবং সে গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সৌর বিদ্যুতের সম্ভাবনা

এস ডি সুব্রত

সোমবার, ২৫ জুলাই ২০২২

মহামারী সংকট আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধাবস্থার কারণে বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিশেষ করে জ্বলানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও। যার ফলশ্রুতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেখা দিয়েছে ঘাটতি। এর প্রভাবে লোডশেডিং অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে।

সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লোডশেডিং। রাত ৮টার পর শপিং মল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি অফিস আদালতে ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। সরকারি অফিসের সময়সূচি কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা চলছে। এ সংকট শুধু বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই তা বিরাজমান। সরকারের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। সরকারের এ পদক্ষেপ সময়োপযোগী। কারন এখন থেকে সচেতন এবং সাশ্রয়ী না হলে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ অবস্থা মোকাবেলা করতে হতে পারে।

নানমুখী পদক্ষেপের সঙ্গে সৌর বিদ্যুতের কথা এখন গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। শুধু জ্বালানির ওপর নির্ভর না করে প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতি অর্থাৎ সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিতে হবে এবং এর ব্যবহার বাঙানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যুৎ সংকটের এই ভয়াবহ অবস্থা কমাতে সৌর বিদ্যুৎ বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বাঙাতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। চর অঞ্চলে এবং হাওর অঞ্চলে এর ব্যবহারে সাফল্য পাওয়া গেছে। শহরাঞ্চলেও এর সুফল পাওয়া যাবে একথা নিশ্চিত বলা যায়।

সৌর বিদ্যুতের ভাবনাটা শুরু হয়েছিল ১৮৬০ এর দশকে। সৌর প্রযুক্তি নিয়ে তখনই নানামুখী ভাবনা শুরু হয়েছিল। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের একটি বাড়ির ছাদে ১৮৮৪ সালে সর্বপ্রথম সৌর বিদ্যুৎ তৈরি করা হলেও এর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং প্রসারণ আর তেমনভাবে ঘটেনি। সৌর বিদ্যুৎ নিয়ে তখন খুব বেশি গবেষণাও হয়নি। তবে বিংশ শতাব্দিতে এসে আবার সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টিকে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালে উত্তর আমেরিকার ৬টি বাড়িতে সৌর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। ১৯৭৯ সালে সারা বিশ্বে জ্বালানি সংকট শুরু হলে জ্বালানি নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলে উন্নত বিশ্ব সৌর প্রযুক্তির উন্নয়নে গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু ১৯৮০এর দশকে জ্বালানি তেলের দাম আবার হ্রাস পেতে শুরু করলে ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল অবধি সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের গতি কমে যায়। আবার ২০১৬ সাল নাগাদ বিশ্বে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। সেসময় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় চীনে।

বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। ঢাকা শহরের অনেক বাড়ির ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্যানেল দেখতে পাওয়া যায়। এক সময় এই ঢাকায় নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সৌর প্যানেল স্থাপনের বাধ্যবাধকতাও করা হয়েছিল। তবে নানা টালবাহানায় সেই উদ্যোগটি অনেকটাই ভেস্তে যায়। অনেকের মতে সৌর বিদ্যুতের জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ বেশি হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে এই বিদ্যুতের ব্যবহার আশানুরূপ আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। কারো অভিমত উদ্যোগটি প্রশংসনীয় হওয়া সত্ত্বেও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এগোতে পারেনি। ঘরবাড়িতে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের চিন্তা করা যেতে পারে। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি সম্পর্কে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সুবিধা বঞ্চিত এলাকায়, বিশেষ করে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছোটবড় চরাঞ্চলে, হাওর অঞ্চলে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন। তাই ওই সব এলাকায় সৌর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়ার জন্য সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়। সেখানে বেশ সফলতাও পাওয়া যায়। করোনা মহামারী, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক। আমাদের দেশে অসংখ্য ইঞ্জিনচালিত লঞ্চ ও স্টিমারসহ নানা ধরনের নৌযান রয়েছে। কোনোটিতে যাত্রী বহন করে, আবার কোনোটিতে বিভিন্ন মালামাল। ওই যানগুলোতে জ্বালানি হিসেবে সাধারণত ডিজেল বা কেরোসিন ব্যবহার করা হয়। আমদানি করা ওই জালানির পরিবর্তে যদি প্রতিটি নৌযানের ওপরের ছাদে সৌর প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায় তাহলে অন্তত কিছুটা বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় সম্ভব। বিদ্যুতের সাশ্রয়ও হবে।

বাংলাদেশে রয়েছে অগণিত নদ-নদী, খাল-বিল আর হাওড়। এছাড়া দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। সতেরো কোটি মানুষের এই ছোট্ট আয়তনের দেশটির ভূমিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো শত শত একর এলাকা জুড়ে সৌর প্যানেল স্থাপন করার জমি নেই। তাই আমাদের যেসব নদ-নদী, খাল-বিল, সাগর রয়েছে সেখানে ভাসমান সৌর প্যানেল স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায় তাহলে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর একটা নতুন পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। আমাদের প্রযুক্তিবিদরা এ বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে পারেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই সমুদ্রের লবণাক্ত পানিকে বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই প্রক্রিয়ায় সৌর বিদ্যুত প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের ঢাকাসহ অনেক স্থানেরই নদীর পানি বর্তমানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাকে আর পানি বলা যায় না। ঐসব নদী বা জলাশয়ের পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। ফলে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের মাধ্যমে লোডশেডিং কমবে। আমাদের গ্রাম-গঞ্জে আগের দিনের মতো এখন আর তেমন বনজঙ্গল নেই। সব কেটেকুটে ফেলায় সেসব বনবাদাড় এখন উজাড় প্রায়। আর ওই সব গাছের বেশির ভাগ কাঠই ব্যবহৃত হয় রান্নার কাজে।

তাই গ্রামাঞ্চলে রান্নার কাজে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা গেলে অনেক গাছপালাই আমাদের হাত থেকে বেঁচে যাবে। পরিবেশ ও প্রকৃতি তার নিজের অবস্থান ফিরে পাবে। অন্যদিকে আমাদের জ্বলানি তথা বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। বড় এবং মাঝারি আকারের সেতুর। দু’পাশে বা দুই লেনের মাঝে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এসব সেতুতে স্থাপিত সৌর প্যানেল থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। আর ওই বিদ্যুৎ শুধু সেতুতে যানবাহন চলাচল পথকেই আলোকিত করবে না, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডেও নেয়া যাবে। রেলপথের দু’ধারে স্থাপিত সৌর প্যানেল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতে ট্রেন চলাচল করা ছাড়াও অন্যত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এর জন্য গবেষণা করতে হবে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে পরিবেশবান্ধব। এ প্রক্রিয়াটি পরিবেশকে দূষিত করে না, পরিবেশকে জীবজগতের জন্য গ্রহণীয় করে রাখে। বলতে গেলে এই বিদ্যুৎ উৎপন্ন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।

স্বল্প খরচে গ্রামের সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্যরে মধ্যে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহার ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিরাট পরিবর্তন আবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন এবং ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে কিছুটা হলেও বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের গতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জন্য অবশ্যই শতভাগ প্রিপেইড মিটার ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক সাশ্রয় হবে। গ্যাসের লাইনগুলো প্রিপেইড মিটার ব্যবহার এমনকি সম্ভব হলে সিলিন্ডার সিস্টেমে নিয়ে আসতে পারলে গ্যাস সাশ্রয় হবে নিঃসন্দেহে এবং সে গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top