alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে পরীক্ষা নিচ্ছিলেন দপ্তরি

মোহাম্মদ আবু নোমান

: সোমবার, ২২ মে ২০২৩

মস্তফা উদ্দীন নামের এক অভিভাবকের করা ২ মিনিট ১১ সেকেন্ডের লাইভের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। এ নিয়ে চলে নানা সমালোচনা। ঘটনাটি গত ১৭ মে বুধবার মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নে অবস্থিত কচুরগুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ভিডিওতে দেখা গেছে, কচুরগুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক নেই। একটি শ্রেণীকক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০-৪০। পরীক্ষার্থীরা হইচই করছে। বিদ্যালয়ের দপ্তরি তারেকুল ইসলাম তাদের শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওইদিন দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রথম প্রান্তিক মূল্যায়ন পরীক্ষা শুরু হয় সকাল ১০টায়।

শিক্ষকরা অনুপস্থিত থাকায় পরীক্ষা গ্রহণ শুরু করেন বিদ্যালয়ের দপ্তরি। দুই ঘণ্টার পরীক্ষার খাতা, প্রশ্নপত্র বিতরণসহ সব একাই সামলান। এমন অবস্থা দেখে বিদ্যালয় থেকে ফেসবুকে লাইভ শুরু করেন মস্তফা উদ্দীন নামের এক অভিভাবক। এরপর বিদ্যালয়ে হাজির হন দুই শিক্ষক।

কচুরগুলের শিক্ষকের কর্তব্যবোধ দেখে আমরা শিহরিত, স্তম্ভিত। আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ঘাটতি আছে, থাকবে। সংশ্লিষ্ট ওই শিক্ষকরা জরুরি কোনো প্রয়োজনে বাইরে যেতে পারেন। তবে সত্য মিথ্যা যা-ই হোক, প্রশাসনিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পরীক্ষা চলাকালীন শিকক্ষকদের একজনও যথাসময়ে উপস্থিত থাকবেন না এটা কী করে সম্ভব? দপ্তরি দিয়ে ডিউটি করানো কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সবকিছুই আমরা ইতোমধ্যে পচিয়ে ফেলেছি, এটি তার একটি উদাহরণ। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষকদের কর্তব্যবোধের মহাঘাটতির খবর নতুন কিছু নয়। শিক্ষার মান তলানিতে। অনেক ছাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করে বাংলা রিডিং পড়তে পারে না।

অভিভাবক মস্তফা উদ্দীন গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যালয়ে চারজন শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জেসমিন আক্তার কিছু দিন ধরে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। বেলা ১১টার দিকে তিনিসহ কয়েক অভিভাবক বিদ্যালয়ে গিয়ে বাকি তিন শিক্ষকের কাউকেই পাননি। এ সময় দপ্তরি তারেকুলকে একা পরীক্ষা নিতে দেখেন। তার একার পক্ষে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করা কষ্ট হচ্ছিল। এরপর তিনি ঘটনাটি ফেসবুকে লাইভ করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দুই সহকারী শিক্ষক বিদ্যালয়ে গিয়ে পৌঁছান। মস্তফা উদ্দীন অভিযোগ করেন, ‘এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সময়মতো আসা-যাওয়া করেন না। ইচ্ছামতো ছুটি দিয়ে চলে যান’।

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও বর্তমান সরকারের আমলে সবপর্যায়ের শিক্ষক, বিশেষত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও গ্রেড অনেক এগিয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও যদি বলা হয় এ বেতন যথেষ্ট নয়, তাহলে বলতে হবে শিক্ষকরা বেতন বাড়ালে সার্ভিস ভালো দেবেন; না সার্ভিস ভালো দিলে বেতন বাড়ানো হবে এ জট খুলতে হবে। প্রাথমিকে বহু নিবেদিত ও উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক রয়েছেন। বিগত ৮-১০ বছর হতে নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ শিক্ষকই যথেষ্ট মেধাবী। কিন্তু তাদের অধিকাংশই এটাকে মনে-প্রাণে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন বলে মনে হয় না। কেউ যদি মনে করেন তিনি এ পেশায় থাকবেন না, তাহলে তিনি চলে যেতে পারেন। কিন্তু যতদিন থাকবেন, কেন কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে ফাঁকিবাজি করবেন?

শুধু পাসের সনদের যোগ্যতা দিয়েই সবাইকে সমান করে ফেলা যায় না। একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা স্নাতক/স্নাতকোত্তর পাস, আপনিও তাই। তাহলে আপনি তার সমমর্যাদার জায়গায় পৌঁছাতে পারলেন না কেন? কেন প্রাইমারি টিচার হতে গেলেন? এতে কি প্রমাণ হয় না, শিক্ষগত যোগ্যতা সমান দেখা গেলেও মেধা সবার সমান না? সবার পক্ষে উঁচু স্থানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। দুই বন্ধুর একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন এক হলেও একজনের বেতন ১ লাখ টাকা, অন্যজন ২০ হাজার টাকা বেতনের একটা চাকরি জোগাড় করতে পারছেন না। অথচ সার্টিফিকেট অনুযায়ী যোগ্যতা দুজনের সমান। উচ্চশিক্ষিত অনেকে পিয়নের চাকরি করেন। পিয়ন হয়ে তিনি কিন্তু বলেন না যে, আমার অফিসারের যোগ্যতা আর আমার যোগ্যতা সমান, তাই আমি তাকে স্যার বলতে পারব না। ২০তম স্কেলে বেতন নিব না, আমাকে ১০ গ্রেডে দিতে হবে।

প্রশাসনিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পরীক্ষা চলাকালীন শিকক্ষকদের একজনও যথাসময়ে উপস্থিত থাকবেন না এটা কী করে সম্ভব? দপ্তরি দিয়ে ডিউটি করানো কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি বিষয়ে সবসময়ই আলোচনায় থাকে, তা হলোÑ কোটায় নিয়োগ ও গ্রেড। প্রাথমিক শিক্ষায় কোটা একটি বড় প্রতিবন্ধক সেটির বিলুপ্তি বা যৌক্তিক সংস্কার জরুরি বলে আমরা মনে করি। এখানে যারা মেধাবী আছেন, বেতন কাঠামোর সংস্কার না হলে তারা এ সেক্টরে থাকবেন না, সেক্ষেত্রে কোটারিরাই গোটা সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করবেন। ১০ম গ্রেডের দাবি দীর্ঘদিনের। এক্ষেত্রে এসএসসি / এইচএসসি পাসে ১০ গ্রেড আসা করা ঠিক নয়। শুধু যারা স্নাতক পাস, কোন প্রকার কোটাবিহীন তাদের জন্য ১০ গ্রেড করা যেতে পারে।

এছাড়া সরকারি প্রাইমারি স্কুলে মহিলা কোটা বেশি থাকায় কোথাও কোথাও দেখা যায়, হেড টিচার (মহিলা), শারীরিক কারণে যিনি ৬ মাসের ছুটিতে আছেন। সহকারী শিক্ষক (মহিলা) তারও শারীরিক কারণে হাঁটা-চলা করতে সাময়িক নিষেধ থাকায় ৩ মাসের ছুটিতে। অন্য সহকারী শিক্ষক (মহিলা), যিনি বিয়ের জন্য ২ সপ্তাহ ছুটিতে আছেন। এখন সরকারি চাকরি ‘সোনার হরিণ’ হওয়ায় মহিলারা উচ্চ বেতনের চাকরিজীবী স্বামী পেয়ে থাকেন। স্বামী সচ্ছল থাকায় এরপর তার চাকরিতে মনোযোগী হওয়া জরুরি নয়, শুধু মাস শেষে বেতন পাওয়াটাই যেন মুখ্য। অন্যদিকে স্কুলের দপ্তরি বিএ/এমএ পাস। যিনি মাঝে মাঝে টিচার, কখনো ম্যাডামের বাচ্চার কেয়ার টেকার, কখনো পরীক্ষার হলের গার্ড। আবার রাতে নাইট গার্ড, কত কী?

দেশে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার দৌড় চলছে। যেখানে সবার চাই লাক্সারিয়াস বাড়ি, গাড়ি, জীবন। লাগামহীন আমোদ প্রবোধ! সরকারি চাকরি বলে কথা। রাজকীয় চাকরি। মাস গেলেই বেতন। সে জন্যই তো সবাই সরকারি চাকরির বাসনায় (মেধা দিয়ে বা মেধাহীনরা টাকা দিয়ে) মরিয়া চেষ্টা করে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ আছে, তারা চাকরির শেষে এককালীন টাকা পাবেন, চাকরি নিরাপত্তা আছে, চাকরি হারানোর ভয় নেই। ডিউটি খুব বেশি নয়, কোন মানসিক চাপ নেই। পক্ষান্তরে অনেক শিক্ষিত লোক প্রাইভেট কোম্পানি, গার্মেন্টস শিল্পে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করেন, যাদের বেতন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। একবার চিন্তা করে দেখুন তাদের চাকরির কোনো গ্যারান্টি নেই, চাকরি শেষে এককালীন কিছুই পাবেন না। সে তুলনায় আপনারা কত ভালো আছেন। সরকারি বেতন বৃদ্ধি হয় ঢালাওভাবে। এ সুযোগ বেসরকারি চাকরিতে নেই বরং, বেতন বাড়ানার কথা বললে ছাঁটাই করা হয়।

অপরদিকে কেজি স্কুলের মাস্টাররা ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বেতনে কীভাবে চলছেন, সেও কিন্তু গ্রাজুয়েশন। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারদের সন্তানরা বেশির ভাগই কেজি স্কুলে পড়ে থাকে। কারণ তারা জানেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কেমন! যে কারণে নিজের সন্তানকেও তারা নিজ প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান না।

কচুরগুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সামছুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যালয়ের একটি কাজে তিনি সকালে উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে রওনা দেন। বৃষ্টির কারণে অপর দুই শিক্ষকের যেতে বিলম্ব হওয়ায় দপ্তরিকে পরীক্ষা শুরু করে দিতে বলেন। আমরা দেখছি, বৃষ্টিতে দপ্তরি যথা সময়ে আসতে পারল। পরীক্ষা দেয়ার জন্য কোমলমতি ছোট ছোট বাচ্চাগুলো যথা সময়ে আসতে পারল, অথচ শিক্ষকরা বৃষ্টির কারণে আসতে পারেনি!

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা :

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেই সে হবেন সরকারি রাজস্বভুক্ত চাকরিজীবী। শুরুতেই বেতন ১৩তম গ্রেডে (১১,০০০-২৬,৫৯০ টাকা)। মূল বেতন ১১ হাজার টাকা। এলাকাভেদে কোথাও বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৬০ শতাংশ, কোথাও ৫০ শতাংশ, কোথাও ৪৫ শতাংশ। চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া রয়েছে টিফিন ভাতা, যাতায়াত ভাতা। সব মিলিয়ে এলাকাভেদে কোথাও মোট বেতন ১৯ হাজার ৫০০ টাকা, কোথাও ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, কোথাও ১৭ হাজার ৯৫০ টাকা। প্রতি বছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি ও মূল বেতনের সমপরিমাণ দুটি উৎসব ভাতা পাবেন, অর্থাৎ ১১ হাজার টাকা করে উৎসব ভাতা। প্রতি বছর মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা। চাকরি তিন বছর পূর্ণ হলে মূল বেতনের সমপরিমাণ শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পাওয়া যায়। চাকরিজীবনে পেয়ে থাকেন দুটি টাইম স্কেল।

এছাড়া সন্তানের বয়স পাঁচ বছর হলে শিক্ষা ভাতা (১ জন হলে ৫০০, দুজন হলে ১ হাজার টাকা) পাবেন। মূল বেতনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ জিপিএফ ফান্ডে জমা রাখতে পারবেন। চাকরি শেষে জিপিএফ ফান্ডের ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৩ শতাংশ হারে মুনাফা আর যদি ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে হয় তাহলে ১২ শতাংশ মুনাফা এবং ৩০ লাখের ওপরে হলে ১১ শতাংশ হারে মুনাফা পাবেন।

জিপিএফ ফান্ড থেকে বিনা মুনাফায় ঋণ নেয়ার সুবিধা রয়েছে। গৃহনির্মাণের ঋণের ব্যবস্থাও আছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় সন্তানের জন্য পোষ্য কোটা রয়েছে। চাকরির পাঁচ বছর পূর্ণ হলে আপনি পেনশনের আওতায় পড়বেন। চাকরি শেষে পাবেন ১৮ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ ল্যামগ্রান্ড, এক বছরের পিআরএল, অর্জিত মূল বেতনের ২৩০ গুণ পেনশন ও আজীবন পারিবারিক পেনশন। ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা। ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে হলে পেনশনারদের মাসিক চিকিৎসা ভাতা হবে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ইত্যাদি।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে পরীক্ষা নিচ্ছিলেন দপ্তরি

মোহাম্মদ আবু নোমান

সোমবার, ২২ মে ২০২৩

মস্তফা উদ্দীন নামের এক অভিভাবকের করা ২ মিনিট ১১ সেকেন্ডের লাইভের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। এ নিয়ে চলে নানা সমালোচনা। ঘটনাটি গত ১৭ মে বুধবার মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নে অবস্থিত কচুরগুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ভিডিওতে দেখা গেছে, কচুরগুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক নেই। একটি শ্রেণীকক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০-৪০। পরীক্ষার্থীরা হইচই করছে। বিদ্যালয়ের দপ্তরি তারেকুল ইসলাম তাদের শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওইদিন দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রথম প্রান্তিক মূল্যায়ন পরীক্ষা শুরু হয় সকাল ১০টায়।

শিক্ষকরা অনুপস্থিত থাকায় পরীক্ষা গ্রহণ শুরু করেন বিদ্যালয়ের দপ্তরি। দুই ঘণ্টার পরীক্ষার খাতা, প্রশ্নপত্র বিতরণসহ সব একাই সামলান। এমন অবস্থা দেখে বিদ্যালয় থেকে ফেসবুকে লাইভ শুরু করেন মস্তফা উদ্দীন নামের এক অভিভাবক। এরপর বিদ্যালয়ে হাজির হন দুই শিক্ষক।

কচুরগুলের শিক্ষকের কর্তব্যবোধ দেখে আমরা শিহরিত, স্তম্ভিত। আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ঘাটতি আছে, থাকবে। সংশ্লিষ্ট ওই শিক্ষকরা জরুরি কোনো প্রয়োজনে বাইরে যেতে পারেন। তবে সত্য মিথ্যা যা-ই হোক, প্রশাসনিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পরীক্ষা চলাকালীন শিকক্ষকদের একজনও যথাসময়ে উপস্থিত থাকবেন না এটা কী করে সম্ভব? দপ্তরি দিয়ে ডিউটি করানো কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সবকিছুই আমরা ইতোমধ্যে পচিয়ে ফেলেছি, এটি তার একটি উদাহরণ। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষকদের কর্তব্যবোধের মহাঘাটতির খবর নতুন কিছু নয়। শিক্ষার মান তলানিতে। অনেক ছাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করে বাংলা রিডিং পড়তে পারে না।

অভিভাবক মস্তফা উদ্দীন গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যালয়ে চারজন শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জেসমিন আক্তার কিছু দিন ধরে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। বেলা ১১টার দিকে তিনিসহ কয়েক অভিভাবক বিদ্যালয়ে গিয়ে বাকি তিন শিক্ষকের কাউকেই পাননি। এ সময় দপ্তরি তারেকুলকে একা পরীক্ষা নিতে দেখেন। তার একার পক্ষে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করা কষ্ট হচ্ছিল। এরপর তিনি ঘটনাটি ফেসবুকে লাইভ করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দুই সহকারী শিক্ষক বিদ্যালয়ে গিয়ে পৌঁছান। মস্তফা উদ্দীন অভিযোগ করেন, ‘এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সময়মতো আসা-যাওয়া করেন না। ইচ্ছামতো ছুটি দিয়ে চলে যান’।

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও বর্তমান সরকারের আমলে সবপর্যায়ের শিক্ষক, বিশেষত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও গ্রেড অনেক এগিয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও যদি বলা হয় এ বেতন যথেষ্ট নয়, তাহলে বলতে হবে শিক্ষকরা বেতন বাড়ালে সার্ভিস ভালো দেবেন; না সার্ভিস ভালো দিলে বেতন বাড়ানো হবে এ জট খুলতে হবে। প্রাথমিকে বহু নিবেদিত ও উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক রয়েছেন। বিগত ৮-১০ বছর হতে নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ শিক্ষকই যথেষ্ট মেধাবী। কিন্তু তাদের অধিকাংশই এটাকে মনে-প্রাণে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন বলে মনে হয় না। কেউ যদি মনে করেন তিনি এ পেশায় থাকবেন না, তাহলে তিনি চলে যেতে পারেন। কিন্তু যতদিন থাকবেন, কেন কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে ফাঁকিবাজি করবেন?

শুধু পাসের সনদের যোগ্যতা দিয়েই সবাইকে সমান করে ফেলা যায় না। একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা স্নাতক/স্নাতকোত্তর পাস, আপনিও তাই। তাহলে আপনি তার সমমর্যাদার জায়গায় পৌঁছাতে পারলেন না কেন? কেন প্রাইমারি টিচার হতে গেলেন? এতে কি প্রমাণ হয় না, শিক্ষগত যোগ্যতা সমান দেখা গেলেও মেধা সবার সমান না? সবার পক্ষে উঁচু স্থানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। দুই বন্ধুর একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন এক হলেও একজনের বেতন ১ লাখ টাকা, অন্যজন ২০ হাজার টাকা বেতনের একটা চাকরি জোগাড় করতে পারছেন না। অথচ সার্টিফিকেট অনুযায়ী যোগ্যতা দুজনের সমান। উচ্চশিক্ষিত অনেকে পিয়নের চাকরি করেন। পিয়ন হয়ে তিনি কিন্তু বলেন না যে, আমার অফিসারের যোগ্যতা আর আমার যোগ্যতা সমান, তাই আমি তাকে স্যার বলতে পারব না। ২০তম স্কেলে বেতন নিব না, আমাকে ১০ গ্রেডে দিতে হবে।

প্রশাসনিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পরীক্ষা চলাকালীন শিকক্ষকদের একজনও যথাসময়ে উপস্থিত থাকবেন না এটা কী করে সম্ভব? দপ্তরি দিয়ে ডিউটি করানো কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি বিষয়ে সবসময়ই আলোচনায় থাকে, তা হলোÑ কোটায় নিয়োগ ও গ্রেড। প্রাথমিক শিক্ষায় কোটা একটি বড় প্রতিবন্ধক সেটির বিলুপ্তি বা যৌক্তিক সংস্কার জরুরি বলে আমরা মনে করি। এখানে যারা মেধাবী আছেন, বেতন কাঠামোর সংস্কার না হলে তারা এ সেক্টরে থাকবেন না, সেক্ষেত্রে কোটারিরাই গোটা সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করবেন। ১০ম গ্রেডের দাবি দীর্ঘদিনের। এক্ষেত্রে এসএসসি / এইচএসসি পাসে ১০ গ্রেড আসা করা ঠিক নয়। শুধু যারা স্নাতক পাস, কোন প্রকার কোটাবিহীন তাদের জন্য ১০ গ্রেড করা যেতে পারে।

এছাড়া সরকারি প্রাইমারি স্কুলে মহিলা কোটা বেশি থাকায় কোথাও কোথাও দেখা যায়, হেড টিচার (মহিলা), শারীরিক কারণে যিনি ৬ মাসের ছুটিতে আছেন। সহকারী শিক্ষক (মহিলা) তারও শারীরিক কারণে হাঁটা-চলা করতে সাময়িক নিষেধ থাকায় ৩ মাসের ছুটিতে। অন্য সহকারী শিক্ষক (মহিলা), যিনি বিয়ের জন্য ২ সপ্তাহ ছুটিতে আছেন। এখন সরকারি চাকরি ‘সোনার হরিণ’ হওয়ায় মহিলারা উচ্চ বেতনের চাকরিজীবী স্বামী পেয়ে থাকেন। স্বামী সচ্ছল থাকায় এরপর তার চাকরিতে মনোযোগী হওয়া জরুরি নয়, শুধু মাস শেষে বেতন পাওয়াটাই যেন মুখ্য। অন্যদিকে স্কুলের দপ্তরি বিএ/এমএ পাস। যিনি মাঝে মাঝে টিচার, কখনো ম্যাডামের বাচ্চার কেয়ার টেকার, কখনো পরীক্ষার হলের গার্ড। আবার রাতে নাইট গার্ড, কত কী?

দেশে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার দৌড় চলছে। যেখানে সবার চাই লাক্সারিয়াস বাড়ি, গাড়ি, জীবন। লাগামহীন আমোদ প্রবোধ! সরকারি চাকরি বলে কথা। রাজকীয় চাকরি। মাস গেলেই বেতন। সে জন্যই তো সবাই সরকারি চাকরির বাসনায় (মেধা দিয়ে বা মেধাহীনরা টাকা দিয়ে) মরিয়া চেষ্টা করে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ আছে, তারা চাকরির শেষে এককালীন টাকা পাবেন, চাকরি নিরাপত্তা আছে, চাকরি হারানোর ভয় নেই। ডিউটি খুব বেশি নয়, কোন মানসিক চাপ নেই। পক্ষান্তরে অনেক শিক্ষিত লোক প্রাইভেট কোম্পানি, গার্মেন্টস শিল্পে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করেন, যাদের বেতন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। একবার চিন্তা করে দেখুন তাদের চাকরির কোনো গ্যারান্টি নেই, চাকরি শেষে এককালীন কিছুই পাবেন না। সে তুলনায় আপনারা কত ভালো আছেন। সরকারি বেতন বৃদ্ধি হয় ঢালাওভাবে। এ সুযোগ বেসরকারি চাকরিতে নেই বরং, বেতন বাড়ানার কথা বললে ছাঁটাই করা হয়।

অপরদিকে কেজি স্কুলের মাস্টাররা ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বেতনে কীভাবে চলছেন, সেও কিন্তু গ্রাজুয়েশন। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারদের সন্তানরা বেশির ভাগই কেজি স্কুলে পড়ে থাকে। কারণ তারা জানেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কেমন! যে কারণে নিজের সন্তানকেও তারা নিজ প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান না।

কচুরগুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সামছুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যালয়ের একটি কাজে তিনি সকালে উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে রওনা দেন। বৃষ্টির কারণে অপর দুই শিক্ষকের যেতে বিলম্ব হওয়ায় দপ্তরিকে পরীক্ষা শুরু করে দিতে বলেন। আমরা দেখছি, বৃষ্টিতে দপ্তরি যথা সময়ে আসতে পারল। পরীক্ষা দেয়ার জন্য কোমলমতি ছোট ছোট বাচ্চাগুলো যথা সময়ে আসতে পারল, অথচ শিক্ষকরা বৃষ্টির কারণে আসতে পারেনি!

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা :

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেই সে হবেন সরকারি রাজস্বভুক্ত চাকরিজীবী। শুরুতেই বেতন ১৩তম গ্রেডে (১১,০০০-২৬,৫৯০ টাকা)। মূল বেতন ১১ হাজার টাকা। এলাকাভেদে কোথাও বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৬০ শতাংশ, কোথাও ৫০ শতাংশ, কোথাও ৪৫ শতাংশ। চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া রয়েছে টিফিন ভাতা, যাতায়াত ভাতা। সব মিলিয়ে এলাকাভেদে কোথাও মোট বেতন ১৯ হাজার ৫০০ টাকা, কোথাও ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, কোথাও ১৭ হাজার ৯৫০ টাকা। প্রতি বছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি ও মূল বেতনের সমপরিমাণ দুটি উৎসব ভাতা পাবেন, অর্থাৎ ১১ হাজার টাকা করে উৎসব ভাতা। প্রতি বছর মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা। চাকরি তিন বছর পূর্ণ হলে মূল বেতনের সমপরিমাণ শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পাওয়া যায়। চাকরিজীবনে পেয়ে থাকেন দুটি টাইম স্কেল।

এছাড়া সন্তানের বয়স পাঁচ বছর হলে শিক্ষা ভাতা (১ জন হলে ৫০০, দুজন হলে ১ হাজার টাকা) পাবেন। মূল বেতনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ জিপিএফ ফান্ডে জমা রাখতে পারবেন। চাকরি শেষে জিপিএফ ফান্ডের ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৩ শতাংশ হারে মুনাফা আর যদি ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে হয় তাহলে ১২ শতাংশ মুনাফা এবং ৩০ লাখের ওপরে হলে ১১ শতাংশ হারে মুনাফা পাবেন।

জিপিএফ ফান্ড থেকে বিনা মুনাফায় ঋণ নেয়ার সুবিধা রয়েছে। গৃহনির্মাণের ঋণের ব্যবস্থাও আছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় সন্তানের জন্য পোষ্য কোটা রয়েছে। চাকরির পাঁচ বছর পূর্ণ হলে আপনি পেনশনের আওতায় পড়বেন। চাকরি শেষে পাবেন ১৮ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ ল্যামগ্রান্ড, এক বছরের পিআরএল, অর্জিত মূল বেতনের ২৩০ গুণ পেনশন ও আজীবন পারিবারিক পেনশন। ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা। ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে হলে পেনশনারদের মাসিক চিকিৎসা ভাতা হবে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ইত্যাদি।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

back to top