alt

opinion » post-editorial

সাক্ষাৎকার

বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার চামড়া রপ্তানি করা সম্ভব

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান

: রোববার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
image

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান

বিশ্বে চামড়ার বাজারের বর্তমান আকার হচ্ছে ২৪০ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া রপ্তানি করেছে মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কাঁচামালের পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ জোগান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রপ্তানিতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছে না। কারণ, চামড়ার আন্তর্জাতিক মানে ঘাটতি। দেশের শুধু দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে (কুয়েট) চামড়াশিল্প সম্পর্কিত ‘লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং’ ডিসপ্লিনে পড়ার সুযোগ রয়েছে। দেশে চামড়া খাতের সম্ভাবনা, সংকট এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের নানা বিষয় নিয়ে সংবাদের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সংবাদ-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি খালেদ মাহমুদ

সংবাদ : বাংলাদেশে চামড়া খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেমন?

মিজানুর রহমান : ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। পোশাক খাতে আমাদের এই অভাবনীয় সাফল্যের কারণ হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করা হয়। অথচ এ খাতের কাঁচামাল সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। অন্যদিকে, চামড়াশিল্পে সম্পূর্ণ ম্যাটেরিয়ালস আমাদের নিজস্ব। শুধু একটা সুষ্ঠু এবং সমন্বিত পরিকল্পনা হলেই আমরা বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারব।

সংবাদ : বাংলাদেশের চামড়া খাতের সংকটটি কোথায়?

মিজানুর রহমান : যে কোন বাণিজ্যে ক্রেতার চাহিদা হচ্ছে মূল বিষয়। বর্তমান পৃথিবী হচ্ছে একটা গ্রামের মতো। এখন আর দেশ বলতে কিছু নেই। কোন একটি অঞ্চল বা দেশে দূষণ হলে সারা পৃথিবীতে এর প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের চামড়ার যারা ক্রেতা যেমন ইউরোপের দেশগুলো পরিবেশ নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। তারা পরিবেশ দূষণ করে উন্নয়নের ঘোরবিরোধী। তারা কোন পণ্য কেনার আগে সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশবান্ধব সার্টিফিকেট আছে কি না, সেটি দেখে। বাংলাদেশে চামড়া ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং চামড়ার কঠিন বর্জ্য ম্যানেজম্যান্টের কোন ব্যবস্থা নেই। ট্যানারি শিল্পে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এগুলোর কোন ক্ষয় হয় না। মাটি এবং পানির মাধ্যমে বিভিন্ন উপায়ে এসব আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। আমাদের একমাত্র কারখানায় পূর্ণাঙ্গ ইটিপি ব্যবহার করা হয়। এ কারণেই আমাদের বেস্ট কোয়ালিটির চামড়া থাকা সত্ত্বেও আধুনিক প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব সনদের অভাবে আমরা এ শিল্পকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারছি না।

সংবাদ : চামড়াশিল্পের উন্নয়নে কি কি প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে?

মিজানুর রহমান : সবার আগে ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে ইটিপি স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। ৫ থেকে ৭টি ছোট ও মাঝারি ট্যানারির সমন্বয়ে ক্লাস্টার গঠন করে ইটিপি স্থাপন করলে ডিসচার্জ লাইন থেকে প্রাপ্ত তরল বর্জ্যের প্রাথমিক পরিশোধন করা সম্ভব হবে, যা সিইটিপিতে তরল বর্জ্য পরিশোধনের চাপ কমাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া বড় ট্যানারিগুলো তাদের নিজস্ব ইটিপি করতে হবে। চামড়ার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে, তা থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বায়োগ্যাস, বায়ো-এনার্জি, বায়ো ফার্টিলাইজার তৈরি করা সম্ভব।

চামড়ার কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপার উন্নত টেকনোলজি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই ইন্ডাস্ট্রি মালিকদের সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। তরল ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো নিশ্চিত হলে আস্তে আস্তে সোসাল কমপ্লায়েন্সও ডেভেপলপ হবে। লেভার ল, পরিবেশ ল এগুলো মানতে হবে। সব ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রির লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিওজি) সনদ অর্জন করতে হবে, যাতে ক্রেতারা আগ্রহী হয়। সর্বোপরি, সম্মিলিতভাবে একটা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সংবাদ : চামড়া খাতের উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন?

মিজানুর রহমান : সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। চামড়াশিল্প একটা বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। অথচ এটি বিসিকের অধীন পরিচালিত হচ্ছে। চামড়া খাতের জন্য একটা বিশেষায়িত অধিদপ্তর খোলা জরুরি। এর জন্য আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব করেছি। কিন্তু সেটি কেউ শুনছে না। চামড়ার কারখানাগুলো হাজারিবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সরকারের একটা সদিচ্ছা ছিল। কিন্তু যাদের সিইটিপি স্থাপনের কাজ দেয়া হয়েছে, তাদের যথাযথ কারিগরি জ্ঞান ও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষিত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। সেটা না করে সেখানে একটা কাস্টমাইজ টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। সেজন্য কোন ফল পাচ্ছি না। এ ছাড়া সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবদের আমরা এ খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অবগত করেছি। কিন্তু আমরা আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি না।

সংবাদ : লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েটরা এ শিল্পের উন্নতিতে কীভাবে অবদান রাখছে?

মিজানুর রহমান : এই ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের চামড়াশিল্প সম্পর্কিত একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে চামড়াশিল্পের তিনটি সাবসেক্টর যথা : ট্যানারি সেক্টর, ফুটওয়্যার সেক্টর এবং লেদার প্রোডাক্টস সেক্টরকে কেন্দ্র করে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং লেদার প্রোডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি প্রদান করা হয়। আমি ইনস্টিটিউটে যোগদান করার পর দেশের নামকরা বিষয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিশ্বমানের সর্বাধুনিক ও যুগোপযোগী সেমিস্টার পদ্ধতিতে দুটি নতুন বিষয়ের গবেষণানির্ভর মাস্টার্স পোগ্রামসহ (এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ইন ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং লেদার প্রোডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং) কারিকুলাম তৈরি করেছি। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, এই আধুনিক ও যুগোপযোগী কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হতে সহায়তা করবে ও চাকরির বাজারে তাদের অনেক চাহিদা সৃষ্টি হবে। এখানকার গ্র্যাজুয়েটরা দেশ-বিদেশে বাটাসহ অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বড় বড় পদে নিয়োজিত আছে। কিন্তু ট্যানারিগুলোতে যেহেতু চামড়া খাতের মালিকরা তেমন লাভ করতে পারছে না। তাই তারা শ্রমিক দিয়েই কম মজুরিতে টেকনিক্যাল কাজও সেরে নেয়। তাই আমাদের এখানকার যে দক্ষ লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গ্র্যাজুয়েটরা বের হচ্ছে তাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত এখান থেকে বের হওয়া দক্ষ গ্র্যাজুয়েটরা এ খাতে না আসবে, তত দিন এ শিল্পের উন্নতি হবে না। এ জন্য আগে যথাযথ বেতন আর কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

সংবাদ : চামড়াশিল্পের উন্নয়নে এ ইনস্টিটিউটে কোন প্রজেক্ট চলমান আছে কি না?

মিজানুর রহমান : আমরা ট্যানারি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গ্রিন টেকনোনোলোজি ও এডাপশন নিয়ে কাজ করছি। ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার ও পলিউশন কীভাবে কমানো যায়, সেটি নিয়েও আমার কয়েকটা প্রজেক্ট চলমান আছে। আমার তত্ত্বাবধানে গবেষণা টিম ইতোমধ্যে ট্যানিংয়ের আগের কাজটি অর্থাৎ প্রি-ট্যানিং অপারেশন এনজাইম দিয়ে সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ ছাড়া আমি ট্যানিং অপারেশন কীভাবে এনজাইম দিয়ে করা যায়, সেটি নিয়েও কাজ করছি। আশা করি আগামী দুই-এক বছরের মধ্যেই আমরা ভালো ফলাফল পাব। এ ছাড়া ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আমাদের কোলাবোরেশান হচ্ছে, তারা আমাদের এখানে এসে জব ফেয়ার করছে।

সংবাদ : ইনস্টিটিউট পরিচালনায় কোন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন কি না?

মিজানুর রহমান : আমাদের চাহিদার তুলনায় খুব কম বাজেট দেয়া হচ্ছে। এখানকার যন্ত্রপাতিগুলোর অনেক দাম। একেকটা মেশিনের দাম কোটি কোটি টাকা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়েরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই ইউজিসির কাছে আমরা ১০ কোটি টাকার একটা বাজেট চেয়েছি। সেটির কোন সাড়া এখনো পর্যন্ত পাইনি।

সংবাদ : আপনাকে ধন্যবাদ।

মিজানুর রহমান : সংবাদের জন্য শুভকামনা।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

রম্যগদ্য: শিক্ষা সহজ, বিদ্যা কঠিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর অধিকার: বিসিএস ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য

ন্যাশনাল গ্যালারি : রঙতুলির মহাসমুদ্রে একদিন

যুব শক্তি বনাম বেকারত্ব

প্রযুক্তি, আর্থিক পরিকল্পনা ও গণিতের ব্যবহার

ফরাসি বিপ্লব: বৈষম্য নিরসনে সামগ্রিক মুক্তির প্রেরণা

অন্তর্বর্তী সরকারের নিউইয়র্ক সফর

প্রবীণদের যত্ন: নৈতিক দায়িত্ব থেকে সামাজিক শক্তি নির্মাণ

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের অপরিহার্যতা

জনমিতিক সুবিধা: স্বপ্নের দশক ও নীতিগত সংস্কারের অপরিহার্যতা

বিদ্যালয় ও মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগ্রাম

শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

ভারতে এসআইআর বিতর্ক

tab

opinion » post-editorial

সাক্ষাৎকার

বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার চামড়া রপ্তানি করা সম্ভব

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান

image

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান

রোববার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

বিশ্বে চামড়ার বাজারের বর্তমান আকার হচ্ছে ২৪০ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া রপ্তানি করেছে মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কাঁচামালের পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ জোগান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রপ্তানিতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছে না। কারণ, চামড়ার আন্তর্জাতিক মানে ঘাটতি। দেশের শুধু দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে (কুয়েট) চামড়াশিল্প সম্পর্কিত ‘লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং’ ডিসপ্লিনে পড়ার সুযোগ রয়েছে। দেশে চামড়া খাতের সম্ভাবনা, সংকট এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের নানা বিষয় নিয়ে সংবাদের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সংবাদ-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি খালেদ মাহমুদ

সংবাদ : বাংলাদেশে চামড়া খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেমন?

মিজানুর রহমান : ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। পোশাক খাতে আমাদের এই অভাবনীয় সাফল্যের কারণ হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করা হয়। অথচ এ খাতের কাঁচামাল সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। অন্যদিকে, চামড়াশিল্পে সম্পূর্ণ ম্যাটেরিয়ালস আমাদের নিজস্ব। শুধু একটা সুষ্ঠু এবং সমন্বিত পরিকল্পনা হলেই আমরা বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারব।

সংবাদ : বাংলাদেশের চামড়া খাতের সংকটটি কোথায়?

মিজানুর রহমান : যে কোন বাণিজ্যে ক্রেতার চাহিদা হচ্ছে মূল বিষয়। বর্তমান পৃথিবী হচ্ছে একটা গ্রামের মতো। এখন আর দেশ বলতে কিছু নেই। কোন একটি অঞ্চল বা দেশে দূষণ হলে সারা পৃথিবীতে এর প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের চামড়ার যারা ক্রেতা যেমন ইউরোপের দেশগুলো পরিবেশ নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। তারা পরিবেশ দূষণ করে উন্নয়নের ঘোরবিরোধী। তারা কোন পণ্য কেনার আগে সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশবান্ধব সার্টিফিকেট আছে কি না, সেটি দেখে। বাংলাদেশে চামড়া ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং চামড়ার কঠিন বর্জ্য ম্যানেজম্যান্টের কোন ব্যবস্থা নেই। ট্যানারি শিল্পে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এগুলোর কোন ক্ষয় হয় না। মাটি এবং পানির মাধ্যমে বিভিন্ন উপায়ে এসব আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। আমাদের একমাত্র কারখানায় পূর্ণাঙ্গ ইটিপি ব্যবহার করা হয়। এ কারণেই আমাদের বেস্ট কোয়ালিটির চামড়া থাকা সত্ত্বেও আধুনিক প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব সনদের অভাবে আমরা এ শিল্পকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারছি না।

সংবাদ : চামড়াশিল্পের উন্নয়নে কি কি প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে?

মিজানুর রহমান : সবার আগে ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে ইটিপি স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। ৫ থেকে ৭টি ছোট ও মাঝারি ট্যানারির সমন্বয়ে ক্লাস্টার গঠন করে ইটিপি স্থাপন করলে ডিসচার্জ লাইন থেকে প্রাপ্ত তরল বর্জ্যের প্রাথমিক পরিশোধন করা সম্ভব হবে, যা সিইটিপিতে তরল বর্জ্য পরিশোধনের চাপ কমাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া বড় ট্যানারিগুলো তাদের নিজস্ব ইটিপি করতে হবে। চামড়ার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে, তা থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বায়োগ্যাস, বায়ো-এনার্জি, বায়ো ফার্টিলাইজার তৈরি করা সম্ভব।

চামড়ার কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপার উন্নত টেকনোলজি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই ইন্ডাস্ট্রি মালিকদের সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। তরল ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো নিশ্চিত হলে আস্তে আস্তে সোসাল কমপ্লায়েন্সও ডেভেপলপ হবে। লেভার ল, পরিবেশ ল এগুলো মানতে হবে। সব ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রির লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিওজি) সনদ অর্জন করতে হবে, যাতে ক্রেতারা আগ্রহী হয়। সর্বোপরি, সম্মিলিতভাবে একটা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সংবাদ : চামড়া খাতের উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন?

মিজানুর রহমান : সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। চামড়াশিল্প একটা বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। অথচ এটি বিসিকের অধীন পরিচালিত হচ্ছে। চামড়া খাতের জন্য একটা বিশেষায়িত অধিদপ্তর খোলা জরুরি। এর জন্য আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব করেছি। কিন্তু সেটি কেউ শুনছে না। চামড়ার কারখানাগুলো হাজারিবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সরকারের একটা সদিচ্ছা ছিল। কিন্তু যাদের সিইটিপি স্থাপনের কাজ দেয়া হয়েছে, তাদের যথাযথ কারিগরি জ্ঞান ও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষিত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। সেটা না করে সেখানে একটা কাস্টমাইজ টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। সেজন্য কোন ফল পাচ্ছি না। এ ছাড়া সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবদের আমরা এ খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অবগত করেছি। কিন্তু আমরা আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি না।

সংবাদ : লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েটরা এ শিল্পের উন্নতিতে কীভাবে অবদান রাখছে?

মিজানুর রহমান : এই ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের চামড়াশিল্প সম্পর্কিত একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে চামড়াশিল্পের তিনটি সাবসেক্টর যথা : ট্যানারি সেক্টর, ফুটওয়্যার সেক্টর এবং লেদার প্রোডাক্টস সেক্টরকে কেন্দ্র করে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং লেদার প্রোডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি প্রদান করা হয়। আমি ইনস্টিটিউটে যোগদান করার পর দেশের নামকরা বিষয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিশ্বমানের সর্বাধুনিক ও যুগোপযোগী সেমিস্টার পদ্ধতিতে দুটি নতুন বিষয়ের গবেষণানির্ভর মাস্টার্স পোগ্রামসহ (এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ইন ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং লেদার প্রোডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং) কারিকুলাম তৈরি করেছি। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, এই আধুনিক ও যুগোপযোগী কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হতে সহায়তা করবে ও চাকরির বাজারে তাদের অনেক চাহিদা সৃষ্টি হবে। এখানকার গ্র্যাজুয়েটরা দেশ-বিদেশে বাটাসহ অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বড় বড় পদে নিয়োজিত আছে। কিন্তু ট্যানারিগুলোতে যেহেতু চামড়া খাতের মালিকরা তেমন লাভ করতে পারছে না। তাই তারা শ্রমিক দিয়েই কম মজুরিতে টেকনিক্যাল কাজও সেরে নেয়। তাই আমাদের এখানকার যে দক্ষ লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গ্র্যাজুয়েটরা বের হচ্ছে তাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত এখান থেকে বের হওয়া দক্ষ গ্র্যাজুয়েটরা এ খাতে না আসবে, তত দিন এ শিল্পের উন্নতি হবে না। এ জন্য আগে যথাযথ বেতন আর কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

সংবাদ : চামড়াশিল্পের উন্নয়নে এ ইনস্টিটিউটে কোন প্রজেক্ট চলমান আছে কি না?

মিজানুর রহমান : আমরা ট্যানারি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গ্রিন টেকনোনোলোজি ও এডাপশন নিয়ে কাজ করছি। ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার ও পলিউশন কীভাবে কমানো যায়, সেটি নিয়েও আমার কয়েকটা প্রজেক্ট চলমান আছে। আমার তত্ত্বাবধানে গবেষণা টিম ইতোমধ্যে ট্যানিংয়ের আগের কাজটি অর্থাৎ প্রি-ট্যানিং অপারেশন এনজাইম দিয়ে সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ ছাড়া আমি ট্যানিং অপারেশন কীভাবে এনজাইম দিয়ে করা যায়, সেটি নিয়েও কাজ করছি। আশা করি আগামী দুই-এক বছরের মধ্যেই আমরা ভালো ফলাফল পাব। এ ছাড়া ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আমাদের কোলাবোরেশান হচ্ছে, তারা আমাদের এখানে এসে জব ফেয়ার করছে।

সংবাদ : ইনস্টিটিউট পরিচালনায় কোন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন কি না?

মিজানুর রহমান : আমাদের চাহিদার তুলনায় খুব কম বাজেট দেয়া হচ্ছে। এখানকার যন্ত্রপাতিগুলোর অনেক দাম। একেকটা মেশিনের দাম কোটি কোটি টাকা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়েরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই ইউজিসির কাছে আমরা ১০ কোটি টাকার একটা বাজেট চেয়েছি। সেটির কোন সাড়া এখনো পর্যন্ত পাইনি।

সংবাদ : আপনাকে ধন্যবাদ।

মিজানুর রহমান : সংবাদের জন্য শুভকামনা।

back to top