তামান্না-ই-নূর
বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর, বসবাস অনুপযোগী ও দূষিত শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শীর্ষে অবস্থান করছে
পরিবেশদূষণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশ নামের এই ছোট্ট ভূখন্ডটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। মানবসৃষ্ট দূষণে ব্যাপকভাবে জলবায়ুগত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। পরিবেশদূষণ, বিশেষত বায়ুদূষণ কেবল পরিবেশই নয় বরং মানুষের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ বায়ুদূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে যা আমাদের সুস্থভাবে বাঁচার পথকে অসম্ভব করে তুলেছে।
বায়ুদূষণ ও এর প্রভাব
বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট দূষিত ধোঁয়া, গ্যাস, গন্ধ, বাষ্প প্রভৃতি অনিষ্টকর উপাদান যখন বায়ুমন্ডলের সঙ্গে মিশে মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ জগতের ক্ষতিসাধন করে তাই মূলত বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ মূলত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে হয়।
প্রাকৃতিক কারণ
বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণ যেমন- অগ্নুৎপাতের সময় আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত নানা ধরনের দূষিত গ্যাস, ছাই; জলাভূমি থেকে নির্গত মিথেন গ্যাস, মরু অঞ্চল থেকে বাতাসে মিশে যাওয়া বিপুল পরিমাণে ধূলিকণা, সামুদ্রিক জলভাগ থেকে বাতাসে মেশা বিপুল পরিমাণ লবণকণা, অরণ্যের দাবানল ইত্যাদি কারণে বায়ুদূষিত হয়।
মানবসৃষ্ট কারণ
একবিংশ শতাব্দীতে মানবসৃষ্ট কারণে প্রধানত বায়ুদূষিত হয়। কলকারখানা, যানবাহন, খনিজ তেল সংশোধনাগার, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বিপুল পরিমাণ দূষিত গ্যাস, ছাই, ধোঁয়া, পারমাণবিক উৎপাদন কেন্দ্র থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় রশ্মি ইত্যাদি কারণে বায়ু ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফারডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেনডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন মনোক্সাইড, সালফিউরিক অ্যাসিড, অ্যাসিড বৃষ্টি ইত্যাদি উপাদানসমূহ বাতাসের সঙ্গে মিশে বায়ুদূষণ ঘটায়।
বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব : দীর্ঘমেয়াদি দূষিত বায়ুর সংস্পর্শ মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা মতে, বাংলাদেশের দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষন্নতায় ভুগছেন যা কম দূষণ এলাকার চাইতে বেশি। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা মানসিক চাপ তৈরি করে যা মানুষের ভালো থাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই মানসিক চাপের দরুন মনোসংযোগে সমস্যা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া ইত্যাদি হতে পারে।
দূষিত বায়ুর সংস্পর্শ চোখ, কান বা গলায় সংক্রমণ ঘটায়, যার ক্ষতিকর প্রভাবে নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, মাথা ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকায় ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, লিভার বা কিডনির মারাত্মক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। দূষিত এলাকার গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে এবং শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের সার্বিক পরিস্থিতি : নিদারুণ হলেও সত্যি যে, বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর, বসবাস অনুপযোগী ও দূষিত শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রতি বছর ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে প্রায় ৫০ টন সিসা নির্গত হচ্ছে এবং শুষ্ক ঋতুতে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে বায়ুতে সিসার পরিমাণ সর্বোচ্চে পৌঁছে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণাধীন ভবনের ধুলা।
ঢাকায় যানজট ও নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ বায়ুদূষণ হয়, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ু মানের চেয়ে ১৫০ শতাংশ এবং ইটভাটার কারণে যে দূষণ হয় তা ১৩৬ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ পরমাণুশক্তি কমিশনের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, নগরবাসী রাস্তাঘাটে নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে সিসা গ্রহণ করছে তা পরিবেশ অধিদপ্তরকর্তৃক ঘোষিত নিরাপদ মাত্রার চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি। গবেষণায় জানা যায়, ঢাকায় সারাদিনে একজন যে পরিমাণ দূষিত বায়ুগ্রহণ করেন, তা প্রায় দুটি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতিকর।
‘বিশ্বের বায়ুর মান প্রতিবেদন-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫ (মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা)-এর মাত্রা ৭৬.৯। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি ঘন মিটারে যা থাকার কথা ১০’র কম।
স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের প্রতিবেদন মতে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। ২০১৯ সালে বায়ুদূষণ ছিল বাংলাদেশে মৃত্যু ও অক্ষমতার দ্বিতীয় বড় কারণ। সেই বছর প্রায় ৮৮ হাজার মৃত্যুর জন্য বায়ুদূষণকে দায়ী করা হয়।
বায়ুদূষণ রোধে প্রণীত বিধিমালা ও সরকারের পদক্ষেপ : ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৮ (ক) তথা পরিবেশ সুরক্ষার মূলনীতি এবং ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫’কে সামনে রেখে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া, অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন এবং নাগরিকের জীবন ও বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের অধিকার ও নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে ‘বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধি মালা, ২০২২’ প্রণীত হয়েছে যা বায়ুদূষণ রোধকল্পের বিধান হিসেবে কাজ করছে। ওই বিধিমালায়- বায়ুদূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা নিরূপণ, জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, দূষণ প্রতিরোধ পরিকল্পনা, অপরাধ, দন্ড, অভিযোগ ও প্রতিকারসহ বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বায়ুদূষণ সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহের জন্য সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদন্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে এখানে।
অপরদিকে, ইটভাটা থেকে সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’, (সংশোধিত ২০১৯) জারি করা হয়েছে এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ১ হাজার ৫১৬টি অভিযান পরিচালনা করে ২ হাজার ৫৯৪টি ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮৮২টি অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদসহ ৬২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী, মো. শাহাব উদ্দিন এক সংবাদ সম্মেলনে শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র বা ইটিপি বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং অনলাইনের আওতায় তা আনার চেষ্টা করছে। যার ফলে কিছুটা হলেও সঠিকভাবে বর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব।
পরিবেশ দূষণের সামগ্রিক প্রভাবে জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে আমাদের অস্তিত্বই বিলীন হতে পারে। তবুও আমরা আমাদের পরিবেশকে রক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। আমাদের এই উদাসীনতায় আমাদের ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাই বাংলাদেশকে বাঁচাতে ও বায়ুদূষণ রোধকল্পে কেবল সরকারই নয় বরং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার উদ্যোগই পারে পরিবেশকে রক্ষা করে আগামী প্রজন্মের জন্য সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে। তাই আসুন আমরা একসঙ্গে উচ্চারণ করি- ‘বায়ুদূষণ রুখবো, সোনার বাংলা গড়বো।’
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গিরনগর বিশ^বিদ্যালয়]
তামান্না-ই-নূর
বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর, বসবাস অনুপযোগী ও দূষিত শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শীর্ষে অবস্থান করছে
বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৩
পরিবেশদূষণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশ নামের এই ছোট্ট ভূখন্ডটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। মানবসৃষ্ট দূষণে ব্যাপকভাবে জলবায়ুগত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। পরিবেশদূষণ, বিশেষত বায়ুদূষণ কেবল পরিবেশই নয় বরং মানুষের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ বায়ুদূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে যা আমাদের সুস্থভাবে বাঁচার পথকে অসম্ভব করে তুলেছে।
বায়ুদূষণ ও এর প্রভাব
বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট দূষিত ধোঁয়া, গ্যাস, গন্ধ, বাষ্প প্রভৃতি অনিষ্টকর উপাদান যখন বায়ুমন্ডলের সঙ্গে মিশে মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ জগতের ক্ষতিসাধন করে তাই মূলত বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ মূলত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে হয়।
প্রাকৃতিক কারণ
বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণ যেমন- অগ্নুৎপাতের সময় আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত নানা ধরনের দূষিত গ্যাস, ছাই; জলাভূমি থেকে নির্গত মিথেন গ্যাস, মরু অঞ্চল থেকে বাতাসে মিশে যাওয়া বিপুল পরিমাণে ধূলিকণা, সামুদ্রিক জলভাগ থেকে বাতাসে মেশা বিপুল পরিমাণ লবণকণা, অরণ্যের দাবানল ইত্যাদি কারণে বায়ুদূষিত হয়।
মানবসৃষ্ট কারণ
একবিংশ শতাব্দীতে মানবসৃষ্ট কারণে প্রধানত বায়ুদূষিত হয়। কলকারখানা, যানবাহন, খনিজ তেল সংশোধনাগার, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বিপুল পরিমাণ দূষিত গ্যাস, ছাই, ধোঁয়া, পারমাণবিক উৎপাদন কেন্দ্র থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় রশ্মি ইত্যাদি কারণে বায়ু ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফারডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেনডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন মনোক্সাইড, সালফিউরিক অ্যাসিড, অ্যাসিড বৃষ্টি ইত্যাদি উপাদানসমূহ বাতাসের সঙ্গে মিশে বায়ুদূষণ ঘটায়।
বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব : দীর্ঘমেয়াদি দূষিত বায়ুর সংস্পর্শ মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা মতে, বাংলাদেশের দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষন্নতায় ভুগছেন যা কম দূষণ এলাকার চাইতে বেশি। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা মানসিক চাপ তৈরি করে যা মানুষের ভালো থাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই মানসিক চাপের দরুন মনোসংযোগে সমস্যা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া ইত্যাদি হতে পারে।
দূষিত বায়ুর সংস্পর্শ চোখ, কান বা গলায় সংক্রমণ ঘটায়, যার ক্ষতিকর প্রভাবে নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, মাথা ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকায় ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, লিভার বা কিডনির মারাত্মক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। দূষিত এলাকার গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে এবং শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের সার্বিক পরিস্থিতি : নিদারুণ হলেও সত্যি যে, বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর, বসবাস অনুপযোগী ও দূষিত শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রতি বছর ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে প্রায় ৫০ টন সিসা নির্গত হচ্ছে এবং শুষ্ক ঋতুতে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে বায়ুতে সিসার পরিমাণ সর্বোচ্চে পৌঁছে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণাধীন ভবনের ধুলা।
ঢাকায় যানজট ও নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ বায়ুদূষণ হয়, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ু মানের চেয়ে ১৫০ শতাংশ এবং ইটভাটার কারণে যে দূষণ হয় তা ১৩৬ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ পরমাণুশক্তি কমিশনের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, নগরবাসী রাস্তাঘাটে নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে সিসা গ্রহণ করছে তা পরিবেশ অধিদপ্তরকর্তৃক ঘোষিত নিরাপদ মাত্রার চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি। গবেষণায় জানা যায়, ঢাকায় সারাদিনে একজন যে পরিমাণ দূষিত বায়ুগ্রহণ করেন, তা প্রায় দুটি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতিকর।
‘বিশ্বের বায়ুর মান প্রতিবেদন-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫ (মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা)-এর মাত্রা ৭৬.৯। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি ঘন মিটারে যা থাকার কথা ১০’র কম।
স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের প্রতিবেদন মতে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। ২০১৯ সালে বায়ুদূষণ ছিল বাংলাদেশে মৃত্যু ও অক্ষমতার দ্বিতীয় বড় কারণ। সেই বছর প্রায় ৮৮ হাজার মৃত্যুর জন্য বায়ুদূষণকে দায়ী করা হয়।
বায়ুদূষণ রোধে প্রণীত বিধিমালা ও সরকারের পদক্ষেপ : ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৮ (ক) তথা পরিবেশ সুরক্ষার মূলনীতি এবং ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫’কে সামনে রেখে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া, অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন এবং নাগরিকের জীবন ও বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের অধিকার ও নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে ‘বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধি মালা, ২০২২’ প্রণীত হয়েছে যা বায়ুদূষণ রোধকল্পের বিধান হিসেবে কাজ করছে। ওই বিধিমালায়- বায়ুদূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা নিরূপণ, জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, দূষণ প্রতিরোধ পরিকল্পনা, অপরাধ, দন্ড, অভিযোগ ও প্রতিকারসহ বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বায়ুদূষণ সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহের জন্য সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদন্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে এখানে।
অপরদিকে, ইটভাটা থেকে সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’, (সংশোধিত ২০১৯) জারি করা হয়েছে এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ১ হাজার ৫১৬টি অভিযান পরিচালনা করে ২ হাজার ৫৯৪টি ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮৮২টি অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদসহ ৬২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী, মো. শাহাব উদ্দিন এক সংবাদ সম্মেলনে শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র বা ইটিপি বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং অনলাইনের আওতায় তা আনার চেষ্টা করছে। যার ফলে কিছুটা হলেও সঠিকভাবে বর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব।
পরিবেশ দূষণের সামগ্রিক প্রভাবে জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে আমাদের অস্তিত্বই বিলীন হতে পারে। তবুও আমরা আমাদের পরিবেশকে রক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। আমাদের এই উদাসীনতায় আমাদের ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাই বাংলাদেশকে বাঁচাতে ও বায়ুদূষণ রোধকল্পে কেবল সরকারই নয় বরং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার উদ্যোগই পারে পরিবেশকে রক্ষা করে আগামী প্রজন্মের জন্য সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে। তাই আসুন আমরা একসঙ্গে উচ্চারণ করি- ‘বায়ুদূষণ রুখবো, সোনার বাংলা গড়বো।’
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গিরনগর বিশ^বিদ্যালয়]