alt

opinion » post-editorial

আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন

রেজাউল করিম খোকন

: বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২২

দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম বেড়েই চলছে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বারবার বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।

মানি লন্ডারিং, অর্থ পাচার, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, ঘুস-দুর্নীতি বা বেআইনি কোনো লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ হলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য প্রতিবেদন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউয়ের কাছে রিপোর্ট করে, যা সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) হিসেবে পরিচিত। একইভাবে ১০ লাখ টাকার ওপরে যেকোনো ধরনের লেনদেন হলে তা নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) হিসেবে রিপোর্ট করতে হয়। এসটিআর আসা মানেই অপরাধ সংঘটিত হওয়া নয়। এসব অপরাধ ঠেকানো ও অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য এসটিআর রিপোর্টিং চালু করা হয়েছে। এ রিপোর্ট পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি তদন্ত করতে পারে।

২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৮ হাজার ৫৭১টি। অর্থাৎ এ সময়ে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬২ দশমিক ৩২ শতাংশ বা ৩ হাজার ২৯১টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২৮০টি। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এমন লেনদেন ও কার্যক্রম হয়েছিল ৩ হাজার ৬৭৫টি। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৭৩টি। অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে আর্থিক খাতে নগদ লেনদেন বৃদ্ধির কারণে বিদায়ী আর্থিক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে। সন্দেহজনক লেনদেনে এগিয়ে আছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ৫২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর তদন্ত করে ৩৩টির রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। সব সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) অপরাধ নয়।

লেনদেন সন্দেহজনক হলে তদন্ত জরুরি। এরপর যদি কোনো অপরাধের তথ্য-প্রমাণ মেলে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারও বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দেশের ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার বিষয়ে রেটিং প্রদান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর নাম প্রকাশ না করলেও কতগুলো ব্যাংকের প্রতিরোধ সক্ষমতা কতটুকু তা প্রকাশ করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ‘শক্তিশালী বা স্ট্রং’ মান পায়নি কোনো ব্যাংক। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওভার ইনভয়েসিং ঠেকাতে পারলেও বন্ধ করা যায়নি আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি।

গত অর্থবছরে সন্ত্রাস ও জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে পুলিশ, গোয়েন্দা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়েছে। অর্থ পাচারে কেউ কেউ আমদানি পণ্যের দাম ২০ থেকে ২শ’ শতাংশ বেশি দেখিয়েছেন; আবার গাড়ি আমদানিতে দাম কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন। ডিজিটাল হুন্ডির এ অপতৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকায় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের বেশ কিছু পরিবেশক ও এজেন্টের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বারবার বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে বিষয়টি আবার সামনে এসেছে

এছাড়া বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে বিএফআইইউ। সন্দেহজনক লেনদেন এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপের তথ্য থাকলেও কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে পেরেছে, আমদানি করা পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ পর্যন্ত দেখিয়ে টাকা পাচার করা হয়েছে। তিনি এটাও বলেছেন- ডলার দেশের বাইরে চলে গেলে ফিরিয়ে আনা দুরূহ ব্যাপার।

দুই দশকের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে গত বছর। বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে এসব অর্থ জমা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। গত ২০২০ সালে সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ এক লাফে এক বছরে ৫৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার তথ্যটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন সরকারের পক্ষ থেকে নামমাত্র কর দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এই টাকা পাচার হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। যার একটা বড় মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি। এর বাইরে টাকা পাচার হচ্ছে ব্যবসার নামে। দেশ থেকে বৈধভাবে টাকা পাঠানোর কোনো পদ্ধতি না থাকার কারণে অবৈধ পথেই পাচার হচ্ছে টাকা। আর পাচার হওয়া এই টাকা রাখা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ থেকে যদি এত অর্থ বিদেশে পাচার হয় এবং বছরের পর বছর তা চলতে থাকে, তবে এ দেশের দ্রুত উন্নয়ন আশার করা বৃথা। একক বছর হিসেবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়। দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে ৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।

চারটি প্রক্রিয়ায় এ অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা। এছাড়াও টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। দুর্নীতি ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। ওই সব টাকায় দুর্নীতিবাজরা বিদেশে সম্পদ গড়ে তুলছেন, জমা রাখছেন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এর বাইরে আরও অনেক ব্যাংকে বাংলাদেশের পাচারকারীদের টাকা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। দেশ থেকে বিদেশে টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে; কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকে ব্যাংক থেকে এ ধরনের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তারপরও বাংলাদেশ থেকে কিভাবে এত টাকা পাচার হয়েছে?

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

পাট চাষের সংকট ও সম্ভাবনা

সামাজিক-প্রযুক্তিগত কল্পনা: বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তার নতুন দিগন্ত

অগ্রক্রয় মোকদ্দমায় উভয় পক্ষের আইনি ডিফেন্স

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

এক সাংবাদিকের খোলা চিঠি

বাংলাদেশের দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

ক্লাউডবার্স্ট: মৃত্যুর বার্তা নিয়ে, আকাশ যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে

রম্যগদ্য:“কবি এখন জেলে...”

কারা কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা ও ‘কারেকশন সার্ভিস’-এর বাস্তবতা

ছবি

বাংলাদেশের শহর পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

tab

opinion » post-editorial

আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন

রেজাউল করিম খোকন

বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২২

দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম বেড়েই চলছে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বারবার বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।

মানি লন্ডারিং, অর্থ পাচার, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, ঘুস-দুর্নীতি বা বেআইনি কোনো লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ হলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য প্রতিবেদন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউয়ের কাছে রিপোর্ট করে, যা সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) হিসেবে পরিচিত। একইভাবে ১০ লাখ টাকার ওপরে যেকোনো ধরনের লেনদেন হলে তা নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) হিসেবে রিপোর্ট করতে হয়। এসটিআর আসা মানেই অপরাধ সংঘটিত হওয়া নয়। এসব অপরাধ ঠেকানো ও অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য এসটিআর রিপোর্টিং চালু করা হয়েছে। এ রিপোর্ট পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি তদন্ত করতে পারে।

২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৮ হাজার ৫৭১টি। অর্থাৎ এ সময়ে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬২ দশমিক ৩২ শতাংশ বা ৩ হাজার ২৯১টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২৮০টি। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এমন লেনদেন ও কার্যক্রম হয়েছিল ৩ হাজার ৬৭৫টি। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৭৩টি। অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে আর্থিক খাতে নগদ লেনদেন বৃদ্ধির কারণে বিদায়ী আর্থিক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে। সন্দেহজনক লেনদেনে এগিয়ে আছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ৫২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর তদন্ত করে ৩৩টির রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। সব সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) অপরাধ নয়।

লেনদেন সন্দেহজনক হলে তদন্ত জরুরি। এরপর যদি কোনো অপরাধের তথ্য-প্রমাণ মেলে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারও বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দেশের ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার বিষয়ে রেটিং প্রদান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর নাম প্রকাশ না করলেও কতগুলো ব্যাংকের প্রতিরোধ সক্ষমতা কতটুকু তা প্রকাশ করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ‘শক্তিশালী বা স্ট্রং’ মান পায়নি কোনো ব্যাংক। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওভার ইনভয়েসিং ঠেকাতে পারলেও বন্ধ করা যায়নি আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি।

গত অর্থবছরে সন্ত্রাস ও জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে পুলিশ, গোয়েন্দা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়েছে। অর্থ পাচারে কেউ কেউ আমদানি পণ্যের দাম ২০ থেকে ২শ’ শতাংশ বেশি দেখিয়েছেন; আবার গাড়ি আমদানিতে দাম কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন। ডিজিটাল হুন্ডির এ অপতৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকায় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের বেশ কিছু পরিবেশক ও এজেন্টের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বারবার বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে বিষয়টি আবার সামনে এসেছে

এছাড়া বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে বিএফআইইউ। সন্দেহজনক লেনদেন এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপের তথ্য থাকলেও কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে পেরেছে, আমদানি করা পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ পর্যন্ত দেখিয়ে টাকা পাচার করা হয়েছে। তিনি এটাও বলেছেন- ডলার দেশের বাইরে চলে গেলে ফিরিয়ে আনা দুরূহ ব্যাপার।

দুই দশকের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে গত বছর। বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে এসব অর্থ জমা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। গত ২০২০ সালে সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ এক লাফে এক বছরে ৫৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার তথ্যটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন সরকারের পক্ষ থেকে নামমাত্র কর দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এই টাকা পাচার হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। যার একটা বড় মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি। এর বাইরে টাকা পাচার হচ্ছে ব্যবসার নামে। দেশ থেকে বৈধভাবে টাকা পাঠানোর কোনো পদ্ধতি না থাকার কারণে অবৈধ পথেই পাচার হচ্ছে টাকা। আর পাচার হওয়া এই টাকা রাখা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ থেকে যদি এত অর্থ বিদেশে পাচার হয় এবং বছরের পর বছর তা চলতে থাকে, তবে এ দেশের দ্রুত উন্নয়ন আশার করা বৃথা। একক বছর হিসেবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়। দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে ৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।

চারটি প্রক্রিয়ায় এ অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা। এছাড়াও টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। দুর্নীতি ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। ওই সব টাকায় দুর্নীতিবাজরা বিদেশে সম্পদ গড়ে তুলছেন, জমা রাখছেন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এর বাইরে আরও অনেক ব্যাংকে বাংলাদেশের পাচারকারীদের টাকা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। দেশ থেকে বিদেশে টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে; কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকে ব্যাংক থেকে এ ধরনের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তারপরও বাংলাদেশ থেকে কিভাবে এত টাকা পাচার হয়েছে?

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top