alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

শৃঙ্খলা ফিরবে কি শ্রীলঙ্কায়

এম এ কবীর

: বুধবার, ২৭ জুলাই ২০২২

দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা। দেশটির দোর্দ- প্রতাপশালী ক্ষমতাসীন পরিবারটি এখন রাজ্যহারা, আশ্রয়হারা। একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তাদের এ দেশ থেকে ও দেশে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। কয়েক মাস আগেও কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছিলেন, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ক্ষমতাধর পরিবারটির সদস্যদের এমন নিরাশ্রয় হতে হবে? মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতায় আসেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েই। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদান কম নয়। তামিল টাইগারদের নির্মূল করে দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অস্থিরতাকে দূরীভূত করতে সক্ষম হন। নজর দেন দেশটির অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেও। আর তা করতে গিয়ে ডুব দেন বৈদেশিক ঋণের সাগরে। যে কারণে প্রবল আর্থিক সংকট ঘিরে ধরে দেশটিকে।

অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে এক দিনও সচল রাখা সম্ভব হচ্ছিল না রাষ্ট্রের চাকা। জ্বালানি, খাদ্যসহ প্রায় সব পণ্যের সংকট শ্রীলঙ্কার জনগণকে অতিষ্ঠ করে তোলে। তারা বিদ্রোহ করে রাজাপাকসে সরকারের বিরুদ্ধে। প্রচন্ড গণবিক্ষোভের মুখে মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। গোতাবায়ার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতায় দীর্ঘদিনের রাজাপাকসে পরিবার যুগের অবসান হলো। একটি পরিবারের স্বেচ্ছাচারিতা, একনায়কতান্ত্রিক শাসন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়-লুণ্ঠন একটি দেশকে কীভাবে দেউলিয়া করতে পারে, শ্রীলঙ্কা তার উদাহরণ। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেও পরবর্তী সময়ে মাহিন্দা রাজাপাকসে হয়ে ওঠেন একনায়ক-স্বৈরশাসক। কায়েম করেন পারিবারিক শাসন। মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যদের আধিপত্য ছিল। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে এই পরিবারের সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলের লুটপাটের বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। রাজাপাকসের অপশাসনে শ্রীলঙ্কার জনগণ এতটাই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে যে, কোন রাজনৈতিক দল বা নেতার নেতৃত্ব ছাড়াই তারা বিদ্রোহ করে বসে। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে রাজাপাকসে পরিবারের এই উচ্ছেদ দেশটিতে শিগগিরই শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে কি না, কিংবা দেশটির রাজনীতি থেকে ওই পরিবারের এটা চির-উচ্ছেদ কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি।

১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ২০ জুলাই তিনি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন হন। তিনি বর্তমান বিশৃঙ্খল শ্রীলঙ্কায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কতটা সক্ষম হবেন বলা মুশকিল। কেননা, অন্ন-বস্ত্রসহ জীবন ধারণের জরুরি অনুষঙ্গের অভাবে ওষ্ঠাগত-প্রাণ লঙ্কানরা এখন আর কাউকেই মানতে চাইছে না। সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো এই বিক্ষুব্ধ এবং উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা। সেটা কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ। অবশ্য সময়ই তার উত্তর দেবে।

বহু শাসক তাদের স্বেচ্ছাচারিতা বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দ্বারা একটা সময় পর্যন্ত ক্ষমতার প্রাসাদ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও একপর্যায়ে তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। কোনো কিছুই আর সে প্রাসাদকে টিকিয়ে রাখতে পারে না।

বিশ্বব্যাপী নিন্দিত এডলফ হিটলার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হন। তার অপশাসনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে জার্মানি, তিনি নিজের জনগণকে দমনের জন্য গড়ে তোলেন গেসটাপো বাহিনী। হিটলারের সামান্য বিরোধিতায়ও তাদের খুন বা গুম করে ফেলা হতো। হিটলারের দম্ভ ও লোভে শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ। যে যুদ্ধে পৃথিবীতে ছয় কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। তখন হিটলারকে ধরার জন্য জার্মানবাসী ও সারা বিশ্ব একাট্টা হয়ে অভিযান পরিচালনা করে। পালানোর কোনো পথ পাচ্ছিলেন না হিটলার। শেষপর্যন্ত এক অন্ধকার গুহায় আশ্রয় নেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ইরানের ক্ষমতায় চেপে বসেন স্বৈরশাসক রেজা শাহ্ পাহলভী। শাহ হিটলারের মতোই গড়ে তোলেন সাভাক বাহিনী। ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সাভাকের নির্যাতন। শাহ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ২২ বছরেরও কম। দীর্ঘ ৩৮ বছর প্রবল পরাক্রমে ইরানের রাজসিংহাসন দখলে রাখলেও শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে বাধ্য হন জনবিক্ষোভের মুখে। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়া এই স্বৈরশাসককেও বিতাড়িত হতে হয় দেশ থেকে। আশ্রয় নেন মিসরে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এমনকি মৃত্যুর পর তার লাশ দাফনের জন্যও ইরানে আনা সম্ভব হয়নি।

বিংশ শতাব্দীর আরেক স্বৈরশাসক ছিলেন ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোস। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন সরকারপ্রধান যে কতটা নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকে পরিণত হতে পারে, মার্কোস তার দৃষ্টান্ত। ১৯৬৫ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। যদিও ১৯৭২ সাল থেকে তিনি দেশ শাসন করছিলেন সামরিক আইনের দ্বারা। ১৯৮৩ সালে ম্যানিলা এয়ারপোর্টে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক বেনিগনো অ্যাকুইনোর হত্যাকান্ডের পর মার্কোস প্রচন্ড জনবিক্ষোভের মুখে পড়েন। তারপর নির্বাচনে কারচুপিকে কেন্দ্র করে নিহত অ্যাকুইনোর স্ত্রী কোরাজন অ্যাকুইনোর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে তার ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে। দেশত্যাগে বাধ্য হন তিনি। আশ্রয় জোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই তার জীবনাবসান হয়। বলা হয়ে থাকে, তার শাসনামলে তার চেয়ে ক্ষমতাধর ছিলেন স্ত্রী ইমেলদা মার্কোস; যার হুংকারে বাঘে-মোষে এক ঘাটে জল খাওয়ার অবস্থা ছিল। কিন্তু সময় তাদের ক্ষমা করেনি। নিক্ষিপ্ত হতে হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

সেই মার্কোসের ছেলে ‘মার্কোস জুনিয়র লিমা দোস সান্তোস’ ওরফে ‘বং বং মার্কোস’ এ বছর জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এখন দেখার বিষয় তিনি তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ফিলিপাইনে পুনরায় স্বৈরশাসন কায়েম করেন, নাকি পিতার পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে একজন গণতান্ত্রিক সরকারপ্রধান হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেন। রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কু ছিলেন মহাপ্রতাপশালী শাসক। একনায়কত্ব কায়েম করে রোমানিয়াকে শাসন করেন দীর্ঘদিন। অবশেষে ১৯৮৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১০ বছর স্বৈরশাসনের দন্ড ঘুরিয়ে পাকিস্তানের গদি দখলে রাখলেও ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তারপর পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে তার চিরবিদায় ঘটে। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, মধ্য আফ্রিকার স¤্রাট বোকাসা, চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশে তারা সবাই মনে করেছিলেন তাদের ক্ষমতা বুঝি চিরস্থায়ী। তাই স্বেচ্ছাচারিতা ও জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের ঘৃণাই শুধু কুড়িয়েছিলেন। আর সে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের শোচনীয় পতনের মধ্য দিয়ে।

শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে রাজাপাকসে পরিবারের এই উচ্ছেদ দেশটিতে শিগগিরই শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে কি না, কিংবা দেশটির রাজনীতি থেকে ওই পরিবারের এটা চির-উচ্ছেদ কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক দুঃশাসকের দেখা পাওয়া যাবে, যাদের পরিণতি ভালো হয়নি। কেউ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে, কেউ নিজের জীবন দিয়ে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে গেছেন। তারা যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন ভেবেছিলেন সামনের দিনগুলোও বোধকরি এমনিভাবে যাবে। কিন্তু ওই যে কবি নজরুলের গানের বাণীর মর্মার্থ চিরদিন কাহারো সমান যায় না...। ক্ষমতা হাতে থাকতে এ সত্যটি অনেকেরই মনে থাকে না। যখন সময় ঘনিয়ে আসে, তখন করার আর কিছুই থাকে না। যুগে যুগে এমনটিই ঘটে আসছে। চোখের সামনে জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত থাকতেও কেউ সাবধান হয় না, সংযত হয় না। কারণ, কথায় আছে, ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না’। মানুষের সুদিন-দুর্দিন নদীর জোয়ার-ভাটার মতো। আজ ভালো তো কাল খারাপ। এই সুদিনকে যারা ভালো কাজে লাগান, তারা মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পান, সমাজে সমাদৃত হন। আর যারা নিজের সুদিনকে অপরের দুর্দিন বানানোর কাজে ব্যবহার করেন, একদিন তাকেই দুর্দিনে নিপতিত হতে হয়। একসময় ঘটে ভাগ্যবিপর্যয়। মানুষকে বঞ্চিত করে, অবাধ লুটপাটের মাধ্যমে যে প্রাসাদ তারা গড়ে তোলেন, প্রচন্ড ঝড়ের এক ঝাপটায় তা ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যায়। রাজাধিরাজ থেকে মুহূর্তে তিনি পরিণত হন দীনভিখারি কাঙালে। ক্ষমতার দম্ভে যিনি একসময় অগণিত মানুষের গৃহ কেড়ে নেন, তাকেই একসময় আশ্রয়ের জন্য ছুটতে হয় এ দ্বারে-সে দ্বারে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

রম্যগদ্য: শিক্ষা সহজ, বিদ্যা কঠিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

শৃঙ্খলা ফিরবে কি শ্রীলঙ্কায়

এম এ কবীর

বুধবার, ২৭ জুলাই ২০২২

দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা। দেশটির দোর্দ- প্রতাপশালী ক্ষমতাসীন পরিবারটি এখন রাজ্যহারা, আশ্রয়হারা। একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তাদের এ দেশ থেকে ও দেশে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। কয়েক মাস আগেও কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছিলেন, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ক্ষমতাধর পরিবারটির সদস্যদের এমন নিরাশ্রয় হতে হবে? মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতায় আসেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েই। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদান কম নয়। তামিল টাইগারদের নির্মূল করে দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অস্থিরতাকে দূরীভূত করতে সক্ষম হন। নজর দেন দেশটির অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেও। আর তা করতে গিয়ে ডুব দেন বৈদেশিক ঋণের সাগরে। যে কারণে প্রবল আর্থিক সংকট ঘিরে ধরে দেশটিকে।

অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে এক দিনও সচল রাখা সম্ভব হচ্ছিল না রাষ্ট্রের চাকা। জ্বালানি, খাদ্যসহ প্রায় সব পণ্যের সংকট শ্রীলঙ্কার জনগণকে অতিষ্ঠ করে তোলে। তারা বিদ্রোহ করে রাজাপাকসে সরকারের বিরুদ্ধে। প্রচন্ড গণবিক্ষোভের মুখে মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। গোতাবায়ার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতায় দীর্ঘদিনের রাজাপাকসে পরিবার যুগের অবসান হলো। একটি পরিবারের স্বেচ্ছাচারিতা, একনায়কতান্ত্রিক শাসন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়-লুণ্ঠন একটি দেশকে কীভাবে দেউলিয়া করতে পারে, শ্রীলঙ্কা তার উদাহরণ। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেও পরবর্তী সময়ে মাহিন্দা রাজাপাকসে হয়ে ওঠেন একনায়ক-স্বৈরশাসক। কায়েম করেন পারিবারিক শাসন। মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যদের আধিপত্য ছিল। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে এই পরিবারের সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলের লুটপাটের বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। রাজাপাকসের অপশাসনে শ্রীলঙ্কার জনগণ এতটাই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে যে, কোন রাজনৈতিক দল বা নেতার নেতৃত্ব ছাড়াই তারা বিদ্রোহ করে বসে। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে রাজাপাকসে পরিবারের এই উচ্ছেদ দেশটিতে শিগগিরই শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে কি না, কিংবা দেশটির রাজনীতি থেকে ওই পরিবারের এটা চির-উচ্ছেদ কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি।

১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ২০ জুলাই তিনি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন হন। তিনি বর্তমান বিশৃঙ্খল শ্রীলঙ্কায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কতটা সক্ষম হবেন বলা মুশকিল। কেননা, অন্ন-বস্ত্রসহ জীবন ধারণের জরুরি অনুষঙ্গের অভাবে ওষ্ঠাগত-প্রাণ লঙ্কানরা এখন আর কাউকেই মানতে চাইছে না। সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো এই বিক্ষুব্ধ এবং উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা। সেটা কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ। অবশ্য সময়ই তার উত্তর দেবে।

বহু শাসক তাদের স্বেচ্ছাচারিতা বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দ্বারা একটা সময় পর্যন্ত ক্ষমতার প্রাসাদ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও একপর্যায়ে তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। কোনো কিছুই আর সে প্রাসাদকে টিকিয়ে রাখতে পারে না।

বিশ্বব্যাপী নিন্দিত এডলফ হিটলার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হন। তার অপশাসনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে জার্মানি, তিনি নিজের জনগণকে দমনের জন্য গড়ে তোলেন গেসটাপো বাহিনী। হিটলারের সামান্য বিরোধিতায়ও তাদের খুন বা গুম করে ফেলা হতো। হিটলারের দম্ভ ও লোভে শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ। যে যুদ্ধে পৃথিবীতে ছয় কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। তখন হিটলারকে ধরার জন্য জার্মানবাসী ও সারা বিশ্ব একাট্টা হয়ে অভিযান পরিচালনা করে। পালানোর কোনো পথ পাচ্ছিলেন না হিটলার। শেষপর্যন্ত এক অন্ধকার গুহায় আশ্রয় নেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ইরানের ক্ষমতায় চেপে বসেন স্বৈরশাসক রেজা শাহ্ পাহলভী। শাহ হিটলারের মতোই গড়ে তোলেন সাভাক বাহিনী। ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সাভাকের নির্যাতন। শাহ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ২২ বছরেরও কম। দীর্ঘ ৩৮ বছর প্রবল পরাক্রমে ইরানের রাজসিংহাসন দখলে রাখলেও শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে বাধ্য হন জনবিক্ষোভের মুখে। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়া এই স্বৈরশাসককেও বিতাড়িত হতে হয় দেশ থেকে। আশ্রয় নেন মিসরে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এমনকি মৃত্যুর পর তার লাশ দাফনের জন্যও ইরানে আনা সম্ভব হয়নি।

বিংশ শতাব্দীর আরেক স্বৈরশাসক ছিলেন ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোস। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন সরকারপ্রধান যে কতটা নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকে পরিণত হতে পারে, মার্কোস তার দৃষ্টান্ত। ১৯৬৫ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। যদিও ১৯৭২ সাল থেকে তিনি দেশ শাসন করছিলেন সামরিক আইনের দ্বারা। ১৯৮৩ সালে ম্যানিলা এয়ারপোর্টে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক বেনিগনো অ্যাকুইনোর হত্যাকান্ডের পর মার্কোস প্রচন্ড জনবিক্ষোভের মুখে পড়েন। তারপর নির্বাচনে কারচুপিকে কেন্দ্র করে নিহত অ্যাকুইনোর স্ত্রী কোরাজন অ্যাকুইনোর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে তার ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে। দেশত্যাগে বাধ্য হন তিনি। আশ্রয় জোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই তার জীবনাবসান হয়। বলা হয়ে থাকে, তার শাসনামলে তার চেয়ে ক্ষমতাধর ছিলেন স্ত্রী ইমেলদা মার্কোস; যার হুংকারে বাঘে-মোষে এক ঘাটে জল খাওয়ার অবস্থা ছিল। কিন্তু সময় তাদের ক্ষমা করেনি। নিক্ষিপ্ত হতে হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

সেই মার্কোসের ছেলে ‘মার্কোস জুনিয়র লিমা দোস সান্তোস’ ওরফে ‘বং বং মার্কোস’ এ বছর জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এখন দেখার বিষয় তিনি তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ফিলিপাইনে পুনরায় স্বৈরশাসন কায়েম করেন, নাকি পিতার পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে একজন গণতান্ত্রিক সরকারপ্রধান হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেন। রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কু ছিলেন মহাপ্রতাপশালী শাসক। একনায়কত্ব কায়েম করে রোমানিয়াকে শাসন করেন দীর্ঘদিন। অবশেষে ১৯৮৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১০ বছর স্বৈরশাসনের দন্ড ঘুরিয়ে পাকিস্তানের গদি দখলে রাখলেও ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তারপর পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে তার চিরবিদায় ঘটে। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, মধ্য আফ্রিকার স¤্রাট বোকাসা, চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশে তারা সবাই মনে করেছিলেন তাদের ক্ষমতা বুঝি চিরস্থায়ী। তাই স্বেচ্ছাচারিতা ও জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের ঘৃণাই শুধু কুড়িয়েছিলেন। আর সে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের শোচনীয় পতনের মধ্য দিয়ে।

শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে রাজাপাকসে পরিবারের এই উচ্ছেদ দেশটিতে শিগগিরই শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে কি না, কিংবা দেশটির রাজনীতি থেকে ওই পরিবারের এটা চির-উচ্ছেদ কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক দুঃশাসকের দেখা পাওয়া যাবে, যাদের পরিণতি ভালো হয়নি। কেউ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে, কেউ নিজের জীবন দিয়ে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে গেছেন। তারা যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন ভেবেছিলেন সামনের দিনগুলোও বোধকরি এমনিভাবে যাবে। কিন্তু ওই যে কবি নজরুলের গানের বাণীর মর্মার্থ চিরদিন কাহারো সমান যায় না...। ক্ষমতা হাতে থাকতে এ সত্যটি অনেকেরই মনে থাকে না। যখন সময় ঘনিয়ে আসে, তখন করার আর কিছুই থাকে না। যুগে যুগে এমনটিই ঘটে আসছে। চোখের সামনে জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত থাকতেও কেউ সাবধান হয় না, সংযত হয় না। কারণ, কথায় আছে, ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না’। মানুষের সুদিন-দুর্দিন নদীর জোয়ার-ভাটার মতো। আজ ভালো তো কাল খারাপ। এই সুদিনকে যারা ভালো কাজে লাগান, তারা মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পান, সমাজে সমাদৃত হন। আর যারা নিজের সুদিনকে অপরের দুর্দিন বানানোর কাজে ব্যবহার করেন, একদিন তাকেই দুর্দিনে নিপতিত হতে হয়। একসময় ঘটে ভাগ্যবিপর্যয়। মানুষকে বঞ্চিত করে, অবাধ লুটপাটের মাধ্যমে যে প্রাসাদ তারা গড়ে তোলেন, প্রচন্ড ঝড়ের এক ঝাপটায় তা ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যায়। রাজাধিরাজ থেকে মুহূর্তে তিনি পরিণত হন দীনভিখারি কাঙালে। ক্ষমতার দম্ভে যিনি একসময় অগণিত মানুষের গৃহ কেড়ে নেন, তাকেই একসময় আশ্রয়ের জন্য ছুটতে হয় এ দ্বারে-সে দ্বারে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

back to top