alt

উপ-সম্পাদকীয়

আঞ্চলিক যোগাযোগের গুরুত্ব

রেজাউল করিম খোকন

: সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে যে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল- সেটিই নতুন অবয়বে আবার ফিরে এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্য শেষ হওয়া নয়াদিল্লি সফরে। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বে থাকা রাজ্যগুলোর সঙ্গে বর্ধিত বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ শুধুমাত্র উত্তর-পূর্বের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে না; বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে।

ভারতের উত্তর-পূর্বে সাতটি রাজ্য রয়েছে। এগুলোকে বলা হয় ‘সেভেন সিস্টার্স’। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন সাত রাজ্যের সঙ্গে ‘সিকিম’কে জুড়ে দিয়ে আট রাজ্যকে একসঙ্গে মিলিয়ে ‘অষ্টলক্ষী’ নামে অভিহিত করেছেন। সেভেন সিস্টার্সে থাকা ভারতের রাজ্যগুলো হচ্ছে- আসাম, মনিপুর, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল। বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও কুড়িগ্রাম অঞ্চল সীমান্তে এসব রাজ্যের অবস্থান।

২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে তার সফরসঙ্গী হিসেবে উত্তর-পূর্বের চারটি সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীরা ছিলেন। ওই রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের ঢাকায় উপস্থিতি তখন দুই দেশের সম্পর্কে আলাদা মাত্রা এনেছিল। সেই সফরের ১১ বছর পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লি সফরে গিয়ে প্রতিবেশী সাত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে এই রাজ্যগুলোর সংযোগসহ নানা ইস্যুতে ক্ষেত্র বাড়াতে পারলে দুই পক্ষেই বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক জাগরণের সম্ভাবনা রয়েছে। দুই অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হলে, চা শিল্প ছাড়া বেশকিছু খনিজ পদার্থ, সিমেন্ট, প্লাস্টিক পণ্য, বাঁশ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পর্যটন ও পরিষেবার ক্ষেত্রে সুবিধা বাড়বে।

ভারতের ওই রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়ন লাভজনক। বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স ফর টেরোরিজম নীতির ফলেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যবসা ও বিনিয়োগের। নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে উঠছে। এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ও বাংলাদেশ ‘নট এ হাব অব টেরোরিস্ট’ ঘোষণার পর থেকেই। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে ভারতের উত্তর-পূর্বের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু এরপর দেশটিতে সরকার পরিবর্তন হওয়ায় ওই আলোচনাটির আর ফলোআপ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরে বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে এবং তা বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়েছে। এছাড়া ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপিও চায়, উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি বাস্তবায়ন হলে দুই পক্ষেরই লাভ হবে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে; কিন্তু তা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যোগাযোগের ঘাটতি। তবে সমস্যা দূর করতে বাংলাদেশ কানেক্টিভিটিতে গুরুত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরকালে সেই বাধাগুলো দূর করার বিষয়ে আলোচনা হয়। ভারত সরকার আন্তরিকভাবেই বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী। সীমান্ত হাট চালুরও প্রস্তাব করা হয়েছে। ভারতের পাঁচ সীমান্তবর্তী রাজ্যের সঙ্গে কথা বলে দুই দেশের মোট ৭০টি স্থান সীমান্ত হাটের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি স্থলবন্দরে বাধা দূর করার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। আগরতলা-আখাউড়া রেললাইন নির্মাণ ও সংলগ্ন সমন্বিত চেকপোস্ট প্রকল্পটি তৈরি হলেও বাংলাদেশের দিকে কাজে ধীরগতির কারণে প্রকল্পটি শেষ হচ্ছে না। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে গোটা এলাকার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল চা চাষে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহুলাংশে বাড়লে দুই দেশই তাতে উপকৃত হবে। চা ছাড়া বেশকিছু খনিজ পদার্থ, সিমেন্ট, প্লাস্টিক পণ্য, বাঁশ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পর্যটন ও পরিষেবার ক্ষেত্র রয়েছে। তবে সমস্যা দূর করতে বাংলাদেশ কানেক্টিভিটিতে গুরুত্ব দেয়। কানেক্টিভিটি, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য, পারস্পরিক আস্থার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের ভালো স্বার্থ নিশ্চিত হবে। লাভবান হবে দুই পক্ষই। ভারতের বহুল আলোচিত ‘লুক ইস্ট’ নীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। তবে উত্তর-পূর্বের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বছর দুয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্দরটিকে ভারত ব্যবহার করতে পারবে জানালেও দেশটি এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে তা শুরু করেনি।

বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্বে ভারতের মধ্যে বহু বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা সফরে আসা উত্তর-পূর্বের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীরা সরকার, ব্যবসায়ী এবং সুশীল সমাজের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সংযোগ বাড়াতে চেয়েছিলেন। তারা যৌথ উদ্যোগের শিল্প প্রকল্প এবং পর্যটন প্রচারের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। এমন প্রস্তাবের পর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কাজও করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু কাজগুলোর আর বাস্তবায়ন হয়নি। এখন আবার সেটি নিয়ে পুরোদমে আলোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সম্পদ ব্যবহার করতে, সার কারখানার মতো কৃষিভিত্তিক শিল্প এবং গ্যাসভিত্তিক ইউনিট স্থাপন করতে পারেন। পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতে ত্রিপুরায় বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশের একটি সম্ভাব্য কেন্দ্র হতে পারে। এছাড়া কম পরিবহন খরচের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাওয়া যাবে। সড়ক পথে কানেক্টিভিটির পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে নৌপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকেও কাজে লাগাতে হবে।

দুই দেশের ট্রানজিট ফি ও অন্যান্য চার্জসমূহ নির্ধারণ করে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা শুরু করা যেতে পারে। নৌপথে কানেক্টিভিটির প্রসার ঘটলে দুই দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার হবে। একসঙ্গে যদি সড়কপথ, রেলপথ এবং নৌপথের কানেক্টিভিটি চালু থাকে, তাহলে বাংলাদেশ অনেক দিক দিয়ে লাভবান হবে। দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা বাণিজ্যে যে ঘাটতি বিদ্যমান রয়েছে তা ঘুচে যেতে পারে কানেক্টিভিটি জোরদার করার মাধ্যমে। নৌপথে এতদাঞ্চলের দেশগুলোর ব্যবসা বাণিজ্যের নতুন নতুন রুট চালু করা যেতে পারে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে; কিন্তু তা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যোগাযোগের ঘাটতি

দুই দেশের মধ্যে বাস সার্ভিস চালুর মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ বাড়লেও অধিক সুবিধা ভোগ করছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। এতদিন তাদের দীর্ঘ ঘুরপথে কলকাতা বা ভারতের অন্যান্য জায়গায় যেতে হতো। এখন তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সেসব জায়গায় যেতে পারছে। অন্যদিকে ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ বাংলাদেশে বেড়াতে আসছেন। এতে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প লাভবান হবে। কোস্টাল শিপিং বা উপকূলীয় পরিবহন দুই দেশের জন্যই লাভজনক হবে। কারণ এটা কার্যকর হলে উভয় দেশের আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের পরিবহন ব্যয় কমবে।

কানেক্টিভিটি বাড়ালে ব্যবসা বাণিজ্যের খরচ আপনা-আপনি কমে আসবে। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে স্বাভাবিকভাবে। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৯০ ভাগই হয় স্থলপথে। উপকূলীয় বাণিজ্য শুরু হলে সমুদ্রপথে বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ তৈরি হবে। ভারত কিংবা এ অঞ্চলের সঙ্গে ‘কানেক্টিভিটি’ প্রশ্নে বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেই কানেক্টিভিটি কার্যক্রম সীমাবদ্ধ না রেখে ভুটান ও নেপালের সঙ্গেও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। কারণ ভুটান ও নেপালে বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রীর বিশাল বাজার গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। কানেক্টিভিটির মাধ্যমে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব। এছাড়া মায়ানমারের সঙ্গেও কানেক্টিভিটি গড়ে তোলার মাধ্যমে দুই দেশের বিদ্যমান বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ অনেকগুণ বাড়ানো যেতে পারে।

এ অঞ্চলে ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সুবিধাজনক। ভূমিবেষ্টিত দেশ নেপাল ও ভুটানকে সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। একইভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। তবে এর মাশুল আদায়ের ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যয় ছাড়াও অবকাঠামো ও পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

অন্যদিকে, ভারতের একাংশ থেকে অন্য অংশে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে তাদের যে আর্থিক সাশ্রয় হবে, তার একটি অংশও বাংলাদেশ পাওয়ার দাবি রাখে। ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট বা কানেক্টিভিটি বা সংযোগের সুবিধা যাতে এ অঞ্চলের সব দেশ ও সব মানুষ সমভাবে পায়, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোকেই। বাংলাদেশের সড়ক, সমুদ্র, রেল ও নৌপথে অন্য দেশের যানবাহন যে শর্তে চলাচল করবে, সেই শর্তে অন্য দেশেও বাংলাদেশের যানবাহনের চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আঞ্চলিক যোগাযোগের গুরুত্ব

রেজাউল করিম খোকন

সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে যে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল- সেটিই নতুন অবয়বে আবার ফিরে এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্য শেষ হওয়া নয়াদিল্লি সফরে। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বে থাকা রাজ্যগুলোর সঙ্গে বর্ধিত বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ শুধুমাত্র উত্তর-পূর্বের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে না; বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে।

ভারতের উত্তর-পূর্বে সাতটি রাজ্য রয়েছে। এগুলোকে বলা হয় ‘সেভেন সিস্টার্স’। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন সাত রাজ্যের সঙ্গে ‘সিকিম’কে জুড়ে দিয়ে আট রাজ্যকে একসঙ্গে মিলিয়ে ‘অষ্টলক্ষী’ নামে অভিহিত করেছেন। সেভেন সিস্টার্সে থাকা ভারতের রাজ্যগুলো হচ্ছে- আসাম, মনিপুর, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল। বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও কুড়িগ্রাম অঞ্চল সীমান্তে এসব রাজ্যের অবস্থান।

২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে তার সফরসঙ্গী হিসেবে উত্তর-পূর্বের চারটি সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীরা ছিলেন। ওই রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের ঢাকায় উপস্থিতি তখন দুই দেশের সম্পর্কে আলাদা মাত্রা এনেছিল। সেই সফরের ১১ বছর পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লি সফরে গিয়ে প্রতিবেশী সাত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে এই রাজ্যগুলোর সংযোগসহ নানা ইস্যুতে ক্ষেত্র বাড়াতে পারলে দুই পক্ষেই বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক জাগরণের সম্ভাবনা রয়েছে। দুই অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হলে, চা শিল্প ছাড়া বেশকিছু খনিজ পদার্থ, সিমেন্ট, প্লাস্টিক পণ্য, বাঁশ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পর্যটন ও পরিষেবার ক্ষেত্রে সুবিধা বাড়বে।

ভারতের ওই রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়ন লাভজনক। বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স ফর টেরোরিজম নীতির ফলেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যবসা ও বিনিয়োগের। নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে উঠছে। এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ও বাংলাদেশ ‘নট এ হাব অব টেরোরিস্ট’ ঘোষণার পর থেকেই। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে ভারতের উত্তর-পূর্বের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু এরপর দেশটিতে সরকার পরিবর্তন হওয়ায় ওই আলোচনাটির আর ফলোআপ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরে বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে এবং তা বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়েছে। এছাড়া ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপিও চায়, উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি বাস্তবায়ন হলে দুই পক্ষেরই লাভ হবে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে; কিন্তু তা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যোগাযোগের ঘাটতি। তবে সমস্যা দূর করতে বাংলাদেশ কানেক্টিভিটিতে গুরুত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরকালে সেই বাধাগুলো দূর করার বিষয়ে আলোচনা হয়। ভারত সরকার আন্তরিকভাবেই বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী। সীমান্ত হাট চালুরও প্রস্তাব করা হয়েছে। ভারতের পাঁচ সীমান্তবর্তী রাজ্যের সঙ্গে কথা বলে দুই দেশের মোট ৭০টি স্থান সীমান্ত হাটের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি স্থলবন্দরে বাধা দূর করার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। আগরতলা-আখাউড়া রেললাইন নির্মাণ ও সংলগ্ন সমন্বিত চেকপোস্ট প্রকল্পটি তৈরি হলেও বাংলাদেশের দিকে কাজে ধীরগতির কারণে প্রকল্পটি শেষ হচ্ছে না। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে গোটা এলাকার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল চা চাষে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহুলাংশে বাড়লে দুই দেশই তাতে উপকৃত হবে। চা ছাড়া বেশকিছু খনিজ পদার্থ, সিমেন্ট, প্লাস্টিক পণ্য, বাঁশ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পর্যটন ও পরিষেবার ক্ষেত্র রয়েছে। তবে সমস্যা দূর করতে বাংলাদেশ কানেক্টিভিটিতে গুরুত্ব দেয়। কানেক্টিভিটি, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য, পারস্পরিক আস্থার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের ভালো স্বার্থ নিশ্চিত হবে। লাভবান হবে দুই পক্ষই। ভারতের বহুল আলোচিত ‘লুক ইস্ট’ নীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। তবে উত্তর-পূর্বের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বছর দুয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্দরটিকে ভারত ব্যবহার করতে পারবে জানালেও দেশটি এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে তা শুরু করেনি।

বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্বে ভারতের মধ্যে বহু বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা সফরে আসা উত্তর-পূর্বের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীরা সরকার, ব্যবসায়ী এবং সুশীল সমাজের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সংযোগ বাড়াতে চেয়েছিলেন। তারা যৌথ উদ্যোগের শিল্প প্রকল্প এবং পর্যটন প্রচারের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। এমন প্রস্তাবের পর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কাজও করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু কাজগুলোর আর বাস্তবায়ন হয়নি। এখন আবার সেটি নিয়ে পুরোদমে আলোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সম্পদ ব্যবহার করতে, সার কারখানার মতো কৃষিভিত্তিক শিল্প এবং গ্যাসভিত্তিক ইউনিট স্থাপন করতে পারেন। পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতে ত্রিপুরায় বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশের একটি সম্ভাব্য কেন্দ্র হতে পারে। এছাড়া কম পরিবহন খরচের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাওয়া যাবে। সড়ক পথে কানেক্টিভিটির পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে নৌপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকেও কাজে লাগাতে হবে।

দুই দেশের ট্রানজিট ফি ও অন্যান্য চার্জসমূহ নির্ধারণ করে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা শুরু করা যেতে পারে। নৌপথে কানেক্টিভিটির প্রসার ঘটলে দুই দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার হবে। একসঙ্গে যদি সড়কপথ, রেলপথ এবং নৌপথের কানেক্টিভিটি চালু থাকে, তাহলে বাংলাদেশ অনেক দিক দিয়ে লাভবান হবে। দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা বাণিজ্যে যে ঘাটতি বিদ্যমান রয়েছে তা ঘুচে যেতে পারে কানেক্টিভিটি জোরদার করার মাধ্যমে। নৌপথে এতদাঞ্চলের দেশগুলোর ব্যবসা বাণিজ্যের নতুন নতুন রুট চালু করা যেতে পারে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে; কিন্তু তা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যোগাযোগের ঘাটতি

দুই দেশের মধ্যে বাস সার্ভিস চালুর মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ বাড়লেও অধিক সুবিধা ভোগ করছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। এতদিন তাদের দীর্ঘ ঘুরপথে কলকাতা বা ভারতের অন্যান্য জায়গায় যেতে হতো। এখন তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সেসব জায়গায় যেতে পারছে। অন্যদিকে ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ বাংলাদেশে বেড়াতে আসছেন। এতে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প লাভবান হবে। কোস্টাল শিপিং বা উপকূলীয় পরিবহন দুই দেশের জন্যই লাভজনক হবে। কারণ এটা কার্যকর হলে উভয় দেশের আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের পরিবহন ব্যয় কমবে।

কানেক্টিভিটি বাড়ালে ব্যবসা বাণিজ্যের খরচ আপনা-আপনি কমে আসবে। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে স্বাভাবিকভাবে। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৯০ ভাগই হয় স্থলপথে। উপকূলীয় বাণিজ্য শুরু হলে সমুদ্রপথে বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ তৈরি হবে। ভারত কিংবা এ অঞ্চলের সঙ্গে ‘কানেক্টিভিটি’ প্রশ্নে বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেই কানেক্টিভিটি কার্যক্রম সীমাবদ্ধ না রেখে ভুটান ও নেপালের সঙ্গেও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। কারণ ভুটান ও নেপালে বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রীর বিশাল বাজার গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। কানেক্টিভিটির মাধ্যমে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব। এছাড়া মায়ানমারের সঙ্গেও কানেক্টিভিটি গড়ে তোলার মাধ্যমে দুই দেশের বিদ্যমান বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ অনেকগুণ বাড়ানো যেতে পারে।

এ অঞ্চলে ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সুবিধাজনক। ভূমিবেষ্টিত দেশ নেপাল ও ভুটানকে সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। একইভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। তবে এর মাশুল আদায়ের ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যয় ছাড়াও অবকাঠামো ও পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

অন্যদিকে, ভারতের একাংশ থেকে অন্য অংশে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে তাদের যে আর্থিক সাশ্রয় হবে, তার একটি অংশও বাংলাদেশ পাওয়ার দাবি রাখে। ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট বা কানেক্টিভিটি বা সংযোগের সুবিধা যাতে এ অঞ্চলের সব দেশ ও সব মানুষ সমভাবে পায়, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোকেই। বাংলাদেশের সড়ক, সমুদ্র, রেল ও নৌপথে অন্য দেশের যানবাহন যে শর্তে চলাচল করবে, সেই শর্তে অন্য দেশেও বাংলাদেশের যানবাহনের চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top