alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

টেকসই উন্নয়নে সাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গি

ইফতেখার নাজিম

: শুক্রবার, ০৫ আগস্ট ২০২২

টেকসই উন্নয়ন হলো সেই উন্নয়ন, যা বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণে সক্ষমতার সঙ্গে আপোস না করে। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনায় ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এই লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ সাল চূড়ান্ত। জাতিসংঘের ১৭টি লক্ষ্যের প্রতিটির উদ্দেশ্য হলো বর্তমান প্রজন্মের জন্য উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলা। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়-বর্তমান প্রজন্মের জীবনাচারণের ওপর নির্ভর করে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎমান কেমন হবে।

আমাদের বুঝতে হবে প্রকৃতিতে সম্পদ সীমিত। তাই, সম্পদের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধে এর ব্যবস্থাপনার দিকে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো এমনভাবে সাজাতে ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যেন সম্পদের অপচয়ের ভারে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঝুঁকিতে না পড়ে। মনে রাখা প্রয়োজন, যেকোন দুর্বল পরিকল্পনা শুধু সম্পদের অপচয় ঘটায় না বরং মানুষের জীবনযাত্রার মানকে হ্রাস করে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাতীয় অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। প্রতিটি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দায়বদ্ধতা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে।

বাংলাদেশে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। যে উন্নয়নের সব উপকরণ অর্থাৎ রড, সিমেন্ট, পাথর, বিটুমিন, ইস্পাত, টাইলস, মার্বেল পাথর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যেখানে রাষ্ট্রকে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিতে হচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়িতে একদিকে যেমন উন্নয়নের সুফল জাতি পাচ্ছে না, তেমনি অপচয়ের বিশাল দায়ভার রাষ্ট্র ও জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। যেমন আসা যাক, ঢাকা শহরের উন্নয়ন চিত্রে। ঢাকা শহরে বছরজুড়ে সড়ক নির্মাণ, ফুটপাত উন্নয়ন, ড্রেন নির্মাণ, বৈদ্যুতিক, টেলিফোন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সাবলাইন নির্মাণ হচ্ছে।

তবে, উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমন্বিত রোডম্যাপ না থাকায় দেখা যায়-কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সিটি করপোরেশন যে সড়ক নির্মাণ করছে (যেখানে উকরণের মান ও সড়ক টেকসইয়ে বিষয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে) সেই সড়ক নির্মাণের কিছু দিন পর বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা সাবলাইনের জন্য সড়কটি কেটে ফেলছে। দেখা গেল বিদ্যুৎ সংস্থার কাটা সড়ক কয়েক দিন পর সিটি করপোরেশন জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করে দিল। তারপর ওই সড়ক কেটে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন লাইন তৈরি করছে ওয়াসা। এই ভাঙ্গা সড়ক কয়েক দিন পর আবার জোড়াতালি দিয়ে সিটি করপোরেশন মেরামত করল। এরপর আসে টেলিফোন সংস্থা। এভাবে ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে আমাদের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলতেই থাকে। অন্যদিকে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণের কারণে নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বেই সড়কগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে এবং জনভোগান্তি বাড়তে থাকে। আবার টেন্ডার হয়, চলতে থাকে ঠিকাদার প্রকৌশলীর কমিশন বাণিজ্য। এ ধরনের আত্মঘাতী উন্নয়নের দায়ভার চূড়ান্তভাবে পড়ে দেশের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

ঢাকার যানজট নিরসনে ৭ হাজার কোটি ব্যয়ে কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল বিদেশি কনসালট্যান্সি ফার্ম। এই উন্নয়ন যে কার্যকর হয়নি, সেটির জন্য দৃষ্টি দেয়া যাক সাতরাস্তা-মগবাজার-মালিবাগ-শান্তিনগর ফ্লাইওভারের দিকে। এই ফ্লাইওভার নির্মাণের পরও এখনো মৌচাক মগবাজার হয়ে সাতরাস্তার দিকে গমনকারী যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিগন্যাল যানজটে বসে থাকতে হয়। আবার রামপুরা হয়ে শান্তিনগর আসার ক্ষেত্রে অনুরূপ অবস্থা মোকাবিলা করতে হয় আবুল হোটেল ও বেইলি রোড সিগন্যালে। ফ্লাইওভার নির্মাণে র‌্যাম্পগুলো নিয়ে নামানো হলো আবুল হোটেল ও বেইলি রোডের ক্রসিংয়ের সামনে। অন্যদিকে মগবাজার থেকে সাতরাস্তার দিকে যাওয়ার জন্য পৃথক লুপ নির্মাণ করা হয়নি। তাহলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই উন্নয়নের সুফলটা কোথায়! অনুরূপভাবে বিআরটি লেন নির্মাণে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে, সেখানেও অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণের চড়া মাশুল দিতে হবে বিমানবন্দন-উত্তরাগামী যাত্রীদের। বর্তমান প্রজন্মের ভুল উন্নয়ন পরিকল্পনা মাশুল দিতে হবে আগামী প্রজন্মকে।

প্রায় ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতরাস্তা থেকে উত্তরা পর্যন্ত নির্মিত ইউলুপগুলোর কোন কোনটা ভেঙে ফেলা হয়েছে, আবার কোন কোনটি বাসস্ট্যান্ডের ভূমিকায় পতিত। এই ইউলুপ নির্মাণ করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী ফুটপাতগুলোকে নষ্ট করা হয়েছে। ফলে ছোট যাত্রাপথে পথচারী হাঁটতে পারছে না। অথচ, জ্বালানি ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য ছোটপথে হাঁটা বা সাইকেল চালানোতে অভ্যস্থ করা হলে একদিকে জ্বালানি সাশ্রয় হতো, অন্যদিকে স্বাস্থ্যের উন্নতি করার পাশাপাশি প্রকৃতি পরিবেশে কার্বন বৃদ্ধিজনিত বিরূপ প্রভাব হ্রাস পেত। যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ অবস্থা থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় সহায়ক হতো। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তব চিত্র বলে দেয়-একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয় যেন আরেকটি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ অপরিহার্য করার জন্য, যা টেকসই উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে না।

অপরিকল্পিত উন্নয়নের মাশুল শুধু সড়ক অবকাঠামোতেই বিদ্যমান নয়। আমাদের সেচ, জ্বালানি, পরিবহন, কৃষি, পণ্য বণ্টন ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। নানান কারণে আমরা প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ধ্বংস করে ক্রমেই ভূগর্ভস্থ পানির টেকসই ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। অথচ, কীভাবে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভার বৃদ্ধি করে আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে, সেদিকে মনোযোগ নেই। টেকসই উন্নয়ন ও আগামী প্রজন্মের নিরাপত্তার স্বার্থে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের পাশাপাশি কৃত্রিম রিচার্জ কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ বাড়ানোতে মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে। এ ছাড়া, আগামী প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তায় মূল্যবান কৃষি জমি রক্ষায় এর ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। উর্বর পলিমাটি নষ্ট করে ইট তৈরি করার প্রতিযোগিতার লাঘাম টেনে ধরতে হবে। হাওরাঞ্চলে দৃশ্যমান উন্নয়নের অপদৃষ্টান্ত স্থাপনের মাশুল দিয়েছে সিলেট অঞ্চলের অকাল বন্যা। এখন অকাল বন্যার দৃশ্য দেখে দৃশ্যমান অপরিকল্পিত উন্নয়ন ভেঙে ফেলার আওয়াজ উঠছে। এই অপচয়ের ভার কেন জাতিকে বহন করতে হবে।

সম্পদের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধে এর ব্যবস্থাপনার দিকে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো এমনভাবে সাজাতে ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যেন সম্পদের অপচয়ের ভারে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঝুঁকিতে না পড়ে

করোনা-পরবর্তী ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি উপকরণের তীব্র সংকট বিশ্বের প্রতিটি দেশকে চরমভাবে ভোগাচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি সংকট ও ভোগ্যপণ্যের আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি প্রতিটি দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। যে সব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক, ওই সব দেশ এই সংকট অত্যন্ত মুন্সীয়ানার সঙ্গে সামাল দিতে পারলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাশ্রয়ী পন্থা অবলম্বন করে চলতে হচ্ছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুদিনে সাশ্রয়ী পন্থা অবলম্বন না করলে দুর্দিনে সাশ্রয়ী হওয়ার আবেদন কার্যকর হয় না। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বাস্তবচিত্র সেটিই নির্দেশ করে। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়াত্ব আর পাকিস্তানের ত্রাহি ত্রাহি ভাব দেখে বাংলাদেশ সরকারও এই সংকট মোকাবিলায় দেশের জনগণকে সাশ্রয়ী হবার আহ্বান জানিয়েছে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাসের পন্থা অবলম্বন করে লোডশেডিং ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছে। তবে যে সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি থেকে নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যে সাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গির অহরহ দৃৃষ্টান্ত নেই, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ ধরনের আবেদন যে বেশি একটা ফলপ্রসূ হবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারে বহুমাত্রিকতাও এসেছে, বেড়েছে গ্রাহক সংখ্যাও। আমরা যদি পূর্ব থেকে সতর্ক অবস্থায় সাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সংযমী হতে পারতাম, বিশেষ করে অঞ্চল ভেদে শিল্প অঞ্চল ব্যতীত প্রত্যেক এলাকায় দৈনিক অন্তত দুই ঘণ্টা লোডশেডিং চালু, শীতাতপযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ, অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা ও অনুষ্ঠান বর্জনের ন্যায় সাশ্রয়ী হতে পারতাম, তাহলে এই বৈশ্বিক সংকট মূহূর্তে জাতিকে অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঘুরপাক খেতে হতো না।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

প্রাণীর প্রতি সহমর্মিতা

র‌্যাগিং: শিক্ষাঙ্গনের ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক অমানবিকতার সংস্কৃতি

বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় হুমকির মুখে নগরের ভবিষ্যত

ঢাকায় তাল-নারকেল-সুপারির সবুজ সম্ভাবনা

শকুন বাঁচানো মানে ভবিষ্যৎ বাঁচানো

ছবি

এআই যুগে নিরাপত্তার সংকট : প্রযুক্তির অন্ধকার দিক

রাজধানীর নগর জীবন : ঝুঁকি, দূষণ ও মানুষের নিরাপত্তা

সরকারি স্বাস্থ্যসেবা : গ্রামীণ রোগীর পাশে আছে কি?

ছবি

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সাধারণ মানুষের নৈরাশ্যের কারণ

জিপিএ-৫ এবং শিক্ষার প্রকৃত মান

প্রবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা জরুরি

ছবি

এইচএসসি ফল : শিক্ষার বাস্তব চিত্র

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

টেকসই উন্নয়নে সাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গি

ইফতেখার নাজিম

শুক্রবার, ০৫ আগস্ট ২০২২

টেকসই উন্নয়ন হলো সেই উন্নয়ন, যা বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণে সক্ষমতার সঙ্গে আপোস না করে। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনায় ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এই লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ সাল চূড়ান্ত। জাতিসংঘের ১৭টি লক্ষ্যের প্রতিটির উদ্দেশ্য হলো বর্তমান প্রজন্মের জন্য উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলা। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়-বর্তমান প্রজন্মের জীবনাচারণের ওপর নির্ভর করে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎমান কেমন হবে।

আমাদের বুঝতে হবে প্রকৃতিতে সম্পদ সীমিত। তাই, সম্পদের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধে এর ব্যবস্থাপনার দিকে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো এমনভাবে সাজাতে ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যেন সম্পদের অপচয়ের ভারে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঝুঁকিতে না পড়ে। মনে রাখা প্রয়োজন, যেকোন দুর্বল পরিকল্পনা শুধু সম্পদের অপচয় ঘটায় না বরং মানুষের জীবনযাত্রার মানকে হ্রাস করে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাতীয় অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। প্রতিটি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দায়বদ্ধতা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে।

বাংলাদেশে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। যে উন্নয়নের সব উপকরণ অর্থাৎ রড, সিমেন্ট, পাথর, বিটুমিন, ইস্পাত, টাইলস, মার্বেল পাথর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যেখানে রাষ্ট্রকে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিতে হচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়িতে একদিকে যেমন উন্নয়নের সুফল জাতি পাচ্ছে না, তেমনি অপচয়ের বিশাল দায়ভার রাষ্ট্র ও জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। যেমন আসা যাক, ঢাকা শহরের উন্নয়ন চিত্রে। ঢাকা শহরে বছরজুড়ে সড়ক নির্মাণ, ফুটপাত উন্নয়ন, ড্রেন নির্মাণ, বৈদ্যুতিক, টেলিফোন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সাবলাইন নির্মাণ হচ্ছে।

তবে, উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমন্বিত রোডম্যাপ না থাকায় দেখা যায়-কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সিটি করপোরেশন যে সড়ক নির্মাণ করছে (যেখানে উকরণের মান ও সড়ক টেকসইয়ে বিষয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে) সেই সড়ক নির্মাণের কিছু দিন পর বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা সাবলাইনের জন্য সড়কটি কেটে ফেলছে। দেখা গেল বিদ্যুৎ সংস্থার কাটা সড়ক কয়েক দিন পর সিটি করপোরেশন জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করে দিল। তারপর ওই সড়ক কেটে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন লাইন তৈরি করছে ওয়াসা। এই ভাঙ্গা সড়ক কয়েক দিন পর আবার জোড়াতালি দিয়ে সিটি করপোরেশন মেরামত করল। এরপর আসে টেলিফোন সংস্থা। এভাবে ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে আমাদের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলতেই থাকে। অন্যদিকে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণের কারণে নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বেই সড়কগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে এবং জনভোগান্তি বাড়তে থাকে। আবার টেন্ডার হয়, চলতে থাকে ঠিকাদার প্রকৌশলীর কমিশন বাণিজ্য। এ ধরনের আত্মঘাতী উন্নয়নের দায়ভার চূড়ান্তভাবে পড়ে দেশের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

ঢাকার যানজট নিরসনে ৭ হাজার কোটি ব্যয়ে কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল বিদেশি কনসালট্যান্সি ফার্ম। এই উন্নয়ন যে কার্যকর হয়নি, সেটির জন্য দৃষ্টি দেয়া যাক সাতরাস্তা-মগবাজার-মালিবাগ-শান্তিনগর ফ্লাইওভারের দিকে। এই ফ্লাইওভার নির্মাণের পরও এখনো মৌচাক মগবাজার হয়ে সাতরাস্তার দিকে গমনকারী যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিগন্যাল যানজটে বসে থাকতে হয়। আবার রামপুরা হয়ে শান্তিনগর আসার ক্ষেত্রে অনুরূপ অবস্থা মোকাবিলা করতে হয় আবুল হোটেল ও বেইলি রোড সিগন্যালে। ফ্লাইওভার নির্মাণে র‌্যাম্পগুলো নিয়ে নামানো হলো আবুল হোটেল ও বেইলি রোডের ক্রসিংয়ের সামনে। অন্যদিকে মগবাজার থেকে সাতরাস্তার দিকে যাওয়ার জন্য পৃথক লুপ নির্মাণ করা হয়নি। তাহলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই উন্নয়নের সুফলটা কোথায়! অনুরূপভাবে বিআরটি লেন নির্মাণে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে, সেখানেও অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণের চড়া মাশুল দিতে হবে বিমানবন্দন-উত্তরাগামী যাত্রীদের। বর্তমান প্রজন্মের ভুল উন্নয়ন পরিকল্পনা মাশুল দিতে হবে আগামী প্রজন্মকে।

প্রায় ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতরাস্তা থেকে উত্তরা পর্যন্ত নির্মিত ইউলুপগুলোর কোন কোনটা ভেঙে ফেলা হয়েছে, আবার কোন কোনটি বাসস্ট্যান্ডের ভূমিকায় পতিত। এই ইউলুপ নির্মাণ করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী ফুটপাতগুলোকে নষ্ট করা হয়েছে। ফলে ছোট যাত্রাপথে পথচারী হাঁটতে পারছে না। অথচ, জ্বালানি ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য ছোটপথে হাঁটা বা সাইকেল চালানোতে অভ্যস্থ করা হলে একদিকে জ্বালানি সাশ্রয় হতো, অন্যদিকে স্বাস্থ্যের উন্নতি করার পাশাপাশি প্রকৃতি পরিবেশে কার্বন বৃদ্ধিজনিত বিরূপ প্রভাব হ্রাস পেত। যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ অবস্থা থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় সহায়ক হতো। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তব চিত্র বলে দেয়-একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয় যেন আরেকটি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ অপরিহার্য করার জন্য, যা টেকসই উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে না।

অপরিকল্পিত উন্নয়নের মাশুল শুধু সড়ক অবকাঠামোতেই বিদ্যমান নয়। আমাদের সেচ, জ্বালানি, পরিবহন, কৃষি, পণ্য বণ্টন ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। নানান কারণে আমরা প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ধ্বংস করে ক্রমেই ভূগর্ভস্থ পানির টেকসই ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। অথচ, কীভাবে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভার বৃদ্ধি করে আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে, সেদিকে মনোযোগ নেই। টেকসই উন্নয়ন ও আগামী প্রজন্মের নিরাপত্তার স্বার্থে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের পাশাপাশি কৃত্রিম রিচার্জ কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ বাড়ানোতে মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে। এ ছাড়া, আগামী প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তায় মূল্যবান কৃষি জমি রক্ষায় এর ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। উর্বর পলিমাটি নষ্ট করে ইট তৈরি করার প্রতিযোগিতার লাঘাম টেনে ধরতে হবে। হাওরাঞ্চলে দৃশ্যমান উন্নয়নের অপদৃষ্টান্ত স্থাপনের মাশুল দিয়েছে সিলেট অঞ্চলের অকাল বন্যা। এখন অকাল বন্যার দৃশ্য দেখে দৃশ্যমান অপরিকল্পিত উন্নয়ন ভেঙে ফেলার আওয়াজ উঠছে। এই অপচয়ের ভার কেন জাতিকে বহন করতে হবে।

সম্পদের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধে এর ব্যবস্থাপনার দিকে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো এমনভাবে সাজাতে ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যেন সম্পদের অপচয়ের ভারে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঝুঁকিতে না পড়ে

করোনা-পরবর্তী ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি উপকরণের তীব্র সংকট বিশ্বের প্রতিটি দেশকে চরমভাবে ভোগাচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি সংকট ও ভোগ্যপণ্যের আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি প্রতিটি দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। যে সব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক, ওই সব দেশ এই সংকট অত্যন্ত মুন্সীয়ানার সঙ্গে সামাল দিতে পারলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাশ্রয়ী পন্থা অবলম্বন করে চলতে হচ্ছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুদিনে সাশ্রয়ী পন্থা অবলম্বন না করলে দুর্দিনে সাশ্রয়ী হওয়ার আবেদন কার্যকর হয় না। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বাস্তবচিত্র সেটিই নির্দেশ করে। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়াত্ব আর পাকিস্তানের ত্রাহি ত্রাহি ভাব দেখে বাংলাদেশ সরকারও এই সংকট মোকাবিলায় দেশের জনগণকে সাশ্রয়ী হবার আহ্বান জানিয়েছে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাসের পন্থা অবলম্বন করে লোডশেডিং ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছে। তবে যে সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি থেকে নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যে সাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গির অহরহ দৃৃষ্টান্ত নেই, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ ধরনের আবেদন যে বেশি একটা ফলপ্রসূ হবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারে বহুমাত্রিকতাও এসেছে, বেড়েছে গ্রাহক সংখ্যাও। আমরা যদি পূর্ব থেকে সতর্ক অবস্থায় সাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সংযমী হতে পারতাম, বিশেষ করে অঞ্চল ভেদে শিল্প অঞ্চল ব্যতীত প্রত্যেক এলাকায় দৈনিক অন্তত দুই ঘণ্টা লোডশেডিং চালু, শীতাতপযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ, অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা ও অনুষ্ঠান বর্জনের ন্যায় সাশ্রয়ী হতে পারতাম, তাহলে এই বৈশ্বিক সংকট মূহূর্তে জাতিকে অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঘুরপাক খেতে হতো না।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top