alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে

মতিউর রহমান

: বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

জাতিসংঘের হাঙ্গার রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্ষুধা সেই সময়কালকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য ব্যবহৃত শব্দ যখন জনসংখ্যা গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়- অর্থাৎ অর্থের অভাবে খাদ্যে প্রবেশাধিকারের অভাব বা অন্যান্য অবস্থার কারণে তারা না খেয়ে থাকে।

জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যাকে খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণের বেশি খাদ্য উৎপাদিত হয় কিন্তু মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ এখনো ক্ষুধার্ত। জাতিসংঘ বলছে গত এক দশক ধরে ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার পর, বিশ্বব্যাপী ক্ষুর্ধাত মানুষের সংখ্যা আবারও বাড়ছে। আর ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ার পেছনে মূলত তিনটি সংকট কাজ করছে-তাহল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারী।

বিশ্বব্যাংকের ‘বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০২১” অনুযায়ী বিশ্বের জনসংখ্যা এখন প্রায় ৭.৮৭ বিলিয়ন বা প্রায় ৭৮৭ কোটি ৫০ লাখ। অপর দিকে ওয়ার্ল্ডোমিটার্সের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৭.৯৭ বিলিয়ন বা প্রায় ৮০০ কোটি।

সাম্প্রতিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যে বাড়িয়ে দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না

সম্প্রতি প্রকাশিত “বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি অবস্থা” রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। প্রায় ২.৩ বিলিয়ন মানুষ পর্যাপ্ত পরিমাণে, মাঝারি বা গুরুতর খাদ্য প্রাপ্তি সমস্যার সম্মুখীন। গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন প্রায় ৯২৪ মিলিয়ন মানুষ।

জাতিসংঘের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সতর্ক করেছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য, জ্বালানি এবং সারের দাম বৃদ্ধি সারা বিশ্বের দেশগুলোকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেয়ার অবস্থা সৃষ্টি করেছে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন “বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা, অনাহার এবং ব্যাপক অভিবাসন একটি নজিরবিহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।”

জাতিসংঘের ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’-এর প্রধান ডেভিড বিসলে বলেছেন, সর্বশেষ বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে ‘রেকর্ড ৩৪৫ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষ তীব্র অনাহারের দ্বারপ্রান্তে’। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার আগে এই সংখ্যা ছিল ২৭৬ মিলিয়ন। বর্তমানে যা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ২০২০ সালের গোড়ার দিকে অর্থাৎ করোনা মহামারী শুরুর আগে এই সংখ্যা ছিল ১৩৫ মিলিয়ন।

ডেভিড বিসলে আরও উল্লেখ করেছেন “এটি একটি সত্যিকারের বিপদ। কারণ সামনের মাসগুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। তিনি উল্লেখ করেছেন বিশ্বের ৪৫টি দেশের ৫০ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে অবস্থান করছে।”

গত মার্চে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২১’ উল্লেখ করে, করোনা মহামারীর প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্তের হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে-২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১১ কোটি ৮০ লাখ; শতকরা হিসাবে এ বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ।

বাংলাদেশে সরকারিভাবে কোনো তথ্য প্রকাশ করা না হলেও ২০২০ ও ২০২১ প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বেসরকারি গবেষণার ফলাফল দেখায় যে, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে দারিদ্র্য হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। এ হার দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। এসব দরিদ্র মানুষের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে পরিসংখ্যান যাই বলুক অবস্থা যে ভয়াবহ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সাম্প্রতিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যে বাড়িয়ে দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক নিম্ন ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে সেসব দেশে যাদের দুর্বল মুদ্রা এবং খাদ্য আমদানির ওপর উচ্চ নির্ভরশীলতা, যেখানে সীমান্ত বন্ধ, সংঘর্ষ বা নিরাপত্তাহীনতা বাণিজ্য প্রবাহকে ব্যাহত করেছে এবং যেখানে আবহাওয়া চরমভাবে খাদ্য উৎপাদন বা প্রাপ্যতা হ্রাস করেছে।

এই সামষ্টিক অর্থনৈতিক কারণগুলো সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের ক্রয়ক্ষমতার ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলেছে। উপরোন্থ করোনা মহামারী-সম্পর্কিত বিধিনিষেধের কারণে অনেকে চাকরি এবং আয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, সংঘাত এবং মহামারীর মিলিত ত্রিবিধ সংকটের কারণে ক্রমবর্ধমান ক্ষুর্ধাত মানুষের ধাক্কা সামলাতে সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন। তারা বলছেন অবিলম্বে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাত বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র কৃষকদের সহায়তা করা, খাদ্য সরবরাহ চেইন শক্তিশালী করা, খাদ্যশস্য ও সবজি উৎপাদনের জন্য নগদ প্রণোদনা এবং পশুসম্পদ রক্ষা করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্ষুধার আকাশছোঁয়া মাত্রা প্রতিরোধ, সরকারগুলোকে সুরক্ষা প্রদান এবং বাণিজ্য প্রবাহিত রাখতে এবং দরিদ্র দেশগুলোকে ক্ষুধা এবং অন্যান্য ধাক্কা থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করার জন্য বিনিয়োগের জন্য উল্লেখযোগ্য নতুন অর্থায়নেরও প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই বুঝতে হবে যে যারা ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ মাত্রার তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছে, সে সঙ্গে যারা খাদ্যের চাপে রয়েছে তাদের গুরুতর পরিণতি প্রশমিত করতে হবে।

জীবন ও জীবিকা রক্ষার জন্য এবং টেকসই খাদ্যব্যবস্থা এবং উৎপাদন বাড়াতে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। নইলে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাদের ক্ষমতা, সম্পদ ও জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়বে। সুতরাং একটি জরুরি রাজনৈতিক সমাধান এখনই প্রয়োজন।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২ ও ৩ (এসডিজি-২ ও ৩) ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী দারিদ্রের বিলোপ ও ক্ষুধামুক্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে বর্তমান বাস্তবতা দেখায় যে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। সুতরাং, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমাতে বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে

মতিউর রহমান

বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

জাতিসংঘের হাঙ্গার রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্ষুধা সেই সময়কালকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য ব্যবহৃত শব্দ যখন জনসংখ্যা গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়- অর্থাৎ অর্থের অভাবে খাদ্যে প্রবেশাধিকারের অভাব বা অন্যান্য অবস্থার কারণে তারা না খেয়ে থাকে।

জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যাকে খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণের বেশি খাদ্য উৎপাদিত হয় কিন্তু মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ এখনো ক্ষুধার্ত। জাতিসংঘ বলছে গত এক দশক ধরে ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার পর, বিশ্বব্যাপী ক্ষুর্ধাত মানুষের সংখ্যা আবারও বাড়ছে। আর ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ার পেছনে মূলত তিনটি সংকট কাজ করছে-তাহল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারী।

বিশ্বব্যাংকের ‘বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০২১” অনুযায়ী বিশ্বের জনসংখ্যা এখন প্রায় ৭.৮৭ বিলিয়ন বা প্রায় ৭৮৭ কোটি ৫০ লাখ। অপর দিকে ওয়ার্ল্ডোমিটার্সের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৭.৯৭ বিলিয়ন বা প্রায় ৮০০ কোটি।

সাম্প্রতিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যে বাড়িয়ে দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না

সম্প্রতি প্রকাশিত “বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি অবস্থা” রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। প্রায় ২.৩ বিলিয়ন মানুষ পর্যাপ্ত পরিমাণে, মাঝারি বা গুরুতর খাদ্য প্রাপ্তি সমস্যার সম্মুখীন। গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন প্রায় ৯২৪ মিলিয়ন মানুষ।

জাতিসংঘের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সতর্ক করেছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য, জ্বালানি এবং সারের দাম বৃদ্ধি সারা বিশ্বের দেশগুলোকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেয়ার অবস্থা সৃষ্টি করেছে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন “বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা, অনাহার এবং ব্যাপক অভিবাসন একটি নজিরবিহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।”

জাতিসংঘের ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’-এর প্রধান ডেভিড বিসলে বলেছেন, সর্বশেষ বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে ‘রেকর্ড ৩৪৫ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষ তীব্র অনাহারের দ্বারপ্রান্তে’। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার আগে এই সংখ্যা ছিল ২৭৬ মিলিয়ন। বর্তমানে যা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ২০২০ সালের গোড়ার দিকে অর্থাৎ করোনা মহামারী শুরুর আগে এই সংখ্যা ছিল ১৩৫ মিলিয়ন।

ডেভিড বিসলে আরও উল্লেখ করেছেন “এটি একটি সত্যিকারের বিপদ। কারণ সামনের মাসগুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। তিনি উল্লেখ করেছেন বিশ্বের ৪৫টি দেশের ৫০ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে অবস্থান করছে।”

গত মার্চে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২১’ উল্লেখ করে, করোনা মহামারীর প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্তের হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে-২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১১ কোটি ৮০ লাখ; শতকরা হিসাবে এ বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ।

বাংলাদেশে সরকারিভাবে কোনো তথ্য প্রকাশ করা না হলেও ২০২০ ও ২০২১ প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বেসরকারি গবেষণার ফলাফল দেখায় যে, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে দারিদ্র্য হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। এ হার দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। এসব দরিদ্র মানুষের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে পরিসংখ্যান যাই বলুক অবস্থা যে ভয়াবহ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সাম্প্রতিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যে বাড়িয়ে দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক নিম্ন ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে সেসব দেশে যাদের দুর্বল মুদ্রা এবং খাদ্য আমদানির ওপর উচ্চ নির্ভরশীলতা, যেখানে সীমান্ত বন্ধ, সংঘর্ষ বা নিরাপত্তাহীনতা বাণিজ্য প্রবাহকে ব্যাহত করেছে এবং যেখানে আবহাওয়া চরমভাবে খাদ্য উৎপাদন বা প্রাপ্যতা হ্রাস করেছে।

এই সামষ্টিক অর্থনৈতিক কারণগুলো সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের ক্রয়ক্ষমতার ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলেছে। উপরোন্থ করোনা মহামারী-সম্পর্কিত বিধিনিষেধের কারণে অনেকে চাকরি এবং আয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, সংঘাত এবং মহামারীর মিলিত ত্রিবিধ সংকটের কারণে ক্রমবর্ধমান ক্ষুর্ধাত মানুষের ধাক্কা সামলাতে সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন। তারা বলছেন অবিলম্বে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাত বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র কৃষকদের সহায়তা করা, খাদ্য সরবরাহ চেইন শক্তিশালী করা, খাদ্যশস্য ও সবজি উৎপাদনের জন্য নগদ প্রণোদনা এবং পশুসম্পদ রক্ষা করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্ষুধার আকাশছোঁয়া মাত্রা প্রতিরোধ, সরকারগুলোকে সুরক্ষা প্রদান এবং বাণিজ্য প্রবাহিত রাখতে এবং দরিদ্র দেশগুলোকে ক্ষুধা এবং অন্যান্য ধাক্কা থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করার জন্য বিনিয়োগের জন্য উল্লেখযোগ্য নতুন অর্থায়নেরও প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই বুঝতে হবে যে যারা ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ মাত্রার তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছে, সে সঙ্গে যারা খাদ্যের চাপে রয়েছে তাদের গুরুতর পরিণতি প্রশমিত করতে হবে।

জীবন ও জীবিকা রক্ষার জন্য এবং টেকসই খাদ্যব্যবস্থা এবং উৎপাদন বাড়াতে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। নইলে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাদের ক্ষমতা, সম্পদ ও জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়বে। সুতরাং একটি জরুরি রাজনৈতিক সমাধান এখনই প্রয়োজন।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২ ও ৩ (এসডিজি-২ ও ৩) ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী দারিদ্রের বিলোপ ও ক্ষুধামুক্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে বর্তমান বাস্তবতা দেখায় যে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। সুতরাং, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমাতে বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top