alt

উপ-সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কালক্ষেপণ নয়

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

: রোববার, ১৯ মার্চ ২০২৩

রেশমা নাহার রত্না, দেশের সর্বোচ্চ পর্বত কেওক্রাডং জয়ী নারী। স্বপ্ন ছিল, দ্বিতীয় উঁচু পাহাড় জয়ের পর একদিন আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো ডিঙিয়ে ছাড়বেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু তাকে আর সামনে এগোতে দেয়নি। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কতজনের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। গবেষণা বলছে, বিগত ৮ বছরে সড়কপথে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ২০২২ সালে। সম্প্রতি প্রকাশিত নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতিবেদনে জানা যায়, বিগত বছরে ৫০৭০টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ৭৬০ জন। আহত ৭ হাজার ৩৩১ জন। ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ৪৯৬৯ জন। দেখা যায়, সড়কে নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। দেশের তিনটি প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম সড়কপথ, রেলপথ এবং নৌপথ। রেলপথ ও নৌপথের পেয়ে সড়কপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে বেশি। যাত্রী বহনকারী বাসের চেয়ে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের বেসামাল চালকের গাড়ির মাত্রাতিরোক্ত গতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না। ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়কে দুঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে এবং প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে অথবা চাপা মেরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, এমন একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে পথচারী! ফুটপাতে, আয়ল্যান্ডে দাঁড়ালে, দ্রুতবেগে যমদূত এসে পিষে মেরে দেবে। টুঁ-শব্দটি করা যাবে না। যানবাহনে চড়াও নিরাপদ নয়। কখন বেপরোয়া চালক লাগামহীন গতিতে গাড়ি চালিয়ে, বেআইনিভাবে ওভারটেক করে মুখোমুখী সংঘর্ষ বাঁধিয়ে প্রাণ কেড়ে নেবে! গত আট বছরে নিবন্ধিত যানবাহন, বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা চারগুণ বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া সরকারি আদেশ অমান্য করে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল জাতীয় এবং মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে ২০২২ সালে সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় একদিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে গত বছরের ২৯ জুলাই। সেদিন ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়েছেন। ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে বাস ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান ও লরি ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ, জিপকার ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এরপর রয়েছে অটোরিকশা ৬ দশমিক ২২ শতাংশ এবং মোটরসাইকেল ২৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মোট দুর্ঘটনার ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ পথচারী চাপা দেয়া, ২১ দশমিক ৬১ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৫ দশমিক ৭৯ ভাগ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে এবং ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অন্যান্য কারণে ঘটেছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে। পরিসংখ্যানে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। নানা গবেষণা বলছে, চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানো সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেয়ার অশুভ প্রতিযোগিতায় পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ফিটনেসবিহীন যান, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রীবহন, হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেল অবাধে চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং, সড়কে যানবাহনের গতিসীমা মনিটরিং না করা, এগুলো সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বড় ঝুঁকি। গাড়িচালকরা তাদের খেয়ালখুশি মতো যেখানে সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী নামান। কোনো স্টপেজের ধার ধারেন না তারা। যাত্রী না নামতেই গাড়ি স্টার্ট দেন, ছিটকে পড়ে যান যাত্রী। কখনো আহত হন, কখনো বা বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ যায়। চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই আলী হোসেনের মতো অনেক স্কুল-কলেজপড়ুয়া সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী ঘাতক বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিয়েছে। ২০২২ সালে দুর্ঘটনায় পড়েছেন ৩ হাজার ৯০ জন চালক, ১ হাজার ৫০৩ জন পথচারী, ৭৪২ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮৮৫ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া রয়েছেন শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, নারী-শিশু, সাংবাদিক, চিকিৎসক এবং অন্যান্য শ্রেণীপেশার মানুষ। সরকারি-বেসরকারি ও নিজস্ব সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রণীত রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে।

২০১৮ সালে ঢাকার বিমানবন্দর সড়ক এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া খানমের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর প্রবল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস হয়। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া তড়িঘড়ি করে মাত্র ৭ দিনের মাথায় মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত করা হয়। সড়ক-মহাসড়কে অব্যাহত দুর্ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুরোধে প্রধানমন্ত্রী ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল- চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা ও পাঁচ ঘণ্টা পর পর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ এবং সিগন্যাল মেনে যানবাহন চালানো ওপর কড়াকড়ি আরোপ। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৯টি সিদ্ধান্ত মোতাবেক লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি চলাচল বন্ধ করা এবং মহানগরীতে মালিক ও চালকদের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন না করে সড়কে শৃঙ্খলা এনে দুর্ঘটনা রোধে কমিটি প্রণীত সুপারিশযুক্ত প্রতিবেদনে আশু করণীয় ৫০টি, স্বল্পমেয়াদি ৩২টি এবং দীর্ঘমেয়াদি ২৯টি প্রস্তাব আনা হয়েছিল। আধুনিক, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং প্রযুক্তিনির্ভর সড়ক পরিবহন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসমর্থনকারী হিসাবে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহত মানুষের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ও সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনার পরপরই চালক ও হেলপারকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা অল্পদিনের মধ্যে ধরাও পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতেও শোনা যায়। কিন্তু সেসব মামলার তদন্তের ফলাফল বা দোষী সাব্যস্ত হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির খবর অজানা থেকে যায়।

দেশের হাইওয়েগুলোতে রয়েছে বেশ কিছু বিপজ্জনক বাঁক। এসব স্থানে গাড়ি চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় দৃশ্যমান দূরত্ব (পাসিং সাইট ডিসট্যান্স) কম থাকে। তাই দ্রুত গতিসম্পন্ন গাড়ি একটি অপরটিকে ওভারটেক করতে গিয়ে বিপরীতমুখী গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়। সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের গতি নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক বিভাগের স্পিডমিটার ব্যবহারসহ নজরদারি বাড়িয়ে যানবাহন চালকের বেপরোয়া গতি ও ওভারটেকিং বন্ধ করার কোনো প্রক্রিয়া চালু নেই। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, ২০২২ সালে দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৭২ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৫২ দশমিক ২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ ফিডার রোডে ঘটেছে। যানবাহনে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেয়ার বিধিনিষেধ মানেন না গাড়ির চালক। মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ানো ১০ লাখ থ্রি-হুইলার, নসিমন, ভটভটি চলাচল বন্ধ করা যায়নি। এসব অনিয়ম, অব্যবস্থা, আইন মেনে না চলার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। সড়কের উপর হাটবাজার বসানো যাবে না। বাড়াতে হবে হাইওয়ে পুলিশের কর্মদক্ষতা ও নজরদারি। অপেশাদার চালক যেন কোনোভাবে গণপরিবহন চালাতে না পারে সেই ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থের বিনিময়ে ভুয়া লাইসেন্স প্রদানকারী বিআরটিএ’র অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সারাদেশে ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন ট্রাক, বাস, কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে আইনানুগ শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোসহ পথচারীবান্ধব ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। সঠিক লাইনে প্রতিটি গাড়ি চলাচল, ফুটপাত দখল উচ্ছেদসহ সড়কের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা চাই। বিভিন্ন মিডিয়া সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে জনগণকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অবহিত করতে পারে। স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হলে ইতিবাচক ফল দেবে। সড়ক পরিবহন খাতকে রাখতে হবে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। সড়কপথে চলমান অরাজকতা বন্ধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যখন তখন অহেতুক পরিবহন ধর্মঘট ডাকা বন্ধ করতে হবে। সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে সবাই প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হলে সড়ক দুর্ঘটনারোধ করা সহজ হবে।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কালক্ষেপণ নয়

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

রোববার, ১৯ মার্চ ২০২৩

রেশমা নাহার রত্না, দেশের সর্বোচ্চ পর্বত কেওক্রাডং জয়ী নারী। স্বপ্ন ছিল, দ্বিতীয় উঁচু পাহাড় জয়ের পর একদিন আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো ডিঙিয়ে ছাড়বেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু তাকে আর সামনে এগোতে দেয়নি। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কতজনের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। গবেষণা বলছে, বিগত ৮ বছরে সড়কপথে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ২০২২ সালে। সম্প্রতি প্রকাশিত নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতিবেদনে জানা যায়, বিগত বছরে ৫০৭০টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ৭৬০ জন। আহত ৭ হাজার ৩৩১ জন। ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ৪৯৬৯ জন। দেখা যায়, সড়কে নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। দেশের তিনটি প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম সড়কপথ, রেলপথ এবং নৌপথ। রেলপথ ও নৌপথের পেয়ে সড়কপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে বেশি। যাত্রী বহনকারী বাসের চেয়ে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের বেসামাল চালকের গাড়ির মাত্রাতিরোক্ত গতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না। ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়কে দুঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে এবং প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে অথবা চাপা মেরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, এমন একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে পথচারী! ফুটপাতে, আয়ল্যান্ডে দাঁড়ালে, দ্রুতবেগে যমদূত এসে পিষে মেরে দেবে। টুঁ-শব্দটি করা যাবে না। যানবাহনে চড়াও নিরাপদ নয়। কখন বেপরোয়া চালক লাগামহীন গতিতে গাড়ি চালিয়ে, বেআইনিভাবে ওভারটেক করে মুখোমুখী সংঘর্ষ বাঁধিয়ে প্রাণ কেড়ে নেবে! গত আট বছরে নিবন্ধিত যানবাহন, বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা চারগুণ বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া সরকারি আদেশ অমান্য করে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল জাতীয় এবং মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে ২০২২ সালে সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় একদিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে গত বছরের ২৯ জুলাই। সেদিন ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়েছেন। ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে বাস ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান ও লরি ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ, জিপকার ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এরপর রয়েছে অটোরিকশা ৬ দশমিক ২২ শতাংশ এবং মোটরসাইকেল ২৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মোট দুর্ঘটনার ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ পথচারী চাপা দেয়া, ২১ দশমিক ৬১ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৫ দশমিক ৭৯ ভাগ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে এবং ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অন্যান্য কারণে ঘটেছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে। পরিসংখ্যানে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। নানা গবেষণা বলছে, চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানো সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেয়ার অশুভ প্রতিযোগিতায় পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ফিটনেসবিহীন যান, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রীবহন, হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেল অবাধে চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং, সড়কে যানবাহনের গতিসীমা মনিটরিং না করা, এগুলো সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বড় ঝুঁকি। গাড়িচালকরা তাদের খেয়ালখুশি মতো যেখানে সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী নামান। কোনো স্টপেজের ধার ধারেন না তারা। যাত্রী না নামতেই গাড়ি স্টার্ট দেন, ছিটকে পড়ে যান যাত্রী। কখনো আহত হন, কখনো বা বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ যায়। চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই আলী হোসেনের মতো অনেক স্কুল-কলেজপড়ুয়া সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী ঘাতক বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিয়েছে। ২০২২ সালে দুর্ঘটনায় পড়েছেন ৩ হাজার ৯০ জন চালক, ১ হাজার ৫০৩ জন পথচারী, ৭৪২ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮৮৫ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া রয়েছেন শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, নারী-শিশু, সাংবাদিক, চিকিৎসক এবং অন্যান্য শ্রেণীপেশার মানুষ। সরকারি-বেসরকারি ও নিজস্ব সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রণীত রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে।

২০১৮ সালে ঢাকার বিমানবন্দর সড়ক এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া খানমের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর প্রবল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস হয়। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া তড়িঘড়ি করে মাত্র ৭ দিনের মাথায় মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত করা হয়। সড়ক-মহাসড়কে অব্যাহত দুর্ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুরোধে প্রধানমন্ত্রী ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল- চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা ও পাঁচ ঘণ্টা পর পর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ এবং সিগন্যাল মেনে যানবাহন চালানো ওপর কড়াকড়ি আরোপ। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৯টি সিদ্ধান্ত মোতাবেক লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি চলাচল বন্ধ করা এবং মহানগরীতে মালিক ও চালকদের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন না করে সড়কে শৃঙ্খলা এনে দুর্ঘটনা রোধে কমিটি প্রণীত সুপারিশযুক্ত প্রতিবেদনে আশু করণীয় ৫০টি, স্বল্পমেয়াদি ৩২টি এবং দীর্ঘমেয়াদি ২৯টি প্রস্তাব আনা হয়েছিল। আধুনিক, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং প্রযুক্তিনির্ভর সড়ক পরিবহন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসমর্থনকারী হিসাবে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহত মানুষের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ও সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনার পরপরই চালক ও হেলপারকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা অল্পদিনের মধ্যে ধরাও পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতেও শোনা যায়। কিন্তু সেসব মামলার তদন্তের ফলাফল বা দোষী সাব্যস্ত হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির খবর অজানা থেকে যায়।

দেশের হাইওয়েগুলোতে রয়েছে বেশ কিছু বিপজ্জনক বাঁক। এসব স্থানে গাড়ি চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় দৃশ্যমান দূরত্ব (পাসিং সাইট ডিসট্যান্স) কম থাকে। তাই দ্রুত গতিসম্পন্ন গাড়ি একটি অপরটিকে ওভারটেক করতে গিয়ে বিপরীতমুখী গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়। সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের গতি নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক বিভাগের স্পিডমিটার ব্যবহারসহ নজরদারি বাড়িয়ে যানবাহন চালকের বেপরোয়া গতি ও ওভারটেকিং বন্ধ করার কোনো প্রক্রিয়া চালু নেই। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, ২০২২ সালে দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৭২ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৫২ দশমিক ২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ ফিডার রোডে ঘটেছে। যানবাহনে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেয়ার বিধিনিষেধ মানেন না গাড়ির চালক। মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ানো ১০ লাখ থ্রি-হুইলার, নসিমন, ভটভটি চলাচল বন্ধ করা যায়নি। এসব অনিয়ম, অব্যবস্থা, আইন মেনে না চলার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। সড়কের উপর হাটবাজার বসানো যাবে না। বাড়াতে হবে হাইওয়ে পুলিশের কর্মদক্ষতা ও নজরদারি। অপেশাদার চালক যেন কোনোভাবে গণপরিবহন চালাতে না পারে সেই ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থের বিনিময়ে ভুয়া লাইসেন্স প্রদানকারী বিআরটিএ’র অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সারাদেশে ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন ট্রাক, বাস, কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে আইনানুগ শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোসহ পথচারীবান্ধব ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। সঠিক লাইনে প্রতিটি গাড়ি চলাচল, ফুটপাত দখল উচ্ছেদসহ সড়কের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা চাই। বিভিন্ন মিডিয়া সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে জনগণকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অবহিত করতে পারে। স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হলে ইতিবাচক ফল দেবে। সড়ক পরিবহন খাতকে রাখতে হবে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। সড়কপথে চলমান অরাজকতা বন্ধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যখন তখন অহেতুক পরিবহন ধর্মঘট ডাকা বন্ধ করতে হবে। সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে সবাই প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হলে সড়ক দুর্ঘটনারোধ করা সহজ হবে।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]

back to top