alt

উপ-সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব

মোস্তাফা জব্বার

: সোমবার, ০৬ মার্চ ২০২৩
image

তিন ॥

১৫ মার্চ ১৯৭৩ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের দেশে এমন ধরনের গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন, যে শিক্ষায় সত্যিকার মানুষ গড়ার মাধ্যমে জাতিকে নতুন করে সংগঠিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে পারি।’ বঙ্গবন্ধুর জীবনের সমগ্র ঘটনাপুঞ্জ বিশ্লেষণ করে এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর বাকশালের চিন্তাভাবনা হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি, বরং ১৯৭০ সাল থেকেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও এর কর্মপদ্ধতি বঙ্গবন্ধুর মাথায় ছিল এবং সেই অনুযায়ী তিনি বারবার কথা বলেছেন ও সেই ভাবনাকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। আমি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে স্মরণ করতে পারি যে ছাত্রলীগের কর্মীরা ৭০-এ নির্বাচনের আগেই আমরা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান দিয়েছি। জনগণকে সমাজতন্ত্রের ধারনায় উদ্বুদ্ধ করেছি।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত থাকলেও কেউ ভুলেও বলে না যে, ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলাফলেই ছিল এই দুর্ভিক্ষ। তিনি দুর্ভিক্ষের দায়ভার নিয়ে কোনো ভণিতা করেননি। সকল ব্যর্থতার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে দুর্ভিক্ষে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন।

একদিকে ১৯৭৪ সালের খাদ্যাভাব বঙ্গবন্ধুকে যেমন খুব মর্মাহত করেছিল, অন্যদিকে এর পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের খাদ্যপ্রাপ্তিতে যে ভয়াবহ সংকট তৈরি হয় তা উতরে যাবার পথ খুঁজছিলেন বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে সেই পরিস্থিতিতে কাজে লাগিয়ে বাম উগ্রপন্থিরা দেশকে অস্থিতিশীল করার, নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তারা নাশকতামূলক কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডও শুরু করে। বস্তুত সারা দেশ যখন খাদ্যাভাবে জর্জরিত তখন চরমপন্থিদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চরম আকার ধারণ করে। তাদের প্রকাশ্য আহ্বান ছিলো বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করা।

সমাজতন্ত্র বা বিপ্লবের নামে নানা ধরনের গোপন কর্মকান্ডও চলতে থাকে। আর এদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণিহীন ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ গঠন করার লক্ষ্যে আরেক স্লোগানধারী সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির ক্যাডাররা ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ৪৯২৫টি গুপ্তহত্যা করেছিল। ৬০টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে জনজীবনকে অস্থির করে তুলছিল। ১৯৭২-৭৩ সালের এই সময়টাতে পাকিস্তানপন্থি জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপিসহ বেশির ভাগ পাকিস্তানী অনুচর রাজনৈতিক দলগুলো গোপনে জুলফিকার আলীর প্রেসক্রিপশনে ‘মুসলিম বাংলা’ কায়েমের জন্য তাদের সকল শক্তি নিয়ে তৎপরতা চালিয়েছিল। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মাওলানা ভাসানী এদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। এককালের প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ও বাম রাজনীতিক মৌলানা সাহেব হয়ে গেলেন সন্ত্রাসের গুরু ও পাকিস্তান কায়েমের নেতা।

তিনি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করব।’ সেই সময়টিতে তিনি খুব দায়িত্বহীনের মতো অনেক আচরণ করেছিলেন। তিনি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলে বসলেন, ‘জয় বাংলা এবং আওয়ামী লীগ তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। তোমাদের ভাগ্য বিহারিদের মতোই হবে।’ দুর্ভিক্ষের চরম সংকটকালে এই উগ্র বামপন্থি ও মুসলিম বাংলা কায়েমকারীরা নাশকতামূলক কর্মকান্ড ও গোপন তৎপরতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রচুর রাজনৈতিক কর্মী হত্যা, খাদ্য ও পাটের গুদামে আগুন, খাদ্য বহনকারী ট্রেন-ট্রাক ধ্বংস, থানা লুট, সার কারখানায় নাশকতা, সন্দ্বীপ চ্যানেলে গমভর্তি জাহাজ ডুবানো, ভাসানীসহ অনেক বিরোধী রাজনৈতিক নেতার দায়িত্বহীন আচরণ, বারবার অস্ত্রের জোরে সরকার উৎখাতের হুমকি, চারজন সংসদ সদস্যকে হত্যা, সবশেষে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঈদের জামাতে সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধু আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেন না।

এগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার নিজ দলের কিছু নেতাদের লুটপাট, চোরাচালান ও ক্ষমতার অপব্যবহার; যা তার ভিশনের সঙ্গে কোনো ভাবেই যাচ্ছিল না। তিনি দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর নিজ দলের অনেক গণপরিষদ সদস্য ও এমসিএকে বহিষ্কার করেছিলেন। প্রায় সাড়ে তিন বছরের প্রতিটি দিন এমন বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে করতে তিনি একেবারে শেষে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে। কাউকেই তিনি আর ভরসা করতে পারছিলেন না। দুর্ভিক্ষে এত মানুষের মৃত্যু তাকে বিমর্ষ ও ডেসপারেট করে তুলেছিল। এত নাশকতা, এত বৈরিতা, এত দুর্নীতি একসময় তাকে বাধ্য করেছে নিজের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নিতে, বাকশাল গঠন করতে।

বাকশালকে তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর এটি ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লব। তবে বাকশালের মতো বিপ্লবী উদ্যোগ পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয়। এর আগেও অনেক দেশে হয়েছে। কিন্তু এর আগে যেটি কখনোই হয়নি সেটিই করে দেখালেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেটি করলেন দেশের বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের বিধি মেনে। বাকশালের মূল কার্যক্রম কি ছিল কয়েকটি উদাহরণ থেকে সেটি স্পষ্ট হতে পারে।

১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ও কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে বলেন, ‘একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লাখ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলার কোনো জমি থাকবে না চাষের জন্য। বাংলার মানুষের বাংলার মানুষের মাংস খাবে, সেজন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্লাানিং করতে হবে। এটা হলো তিন নম্বর কাজ। এক নম্বর হলো দুর্নীতিবাজ খতম করুন। দুই নম্বর হলো কারখানায়-ক্ষেতে খামারে প্রোডাকশন বাড়ান, তিন নম্বর পপুলেশন প্লানিং আর চার নম্বর হলো জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য এক দল করা হয়েছে। যারা দেশকে ভালোবাসে, যারা এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মেনে সৎপথে চলে তারা সবাই এই দলের সদস্য হতে পারবেন। যারা বিদেশি এজেন্ট, যারা বহিঃশত্রুর কাছ থেকে পয়সা নেয় এতে তাদের স্থান নেই। সরকারি কর্মচারীরাও এই দলের সদস্য হতে পারবে। কারণ তারাও এই জাতির একটা অংশ। তাদেরও অধিকার থাকবে এই দলের সদস্য হওয়ার। এজন্য সবাই যে যেখানে আছি একতাবদ্ধ হয়ে দেশের কাজে লাগাতে হবে।’

ওই ভাষণে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত নাই। একটা লোককে আপনি ভিক্ষা দেন এক টাকা বা আটআনা পয়সা, একটা জাতি যখন ভিক্ষুক হয় মানুষের কাছে হাত পাতে আমাদের খাবার দাও, আমাকে টাকা দাও, সেই জাতির ইজ্জত থাকতে পারে না। আমি ভিক্ষুক জাতির নেতা থাকতে চাই না।’

তিনি বলেন, আঘাত করতে চাই এ ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে আমি আপনাদের সমর্থন চাই আমি জানি আপনাদের সমর্থন আছে কিন্তু একটা কথা এ যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে, ভুল করবেন না, আমি আপনাদের জমি নিব না, পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশে ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে, প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে এ কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। যারা কাজ করতে পারে তাকে কো-অপারেটিভে সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে, পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশত থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পলসারি কো-অপারেটিভ হবে, আপনাদের জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভে, অংশ যাবে গভর্মেন্টের হাতে। তিনগুণ ফসল হবে।

অর্থাৎ আধুনিকীকরণ করে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন। শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো বলেন, ‘আজকে একটা কথা বলি, শ্রমিক ভাইয়েরা আপনাদের কষ্ট আছে, এত কষ্ট আমি জানি তাই ভুলতে পারছি না। বিশেষ করে ফিক্সড ইনকাম গ্রুপের কষ্টের সীমা নাই। প্রোডাকশন বাড়াতে পারলেই তারপর আপনাদের উন্নতি হবে। এছাড়া তিনি বলেন, থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে।

এই কাউন্সিলে রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি কর্মচারি যেই হয় একজন তার চেয়ারম্যান হবে, এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সরকারি কর্মচারি, তার মধ্যে আমাদের কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবে, যুবক প্রতিনিধি থাকবে, কৃষক প্রতিনিধি থাকবে তারাই থানাকে চালাবে আর সমস্ত মহকুমাগুলো জেলা হয়ে যাবে। সেই মহকুমায় একটি করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হবে, চেয়ারম্যান থাকবে, সব কর্মচারী একসাথে তার মধ্যে থাকবে। তারা সরকার চালাবে। এভাবে আমি একটা সিস্টেমের চিন্তা করছি।’ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। জেলা গভর্ণরের কাছে যাবে আমার টেষ্ট রিলিফ, লোন, বিল, সেচ প্রকল্পের টাকা। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ডাইরেক্ট কন্ট্রোলে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট এডমিনিস্ট্রেটিভ এডমিনিস্ট্রেশন পরিচালনা করবে।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব

মোস্তাফা জব্বার

image

সোমবার, ০৬ মার্চ ২০২৩

তিন ॥

১৫ মার্চ ১৯৭৩ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের দেশে এমন ধরনের গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন, যে শিক্ষায় সত্যিকার মানুষ গড়ার মাধ্যমে জাতিকে নতুন করে সংগঠিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে পারি।’ বঙ্গবন্ধুর জীবনের সমগ্র ঘটনাপুঞ্জ বিশ্লেষণ করে এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর বাকশালের চিন্তাভাবনা হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি, বরং ১৯৭০ সাল থেকেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও এর কর্মপদ্ধতি বঙ্গবন্ধুর মাথায় ছিল এবং সেই অনুযায়ী তিনি বারবার কথা বলেছেন ও সেই ভাবনাকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। আমি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে স্মরণ করতে পারি যে ছাত্রলীগের কর্মীরা ৭০-এ নির্বাচনের আগেই আমরা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান দিয়েছি। জনগণকে সমাজতন্ত্রের ধারনায় উদ্বুদ্ধ করেছি।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত থাকলেও কেউ ভুলেও বলে না যে, ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলাফলেই ছিল এই দুর্ভিক্ষ। তিনি দুর্ভিক্ষের দায়ভার নিয়ে কোনো ভণিতা করেননি। সকল ব্যর্থতার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে দুর্ভিক্ষে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন।

একদিকে ১৯৭৪ সালের খাদ্যাভাব বঙ্গবন্ধুকে যেমন খুব মর্মাহত করেছিল, অন্যদিকে এর পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের খাদ্যপ্রাপ্তিতে যে ভয়াবহ সংকট তৈরি হয় তা উতরে যাবার পথ খুঁজছিলেন বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে সেই পরিস্থিতিতে কাজে লাগিয়ে বাম উগ্রপন্থিরা দেশকে অস্থিতিশীল করার, নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তারা নাশকতামূলক কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডও শুরু করে। বস্তুত সারা দেশ যখন খাদ্যাভাবে জর্জরিত তখন চরমপন্থিদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চরম আকার ধারণ করে। তাদের প্রকাশ্য আহ্বান ছিলো বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করা।

সমাজতন্ত্র বা বিপ্লবের নামে নানা ধরনের গোপন কর্মকান্ডও চলতে থাকে। আর এদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণিহীন ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ গঠন করার লক্ষ্যে আরেক স্লোগানধারী সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির ক্যাডাররা ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ৪৯২৫টি গুপ্তহত্যা করেছিল। ৬০টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে জনজীবনকে অস্থির করে তুলছিল। ১৯৭২-৭৩ সালের এই সময়টাতে পাকিস্তানপন্থি জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপিসহ বেশির ভাগ পাকিস্তানী অনুচর রাজনৈতিক দলগুলো গোপনে জুলফিকার আলীর প্রেসক্রিপশনে ‘মুসলিম বাংলা’ কায়েমের জন্য তাদের সকল শক্তি নিয়ে তৎপরতা চালিয়েছিল। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মাওলানা ভাসানী এদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। এককালের প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ও বাম রাজনীতিক মৌলানা সাহেব হয়ে গেলেন সন্ত্রাসের গুরু ও পাকিস্তান কায়েমের নেতা।

তিনি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করব।’ সেই সময়টিতে তিনি খুব দায়িত্বহীনের মতো অনেক আচরণ করেছিলেন। তিনি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলে বসলেন, ‘জয় বাংলা এবং আওয়ামী লীগ তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। তোমাদের ভাগ্য বিহারিদের মতোই হবে।’ দুর্ভিক্ষের চরম সংকটকালে এই উগ্র বামপন্থি ও মুসলিম বাংলা কায়েমকারীরা নাশকতামূলক কর্মকান্ড ও গোপন তৎপরতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রচুর রাজনৈতিক কর্মী হত্যা, খাদ্য ও পাটের গুদামে আগুন, খাদ্য বহনকারী ট্রেন-ট্রাক ধ্বংস, থানা লুট, সার কারখানায় নাশকতা, সন্দ্বীপ চ্যানেলে গমভর্তি জাহাজ ডুবানো, ভাসানীসহ অনেক বিরোধী রাজনৈতিক নেতার দায়িত্বহীন আচরণ, বারবার অস্ত্রের জোরে সরকার উৎখাতের হুমকি, চারজন সংসদ সদস্যকে হত্যা, সবশেষে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঈদের জামাতে সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধু আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেন না।

এগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার নিজ দলের কিছু নেতাদের লুটপাট, চোরাচালান ও ক্ষমতার অপব্যবহার; যা তার ভিশনের সঙ্গে কোনো ভাবেই যাচ্ছিল না। তিনি দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর নিজ দলের অনেক গণপরিষদ সদস্য ও এমসিএকে বহিষ্কার করেছিলেন। প্রায় সাড়ে তিন বছরের প্রতিটি দিন এমন বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে করতে তিনি একেবারে শেষে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে। কাউকেই তিনি আর ভরসা করতে পারছিলেন না। দুর্ভিক্ষে এত মানুষের মৃত্যু তাকে বিমর্ষ ও ডেসপারেট করে তুলেছিল। এত নাশকতা, এত বৈরিতা, এত দুর্নীতি একসময় তাকে বাধ্য করেছে নিজের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নিতে, বাকশাল গঠন করতে।

বাকশালকে তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর এটি ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লব। তবে বাকশালের মতো বিপ্লবী উদ্যোগ পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয়। এর আগেও অনেক দেশে হয়েছে। কিন্তু এর আগে যেটি কখনোই হয়নি সেটিই করে দেখালেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেটি করলেন দেশের বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের বিধি মেনে। বাকশালের মূল কার্যক্রম কি ছিল কয়েকটি উদাহরণ থেকে সেটি স্পষ্ট হতে পারে।

১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ও কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে বলেন, ‘একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লাখ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলার কোনো জমি থাকবে না চাষের জন্য। বাংলার মানুষের বাংলার মানুষের মাংস খাবে, সেজন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্লাানিং করতে হবে। এটা হলো তিন নম্বর কাজ। এক নম্বর হলো দুর্নীতিবাজ খতম করুন। দুই নম্বর হলো কারখানায়-ক্ষেতে খামারে প্রোডাকশন বাড়ান, তিন নম্বর পপুলেশন প্লানিং আর চার নম্বর হলো জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য এক দল করা হয়েছে। যারা দেশকে ভালোবাসে, যারা এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মেনে সৎপথে চলে তারা সবাই এই দলের সদস্য হতে পারবেন। যারা বিদেশি এজেন্ট, যারা বহিঃশত্রুর কাছ থেকে পয়সা নেয় এতে তাদের স্থান নেই। সরকারি কর্মচারীরাও এই দলের সদস্য হতে পারবে। কারণ তারাও এই জাতির একটা অংশ। তাদেরও অধিকার থাকবে এই দলের সদস্য হওয়ার। এজন্য সবাই যে যেখানে আছি একতাবদ্ধ হয়ে দেশের কাজে লাগাতে হবে।’

ওই ভাষণে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত নাই। একটা লোককে আপনি ভিক্ষা দেন এক টাকা বা আটআনা পয়সা, একটা জাতি যখন ভিক্ষুক হয় মানুষের কাছে হাত পাতে আমাদের খাবার দাও, আমাকে টাকা দাও, সেই জাতির ইজ্জত থাকতে পারে না। আমি ভিক্ষুক জাতির নেতা থাকতে চাই না।’

তিনি বলেন, আঘাত করতে চাই এ ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে আমি আপনাদের সমর্থন চাই আমি জানি আপনাদের সমর্থন আছে কিন্তু একটা কথা এ যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে, ভুল করবেন না, আমি আপনাদের জমি নিব না, পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশে ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে, প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে এ কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। যারা কাজ করতে পারে তাকে কো-অপারেটিভে সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে, পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশত থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পলসারি কো-অপারেটিভ হবে, আপনাদের জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভে, অংশ যাবে গভর্মেন্টের হাতে। তিনগুণ ফসল হবে।

অর্থাৎ আধুনিকীকরণ করে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন। শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো বলেন, ‘আজকে একটা কথা বলি, শ্রমিক ভাইয়েরা আপনাদের কষ্ট আছে, এত কষ্ট আমি জানি তাই ভুলতে পারছি না। বিশেষ করে ফিক্সড ইনকাম গ্রুপের কষ্টের সীমা নাই। প্রোডাকশন বাড়াতে পারলেই তারপর আপনাদের উন্নতি হবে। এছাড়া তিনি বলেন, থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে।

এই কাউন্সিলে রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি কর্মচারি যেই হয় একজন তার চেয়ারম্যান হবে, এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সরকারি কর্মচারি, তার মধ্যে আমাদের কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবে, যুবক প্রতিনিধি থাকবে, কৃষক প্রতিনিধি থাকবে তারাই থানাকে চালাবে আর সমস্ত মহকুমাগুলো জেলা হয়ে যাবে। সেই মহকুমায় একটি করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হবে, চেয়ারম্যান থাকবে, সব কর্মচারী একসাথে তার মধ্যে থাকবে। তারা সরকার চালাবে। এভাবে আমি একটা সিস্টেমের চিন্তা করছি।’ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। জেলা গভর্ণরের কাছে যাবে আমার টেষ্ট রিলিফ, লোন, বিল, সেচ প্রকল্পের টাকা। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ডাইরেক্ট কন্ট্রোলে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট এডমিনিস্ট্রেটিভ এডমিনিস্ট্রেশন পরিচালনা করবে।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]

back to top