আফরোজা সোমা
বিষামৃতপুরাণ : খান বীজ ভান্ডার ...
সোশ্যাল মিডিয়া একটা আজীব জায়গা। আমি এর নাম দিয়েছি, বিষামৃতপুরাণ। মানে বিষে ও অমৃতে এইখানে একাকার। মহতী রানীর মৃত্যু থেকে মহান কিং খান তথা নাম্বার ওয়ান শাকিব খানের পুত্রের জন্ম-সবকিছুই এখানে বাহাস ও বিনোদনের বিষয়।
হালের আলোচিত নায়িকা বুবলি মা হয়েছেন। বিনোদন পাতায় এটাও নিশ্চয়ই এক-দুই কলামের খবরের আইটেম। কিন্তু বুবলির মা হওয়ার খবর চোখের নিমিষে জাতীয় খবরে পরিণত হলো। সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবানলের মতোন ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। এর কৃতিত্ব যত না বুবলির তারচে অধিক নাম্বার ওয়ান শাকিব খানের।
অবশ্য, পিতৃত্বজনিত কারণে খবরের শিরোনাম হওয়ার অভিজ্ঞতা শাকিবের জন্য এটাই প্রথম নয়। আগেও তিনি পিতা হিসেবে খবর হয়েছেন। অপু বিশ্বাসকে বিয়ে করে, সেই বিয়ে গোপন করে, অপুর পেটে বাচ্চা জন্মানোর ‘বীজ’ দিয়ে শাকিব ‘কেটে পড়েছেন’।
নায়িকাদের সন্তানবতী করার ক্ষেত্রে শাকিবের এই উদারতা নিয়ে রসিক নেটিজেনরা ফেসবুকে চালু করেছেন শব্দবন্ধ : ‘খান বীজ ভান্ডার’।
নেটিজেনদের এই রস (উইট) বুবলি আর অপুর মর্মপীড়ার কারণ হতে পারে বটে। কিন্তু দর্শকের কাছে নিজের জীবন ব্যতীত আর সকলি থিয়েট্রিকেল বা বলা চলে, প্রায় এক প্রকার সিনেমা। যে কারণে কাচঘেরা রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে কাচের দেয়ালের ওপারে চলমান মানুষের কোলাহলের দিকে তাকিয়ে আমরা আদতে যা দেখি তা লাইভ থিয়েটারই বটে। আবার একই কায়দায় কাচের দেয়ালের এই পাড়ে, রেস্টুরেন্টের ভেতর, আহারে বসে সবান্ধব গল্পে মশগুল আমাদের দিকে চেয়ে পথচারীরাও আদতে দেখে ‘ফাও’ লাইভ থিয়েটার।
অপু বিশ্বাস, বুবলি ও শাকিবের এই গল্পে ‘লাভ, সেক্স অউর ধোঁকা’— কোন ভাব প্রধান? নাকি এর বাইরেও এইখানে আরও কোন উপাদান যুক্ত আছে? চলুন, একটু অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
পুরাণের দুষ্মন্ত, হালের শাকিব
কথায় বলে, ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান’। মহাভারতেই বর্ণিত আছে বনাচারী কন্যা শকুন্তলা ও রাজা দুষ্মন্তের উপাখ্যান। রাজা মৃগয়ায় এসে হরিণের পিছু ধাওয়া করতে করতে দেখা পান অপূর্ব সুন্দরী শকুন্তলার। দেখা মাত্রই তিনি তরুণীর প্রেমে মজে যান।
প্রকৃতির মতোন সরল-সুন্দর শকুন্তলাও চঞ্চলা হরিণীর মতোন রাজার প্রেমের তীরে বিদ্ধ হন। অতএব আমে-দুধে একাকার। আশি বা নব্বইয়ের দশকের সিনেমা হলে গল্পের এই পর্যায়ে একটা তুমুল প্রেমের গান জুড়ে দেয়া হতো। পর্দায় দেখা যেত নায়ক-নায়িকা একে অন্যের বাহুতে বন্দী। ক্যামেরায় ক্লোজ-আপে একবার নায়িকার কম্পিত লাল অধর আর একবার নায়কের ঠোঁট দেখানো হতো। তারপর হয়তো একটি দৃশ্যে দেখানো হতো দুটো ফুলে ঠোকাঠুকি হচ্ছে। অথবা হয়তো দেখানো হতো একটি প্রজাপতি ফুলের উপর বসে মধু খাচ্ছে আর পাখা নাড়াচ্ছে।
কিন্তু মহাভারতে এরকম দৃশ্যের বর্ণনা নেই। সেখানে যা বর্ণিত আছে তার সরলার্থ দাঁড়ায়ঃ অতঃপর তাহারা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা গান্ধর্ব ধর্মমতে বিবাহ করিল।
বিবাহের পর ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বা ‘ভালোবাসাবাসির দিন’ আর কয়দিনই বা থাকে! অতএব, মধুচন্দ্রিমাসম শকুন্তলার প্রেমভরপুর দিনও সত্বর ফুরাইলো। মৃগয়া বা বিহার শেষে দুষ্মন্ত রাজ্য সামলানোর নিমিত্তে শকুন্তলাকে ছেড়ে রাজধানীতে গমন করেন। সিনেমার এই দৃশ্যে, ব্যাকগ্রাউন্ডে আপনি ‘যদি বন্ধু যাইবার চাও ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও, থুইয়া যাও রে’ গানটা শুনতে পারেন। এই মুহূর্তে আমার মগজেও এটাই বাজছে।
তারপর কী হলো? রাজা দুষ্মন্ত রাজধানীতে গেল যে গেল। আর ‘ডিড নট কাম’। মানে আর আসার নামগন্ধও নেই। এদিকে বিরহী শকুন্তলার দুঃখে পরাণ ফাটে। তার উপরে সে আবার সন্তানবতী। তারে ‘বীজ’ দিয়ে গেছেন দুষ্মন্ত বীজ ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী।
একে-দুইয়ে-তিন করে দিন-মাস যায়। বছর গড়ায়। শকুন্তলার ঘর আলো করে অপু ও বুবলীর মতোন আসে এক ছেলে সন্তান। পুরাণে সেই ছেলেই ‘ভরত’ নামে পরিচিত হয়। অভাগী শকুন্তলা অপেক্ষায়। একদিন হয়তো তার প্রাণের রাজা আসবে। আসবে। আসবে। কিন্তু হায়! আশার গুড়ে বালি।
নিজের স্ত্রী পরিচয় না হোক, অন্তত সন্তানের তো পিতৃপরিচয় প্রয়োজন। অবশেষে সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অনাহুত শকুন্তলা নিজেই রাজার দরবারে হাজির। কিসের প্রেম, কিসের পরিণয়! কিসের আবার বরণডালা সাজানো! শকুন্তলাকে যে দুষ্মন্ত চিনতেই পারেন না! অপমানিতা শকুন্তলা প্রাণপণে রাজাকে বোঝায়, তারা স্বামী-স্ত্রী, এই পুত্র তাদের! কিন্তু রাজা অনড়! এক্সট্র্যাক্ট সিনেমার নায়কের মতোন দুষ্মন্ত শুধু বলে ‘পমান দাও’।
হায়! শকুন্তলার কাছে যে প্রমাণ নেই। রাজার দেয়া আংটি যে সে হারিয়ে ফেলেছে! এখন আছে শুধু এই পুত্রটি তার।
পুত্র নিয়ে হাজির হলেই তো আর রাজার স্ত্রী হওয়া যায় না, শকুন্তলা তা জানত না। তাই, কোথাকার কোন রমণীর প্রলাপকে রাজার সভাসদেরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। শকুন্তলা তাৎক্ষণিকভাবে প্রমাণও করতে পারে না যে তাদের বিবাহ হয়েছিলো। পরে গল্পে আরো অনেক ঘটনা আছে। সেখান থেকে বিরতি নিয়ে এবার আমরা শাকিব-বুবলি-অপুর গল্পে আসি।
পুরাণের এই গল্পে দুষ্মন্তের জায়গায় শাকিবের নামটা বসান। আর শকুন্তলার জায়গায় প্রথমে পড়ুন অপু বিশ্বাস, দ্বিতীয়ত পড়ুন বুবলির নাম।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অবশ্য রাত্রি বলে আরেকজনের কাহিনীও চাউর হয়েছে। যদি রাত্রির দাবি সত্য হয়, তাহলে অধুনা শকুন্তলার কাহিনীতে অপু, বুবলি ও রাত্রির মধ্যে তিনিই ‘খাঁটি’ শকুন্তলা।
দুষ্মন্তই যে ভরতের পিতা সেই পরিচয় নিশ্চিত ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য বহু ঘটনা ঘটাতে হয়েছে কাহিনীকারকে। কিন্তু এই যুগে কাজটা খুব সোজা। শাকিব-রাত্রির ছেলে বলে যাকে দাবি করা হচ্ছে, যে ছেলে কিনা বর্তমানে একটা গ্যারাজে মেকানিকের কাজ করে বলে বলা হচ্ছে, তার একটা ডিএনএ টেস্ট করলেই ‘কেল্লা ফতে’। মানে সিনেমার শেষ দৃশ্যে গান গাইতে-গাইতে বাপে-পুতে মিলন হবার চেয়ে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে কে কার ছেলে আর কে কার বাপ তা নিশ্চিত হওয়া অনেক সহজ ও কার্যকর পন্থা।
নারী প্রশ্নে সমাজ যখন মান্ধাতা আমলে...
রাজা মৃগয়ায় গিয়ে প্রেমে পড়েন। মহাভারতের রাজা শান্তনুও মৃগয়া বা বিহারে গিয়ে গঙ্গার প্রেমে পড়েছিলেন। আর শাকিব পড়েন সিনেমার সেটে। যাহা বিহার তাহাই সিনেমার সেট ভেবে নিলেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়।
মহাভারতের কাল থেকে গত কয়েক হাজার বছরে ভূভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব বলতে গেলে আমূল পালটে গেছে। কিন্তু নারী প্রশ্নে আমাদের সমাজ এখনো সেই মান্ধাতা আমলেই আছে। এখনো সন্তান কোলে নিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে নারীকে দাঁড়াতে হয় কলংক মোচনের চেষ্টায়।
অপু বা বুবলি কেন নিজেদের বিয়ের কথা, মতিকণ্ঠের ভাষায়, ‘গুপন’ রাখতে ‘বাধ্য’ বা ‘প্ররোচিত’ হন বা চাপ বোধ করেন?
করেন, কারণ আমাদের দেশে বিবাহিত নায়িকার ক্যারিয়ার পড়ে যায়। ভারতেও তাই। বিয়ে বা বাচ্চা উৎপাদনের সঙ্গে নায়ক তথা পিতা তথা পুরুষের সৌন্দর্যের হানি ঘটে না বলেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু নারীর বেলায় সাধারণত, তার অভিজ্ঞতা, মেধা, যোগ্যতা হয় সেকেন্ডারি। তার ‘শরীর’ই মুখ্য। সামাজিক এই চাপকে পুঁজি করেই শাকিব খান অপু ও বুবলিকে ‘পটিয়ে’ বিয়ে ও বাচ্চা গোপন রাখার ‘ধুরন্ধরপনা’ জারি রাখতে পারে।
সমাজের ভূমিকা এখানেই শেষ নয়। কেন একজন নায়িকাকে বাচ্চা কোলে নিয়ে তার সন্তানের পিতৃ-পরিচয় নিশ্চিত করতে টেলিভিশন সেটে এসে অশ্রুপাত করতে হয়? কেন ফেসবুকে এসে আজান দিয়ে জানাতে হয়, এই আমার পুত্র, এই তার পুত্রের পিতা? কেন পিতা-পুত্রের সম্পর্কের প্রমাণস্বরূপ জুড়ে দিতে হয় ছবি? হয় কারণ নায়িকা বা নারীটি চাইলেও সন্তানকে শুধু নিজের একক পরিচয়ে বড় করানোর মতোন সামাজিক ব্যবস্থা এখানে নেই। যে বাবা সন্তানের পরিচয়ই দেয় না, তার পেছনেও ভিখিরির মতোন পরিচয়ের সামাজিক দলিল পেতে নারীটির ঘুরতে হয় কারণ এই দেশে কাগজে-কলমে মা সন্তানের প্রকৃত ‘মালিক’ বা ‘স্বত্বাধিকারী’ নন। আইন মতে, বাবা হলেন সর্বেসর্বা। মা হলেন কেবল ‘অভিভাবক’।
নারীকে এই ভাবে পদে পদে সিস্টেমিক কায়দায় এই দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রাখা হয়েছে। যে কারণে ভালো আয়রোজগার করেন, সংসার চালান তেমন নারীও ‘একখানি পুরুষ’ এর পরিচয়, নিদেনপক্ষে নামখানি সন্তানের নামের পাশে রাখতে বাধ্য হন।
দুনিয়া অনেক এগিয়ে গেছে। এখন চাইলে স্পার্ম ডোনেশন পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ যেই নারী নিজের উপার্জনে নিজের পরিবার চালাতে সক্ষম তিনি যদি বিয়ে না করে, স্বামীর পরিচয়ের ধারণার বাইরে গিয়ে স্পার্ম ক্রয় করে বা ডোনেশান নিয়ে ‘সিঙ্গেল মাদার’ হিসেবে পরিবার গঠন করতে চান তাহলেও এই সুযোগ তার নেই। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র সেই অধিকার থেকে নাগরিককে বঞ্চিত করে কোন ক্ষমতা বলে? সমাজ এগিয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের আইন-কানুন এখনো পড়ে আছে একশ বছর পেছনে। এইখানে ঝাকুনি দিতে হবে। নইলে শুধু বুবলি আর অপুকে নিয়ে কথা বলে শাকিব-অপু-বুবলি তথা বৃহত্তর সমাজের সংকটের অবসান হবে না।
আমরা যিশু ও মাতা মেরির কথা জানি। ঈশ্বর সাক্ষী, জগতে সকলেই তো আর জননী মেরি এবং তার সন্তান যিশুর মতোন সৌভাগ্য নিয়ে দুনিয়ায় আসে না। আমরা দেখি, পিতার পরিচয় না থাকলে সমাজ সন্তানকে ‘জারজ’ বলে ডাকে। সেই সন্তানের মাকে বলে ‘চরিত্রহীন’। তাই, কবীর সুমনের গানে আমরা দেখি ‘‘কোলকাতার যিশু’দের জন্য বেদনা। কিন্তু শুধু সমবেদনা দিয়ে জীবন চলে না। জীবন কখনো-কখনো ক্লাসিক্যাল মিউজিকের চেয়েও জটিল বিষয়। তাই, সেই জটিলতার কাছে পরাস্ত হয়েই অপু-বুবলিকে মিডিয়ার শরণ নিতে হয়।
নারী ক্ষেত্র, পুরুষ বীজ ভা-ার...
আবারও মহাভারতের কাছে আসি। সেই মহাভারতের কাল থেকেই নারীকে কেবলি ‘ক্ষেত্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সত্যবতী ও শান্তনুর দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্র বীর্যের মৃত্যুর পর হস্তিনাপুর উত্তরাধিকারীর সংকটে পড়ে। কারণ তখনবিকল্প পন্থায় সত্যবতী তার বিবাহপূর্ব জীবনের পুত্র বেদব্যাসকে ডেকে আনেন। পুত্রের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন এবং বিচিত্র বীর্যের দুই স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকাকে সন্তানদান নিমিত্তে তাদের সঙ্গে মিলিত হতে মিনতি করেন। মায়ের অনুরোধে ব্যাসদেব ভ্রাতৃবধূদের সঙ্গে মিলিত হন এবং তারা গর্ভবতী হন।
এইভাবে, হস্তিনাপুর পায় রাজ্যের দুই উত্তরাধিকারী ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডুর। এইখানে গল্পে আরো প্যাঁচ আছে। সেইখানে যাচ্ছি না। সংক্ষেপে, গল্প সারতে শুধু এইটুকু বলে রাখি, মহাভারতের কালে রাজ্য রক্ষায় এইভাবে সন্তান উৎপাদন ছিল বৈধ পন্থা।
মহাভারতেই আছে, গান্ধারী যখন রাগে-দুঃখে কিলিয়ে নিজের গর্ভপাত করেন তখন ব্যাসদেব গিয়ে সেই মাংসপি-কে শত টুকরো করে শত কলসির মধ্যে রেখে দেন। সেখানেই পি-গুলো পুরোপুরি মানবশিশু হিসেবে পরিণত হয়।
ক্ষেত্রের এমন উদাহরণ আরও টেনে আনলে লেখার কলেবর বেড়ে যাবে। তাই এখানেই থামছি।
সেই মহাভারত থেকে আজকের বাংলাদেশেও নারীর নিজের জীবনের উপরে আজও নিজের হক প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই দেশের আইন-কানুন, সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতিতে নারীকে ‘অপর’ করে রাখা হয়েছে। সেই সিস্টেমিক রিপ্রেশানের খানাখন্দে পড়েই খাবি খাচ্ছেন অপু, বুবলি। হয়তো খাবি খাচ্ছেন আপনিও, হে সম্মানিত পাঠক।
অপু, বুবলির মতোন প্রতারিত নারীর সংখ্যা এই দেশে অগুন্তি। স্ত্রী ও সন্তানের কথা গোপন করে অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক করা বা সম্পর্কের নামে এমন ‘পলাবুঞ্জি’ বা লুকোচুরি শুধু শাকিব খান একা খেলেন না। এমন ‘খেলোয়াড়’ দেশে আরও আছে। সেই খেলোয়াড়ের আশপাশে ‘দেখোয়াড়’ও থাকেন; যারা হয়তো রা’টি কাড়েন না। তবে, জনসাধরণের মধ্যে থাকা খেলোয়াড়রা কেউ শাকিবের মতন সেলিব্রেটি নন বলে তাদের কথা মিডিয়াতে ‘সেনসেশনাল নিউজ’ হয়ে উঠে না।
শাকিব খান সমাজে প্রতিষ্ঠিত নায়ক। সংস্কৃতি জগতের আইডলও বলা চলে। সেই ‘আইডল’ যখন নারী বিষয়ে ‘পলাবুঞ্জি’ খেলেন, তখন মিডিয়া তার নিউজটা যেভাবে, যে এংগেল থেকে কাভার করে নারী ‘আইডল’দের ক্ষেত্রে কি তা করে? স্পষ্টতই তা করে না।
শাকিবের জায়গায় আজকে যদি কোনো সেলিব্রেটি নারী এই কা- ঘটাতেন তাহলে সেই নারীর দশা কী হতো? শাকিবের তুলনায় কিছুই না করেও পরীমনি ও মিথিলার জীবন নরক গুলজার হয়ে গেছে। ক্রিকেটার নাসিরের স্ত্রী তামিমার কথাও ভেবে দেখতে পারেন। মিডিয়া কাভারেজের ঘাত (নাকি অপঘাত?) সেলিব্রেটি নারীদের যেভাবে হজম করতে হয়েছে বা হয় শাকিবের তা হচ্ছে না।
শাকিব খানের প্রেম-বিয়ে-সন্তান নিয়ে এই লুকোচুরি খেলার প্রসঙ্গটি নিয়ে আমি অন্তত পঞ্চাশজন তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বুঝতে চেয়েছি, এই ঘটনাটিকে তরুণেরা কিভাবে বিশ্লেষণ করছেন? মোটা দাগে তাদের মতামত তিন প্রকার।
প্রথমত, তারা মনে করেন ‘বিনোদন জগতের মানুষেরা এরকম করে’। অর্থাৎ এটা সাধারণের মধ্যে চর্চিত হতে দেখা যায় না, মিডিয়া পাড়াতেই এগুলো বেশি ঘটে। দ্বিতীয়ত, শাকিবের এই কাজটা ‘অপকর্ম’ এবং ‘আনএথিকেল’ বা অনৈতিক হয়েছে। তৃতীয়ত, শাকিব খান একজন আইডল বা আইকন। একজন আইকন হিসেবে এই ধরনের অপকর্মের পরও তাকে যদি সামাজিকভাবে ‘স্টার’ হিসেবে ‘সম্মানিত’ হতে দেখা যায় তাহলে সমাজে বৃহত্তর অর্থে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
নেতিবাচক প্রভাব বলতে তারা উল্লেখ করেছেন, মিডিয়া জগত সম্পর্কে মানুষের ‘খারাপ ধারণা’ হবে। পাশাপাশি, টাকা, ক্ষমতা ও সামাজিক পরিচিত থাকা সেলিব্রেটি নারীরও যখন এই অবস্থা হয় তখন অন্য নারীদের সঙ্গে এরকম করে তো পার পাওয়া যাবেই-এমন একটা ধারণাও শাকিবের মতোন লুকোচুরি-প্রিয় পুরুষ সমাজ পাবে বলে উল্লেখ করেছেন তরুণ-তরুণীরা।
তাৎক্ষণিক সংকটের তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে আপাতত শাকিবের একটা প্রেস কনফারেন্স করা উচিত। সিনে জগতের অন্যতম আইডল হিসেবে বিষয়গুলো তার পরিষ্কার করা উচিত। এই নিয়ে সিনে সমিতিগুলো তার ওপর চাপ বাড়াতে পারে। নইলে সব সিনেমা থেকে তাক বাদ দিয়ে দেয়ার হুমকিও এবং প্রয়োজনে বাদ দিয়েও দেয়া যেতে পারে।
তবে, শাকিব-অপু-বুবলি কেসের পর নারী অধিকার প্রশ্নে অ্যাক্টিভিস্ট ও একাডেমিয়ার মানুষদেরও আরও জাগ্রত হওয়া দরকার। সরকারের একপেশে আইন-কানুনগুলো পাল্টাতে জোর ধাক্কা চাই। নইলে এই জগদ্দল পাথর নড়বে না।
[লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও জেন্ডার বিষয়ক গবেষক]
আফরোজা সোমা
বুধবার, ০৫ অক্টোবর ২০২২
বিষামৃতপুরাণ : খান বীজ ভান্ডার ...
সোশ্যাল মিডিয়া একটা আজীব জায়গা। আমি এর নাম দিয়েছি, বিষামৃতপুরাণ। মানে বিষে ও অমৃতে এইখানে একাকার। মহতী রানীর মৃত্যু থেকে মহান কিং খান তথা নাম্বার ওয়ান শাকিব খানের পুত্রের জন্ম-সবকিছুই এখানে বাহাস ও বিনোদনের বিষয়।
হালের আলোচিত নায়িকা বুবলি মা হয়েছেন। বিনোদন পাতায় এটাও নিশ্চয়ই এক-দুই কলামের খবরের আইটেম। কিন্তু বুবলির মা হওয়ার খবর চোখের নিমিষে জাতীয় খবরে পরিণত হলো। সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবানলের মতোন ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। এর কৃতিত্ব যত না বুবলির তারচে অধিক নাম্বার ওয়ান শাকিব খানের।
অবশ্য, পিতৃত্বজনিত কারণে খবরের শিরোনাম হওয়ার অভিজ্ঞতা শাকিবের জন্য এটাই প্রথম নয়। আগেও তিনি পিতা হিসেবে খবর হয়েছেন। অপু বিশ্বাসকে বিয়ে করে, সেই বিয়ে গোপন করে, অপুর পেটে বাচ্চা জন্মানোর ‘বীজ’ দিয়ে শাকিব ‘কেটে পড়েছেন’।
নায়িকাদের সন্তানবতী করার ক্ষেত্রে শাকিবের এই উদারতা নিয়ে রসিক নেটিজেনরা ফেসবুকে চালু করেছেন শব্দবন্ধ : ‘খান বীজ ভান্ডার’।
নেটিজেনদের এই রস (উইট) বুবলি আর অপুর মর্মপীড়ার কারণ হতে পারে বটে। কিন্তু দর্শকের কাছে নিজের জীবন ব্যতীত আর সকলি থিয়েট্রিকেল বা বলা চলে, প্রায় এক প্রকার সিনেমা। যে কারণে কাচঘেরা রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে কাচের দেয়ালের ওপারে চলমান মানুষের কোলাহলের দিকে তাকিয়ে আমরা আদতে যা দেখি তা লাইভ থিয়েটারই বটে। আবার একই কায়দায় কাচের দেয়ালের এই পাড়ে, রেস্টুরেন্টের ভেতর, আহারে বসে সবান্ধব গল্পে মশগুল আমাদের দিকে চেয়ে পথচারীরাও আদতে দেখে ‘ফাও’ লাইভ থিয়েটার।
অপু বিশ্বাস, বুবলি ও শাকিবের এই গল্পে ‘লাভ, সেক্স অউর ধোঁকা’— কোন ভাব প্রধান? নাকি এর বাইরেও এইখানে আরও কোন উপাদান যুক্ত আছে? চলুন, একটু অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
পুরাণের দুষ্মন্ত, হালের শাকিব
কথায় বলে, ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান’। মহাভারতেই বর্ণিত আছে বনাচারী কন্যা শকুন্তলা ও রাজা দুষ্মন্তের উপাখ্যান। রাজা মৃগয়ায় এসে হরিণের পিছু ধাওয়া করতে করতে দেখা পান অপূর্ব সুন্দরী শকুন্তলার। দেখা মাত্রই তিনি তরুণীর প্রেমে মজে যান।
প্রকৃতির মতোন সরল-সুন্দর শকুন্তলাও চঞ্চলা হরিণীর মতোন রাজার প্রেমের তীরে বিদ্ধ হন। অতএব আমে-দুধে একাকার। আশি বা নব্বইয়ের দশকের সিনেমা হলে গল্পের এই পর্যায়ে একটা তুমুল প্রেমের গান জুড়ে দেয়া হতো। পর্দায় দেখা যেত নায়ক-নায়িকা একে অন্যের বাহুতে বন্দী। ক্যামেরায় ক্লোজ-আপে একবার নায়িকার কম্পিত লাল অধর আর একবার নায়কের ঠোঁট দেখানো হতো। তারপর হয়তো একটি দৃশ্যে দেখানো হতো দুটো ফুলে ঠোকাঠুকি হচ্ছে। অথবা হয়তো দেখানো হতো একটি প্রজাপতি ফুলের উপর বসে মধু খাচ্ছে আর পাখা নাড়াচ্ছে।
কিন্তু মহাভারতে এরকম দৃশ্যের বর্ণনা নেই। সেখানে যা বর্ণিত আছে তার সরলার্থ দাঁড়ায়ঃ অতঃপর তাহারা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা গান্ধর্ব ধর্মমতে বিবাহ করিল।
বিবাহের পর ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বা ‘ভালোবাসাবাসির দিন’ আর কয়দিনই বা থাকে! অতএব, মধুচন্দ্রিমাসম শকুন্তলার প্রেমভরপুর দিনও সত্বর ফুরাইলো। মৃগয়া বা বিহার শেষে দুষ্মন্ত রাজ্য সামলানোর নিমিত্তে শকুন্তলাকে ছেড়ে রাজধানীতে গমন করেন। সিনেমার এই দৃশ্যে, ব্যাকগ্রাউন্ডে আপনি ‘যদি বন্ধু যাইবার চাও ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও, থুইয়া যাও রে’ গানটা শুনতে পারেন। এই মুহূর্তে আমার মগজেও এটাই বাজছে।
তারপর কী হলো? রাজা দুষ্মন্ত রাজধানীতে গেল যে গেল। আর ‘ডিড নট কাম’। মানে আর আসার নামগন্ধও নেই। এদিকে বিরহী শকুন্তলার দুঃখে পরাণ ফাটে। তার উপরে সে আবার সন্তানবতী। তারে ‘বীজ’ দিয়ে গেছেন দুষ্মন্ত বীজ ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী।
একে-দুইয়ে-তিন করে দিন-মাস যায়। বছর গড়ায়। শকুন্তলার ঘর আলো করে অপু ও বুবলীর মতোন আসে এক ছেলে সন্তান। পুরাণে সেই ছেলেই ‘ভরত’ নামে পরিচিত হয়। অভাগী শকুন্তলা অপেক্ষায়। একদিন হয়তো তার প্রাণের রাজা আসবে। আসবে। আসবে। কিন্তু হায়! আশার গুড়ে বালি।
নিজের স্ত্রী পরিচয় না হোক, অন্তত সন্তানের তো পিতৃপরিচয় প্রয়োজন। অবশেষে সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অনাহুত শকুন্তলা নিজেই রাজার দরবারে হাজির। কিসের প্রেম, কিসের পরিণয়! কিসের আবার বরণডালা সাজানো! শকুন্তলাকে যে দুষ্মন্ত চিনতেই পারেন না! অপমানিতা শকুন্তলা প্রাণপণে রাজাকে বোঝায়, তারা স্বামী-স্ত্রী, এই পুত্র তাদের! কিন্তু রাজা অনড়! এক্সট্র্যাক্ট সিনেমার নায়কের মতোন দুষ্মন্ত শুধু বলে ‘পমান দাও’।
হায়! শকুন্তলার কাছে যে প্রমাণ নেই। রাজার দেয়া আংটি যে সে হারিয়ে ফেলেছে! এখন আছে শুধু এই পুত্রটি তার।
পুত্র নিয়ে হাজির হলেই তো আর রাজার স্ত্রী হওয়া যায় না, শকুন্তলা তা জানত না। তাই, কোথাকার কোন রমণীর প্রলাপকে রাজার সভাসদেরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। শকুন্তলা তাৎক্ষণিকভাবে প্রমাণও করতে পারে না যে তাদের বিবাহ হয়েছিলো। পরে গল্পে আরো অনেক ঘটনা আছে। সেখান থেকে বিরতি নিয়ে এবার আমরা শাকিব-বুবলি-অপুর গল্পে আসি।
পুরাণের এই গল্পে দুষ্মন্তের জায়গায় শাকিবের নামটা বসান। আর শকুন্তলার জায়গায় প্রথমে পড়ুন অপু বিশ্বাস, দ্বিতীয়ত পড়ুন বুবলির নাম।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অবশ্য রাত্রি বলে আরেকজনের কাহিনীও চাউর হয়েছে। যদি রাত্রির দাবি সত্য হয়, তাহলে অধুনা শকুন্তলার কাহিনীতে অপু, বুবলি ও রাত্রির মধ্যে তিনিই ‘খাঁটি’ শকুন্তলা।
দুষ্মন্তই যে ভরতের পিতা সেই পরিচয় নিশ্চিত ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য বহু ঘটনা ঘটাতে হয়েছে কাহিনীকারকে। কিন্তু এই যুগে কাজটা খুব সোজা। শাকিব-রাত্রির ছেলে বলে যাকে দাবি করা হচ্ছে, যে ছেলে কিনা বর্তমানে একটা গ্যারাজে মেকানিকের কাজ করে বলে বলা হচ্ছে, তার একটা ডিএনএ টেস্ট করলেই ‘কেল্লা ফতে’। মানে সিনেমার শেষ দৃশ্যে গান গাইতে-গাইতে বাপে-পুতে মিলন হবার চেয়ে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে কে কার ছেলে আর কে কার বাপ তা নিশ্চিত হওয়া অনেক সহজ ও কার্যকর পন্থা।
নারী প্রশ্নে সমাজ যখন মান্ধাতা আমলে...
রাজা মৃগয়ায় গিয়ে প্রেমে পড়েন। মহাভারতের রাজা শান্তনুও মৃগয়া বা বিহারে গিয়ে গঙ্গার প্রেমে পড়েছিলেন। আর শাকিব পড়েন সিনেমার সেটে। যাহা বিহার তাহাই সিনেমার সেট ভেবে নিলেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়।
মহাভারতের কাল থেকে গত কয়েক হাজার বছরে ভূভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব বলতে গেলে আমূল পালটে গেছে। কিন্তু নারী প্রশ্নে আমাদের সমাজ এখনো সেই মান্ধাতা আমলেই আছে। এখনো সন্তান কোলে নিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে নারীকে দাঁড়াতে হয় কলংক মোচনের চেষ্টায়।
অপু বা বুবলি কেন নিজেদের বিয়ের কথা, মতিকণ্ঠের ভাষায়, ‘গুপন’ রাখতে ‘বাধ্য’ বা ‘প্ররোচিত’ হন বা চাপ বোধ করেন?
করেন, কারণ আমাদের দেশে বিবাহিত নায়িকার ক্যারিয়ার পড়ে যায়। ভারতেও তাই। বিয়ে বা বাচ্চা উৎপাদনের সঙ্গে নায়ক তথা পিতা তথা পুরুষের সৌন্দর্যের হানি ঘটে না বলেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু নারীর বেলায় সাধারণত, তার অভিজ্ঞতা, মেধা, যোগ্যতা হয় সেকেন্ডারি। তার ‘শরীর’ই মুখ্য। সামাজিক এই চাপকে পুঁজি করেই শাকিব খান অপু ও বুবলিকে ‘পটিয়ে’ বিয়ে ও বাচ্চা গোপন রাখার ‘ধুরন্ধরপনা’ জারি রাখতে পারে।
সমাজের ভূমিকা এখানেই শেষ নয়। কেন একজন নায়িকাকে বাচ্চা কোলে নিয়ে তার সন্তানের পিতৃ-পরিচয় নিশ্চিত করতে টেলিভিশন সেটে এসে অশ্রুপাত করতে হয়? কেন ফেসবুকে এসে আজান দিয়ে জানাতে হয়, এই আমার পুত্র, এই তার পুত্রের পিতা? কেন পিতা-পুত্রের সম্পর্কের প্রমাণস্বরূপ জুড়ে দিতে হয় ছবি? হয় কারণ নায়িকা বা নারীটি চাইলেও সন্তানকে শুধু নিজের একক পরিচয়ে বড় করানোর মতোন সামাজিক ব্যবস্থা এখানে নেই। যে বাবা সন্তানের পরিচয়ই দেয় না, তার পেছনেও ভিখিরির মতোন পরিচয়ের সামাজিক দলিল পেতে নারীটির ঘুরতে হয় কারণ এই দেশে কাগজে-কলমে মা সন্তানের প্রকৃত ‘মালিক’ বা ‘স্বত্বাধিকারী’ নন। আইন মতে, বাবা হলেন সর্বেসর্বা। মা হলেন কেবল ‘অভিভাবক’।
নারীকে এই ভাবে পদে পদে সিস্টেমিক কায়দায় এই দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রাখা হয়েছে। যে কারণে ভালো আয়রোজগার করেন, সংসার চালান তেমন নারীও ‘একখানি পুরুষ’ এর পরিচয়, নিদেনপক্ষে নামখানি সন্তানের নামের পাশে রাখতে বাধ্য হন।
দুনিয়া অনেক এগিয়ে গেছে। এখন চাইলে স্পার্ম ডোনেশন পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ যেই নারী নিজের উপার্জনে নিজের পরিবার চালাতে সক্ষম তিনি যদি বিয়ে না করে, স্বামীর পরিচয়ের ধারণার বাইরে গিয়ে স্পার্ম ক্রয় করে বা ডোনেশান নিয়ে ‘সিঙ্গেল মাদার’ হিসেবে পরিবার গঠন করতে চান তাহলেও এই সুযোগ তার নেই। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র সেই অধিকার থেকে নাগরিককে বঞ্চিত করে কোন ক্ষমতা বলে? সমাজ এগিয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের আইন-কানুন এখনো পড়ে আছে একশ বছর পেছনে। এইখানে ঝাকুনি দিতে হবে। নইলে শুধু বুবলি আর অপুকে নিয়ে কথা বলে শাকিব-অপু-বুবলি তথা বৃহত্তর সমাজের সংকটের অবসান হবে না।
আমরা যিশু ও মাতা মেরির কথা জানি। ঈশ্বর সাক্ষী, জগতে সকলেই তো আর জননী মেরি এবং তার সন্তান যিশুর মতোন সৌভাগ্য নিয়ে দুনিয়ায় আসে না। আমরা দেখি, পিতার পরিচয় না থাকলে সমাজ সন্তানকে ‘জারজ’ বলে ডাকে। সেই সন্তানের মাকে বলে ‘চরিত্রহীন’। তাই, কবীর সুমনের গানে আমরা দেখি ‘‘কোলকাতার যিশু’দের জন্য বেদনা। কিন্তু শুধু সমবেদনা দিয়ে জীবন চলে না। জীবন কখনো-কখনো ক্লাসিক্যাল মিউজিকের চেয়েও জটিল বিষয়। তাই, সেই জটিলতার কাছে পরাস্ত হয়েই অপু-বুবলিকে মিডিয়ার শরণ নিতে হয়।
নারী ক্ষেত্র, পুরুষ বীজ ভা-ার...
আবারও মহাভারতের কাছে আসি। সেই মহাভারতের কাল থেকেই নারীকে কেবলি ‘ক্ষেত্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সত্যবতী ও শান্তনুর দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্র বীর্যের মৃত্যুর পর হস্তিনাপুর উত্তরাধিকারীর সংকটে পড়ে। কারণ তখনবিকল্প পন্থায় সত্যবতী তার বিবাহপূর্ব জীবনের পুত্র বেদব্যাসকে ডেকে আনেন। পুত্রের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন এবং বিচিত্র বীর্যের দুই স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকাকে সন্তানদান নিমিত্তে তাদের সঙ্গে মিলিত হতে মিনতি করেন। মায়ের অনুরোধে ব্যাসদেব ভ্রাতৃবধূদের সঙ্গে মিলিত হন এবং তারা গর্ভবতী হন।
এইভাবে, হস্তিনাপুর পায় রাজ্যের দুই উত্তরাধিকারী ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডুর। এইখানে গল্পে আরো প্যাঁচ আছে। সেইখানে যাচ্ছি না। সংক্ষেপে, গল্প সারতে শুধু এইটুকু বলে রাখি, মহাভারতের কালে রাজ্য রক্ষায় এইভাবে সন্তান উৎপাদন ছিল বৈধ পন্থা।
মহাভারতেই আছে, গান্ধারী যখন রাগে-দুঃখে কিলিয়ে নিজের গর্ভপাত করেন তখন ব্যাসদেব গিয়ে সেই মাংসপি-কে শত টুকরো করে শত কলসির মধ্যে রেখে দেন। সেখানেই পি-গুলো পুরোপুরি মানবশিশু হিসেবে পরিণত হয়।
ক্ষেত্রের এমন উদাহরণ আরও টেনে আনলে লেখার কলেবর বেড়ে যাবে। তাই এখানেই থামছি।
সেই মহাভারত থেকে আজকের বাংলাদেশেও নারীর নিজের জীবনের উপরে আজও নিজের হক প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই দেশের আইন-কানুন, সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতিতে নারীকে ‘অপর’ করে রাখা হয়েছে। সেই সিস্টেমিক রিপ্রেশানের খানাখন্দে পড়েই খাবি খাচ্ছেন অপু, বুবলি। হয়তো খাবি খাচ্ছেন আপনিও, হে সম্মানিত পাঠক।
অপু, বুবলির মতোন প্রতারিত নারীর সংখ্যা এই দেশে অগুন্তি। স্ত্রী ও সন্তানের কথা গোপন করে অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক করা বা সম্পর্কের নামে এমন ‘পলাবুঞ্জি’ বা লুকোচুরি শুধু শাকিব খান একা খেলেন না। এমন ‘খেলোয়াড়’ দেশে আরও আছে। সেই খেলোয়াড়ের আশপাশে ‘দেখোয়াড়’ও থাকেন; যারা হয়তো রা’টি কাড়েন না। তবে, জনসাধরণের মধ্যে থাকা খেলোয়াড়রা কেউ শাকিবের মতন সেলিব্রেটি নন বলে তাদের কথা মিডিয়াতে ‘সেনসেশনাল নিউজ’ হয়ে উঠে না।
শাকিব খান সমাজে প্রতিষ্ঠিত নায়ক। সংস্কৃতি জগতের আইডলও বলা চলে। সেই ‘আইডল’ যখন নারী বিষয়ে ‘পলাবুঞ্জি’ খেলেন, তখন মিডিয়া তার নিউজটা যেভাবে, যে এংগেল থেকে কাভার করে নারী ‘আইডল’দের ক্ষেত্রে কি তা করে? স্পষ্টতই তা করে না।
শাকিবের জায়গায় আজকে যদি কোনো সেলিব্রেটি নারী এই কা- ঘটাতেন তাহলে সেই নারীর দশা কী হতো? শাকিবের তুলনায় কিছুই না করেও পরীমনি ও মিথিলার জীবন নরক গুলজার হয়ে গেছে। ক্রিকেটার নাসিরের স্ত্রী তামিমার কথাও ভেবে দেখতে পারেন। মিডিয়া কাভারেজের ঘাত (নাকি অপঘাত?) সেলিব্রেটি নারীদের যেভাবে হজম করতে হয়েছে বা হয় শাকিবের তা হচ্ছে না।
শাকিব খানের প্রেম-বিয়ে-সন্তান নিয়ে এই লুকোচুরি খেলার প্রসঙ্গটি নিয়ে আমি অন্তত পঞ্চাশজন তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বুঝতে চেয়েছি, এই ঘটনাটিকে তরুণেরা কিভাবে বিশ্লেষণ করছেন? মোটা দাগে তাদের মতামত তিন প্রকার।
প্রথমত, তারা মনে করেন ‘বিনোদন জগতের মানুষেরা এরকম করে’। অর্থাৎ এটা সাধারণের মধ্যে চর্চিত হতে দেখা যায় না, মিডিয়া পাড়াতেই এগুলো বেশি ঘটে। দ্বিতীয়ত, শাকিবের এই কাজটা ‘অপকর্ম’ এবং ‘আনএথিকেল’ বা অনৈতিক হয়েছে। তৃতীয়ত, শাকিব খান একজন আইডল বা আইকন। একজন আইকন হিসেবে এই ধরনের অপকর্মের পরও তাকে যদি সামাজিকভাবে ‘স্টার’ হিসেবে ‘সম্মানিত’ হতে দেখা যায় তাহলে সমাজে বৃহত্তর অর্থে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
নেতিবাচক প্রভাব বলতে তারা উল্লেখ করেছেন, মিডিয়া জগত সম্পর্কে মানুষের ‘খারাপ ধারণা’ হবে। পাশাপাশি, টাকা, ক্ষমতা ও সামাজিক পরিচিত থাকা সেলিব্রেটি নারীরও যখন এই অবস্থা হয় তখন অন্য নারীদের সঙ্গে এরকম করে তো পার পাওয়া যাবেই-এমন একটা ধারণাও শাকিবের মতোন লুকোচুরি-প্রিয় পুরুষ সমাজ পাবে বলে উল্লেখ করেছেন তরুণ-তরুণীরা।
তাৎক্ষণিক সংকটের তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে আপাতত শাকিবের একটা প্রেস কনফারেন্স করা উচিত। সিনে জগতের অন্যতম আইডল হিসেবে বিষয়গুলো তার পরিষ্কার করা উচিত। এই নিয়ে সিনে সমিতিগুলো তার ওপর চাপ বাড়াতে পারে। নইলে সব সিনেমা থেকে তাক বাদ দিয়ে দেয়ার হুমকিও এবং প্রয়োজনে বাদ দিয়েও দেয়া যেতে পারে।
তবে, শাকিব-অপু-বুবলি কেসের পর নারী অধিকার প্রশ্নে অ্যাক্টিভিস্ট ও একাডেমিয়ার মানুষদেরও আরও জাগ্রত হওয়া দরকার। সরকারের একপেশে আইন-কানুনগুলো পাল্টাতে জোর ধাক্কা চাই। নইলে এই জগদ্দল পাথর নড়বে না।
[লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও জেন্ডার বিষয়ক গবেষক]