alt

উপ-সম্পাদকীয়

ফ্লোর প্রাইস ও স্থিতিশীল শেয়ারবাজার

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম

: বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৩

গুজবের সবচেয়ে উর্বর জায়গা হচ্ছে শেয়ারবাজার। গুজবই এক সময় শেয়ারবাজারে গজবে পরিণত হয়। হামেশাই এমনই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের শেয়ারবাজার। যখনই বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পায় তখনই মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় কোনো না কোনো গুজব। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে এমনই এক গুজবের বিষয়বস্তু হচ্ছে- ফ্লোর প্রাইস। ফ্লোর প্রাইস তুলে ফেলা হবে কী হবে না, এটা বিনিয়োগকারীদের চিন্তার বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথমে ভেবে দেখা দরকার, ফ্লোর প্রাইস কেন আরোপ করা হয়েছে এবং কাদের জন্য? বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে শেয়ারদর যখন একেবারে তলানিতে এবং শেয়ারবাজারের সূত্র মতে, বাজারের নিজস্ব শক্তিতে ঘুরে না দাঁড়িয়ে উল্টো আচরণ করে অর্থাৎ সূচক যখন বারবার সূচনালগ্নের অবস্থানে ফিরে যায়। তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিরূপায় হয়ে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। এযাবৎকালে শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এবার নিয়ে দুইবার ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়া হয়। যদিও এটি একটি সাময়িক সমাধান। ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আস্থা হারিয়ে ফেলা হতাশ বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। তারা নিশ্চয়তা দেয়, শেয়ারদর এর নিচে আর নামবে না। এটি দৃশ্যত বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য। ফলে সূচকও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে যায়। ধারণা করা হয়, যারা সূচক দেখে বিনিয়োগ করে এর ফলে তারা আবার বিনিয়োগে ফিরে আসবে। বাজার চাঙা হবে।

কিন্তু প্রকৃত চিত্র বলছে অন্য কথা- বছরজুড়েই অস্থিরতায় কেটেছে শেয়ারবাজার। ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৭ হাজার ২৪ পয়েন্ট। লেনদেন হয় ১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। সেই অবস্থান থেকে সূচকের টানা ক্রমাবনতি হয়ে ২৯ ডিসেম্বর সূচক দাঁড়ায় ৬ হাজার ২০৬ পয়েন্টে। লেনদেনেরও একই হাল ৩৪৫ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আবার নতুন বছরের ২ জানুয়ারি লেনদেন হয় ১৪৫ কোটি টাকা।

নতুন বছরেও দরপতন অব্যাহত আছে। হাজার কোটি টাকার লেনদেন নেমেছে ২০০ কোটি টাকার আশপাশে। বাজারে চরম তারল্য সংকট চলছে। কারণ বিনিয়োগকারীরা লেনদেনে অংশ নিচ্ছেন না। আরও দরপতনের অপেক্ষা করছে। বাজারে প্রায় ৪০০ কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে অনেক কোম্পানি ভালো মৌলভিত্তির। যেখানে যেকোনো বিবেচনায় বিনিয়োগ করা যায়। ডিভিডেন্ড ইল্ড অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় হচ্ছে- এসব কোম্পানিও ফ্লোর প্রাইসে পড়ে রয়েছে। আর লেনদেন হচ্ছে হাতেগোনা নির্দিষ্ট ২৫ থেকে ৩০টি কোম্পানির।

বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। ফলে মোটের ওপর বাজারে এক ধরনের অচলায়তন চলছে। এ থেকে নিষ্কৃতির উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। কেউ কেউ বলছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারে লেনদেন হচ্ছে না। বড় কোম্পানির শেয়ারে কোনো মুভমেন্ট নেই। ছোট কোম্পানির শেয়ার দিয়ে একটি কৃত্রিম সূচক দেখানো হচ্ছে। এইভাবে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে দিনের পর দিন বাজার অকার্যকর করে রাখার কোনো মানে হয় না। তাই তো অনেকের মতে, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া ১৬৯টি কোম্পানির নিচের দিকে যে ১ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়েছে তা ২ থেকে ৩ শতাংশ করে পর্যবেক্ষণ করা যায় কিনা।

পাশাপাশি ব্লক মার্কেটে শেয়ার কেনাবেচার পরিমাণ ৫ লাখ টাকার পরিবর্তে ২ লাখ নির্ধারণ করা। কারণ যাদের পুঁজি কম তারাও যেন লেনদেন করতে পারে। ফলে লেনদেন বাড়বে। অনেকের যুক্তি- সারাবিশ্বইতো যুদ্ধের উত্তাপে পুড়ছে। কিন্তু কোথাও তো ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়নি অথবা এ জাতীয় ঠেকনা দিয়ে শেয়ারবাজার ঠেকিয়ে রাখার কোনো একাডেমিক ভিত্তি নেই। শেয়ারবাজারে চাহিদা ও সরবরাহ মুক্তভাবে ওঠানামা করতে দেয়া উচিত। ধরে নিলাম কথাগুলো সবই যৌক্তিক। এই নজিরবিহীন ফেøার প্রাইসই যত সমস্যার মূল। তবে যারা যুদ্ধ করছে, সেই রাশিয়ার শেয়ারবাজার এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে অথবা দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কার বাজারও স্বাভাবিকের পথে। সমস্যা যত বাংলাদেশে।

শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতা একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আজ ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হলে, সূচক যে আবার ৩ হাজারের ঘরে আসবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? আমরা কি প্রতি বছর নতুন করে শুরু করব? শেয়ারবাজারের এই ন্যক্কারজনক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আর কত?

বিনিয়োগকারীদের সবাই স্বল্পসময়ে ধনী হতে চায়। ধনী একশ্রেণীর লোক ঠিকই হয়, তবে বছর শেষে ফতুর হয় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে আমাদের বিনিয়োগকারীরাও সাহসী নয়। জ্ঞানের স্বল্পতা থেকে এই ভীরু মানসিকতা তৈরি হয়। না হয় ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারগুলোর পিই রেশিও এখন যথেষ্ট বিনিয়োগযোগ্য থাকার পরও কেউ বিনিয়োগ করছে না। সবাই অপেক্ষায় আরও দর কমবে। কোম্পানির শেয়ারের অন্তর্নিহিত যে একটি মূল্য আছে সেটি কেউ বুঝতে চায় না। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে অভ্যস্থ নয়। সবাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে প্রথমদিন থেকেই লাভ করতে চায়। মনে রাখা দরকার, দ্রুত অর্থ উপার্জনের কোনো শর্টকাট নেই। প্রতিটি দ্রুত অর্থ উপার্জনের কৌশলগুলো অবশেষে অর্থ হারানোর কৌশল হিসেবে দেখা দেয়।

ভালো মৌলভিত্তি বা উচ্চমানের শেয়ারের বিনিয়োগ এবং সঠিক সময়ের জন্য তাদের ধরে রাখা সম্পদ তৈরির একমাত্র উপায়। অনেক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে সমস্ত সম্পদ শ্রেণীর মধ্যে, শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দোষ দিয়ে কী লাভ। যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো এক নীতির ওপর অটল থাকতে পারে না। সকাল-সন্ধ্যা নীতি পরিবর্তন করে। আর ফ্লোর প্রাইস তুলে ফেলার জন্য সবচেয়ে যাদের বেশি তাড়া বা লেনদেনের জন্য যে এত মায়াকান্না, সেই ব্রোকার হাউসদের কথা বললে প্রথমে বলতে হয়, কিছুদিন আগেও যখন বিভিন্ন জাঙ্ক শেয়ারে অস্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছিল বা এখনো হয়। তখন কি এই ব্রোকাররা তাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁস অর্থাৎ অসচেতন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কোথায় বিনিয়োগ করা উচিত বা অনুচিত, সে বিষয়ে সতর্ক করেছে?

তারা সর্বদা নগদ কমিশন লাভে ব্যস্ত। ফলে আজ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নিঃস্ব। বাজারের কোনো নিজস্বতা নেই। লেনদেনের দীনতায় হাউসগুলোর লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। শেয়ারশুন্য বিও হিসাবের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। নতুন ট্রেক লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নাকি একেবারেই বিনিয়োগকারী খুঁজে পাচ্ছে না। এটি ব্রোকার হাউসের অতীত কর্মের ফল। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, ব্রোকার হাউস কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনের একটি কথা মনে রাখতে হবে। শেয়ারবাজার খুব বেশি দৌড়ানোর জায়গা নয়। এখানে আস্তে আস্তে ধৈর্য নিয়ে হাঁটতে হয়। তা হলেই গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ সুগম হয়।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ফ্লোর প্রাইস ও স্থিতিশীল শেয়ারবাজার

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম

বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৩

গুজবের সবচেয়ে উর্বর জায়গা হচ্ছে শেয়ারবাজার। গুজবই এক সময় শেয়ারবাজারে গজবে পরিণত হয়। হামেশাই এমনই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের শেয়ারবাজার। যখনই বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পায় তখনই মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় কোনো না কোনো গুজব। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে এমনই এক গুজবের বিষয়বস্তু হচ্ছে- ফ্লোর প্রাইস। ফ্লোর প্রাইস তুলে ফেলা হবে কী হবে না, এটা বিনিয়োগকারীদের চিন্তার বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথমে ভেবে দেখা দরকার, ফ্লোর প্রাইস কেন আরোপ করা হয়েছে এবং কাদের জন্য? বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে শেয়ারদর যখন একেবারে তলানিতে এবং শেয়ারবাজারের সূত্র মতে, বাজারের নিজস্ব শক্তিতে ঘুরে না দাঁড়িয়ে উল্টো আচরণ করে অর্থাৎ সূচক যখন বারবার সূচনালগ্নের অবস্থানে ফিরে যায়। তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিরূপায় হয়ে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। এযাবৎকালে শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এবার নিয়ে দুইবার ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়া হয়। যদিও এটি একটি সাময়িক সমাধান। ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আস্থা হারিয়ে ফেলা হতাশ বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। তারা নিশ্চয়তা দেয়, শেয়ারদর এর নিচে আর নামবে না। এটি দৃশ্যত বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য। ফলে সূচকও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে যায়। ধারণা করা হয়, যারা সূচক দেখে বিনিয়োগ করে এর ফলে তারা আবার বিনিয়োগে ফিরে আসবে। বাজার চাঙা হবে।

কিন্তু প্রকৃত চিত্র বলছে অন্য কথা- বছরজুড়েই অস্থিরতায় কেটেছে শেয়ারবাজার। ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৭ হাজার ২৪ পয়েন্ট। লেনদেন হয় ১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। সেই অবস্থান থেকে সূচকের টানা ক্রমাবনতি হয়ে ২৯ ডিসেম্বর সূচক দাঁড়ায় ৬ হাজার ২০৬ পয়েন্টে। লেনদেনেরও একই হাল ৩৪৫ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আবার নতুন বছরের ২ জানুয়ারি লেনদেন হয় ১৪৫ কোটি টাকা।

নতুন বছরেও দরপতন অব্যাহত আছে। হাজার কোটি টাকার লেনদেন নেমেছে ২০০ কোটি টাকার আশপাশে। বাজারে চরম তারল্য সংকট চলছে। কারণ বিনিয়োগকারীরা লেনদেনে অংশ নিচ্ছেন না। আরও দরপতনের অপেক্ষা করছে। বাজারে প্রায় ৪০০ কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে অনেক কোম্পানি ভালো মৌলভিত্তির। যেখানে যেকোনো বিবেচনায় বিনিয়োগ করা যায়। ডিভিডেন্ড ইল্ড অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় হচ্ছে- এসব কোম্পানিও ফ্লোর প্রাইসে পড়ে রয়েছে। আর লেনদেন হচ্ছে হাতেগোনা নির্দিষ্ট ২৫ থেকে ৩০টি কোম্পানির।

বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। ফলে মোটের ওপর বাজারে এক ধরনের অচলায়তন চলছে। এ থেকে নিষ্কৃতির উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। কেউ কেউ বলছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারে লেনদেন হচ্ছে না। বড় কোম্পানির শেয়ারে কোনো মুভমেন্ট নেই। ছোট কোম্পানির শেয়ার দিয়ে একটি কৃত্রিম সূচক দেখানো হচ্ছে। এইভাবে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে দিনের পর দিন বাজার অকার্যকর করে রাখার কোনো মানে হয় না। তাই তো অনেকের মতে, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া ১৬৯টি কোম্পানির নিচের দিকে যে ১ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়েছে তা ২ থেকে ৩ শতাংশ করে পর্যবেক্ষণ করা যায় কিনা।

পাশাপাশি ব্লক মার্কেটে শেয়ার কেনাবেচার পরিমাণ ৫ লাখ টাকার পরিবর্তে ২ লাখ নির্ধারণ করা। কারণ যাদের পুঁজি কম তারাও যেন লেনদেন করতে পারে। ফলে লেনদেন বাড়বে। অনেকের যুক্তি- সারাবিশ্বইতো যুদ্ধের উত্তাপে পুড়ছে। কিন্তু কোথাও তো ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়নি অথবা এ জাতীয় ঠেকনা দিয়ে শেয়ারবাজার ঠেকিয়ে রাখার কোনো একাডেমিক ভিত্তি নেই। শেয়ারবাজারে চাহিদা ও সরবরাহ মুক্তভাবে ওঠানামা করতে দেয়া উচিত। ধরে নিলাম কথাগুলো সবই যৌক্তিক। এই নজিরবিহীন ফেøার প্রাইসই যত সমস্যার মূল। তবে যারা যুদ্ধ করছে, সেই রাশিয়ার শেয়ারবাজার এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে অথবা দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কার বাজারও স্বাভাবিকের পথে। সমস্যা যত বাংলাদেশে।

শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতা একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আজ ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হলে, সূচক যে আবার ৩ হাজারের ঘরে আসবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? আমরা কি প্রতি বছর নতুন করে শুরু করব? শেয়ারবাজারের এই ন্যক্কারজনক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আর কত?

বিনিয়োগকারীদের সবাই স্বল্পসময়ে ধনী হতে চায়। ধনী একশ্রেণীর লোক ঠিকই হয়, তবে বছর শেষে ফতুর হয় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে আমাদের বিনিয়োগকারীরাও সাহসী নয়। জ্ঞানের স্বল্পতা থেকে এই ভীরু মানসিকতা তৈরি হয়। না হয় ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারগুলোর পিই রেশিও এখন যথেষ্ট বিনিয়োগযোগ্য থাকার পরও কেউ বিনিয়োগ করছে না। সবাই অপেক্ষায় আরও দর কমবে। কোম্পানির শেয়ারের অন্তর্নিহিত যে একটি মূল্য আছে সেটি কেউ বুঝতে চায় না। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে অভ্যস্থ নয়। সবাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে প্রথমদিন থেকেই লাভ করতে চায়। মনে রাখা দরকার, দ্রুত অর্থ উপার্জনের কোনো শর্টকাট নেই। প্রতিটি দ্রুত অর্থ উপার্জনের কৌশলগুলো অবশেষে অর্থ হারানোর কৌশল হিসেবে দেখা দেয়।

ভালো মৌলভিত্তি বা উচ্চমানের শেয়ারের বিনিয়োগ এবং সঠিক সময়ের জন্য তাদের ধরে রাখা সম্পদ তৈরির একমাত্র উপায়। অনেক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে সমস্ত সম্পদ শ্রেণীর মধ্যে, শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দোষ দিয়ে কী লাভ। যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো এক নীতির ওপর অটল থাকতে পারে না। সকাল-সন্ধ্যা নীতি পরিবর্তন করে। আর ফ্লোর প্রাইস তুলে ফেলার জন্য সবচেয়ে যাদের বেশি তাড়া বা লেনদেনের জন্য যে এত মায়াকান্না, সেই ব্রোকার হাউসদের কথা বললে প্রথমে বলতে হয়, কিছুদিন আগেও যখন বিভিন্ন জাঙ্ক শেয়ারে অস্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছিল বা এখনো হয়। তখন কি এই ব্রোকাররা তাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁস অর্থাৎ অসচেতন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কোথায় বিনিয়োগ করা উচিত বা অনুচিত, সে বিষয়ে সতর্ক করেছে?

তারা সর্বদা নগদ কমিশন লাভে ব্যস্ত। ফলে আজ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নিঃস্ব। বাজারের কোনো নিজস্বতা নেই। লেনদেনের দীনতায় হাউসগুলোর লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। শেয়ারশুন্য বিও হিসাবের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। নতুন ট্রেক লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নাকি একেবারেই বিনিয়োগকারী খুঁজে পাচ্ছে না। এটি ব্রোকার হাউসের অতীত কর্মের ফল। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, ব্রোকার হাউস কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনের একটি কথা মনে রাখতে হবে। শেয়ারবাজার খুব বেশি দৌড়ানোর জায়গা নয়। এখানে আস্তে আস্তে ধৈর্য নিয়ে হাঁটতে হয়। তা হলেই গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ সুগম হয়।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

back to top