মিথুশিলাক মুরমু
প্রয়াত আদিবাসী সাঁওতাল নেতা আলফ্রেড সরেনের গ্রাম নওগাঁর ভীমপুরে গিয়েছিলাম ২৭ ফেব্রুয়ারি। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে স্থানীয় ভূমিদস্যু ও চিহ্নিত জোতদারদের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছিলেন আলফ্রেড সরেন। দীর্ঘ ২২টি বসন্ত পেরিয়েছে কিন্তু বিচারের চাকা স্থবির হয়ে আছে। আদিবাসীরা বিচার নিয়ে সন্দিহান, সরকারের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ। এই ভীমপুরে একসময় ২২টি সাঁওতাল পরিবার বসবাস করতেন, এখন টিকে আছে মাত্র ৮টি। নতুন করে এসে ভিড়েছে ৯টি মুচি, মাহালি, পাল পরিবার। এখন সব মিলিয়ে ১৭টি পরিবার ভীমপুরে বসবাস করে। গ্রামে প্রবেশমুখে থাকা দোকানে প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম- কার কাছে যাবেন? জানালাম- ভীমপুর দেখতে এসেছি। আলফ্রেড সরেন-এর ভাই মহেশ^র সরেনকে দেখে পরিচিত হলাম। তিনি নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলেন, দেখালেন- আলফ্রেড সরেনের হত্যার জায়গা, কবরস্থান, ফসলের জমিগুলো। গ্রামের প্রান্ত থেকে সবুজ ও সবুজের সমাহার, এখন ইরি ধানগুলো লকলকে হয়ে উঠেছে। কথা প্রসঙ্গে জানাচ্ছিলেন, হত্যাকান্ডের পরই আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারগুলো স্থানান্তর হয়েছে- কেননা তৎকালীন সময়ে হাট-বাজারে, মাঠে-ময়দানে সর্বত্রই ছায়ার মতো কিছু লোক অনুসরণ করত।
আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারগুলো বিচারের সম্বুকগতির অগ্রগতিতে আশাহত হয়েছে। অভিযুক্তরা জামিনে বেরিয়ে এসেছে। ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পত্তির মায়াকে বিসর্জন দিয়ে জীবনের নিরাপত্তা ও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে আদিবাসীরা। এনজিওগুলো স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এনজিওর উপস্থিতিও শূন্যের কোটায়। ফলস্বরূপ আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারেনি। ভীমপুর গ্রামের সাড়ে ৫ বিঘা বাড়ি ভিটায় অর্পিত সম্পত্তির তালিকায়, সামান্যটুকু খাস খতিয়ানে উল্লেখ আছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানাচ্ছিলেন, ভীমপুর মৌজায় প্রায় ৫৭৫ বিঘা সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় তালিকাভুক্ত। অত্র অঞ্চলের আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তালিকা থেকে অবমুক্ত করতে মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
আলফ্রেড সরেন-এর সহদর মহেশ^র সরেন বর্তমানে ৩০ বিঘা জমির মতো চাষাবাদ করছেন। এটি স্থানীয় মহাদেবপুর উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে; আরো ৩৩ বিঘা জমির মোকদ্দমা আদালতে চলমান রয়েছে। তিনি আশান্বিত যে, ৩৩ বিঘা জমিও অতি শীঘ্রই তাকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। চোখে মুখে দৃঢ়তার ছাপ থাকলেও ভাই হারানো বেদনা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
সরকার অধিকারহারা আদিবাসীদের মামলাগুলো দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করলে আদিবাসীরা কতই না উপকৃত হতো। চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর অন্যতম হচ্ছে সাঁওতাল আলফ্রেড সরেন হত্যামামলা। এটি আজ পর্যন্ত অন্ধকারেই রয়েছে। আদৌ আলফ্রেড সরেন হত্যার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
২০০১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা ভীমপুর এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে। আলফ্রেড সরেনের স্মৃতিফলক উদ্বোধন করেন, যেটিতে লেখা রয়েছে- ‘শহীদ আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের স্মৃতিসৌধ’। আলফ্রেড সরেনের কবরের চতুর্দিকে বাধাই করে সৌন্দর্যবর্ধন কাজে সহায়তা করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাফুল হক চৌধুরী আরব। ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন স্মৃতিফলকে দেখা যায়, ‘ভূমি অধিকার আন্দোলনের আদিবাসী নেতা শহীদ আলফ্রেড সরেনের সমাধিস্থলের উন্নয়ন কাজের শুভ উদ্বোধন করেন ’৬০-এর দশকের ছাত্রনেতা আফতাফুল হক চৌধুরী আরব।’ মহেশ^র জানাচ্ছিলেন, বছরান্তে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতারা আসেন মৃত্যুবাষির্কী স্মরণে, আলোচনা সভা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিকগুলো নতুনভাবে উন্মোচিত হয়। এছাড়া অনেকেই আসেন আলফ্রেড সরেন আপসহীন সংগ্রাম ও আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হতে। আলফ্রেড সরেন এখন চেতনার
বিচ্ছুরণ।
আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার আন্দোলনে সামিল হতে এসেছিলেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ। সেদিন তিনি কথা দিয়েছিলেন, আদিবাসী সাঁওতাল আলফ্রেড সরেনের জন্য কিছু করবেনই। সেই তাড়না থেকেই সৃষ্টি করেন রাঢ়াঙ। সাঁওতালদের জীবনাচার, সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার ও সংগ্রামী ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণাধর্মী নাটকটি লিখেছেন মামুনুর রশীদ, নির্দেশনাও তারই। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শত-সহ¯্র বছরের দ্বান্দ্বিক বিষয়, আদিবাসীদের অব্যক্ত ছাপ রাঢ়াঙ নাটকে। ২০০৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর আরণ্যক রাঢ়াঙ মঞ্চে উপস্থাপন করে, এটি আরণ্যকের ৪০তম প্রযোজনা। রেভারে- যোনা মুরমুর লেখা গান ‘লেগেজ লেগেজ মেনাকবোনা জুয়ানকো, জুয়ানকো/ লেগেজ লেগেজ বাহাকো লেকাগে, ধারতি মা বাগান তালারে’।
গানটির মধ্যেই নিহিত আছে শান্তি, সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও মর্যাদার অভিযাত্রা। অতঃপর কেটেছে প্রায় দু’দশক। আদিবাসী সাঁওতালদের নিয়ে নির্মিত প্রথম নাটকটি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে প্রশংসিত হয়েছে, পেয়েছে সর্বস্তর মানুষের আকুণ্ঠ ভালোবাসা। ৬টি ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভালে রাঢ়াঙ মঞ্চায়িত হয়েছে। পশ্চিম বাংলার নাট্যগবেষক ও সমালোচক আংশুমান ভৌমিক-এর ভাষায়, ‘যত দিন যাচ্ছে, তত ধার বাড়ছে ‘রাঢ়াঙ’-এর, ভারেও কাটছে। ...‘রাঢ়াঙ’-এর গতি পাহাড়ি ঝোরার মতো। চেনা ছকে বাঁধা নয়। এঁকেবেঁকে পথ কেটে চলেছে। দৃশ্য ও সংলাপ রচনার যে পশ্চিমি ছাঁদ মামুনুর রশীদের আর পাঁচটা নাটকে থাকে, ‘রাঢ়াঙ’ তার থেকেও আলাদা। সত্যি বলতে কী, কথা নয়, আজকালকার কেতায় যাকে সিনোগ্রাফি বলি, সেটাই এ নাটকের তুরুপের তাস।’
রাঢ়াঙ নির্মাণে সময় লেগেছে ৪ বছরের অধিক। নাট্যকারকে বারবার যেতে হয়েছে সাঁওতাল পল্লীতে, মিশতে হয়েছে আদিবাসীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে। রাঢ়াঙ শব্দের অর্থ হচ্ছে নিখাঁত ও সুস্পষ্ট, উচ্চসুর ও অমিশ্রিত, মৌলিক ও খাঁটি শব্দের আওয়াজ, যে আওয়াজে আদিবাসীদের কান খাড়া হয়ে ওঠে। সেটি হোক মাদলের, সেটি হোক বাঁশির কিংবা গানের ঐক্যের সুর। রাঢ়াঙ-এর মুলমন্ত্র হচ্ছে- ‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণী সংগ্রামের সুতীক্ষ্ম হাতিয়ার’।
আরণ্যক নগরসভ্যতা যাদের বলে আদিবাসী, মূলবাসী, বনবাসী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে আলাদা করে দেয়, নিজের অজান্তেই অপর নির্মাণের খেলায় নামিয়ে দেয়; সেই তাহাদের কথা নিবিড় উষ্ণতায় মুড়ে ও সামাজিক প্রজ্ঞায় জুড়ে মঞ্চে এনেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতালদের হালফিলের অভিজ্ঞতাকে প্রতিপাদ্য করলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তর-পূর্ব, মধ্য-পূর্ব বাংলাদেশের পাহাড়িয়া এলাকার আদিবাসীদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে রাঢ়াঙ। আরণ্যকের কুশীলবকূল মঞ্চে এসেছেন সাঁওতালদের প্রতিনিধি হয়ে, সাঁওতাল হয়ে নয়। আর পাঁচটা সিনেমা-থিয়েটারের মুখে কালো রঙ মেখে বা মেকি ঢঙ রেখে সাঁওতাল সাজেননি তারা। সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতির শর্তে সংখ্যালঘুকে গড়েননি। নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতির অস্মিতার পক্ষে সওয়াল করেছেন, তার দোসর হতে চেয়েছেন। তাদের আপাত-প্রাকৃত লোকাচারের মধ্যে যে পারফরমেন্স স্টাডিজের মালমশলা আছে তাকেও মর্যাদা দিয়ে মঞ্চে এনেছেন। মামুনুর রশীদ বলেছেন, ‘মানুষের কাছ থেকে অভাবনীয় সাড়া ও ভালোবাসা পেয়েছি এই নাটকের জন্য’।
প্রায় দুই ঘণ্টার নাটকটির মূল প্রতিপাদ্যই ভীমপুর। দলপ্রধান, নাট্যকার ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেছেন, ‘২০০তম প্রদর্শনীর পর আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় আরণ্যকের ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে ২০১তম প্রদর্শনী করে আমরা এবারের মতো ‘রাঢ়াঙ’-এর ইতি টানব।’ ইতোপূর্বে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মামুনুর রশীদ বলেছেন, ‘রাঢ়াঙ নাটকের ২০০তম শো করছি, এটি বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের জন্য আনন্দের, তেমনি দল হিসেবে আরণ্যক নাট্যদলের জন্যও আনন্দের, আমার জন্য তো বটেই’। রাঢ়াঙ-এর ইতি নয়, রাঢ়াঙ আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার; সাঁওতাল বিদ্রোহের পর থেকে ক্রমশই জল-জঙ্গল হারিয়ে, ভিটেমাটি খুইয়ে আজ প্রান্তিকতার কোন গভীর খাদের ধারে এসে দাঁড়িয়েছেন এ নৃতাত্ত্বিক বিচারে এ তল্লাটের খাস বাসিন্দারা, তাদের আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নয়, এতটুকু, একচিলতে স্বপ্ন কিভাবে ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে তার বেদনার্ত উচ্চারণ রাঢ়াঙ। রাঢ়াঙ-এর সীমানা অবারিত হোক, যাত্রা গতিময় হোক, চেতনা বিকাশিত হোক।
[লেখক: কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩
প্রয়াত আদিবাসী সাঁওতাল নেতা আলফ্রেড সরেনের গ্রাম নওগাঁর ভীমপুরে গিয়েছিলাম ২৭ ফেব্রুয়ারি। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে স্থানীয় ভূমিদস্যু ও চিহ্নিত জোতদারদের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছিলেন আলফ্রেড সরেন। দীর্ঘ ২২টি বসন্ত পেরিয়েছে কিন্তু বিচারের চাকা স্থবির হয়ে আছে। আদিবাসীরা বিচার নিয়ে সন্দিহান, সরকারের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ। এই ভীমপুরে একসময় ২২টি সাঁওতাল পরিবার বসবাস করতেন, এখন টিকে আছে মাত্র ৮টি। নতুন করে এসে ভিড়েছে ৯টি মুচি, মাহালি, পাল পরিবার। এখন সব মিলিয়ে ১৭টি পরিবার ভীমপুরে বসবাস করে। গ্রামে প্রবেশমুখে থাকা দোকানে প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম- কার কাছে যাবেন? জানালাম- ভীমপুর দেখতে এসেছি। আলফ্রেড সরেন-এর ভাই মহেশ^র সরেনকে দেখে পরিচিত হলাম। তিনি নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলেন, দেখালেন- আলফ্রেড সরেনের হত্যার জায়গা, কবরস্থান, ফসলের জমিগুলো। গ্রামের প্রান্ত থেকে সবুজ ও সবুজের সমাহার, এখন ইরি ধানগুলো লকলকে হয়ে উঠেছে। কথা প্রসঙ্গে জানাচ্ছিলেন, হত্যাকান্ডের পরই আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারগুলো স্থানান্তর হয়েছে- কেননা তৎকালীন সময়ে হাট-বাজারে, মাঠে-ময়দানে সর্বত্রই ছায়ার মতো কিছু লোক অনুসরণ করত।
আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারগুলো বিচারের সম্বুকগতির অগ্রগতিতে আশাহত হয়েছে। অভিযুক্তরা জামিনে বেরিয়ে এসেছে। ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পত্তির মায়াকে বিসর্জন দিয়ে জীবনের নিরাপত্তা ও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে আদিবাসীরা। এনজিওগুলো স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এনজিওর উপস্থিতিও শূন্যের কোটায়। ফলস্বরূপ আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারেনি। ভীমপুর গ্রামের সাড়ে ৫ বিঘা বাড়ি ভিটায় অর্পিত সম্পত্তির তালিকায়, সামান্যটুকু খাস খতিয়ানে উল্লেখ আছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানাচ্ছিলেন, ভীমপুর মৌজায় প্রায় ৫৭৫ বিঘা সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় তালিকাভুক্ত। অত্র অঞ্চলের আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তালিকা থেকে অবমুক্ত করতে মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
আলফ্রেড সরেন-এর সহদর মহেশ^র সরেন বর্তমানে ৩০ বিঘা জমির মতো চাষাবাদ করছেন। এটি স্থানীয় মহাদেবপুর উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে; আরো ৩৩ বিঘা জমির মোকদ্দমা আদালতে চলমান রয়েছে। তিনি আশান্বিত যে, ৩৩ বিঘা জমিও অতি শীঘ্রই তাকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। চোখে মুখে দৃঢ়তার ছাপ থাকলেও ভাই হারানো বেদনা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
সরকার অধিকারহারা আদিবাসীদের মামলাগুলো দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করলে আদিবাসীরা কতই না উপকৃত হতো। চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর অন্যতম হচ্ছে সাঁওতাল আলফ্রেড সরেন হত্যামামলা। এটি আজ পর্যন্ত অন্ধকারেই রয়েছে। আদৌ আলফ্রেড সরেন হত্যার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
২০০১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা ভীমপুর এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে। আলফ্রেড সরেনের স্মৃতিফলক উদ্বোধন করেন, যেটিতে লেখা রয়েছে- ‘শহীদ আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের স্মৃতিসৌধ’। আলফ্রেড সরেনের কবরের চতুর্দিকে বাধাই করে সৌন্দর্যবর্ধন কাজে সহায়তা করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাফুল হক চৌধুরী আরব। ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন স্মৃতিফলকে দেখা যায়, ‘ভূমি অধিকার আন্দোলনের আদিবাসী নেতা শহীদ আলফ্রেড সরেনের সমাধিস্থলের উন্নয়ন কাজের শুভ উদ্বোধন করেন ’৬০-এর দশকের ছাত্রনেতা আফতাফুল হক চৌধুরী আরব।’ মহেশ^র জানাচ্ছিলেন, বছরান্তে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতারা আসেন মৃত্যুবাষির্কী স্মরণে, আলোচনা সভা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিকগুলো নতুনভাবে উন্মোচিত হয়। এছাড়া অনেকেই আসেন আলফ্রেড সরেন আপসহীন সংগ্রাম ও আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হতে। আলফ্রেড সরেন এখন চেতনার
বিচ্ছুরণ।
আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার আন্দোলনে সামিল হতে এসেছিলেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ। সেদিন তিনি কথা দিয়েছিলেন, আদিবাসী সাঁওতাল আলফ্রেড সরেনের জন্য কিছু করবেনই। সেই তাড়না থেকেই সৃষ্টি করেন রাঢ়াঙ। সাঁওতালদের জীবনাচার, সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার ও সংগ্রামী ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণাধর্মী নাটকটি লিখেছেন মামুনুর রশীদ, নির্দেশনাও তারই। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শত-সহ¯্র বছরের দ্বান্দ্বিক বিষয়, আদিবাসীদের অব্যক্ত ছাপ রাঢ়াঙ নাটকে। ২০০৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর আরণ্যক রাঢ়াঙ মঞ্চে উপস্থাপন করে, এটি আরণ্যকের ৪০তম প্রযোজনা। রেভারে- যোনা মুরমুর লেখা গান ‘লেগেজ লেগেজ মেনাকবোনা জুয়ানকো, জুয়ানকো/ লেগেজ লেগেজ বাহাকো লেকাগে, ধারতি মা বাগান তালারে’।
গানটির মধ্যেই নিহিত আছে শান্তি, সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও মর্যাদার অভিযাত্রা। অতঃপর কেটেছে প্রায় দু’দশক। আদিবাসী সাঁওতালদের নিয়ে নির্মিত প্রথম নাটকটি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে প্রশংসিত হয়েছে, পেয়েছে সর্বস্তর মানুষের আকুণ্ঠ ভালোবাসা। ৬টি ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভালে রাঢ়াঙ মঞ্চায়িত হয়েছে। পশ্চিম বাংলার নাট্যগবেষক ও সমালোচক আংশুমান ভৌমিক-এর ভাষায়, ‘যত দিন যাচ্ছে, তত ধার বাড়ছে ‘রাঢ়াঙ’-এর, ভারেও কাটছে। ...‘রাঢ়াঙ’-এর গতি পাহাড়ি ঝোরার মতো। চেনা ছকে বাঁধা নয়। এঁকেবেঁকে পথ কেটে চলেছে। দৃশ্য ও সংলাপ রচনার যে পশ্চিমি ছাঁদ মামুনুর রশীদের আর পাঁচটা নাটকে থাকে, ‘রাঢ়াঙ’ তার থেকেও আলাদা। সত্যি বলতে কী, কথা নয়, আজকালকার কেতায় যাকে সিনোগ্রাফি বলি, সেটাই এ নাটকের তুরুপের তাস।’
রাঢ়াঙ নির্মাণে সময় লেগেছে ৪ বছরের অধিক। নাট্যকারকে বারবার যেতে হয়েছে সাঁওতাল পল্লীতে, মিশতে হয়েছে আদিবাসীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে। রাঢ়াঙ শব্দের অর্থ হচ্ছে নিখাঁত ও সুস্পষ্ট, উচ্চসুর ও অমিশ্রিত, মৌলিক ও খাঁটি শব্দের আওয়াজ, যে আওয়াজে আদিবাসীদের কান খাড়া হয়ে ওঠে। সেটি হোক মাদলের, সেটি হোক বাঁশির কিংবা গানের ঐক্যের সুর। রাঢ়াঙ-এর মুলমন্ত্র হচ্ছে- ‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণী সংগ্রামের সুতীক্ষ্ম হাতিয়ার’।
আরণ্যক নগরসভ্যতা যাদের বলে আদিবাসী, মূলবাসী, বনবাসী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে আলাদা করে দেয়, নিজের অজান্তেই অপর নির্মাণের খেলায় নামিয়ে দেয়; সেই তাহাদের কথা নিবিড় উষ্ণতায় মুড়ে ও সামাজিক প্রজ্ঞায় জুড়ে মঞ্চে এনেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতালদের হালফিলের অভিজ্ঞতাকে প্রতিপাদ্য করলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তর-পূর্ব, মধ্য-পূর্ব বাংলাদেশের পাহাড়িয়া এলাকার আদিবাসীদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে রাঢ়াঙ। আরণ্যকের কুশীলবকূল মঞ্চে এসেছেন সাঁওতালদের প্রতিনিধি হয়ে, সাঁওতাল হয়ে নয়। আর পাঁচটা সিনেমা-থিয়েটারের মুখে কালো রঙ মেখে বা মেকি ঢঙ রেখে সাঁওতাল সাজেননি তারা। সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতির শর্তে সংখ্যালঘুকে গড়েননি। নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতির অস্মিতার পক্ষে সওয়াল করেছেন, তার দোসর হতে চেয়েছেন। তাদের আপাত-প্রাকৃত লোকাচারের মধ্যে যে পারফরমেন্স স্টাডিজের মালমশলা আছে তাকেও মর্যাদা দিয়ে মঞ্চে এনেছেন। মামুনুর রশীদ বলেছেন, ‘মানুষের কাছ থেকে অভাবনীয় সাড়া ও ভালোবাসা পেয়েছি এই নাটকের জন্য’।
প্রায় দুই ঘণ্টার নাটকটির মূল প্রতিপাদ্যই ভীমপুর। দলপ্রধান, নাট্যকার ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেছেন, ‘২০০তম প্রদর্শনীর পর আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় আরণ্যকের ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে ২০১তম প্রদর্শনী করে আমরা এবারের মতো ‘রাঢ়াঙ’-এর ইতি টানব।’ ইতোপূর্বে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মামুনুর রশীদ বলেছেন, ‘রাঢ়াঙ নাটকের ২০০তম শো করছি, এটি বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের জন্য আনন্দের, তেমনি দল হিসেবে আরণ্যক নাট্যদলের জন্যও আনন্দের, আমার জন্য তো বটেই’। রাঢ়াঙ-এর ইতি নয়, রাঢ়াঙ আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার; সাঁওতাল বিদ্রোহের পর থেকে ক্রমশই জল-জঙ্গল হারিয়ে, ভিটেমাটি খুইয়ে আজ প্রান্তিকতার কোন গভীর খাদের ধারে এসে দাঁড়িয়েছেন এ নৃতাত্ত্বিক বিচারে এ তল্লাটের খাস বাসিন্দারা, তাদের আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নয়, এতটুকু, একচিলতে স্বপ্ন কিভাবে ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে তার বেদনার্ত উচ্চারণ রাঢ়াঙ। রাঢ়াঙ-এর সীমানা অবারিত হোক, যাত্রা গতিময় হোক, চেতনা বিকাশিত হোক।
[লেখক: কলামিস্ট]