alt

opinion » post-editorial

কৃষিজমি সুরক্ষায় সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন

রেজাউল করিম খোকন

: রোববার, ১৯ মার্চ ২০২৩
image

দেশে ফসলি জমির পরিমাণ কমছে

দেশে দ্রুত হারে কমছে ফসলি জমির পরিমাণ। যা অচিরেই অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। গত কয়েক দশকে আগের তুলনায় দ্রুত হারে কমেছে ফসলি জমির পরিমাণ। এটাকে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় একটি হুমকি বলে মনের করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানা নির্মাণে ব্যবহারের কারণে প্রতিদিনই কমছে বিস্তৃীর্ণ ফসলি জমি। বিভিন্ন জলাভূমিও ভরাট করে ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তামাক ও চিংড়ি চাষের ফলেও প্রতি বছর ২৪ হাজার বিঘা জমি কৃষি কাজের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।

শহরতলী কিংবা গ্রামে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, নগরায়ন, শিল্প কারখানা নির্মাণ, ইটভাটা তৈরি, পুকুর-দিঘি খনন, মাছ চাষ ও নদী ভাঙনের ফলে ক্রমাগতভাবে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। আবার আর্থিক অসঙ্গতি ও দুরবস্থার কারণে জমি বিক্রি করে বাস্তহারা হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতিনিয়ত অবকাঠামোগত উন্নয়নের নমে তৈরি হচ্ছে বাসগৃহ, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, দীর্ঘ সেতু ইত্যাদি। আশঙ্কার বিষয় হলো দেশে কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে তা কিন্ত নয়, সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণেও কমছে কৃষিজমি। কৃষিজমি যে কেউ যে কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারেন। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই।

এজন্য আইন পরিবর্তন করে উর্বর ও কৃষি উপযোগী জমির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বারবার বলা হয়েছে। কিন্ত এ বিষয়ে কোনো বিধিবিধান করা হয়নি এখন পর্যন্ত। জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন ২০১০ অনুযায়ী কৃষিজমি ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো কৃষিজমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্প কারখানা ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না উল্লেখ করে একটি নামমাত্র আইন থাকলেও এর শাস্তির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। পরিকল্পনাহীন নগরায়নের ছোবলে বৈচিত্র্যও হারাচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা।

ইটভাটার জন্যও প্রতি বছর হাজার হাজার একর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকায় ধানের জমিতে বাঁধ দিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। কোথাও হচ্ছে লবনের উৎপাদন। নানাভাবে কৃষিজমি অনুৎপাদনশীল কর্মকান্ডে ব্যবহার হচ্ছে। এ অবস্থা ক্রমাগতভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে দেশে কৃষিজমির ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হবে সহজেই ধারনা করা যায়। জনসংখ্যা অনুপাতে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত কৃষিজমি না থাকলে স্বাভাবিকভাবে দেশে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে। তখন দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশ থেকে খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। ফলশ্রুতিতে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে। কৃষিজমি সুরক্ষার জন্য সরকারিভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।

আমাদের অর্থনীতিতে নানা পালাবদল ঘটেছে গত কয়েক দশকে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দাপট অনেকটা কমে গেছে। এখন শিল্প ও সেবাভিত্তিক কর্মকান্ডের মধ্যে আমাদের অর্থনীতি নতুন ঠিকানা খুঁজছে। কিন্ত দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিজমির ব্যবস্থা না করে শিল্প ও সেবাভিত্তিক অর্থনীতি টেকসই হবে না- এটা সবাইকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। বর্তমানে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি এবং আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির অনুসরণের কারণে খাদ্য উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়েছে বটে। বর্তমানে দেশে কোনো খাদ্য সংকট নেই। তবে এ অবস্থা একটানা দীর্ঘদিন বজায় থাকবে না। ক্রমাগত কৃষিজমি ব্যবহারের ফলে একসময় জমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়, একথা মনে রাখতে হবে সবাইকে। উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ার পর আমাদের কৃষি উৎপাদন তথা খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

দেশের কৃষি উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেলে বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে। যা আমাদের অর্থনীতিতে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, কৃষিজমি সুরক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখনই সঠিক পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কৃষি খাতে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ এগিয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে দেশ। এজন্য অবশ্য সরকারি পৃষ্ঠপোষাকতাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।

কৃষিক্ষেত্রে আজকাল আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন সবাই। বিদ্যুৎ এবং সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার কৃষি জমিতে সেচের ক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব এনেছে। প্রথম দিকে এদেশের কৃষক বিদেশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উন্নাসিকতা দেখালেও পরবর্তী সময়ে এর সুফলের নানা দিক উপলব্ধি করেছেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং নতুন যুগোপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এসবের প্রতি কৃষকদের উৎসাহ দিন দিন বাড়ছে। অতীতের প্রযুক্তি এখন পুরনো এবং অচল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কারণ, এর মাধ্যমে কাঙ্খিত মাত্রায় উৎপাদনশীলতাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পুরনো প্রযুক্তি প্রয়োগে সুফল পাওয়ার আশা করাটাই বৃথা এখন। নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক কৃষি খাতকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে নতুন প্রযুক্তি সংযোজন ও সংস্কার কার্যক্রমকে আরো বেগবান করতেই হবে।

বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বহু সুযোগ রয়েছে। আমাদের অনেক ফসলের উৎপাদনশীলতা এখনও অনেক কম, যার কারণে উৎপাদন ব্যয় অনেকটাই বেড়ে যায়। প্রযুক্তি ছাড়া কৃষি খাতকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়, এটা এখন সবাই মানেন এবং বোঝেন। নতুন প্রযুক্তিগুলো কৃষকদের কাছে নিয়ে যেতে হবে যথাযথভাবে। বর্তমানে যে পরিমাণ উৎপাদিত আলু অবিক্রিত অবস্থায় হিমাগারে পড়ে আছে, এর পেছনে অপরিকল্পিত উৎপাদনটাই বেশি দায়ী।

উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে আমাদের দেশে পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। কোনো একটি এলাকায় এক বছর আলুর দাম বেশি পাওয়া গেলে পরবর্তী বছর সে এলাকায় সবাই আলু উৎপাদন করে বসেন। ফলে কৃষককে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্ব রয়েছে। তারা এক্ষেত্রে চাহিদা বুঝে কৃষককে প্রয়োজনীয় পরিমাণে আলু উৎপাদনের পরামর্শ দিতে পারেন। কৃষককে সচেতন করে পরিকল্পিত উৎপাদনেও মনোযোগী করা যেতে পারে। সরকারের পরিকল্পনায় থাকা উচিত কোন শস্যটি কী পরিমাণ উৎপাদন করা হবে। এর মাধ্যমে উৎপাদিত শস্যের পরিমাণে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। যাতে কৃষকদের লোকসানের মধ্যে পড়তে হবে না।

কৃষি খাতে সরকার যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করছে তা একমুখী অর্থাৎ সরকারি বিভিন্ন বিভাগ ও এজেন্সিকেন্দ্রিক। যেখানে কৃষি খাতে নিয়োজিত বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো উচিত। কৃষি খাতের প্রযুক্তি যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে সরকারি পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত জরুরি। কৃষি খাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে যথেষ্ট পুঁজির আবশ্যকতা রয়েছে। যার অভাব রয়েছে এখনও। কৃষি খাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের যথেষ্ট পুঁজির জোগান দিতে সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আরও বাস্তবমুখী উদ্যোগ এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, কৃষিতে আমাদের অর্জন যতটা, তার অনেকটাই মৌলিক।

দারিদ্র বিমোচনে যে সাফল্য এসেছে, তা কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমেই এসেছে। কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বারোপ কিংবা অন্য যে কোনোভাবেই হোক না কেন তা দারিদ্র দূরীকরণে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। কৃষিক্ষেত্রে যতটা অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তা আরো এগিয়ে নিতে হলে কৃষি প্রযুক্তিতে আরো নতুন এবং অধিক উৎপাদনসক্ষম কলাকৌশল প্রয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে সন্দেহ নেই। এটা অর্থনীতিতে নতুন গতি এনে দিতে পারে।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

কৃষিজমি সুরক্ষায় সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন

রেজাউল করিম খোকন

image

দেশে ফসলি জমির পরিমাণ কমছে

রোববার, ১৯ মার্চ ২০২৩

দেশে দ্রুত হারে কমছে ফসলি জমির পরিমাণ। যা অচিরেই অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। গত কয়েক দশকে আগের তুলনায় দ্রুত হারে কমেছে ফসলি জমির পরিমাণ। এটাকে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় একটি হুমকি বলে মনের করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানা নির্মাণে ব্যবহারের কারণে প্রতিদিনই কমছে বিস্তৃীর্ণ ফসলি জমি। বিভিন্ন জলাভূমিও ভরাট করে ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তামাক ও চিংড়ি চাষের ফলেও প্রতি বছর ২৪ হাজার বিঘা জমি কৃষি কাজের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।

শহরতলী কিংবা গ্রামে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, নগরায়ন, শিল্প কারখানা নির্মাণ, ইটভাটা তৈরি, পুকুর-দিঘি খনন, মাছ চাষ ও নদী ভাঙনের ফলে ক্রমাগতভাবে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। আবার আর্থিক অসঙ্গতি ও দুরবস্থার কারণে জমি বিক্রি করে বাস্তহারা হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতিনিয়ত অবকাঠামোগত উন্নয়নের নমে তৈরি হচ্ছে বাসগৃহ, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, দীর্ঘ সেতু ইত্যাদি। আশঙ্কার বিষয় হলো দেশে কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে তা কিন্ত নয়, সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণেও কমছে কৃষিজমি। কৃষিজমি যে কেউ যে কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারেন। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই।

এজন্য আইন পরিবর্তন করে উর্বর ও কৃষি উপযোগী জমির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বারবার বলা হয়েছে। কিন্ত এ বিষয়ে কোনো বিধিবিধান করা হয়নি এখন পর্যন্ত। জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন ২০১০ অনুযায়ী কৃষিজমি ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো কৃষিজমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্প কারখানা ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না উল্লেখ করে একটি নামমাত্র আইন থাকলেও এর শাস্তির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। পরিকল্পনাহীন নগরায়নের ছোবলে বৈচিত্র্যও হারাচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা।

ইটভাটার জন্যও প্রতি বছর হাজার হাজার একর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকায় ধানের জমিতে বাঁধ দিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। কোথাও হচ্ছে লবনের উৎপাদন। নানাভাবে কৃষিজমি অনুৎপাদনশীল কর্মকান্ডে ব্যবহার হচ্ছে। এ অবস্থা ক্রমাগতভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে দেশে কৃষিজমির ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হবে সহজেই ধারনা করা যায়। জনসংখ্যা অনুপাতে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত কৃষিজমি না থাকলে স্বাভাবিকভাবে দেশে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে। তখন দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশ থেকে খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। ফলশ্রুতিতে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে। কৃষিজমি সুরক্ষার জন্য সরকারিভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।

আমাদের অর্থনীতিতে নানা পালাবদল ঘটেছে গত কয়েক দশকে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দাপট অনেকটা কমে গেছে। এখন শিল্প ও সেবাভিত্তিক কর্মকান্ডের মধ্যে আমাদের অর্থনীতি নতুন ঠিকানা খুঁজছে। কিন্ত দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিজমির ব্যবস্থা না করে শিল্প ও সেবাভিত্তিক অর্থনীতি টেকসই হবে না- এটা সবাইকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। বর্তমানে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি এবং আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির অনুসরণের কারণে খাদ্য উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়েছে বটে। বর্তমানে দেশে কোনো খাদ্য সংকট নেই। তবে এ অবস্থা একটানা দীর্ঘদিন বজায় থাকবে না। ক্রমাগত কৃষিজমি ব্যবহারের ফলে একসময় জমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়, একথা মনে রাখতে হবে সবাইকে। উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ার পর আমাদের কৃষি উৎপাদন তথা খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

দেশের কৃষি উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেলে বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে। যা আমাদের অর্থনীতিতে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, কৃষিজমি সুরক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখনই সঠিক পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কৃষি খাতে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ এগিয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে দেশ। এজন্য অবশ্য সরকারি পৃষ্ঠপোষাকতাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।

কৃষিক্ষেত্রে আজকাল আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন সবাই। বিদ্যুৎ এবং সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার কৃষি জমিতে সেচের ক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব এনেছে। প্রথম দিকে এদেশের কৃষক বিদেশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উন্নাসিকতা দেখালেও পরবর্তী সময়ে এর সুফলের নানা দিক উপলব্ধি করেছেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং নতুন যুগোপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এসবের প্রতি কৃষকদের উৎসাহ দিন দিন বাড়ছে। অতীতের প্রযুক্তি এখন পুরনো এবং অচল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কারণ, এর মাধ্যমে কাঙ্খিত মাত্রায় উৎপাদনশীলতাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পুরনো প্রযুক্তি প্রয়োগে সুফল পাওয়ার আশা করাটাই বৃথা এখন। নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক কৃষি খাতকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে নতুন প্রযুক্তি সংযোজন ও সংস্কার কার্যক্রমকে আরো বেগবান করতেই হবে।

বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বহু সুযোগ রয়েছে। আমাদের অনেক ফসলের উৎপাদনশীলতা এখনও অনেক কম, যার কারণে উৎপাদন ব্যয় অনেকটাই বেড়ে যায়। প্রযুক্তি ছাড়া কৃষি খাতকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়, এটা এখন সবাই মানেন এবং বোঝেন। নতুন প্রযুক্তিগুলো কৃষকদের কাছে নিয়ে যেতে হবে যথাযথভাবে। বর্তমানে যে পরিমাণ উৎপাদিত আলু অবিক্রিত অবস্থায় হিমাগারে পড়ে আছে, এর পেছনে অপরিকল্পিত উৎপাদনটাই বেশি দায়ী।

উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে আমাদের দেশে পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। কোনো একটি এলাকায় এক বছর আলুর দাম বেশি পাওয়া গেলে পরবর্তী বছর সে এলাকায় সবাই আলু উৎপাদন করে বসেন। ফলে কৃষককে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্ব রয়েছে। তারা এক্ষেত্রে চাহিদা বুঝে কৃষককে প্রয়োজনীয় পরিমাণে আলু উৎপাদনের পরামর্শ দিতে পারেন। কৃষককে সচেতন করে পরিকল্পিত উৎপাদনেও মনোযোগী করা যেতে পারে। সরকারের পরিকল্পনায় থাকা উচিত কোন শস্যটি কী পরিমাণ উৎপাদন করা হবে। এর মাধ্যমে উৎপাদিত শস্যের পরিমাণে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। যাতে কৃষকদের লোকসানের মধ্যে পড়তে হবে না।

কৃষি খাতে সরকার যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করছে তা একমুখী অর্থাৎ সরকারি বিভিন্ন বিভাগ ও এজেন্সিকেন্দ্রিক। যেখানে কৃষি খাতে নিয়োজিত বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো উচিত। কৃষি খাতের প্রযুক্তি যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে সরকারি পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত জরুরি। কৃষি খাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে যথেষ্ট পুঁজির আবশ্যকতা রয়েছে। যার অভাব রয়েছে এখনও। কৃষি খাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের যথেষ্ট পুঁজির জোগান দিতে সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আরও বাস্তবমুখী উদ্যোগ এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, কৃষিতে আমাদের অর্জন যতটা, তার অনেকটাই মৌলিক।

দারিদ্র বিমোচনে যে সাফল্য এসেছে, তা কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমেই এসেছে। কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বারোপ কিংবা অন্য যে কোনোভাবেই হোক না কেন তা দারিদ্র দূরীকরণে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। কৃষিক্ষেত্রে যতটা অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তা আরো এগিয়ে নিতে হলে কৃষি প্রযুক্তিতে আরো নতুন এবং অধিক উৎপাদনসক্ষম কলাকৌশল প্রয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে সন্দেহ নেই। এটা অর্থনীতিতে নতুন গতি এনে দিতে পারে।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top