alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

কঠিন পরিস্থিতিতে প্রিয় দেশ

মোহাম্মদ আবু নোমান

: বৃহস্পতিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২২

বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ বর্তমানে যে দলই সমাবেশ ডেকে থাকে, তারা শত শত মাইল দূর থেকে গাড়ি ও মানুষ ভাড়া করে নিয়ে আসে। এতে জনদুর্ভোগসহ হাসপাতাল অভিমুখী অসুস্থ ও সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলো যে শহরে জনসভা করছে সে শহরে কি মানুষের অভাব আছে যে, রাস্তায় জনদুর্ভোগ তৈরি করে ভাড়া করে শত শত মাইল দূর থেকে মানুষ নিয়ে আসতে হবে? এখন এটা স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কেউই জনগণের কথা ভেবে রাজনীতি করে না। নিশ্চিত করেই বলা যায়, আমাদের প্রিয় দেশটি কঠিন পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

এমন না যে, এ সমাবেশ হলে আজকেই সরকার পতন হবে। সরকার তাহলে সব জনগণকে বিএনপি মনে করে সবকিছু বন্ধ করছে? বিএনপির সমাবেশের বিপরীতে আওয়ামী লীগ আরো বড় সমাবেশ করে দেখাতে পারে। তা না করে পেশিশক্তি দেখানো হলে, বিএনপিকে ঠেকানোর নামে জনগণকে কষ্ট দিলে বিএনপির সাপোর্টার বাড়বে। মানুষকে অতটা বোকা ভাবা ঠিক নয়। সরকার নিজে যানবাহন বন্ধ না করে, মালিক-শ্রমিকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যানবাহন বন্ধ রাখছে। অতীতে সব সরকারই এমনটা করেছে। বিএনপির আমলে যতবার সমাবেশ ডাকা হতো, ঢাকার চারপাশে অঘোষিত কারফিউ জারি হয়ে যেত।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও নির্বাচন বিষয়ে পাকিস্তানি ধারণা থেকে উত্তরণের কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, কেউ বিরোধী দলের মতামত নিয়ে দেশের উন্নয়নমূলক কাজ করেনি। ভিন্নমতের প্রতি সাধারণ সহিষ্ণতাটুকু দেখাতে কেউ রাজি হয়নি। এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেছে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ ও এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ অন্যদের নিয়ে আন্দোলন করেছে। এখন বিএনপি ও অন্যান্য দল একই দাবিতে আন্দোলন করছে।

গণতন্ত্র মানে শুধু ভোটের রাজনীতি বা ভোটের সময় মানুষের দুয়ারে-দুয়ারে ঘোরা, হাত-পা ধরা নয়! গণতন্ত্র হলো, গণমানুষ তথা সাধারণ মানুষের কথা বলা, জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা থাকা। কিন্তু বাংলাদেশে এই জবাবদিহিতা আছে কী? জবাবদিহিতা থাকলে দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, চুরিচামারি, লুটপাট চলতে পারবে না। বাংলাদেশ বেশকিছু ক্ষেত্রে সত্যিই অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু দেশটিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। দেশের জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন- এ বিষয়ে ফেয়ার কোনো পদ্ধতি আজও কার্যকর হয়নি। এ দায় কারো একার নয়। এ দায় সমানভাবে বর্তায় জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগের ওপর।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি বক্তব্য দিচ্ছে- নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে আগামী নির্বাচন থেকে তারা শুধু দূরেই থাকবে না, ওই নির্বাচন বর্জনও করবে। এ দেশের ইতিহাস হলো, যারা ক্ষমতায় থাকে তারা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যস্ত থাকে। তবে সবারই লক্ষ্য নির্বাচন। নির্বাচনের বৈতরণী পার হলেই পোয়াবারো। আমাদের দেশের রাজনীতি মূলত দোষারোপের রাজনীতির দুষ্টচক্রের আবর্তে আবর্তিত।

বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আবার যদি নির্বাচন নিয়ে নতুন করে কোনো সংকট তৈরি হয়, তাহলে এ মুহূর্তে সেই ঝামেলা সামাল দেওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের পরিণতি হবে শ্রীলংকা থেকেও আরো ভয়াবহ। আওয়ামী লীগ যদি একতরফা নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয় এবং বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা তা প্রতিরোধের চেষ্টা করে, কী পরিস্থিতি হবে? কারো হাতে ৫০০ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে, এক বোতল পেট্রল ধরিয়ে দিয়ে বললেই হয় ‘আগুন দিয়ে ওই বাসে ছুড়ে আয়’। তাতেই কাজ হয়ে যাবে। শ্রীলংকায় যা হয়েছে তাতে কেউই জয়ী হয়নি। রাষ্ট্র পরাজিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় আগের অবস্থায় আসতে তাদের অনেক অনেক দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। আজ দেশে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নয়, বিদেশ থেকে টাকা পাঠালে ব্যাংক দিতে পারবে না। রেমিট্যান্সে এর প্রভাবও ইতোমধ্যে পড়েছে। আমদানি ও প্রবাসী আয়ে হ্রাসের কারণে সরকার বেকায়দায় আছে। তাই নিজ দেশের ক্ষতি ও ধংস করায় উৎসাহ ও রিউমার না ছড়িয়ে বিরোধীদের মানবিক হতে হবে।

বর্তমানে অসহ্য বাজার দর, চাল, ডাল, তেলের দামে মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা দিশেহারা। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। বিদ্যুৎ-সংকট, জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি, ডলারের সংকট, মানুষের মেজাজ ঠিক নেই। বৈষম্য আর দারিদ্র্যও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সংকটে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড নিচে নেমে এসেছে। উচ্চ ঋণ নিয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা না হোক, নির্বাচন নিয়ে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘটলে তা সামাল দেওয়া, সংঘাত সংকটের ভার বহন করা সক্ষমতা আমাদের নেই। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যদিনের খরচের বোঝা মানুষজন আর টানতে পারছে না। এসব কারণে সাধারণের উপস্থিতি বিএনপির মিছিলে বাড়ছে।

এর আগে সিইসি মাঠ ছেড়ে না দিয়ে তলোয়ারের বিরুদ্ধে তলোয়ার বা রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। পরে যদিও সিইসি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি তলোয়ার ও রাইফেলের প্রসঙ্গটি বলেছেন কৌতুক করে। সিইসির এ বক্তব্যে যে নির্মম সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো- নির্বাচনের নামে দেশে শক্তি পরীক্ষার মহড়া। নির্বাচন কমিশন কৌতুক করে বললেও মাঠে কিন্তু ঢাল-তলোয়ারের খেলা শুরু হয়েছে। সিইসি যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চায়, প্রথমে তাদের কর্তব্য হবে নির্বাচনী মাঠকে তলোয়ারমুক্ত করা। ইতোপূর্বে বিএনপিকে ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক সন্ত্রাস ও হানাহানি ঘটেছে।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তার পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই এক-এগারোর পটপরিবর্তন ঘটে। বিরোধী দলের আন্দোলন, কূটনীতিকদের সুপরামর্শ উপেক্ষা করে বিএনপি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে দিয়ে একটি জবরদস্তির নির্বাচন করতে গিয়ে যে ভুল করেছিল, নেতারা এখন তা স্বীকার করেন। আওয়ামী লীগও যদি আবার দেশবাসীর ওপর জবরদস্তির নির্বাচন চাপিয়ে দিতে চায়, তার পরিণতি কী হবে সৃষ্টিকর্তাই জানেন। ক্ষমতা ছাড়লেই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় আটক হবেন ক্ষমতাসীনরা। তাই আমৃত্যু ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা জারি রাখবেন। বিএনপিও ঠিক একই কারণে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করার চেষ্টা করেছিল অতীতে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগও একই কথা বলত। সে সময়ে আওয়ামী লীগের দাবি যদি যৌক্তিক হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগও এখন সেই দাবিকে অযৌক্তিক ও অসাড় প্রমাণ করবে কিভাবে?

এরশাদ সরকারের পতনের পর তথা ১৯৯০ সালের পর থেকে যত সরকারই এসেছে, যে দৃশ্য বারবার দেখা গেছে তা হলো, বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া। অতীতে দেখা গেছে, যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা বিরোধী দলের ন্যায্য দাবিও আমলে নেন না। ফলে বিরোধী দল হরতাল, আন্দোলনের নামে জান-মালের হানি, গণমাধ্যমে দেশবাসীকে তাদের দাবি-দাওয়ার কথা জানানো, সর্বশেষ বিদেশিদের কাছে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে দাবি মানতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।

আমরা বলতে চাই, কেন বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান সে বিষয়টিও ভাবা দরকার। আওয়ামী লীগের ভুলে যাবার কথা নয়, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষদিকে আওয়ামী লীগ তখনকার দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে কতবার বৈঠক করেছেন বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। সেই সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, কানাডার হাইকমিশনার বারবারা রিচার্ডসন, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ডগলাস ফসকেট, এমনকি তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান, মিসর, ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন।

সরকারের আচরণ এমন হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়; যাতে বিরোধীরা অসহায় হয়ে ভিনদেশিদের কাছে সাহায্য চাইতে হয়। এটা শুধু সরকারের জন্য লজ্জার নয়, সরকারের ব্যর্থতাকেও স্পষ্ট করে। এটা ঠিক যে, দেশের নির্বাচন বা গণতন্ত্র নিয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া যতটা অমর্যাদার, তার চেয়ে বেশি লজ্জার সুষ্ঠু নির্বাচন না করার ক্ষেত্র তৈরি করা।

দল-মত নির্বিশেষে অতীতের সব অজ্ঞতা ও দুর্বলতা এবং ভুলগুলো ভুলে গিয়ে আমাদের দেশ গঠনে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীটাই একটা বিপদের সম্মুখীন। আমরা নিজেরা যদি দলাদলি করতে থাকি, হিংসার আগুনে জ্বলতে এবং জ্বালাতে থাকি তাহলে দিনশেষে ক্ষতিটা আমাদেরই হবে।

[লেখক : সাংবাদিক]

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

ভূমিকম্প, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা: মানসিকতার নতুন অর্থনীতি

নবম পে স্কেল ও এর আর্থসামাজিক প্রভাব

মৃত্যুদণ্ড, তারপর...

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

কঠিন পরিস্থিতিতে প্রিয় দেশ

মোহাম্মদ আবু নোমান

বৃহস্পতিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২২

বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ বর্তমানে যে দলই সমাবেশ ডেকে থাকে, তারা শত শত মাইল দূর থেকে গাড়ি ও মানুষ ভাড়া করে নিয়ে আসে। এতে জনদুর্ভোগসহ হাসপাতাল অভিমুখী অসুস্থ ও সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলো যে শহরে জনসভা করছে সে শহরে কি মানুষের অভাব আছে যে, রাস্তায় জনদুর্ভোগ তৈরি করে ভাড়া করে শত শত মাইল দূর থেকে মানুষ নিয়ে আসতে হবে? এখন এটা স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কেউই জনগণের কথা ভেবে রাজনীতি করে না। নিশ্চিত করেই বলা যায়, আমাদের প্রিয় দেশটি কঠিন পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

এমন না যে, এ সমাবেশ হলে আজকেই সরকার পতন হবে। সরকার তাহলে সব জনগণকে বিএনপি মনে করে সবকিছু বন্ধ করছে? বিএনপির সমাবেশের বিপরীতে আওয়ামী লীগ আরো বড় সমাবেশ করে দেখাতে পারে। তা না করে পেশিশক্তি দেখানো হলে, বিএনপিকে ঠেকানোর নামে জনগণকে কষ্ট দিলে বিএনপির সাপোর্টার বাড়বে। মানুষকে অতটা বোকা ভাবা ঠিক নয়। সরকার নিজে যানবাহন বন্ধ না করে, মালিক-শ্রমিকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যানবাহন বন্ধ রাখছে। অতীতে সব সরকারই এমনটা করেছে। বিএনপির আমলে যতবার সমাবেশ ডাকা হতো, ঢাকার চারপাশে অঘোষিত কারফিউ জারি হয়ে যেত।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও নির্বাচন বিষয়ে পাকিস্তানি ধারণা থেকে উত্তরণের কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, কেউ বিরোধী দলের মতামত নিয়ে দেশের উন্নয়নমূলক কাজ করেনি। ভিন্নমতের প্রতি সাধারণ সহিষ্ণতাটুকু দেখাতে কেউ রাজি হয়নি। এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেছে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ ও এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ অন্যদের নিয়ে আন্দোলন করেছে। এখন বিএনপি ও অন্যান্য দল একই দাবিতে আন্দোলন করছে।

গণতন্ত্র মানে শুধু ভোটের রাজনীতি বা ভোটের সময় মানুষের দুয়ারে-দুয়ারে ঘোরা, হাত-পা ধরা নয়! গণতন্ত্র হলো, গণমানুষ তথা সাধারণ মানুষের কথা বলা, জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা থাকা। কিন্তু বাংলাদেশে এই জবাবদিহিতা আছে কী? জবাবদিহিতা থাকলে দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, চুরিচামারি, লুটপাট চলতে পারবে না। বাংলাদেশ বেশকিছু ক্ষেত্রে সত্যিই অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু দেশটিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। দেশের জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন- এ বিষয়ে ফেয়ার কোনো পদ্ধতি আজও কার্যকর হয়নি। এ দায় কারো একার নয়। এ দায় সমানভাবে বর্তায় জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগের ওপর।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি বক্তব্য দিচ্ছে- নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে আগামী নির্বাচন থেকে তারা শুধু দূরেই থাকবে না, ওই নির্বাচন বর্জনও করবে। এ দেশের ইতিহাস হলো, যারা ক্ষমতায় থাকে তারা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যস্ত থাকে। তবে সবারই লক্ষ্য নির্বাচন। নির্বাচনের বৈতরণী পার হলেই পোয়াবারো। আমাদের দেশের রাজনীতি মূলত দোষারোপের রাজনীতির দুষ্টচক্রের আবর্তে আবর্তিত।

বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আবার যদি নির্বাচন নিয়ে নতুন করে কোনো সংকট তৈরি হয়, তাহলে এ মুহূর্তে সেই ঝামেলা সামাল দেওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের পরিণতি হবে শ্রীলংকা থেকেও আরো ভয়াবহ। আওয়ামী লীগ যদি একতরফা নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয় এবং বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা তা প্রতিরোধের চেষ্টা করে, কী পরিস্থিতি হবে? কারো হাতে ৫০০ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে, এক বোতল পেট্রল ধরিয়ে দিয়ে বললেই হয় ‘আগুন দিয়ে ওই বাসে ছুড়ে আয়’। তাতেই কাজ হয়ে যাবে। শ্রীলংকায় যা হয়েছে তাতে কেউই জয়ী হয়নি। রাষ্ট্র পরাজিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় আগের অবস্থায় আসতে তাদের অনেক অনেক দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। আজ দেশে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নয়, বিদেশ থেকে টাকা পাঠালে ব্যাংক দিতে পারবে না। রেমিট্যান্সে এর প্রভাবও ইতোমধ্যে পড়েছে। আমদানি ও প্রবাসী আয়ে হ্রাসের কারণে সরকার বেকায়দায় আছে। তাই নিজ দেশের ক্ষতি ও ধংস করায় উৎসাহ ও রিউমার না ছড়িয়ে বিরোধীদের মানবিক হতে হবে।

বর্তমানে অসহ্য বাজার দর, চাল, ডাল, তেলের দামে মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা দিশেহারা। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। বিদ্যুৎ-সংকট, জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি, ডলারের সংকট, মানুষের মেজাজ ঠিক নেই। বৈষম্য আর দারিদ্র্যও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সংকটে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড নিচে নেমে এসেছে। উচ্চ ঋণ নিয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা না হোক, নির্বাচন নিয়ে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘটলে তা সামাল দেওয়া, সংঘাত সংকটের ভার বহন করা সক্ষমতা আমাদের নেই। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যদিনের খরচের বোঝা মানুষজন আর টানতে পারছে না। এসব কারণে সাধারণের উপস্থিতি বিএনপির মিছিলে বাড়ছে।

এর আগে সিইসি মাঠ ছেড়ে না দিয়ে তলোয়ারের বিরুদ্ধে তলোয়ার বা রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। পরে যদিও সিইসি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি তলোয়ার ও রাইফেলের প্রসঙ্গটি বলেছেন কৌতুক করে। সিইসির এ বক্তব্যে যে নির্মম সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো- নির্বাচনের নামে দেশে শক্তি পরীক্ষার মহড়া। নির্বাচন কমিশন কৌতুক করে বললেও মাঠে কিন্তু ঢাল-তলোয়ারের খেলা শুরু হয়েছে। সিইসি যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চায়, প্রথমে তাদের কর্তব্য হবে নির্বাচনী মাঠকে তলোয়ারমুক্ত করা। ইতোপূর্বে বিএনপিকে ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক সন্ত্রাস ও হানাহানি ঘটেছে।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তার পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই এক-এগারোর পটপরিবর্তন ঘটে। বিরোধী দলের আন্দোলন, কূটনীতিকদের সুপরামর্শ উপেক্ষা করে বিএনপি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে দিয়ে একটি জবরদস্তির নির্বাচন করতে গিয়ে যে ভুল করেছিল, নেতারা এখন তা স্বীকার করেন। আওয়ামী লীগও যদি আবার দেশবাসীর ওপর জবরদস্তির নির্বাচন চাপিয়ে দিতে চায়, তার পরিণতি কী হবে সৃষ্টিকর্তাই জানেন। ক্ষমতা ছাড়লেই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় আটক হবেন ক্ষমতাসীনরা। তাই আমৃত্যু ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা জারি রাখবেন। বিএনপিও ঠিক একই কারণে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করার চেষ্টা করেছিল অতীতে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগও একই কথা বলত। সে সময়ে আওয়ামী লীগের দাবি যদি যৌক্তিক হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগও এখন সেই দাবিকে অযৌক্তিক ও অসাড় প্রমাণ করবে কিভাবে?

এরশাদ সরকারের পতনের পর তথা ১৯৯০ সালের পর থেকে যত সরকারই এসেছে, যে দৃশ্য বারবার দেখা গেছে তা হলো, বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া। অতীতে দেখা গেছে, যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা বিরোধী দলের ন্যায্য দাবিও আমলে নেন না। ফলে বিরোধী দল হরতাল, আন্দোলনের নামে জান-মালের হানি, গণমাধ্যমে দেশবাসীকে তাদের দাবি-দাওয়ার কথা জানানো, সর্বশেষ বিদেশিদের কাছে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে দাবি মানতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।

আমরা বলতে চাই, কেন বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান সে বিষয়টিও ভাবা দরকার। আওয়ামী লীগের ভুলে যাবার কথা নয়, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষদিকে আওয়ামী লীগ তখনকার দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে কতবার বৈঠক করেছেন বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। সেই সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, কানাডার হাইকমিশনার বারবারা রিচার্ডসন, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ডগলাস ফসকেট, এমনকি তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান, মিসর, ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন।

সরকারের আচরণ এমন হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়; যাতে বিরোধীরা অসহায় হয়ে ভিনদেশিদের কাছে সাহায্য চাইতে হয়। এটা শুধু সরকারের জন্য লজ্জার নয়, সরকারের ব্যর্থতাকেও স্পষ্ট করে। এটা ঠিক যে, দেশের নির্বাচন বা গণতন্ত্র নিয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া যতটা অমর্যাদার, তার চেয়ে বেশি লজ্জার সুষ্ঠু নির্বাচন না করার ক্ষেত্র তৈরি করা।

দল-মত নির্বিশেষে অতীতের সব অজ্ঞতা ও দুর্বলতা এবং ভুলগুলো ভুলে গিয়ে আমাদের দেশ গঠনে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীটাই একটা বিপদের সম্মুখীন। আমরা নিজেরা যদি দলাদলি করতে থাকি, হিংসার আগুনে জ্বলতে এবং জ্বালাতে থাকি তাহলে দিনশেষে ক্ষতিটা আমাদেরই হবে।

[লেখক : সাংবাদিক]

back to top